হালকা চপল ছন্দে শরত এসেছে গ্রীষ্মের প্রখরতার আতংক আর বর্ষার বিষণ্ন বিধুরতা মুছে দিয়ে। প্রসন্ন হাসি গাছের পাতার সবুজ রিবনে, মেঘ- রোদ্দুরের লুকোচুরি খেলায়, কাশবনের হিন্দোলে. প্রকৃতি জুড়ে মা দুর্গার আগমনী গান… “য়া চন্ডী মধুকৈটভাদি দৈত্যদলনী… ” শরতের পূর্নতায় আপামর মানুষ মেতে ওঠে ঢাকের তালে উৎসবের বন্যায়. কিন্তু পুজোর আনন্দ – আয়োজন কি সবার জন্য? না, ব্যতিক্রম আছে বই কি। নানা রকম কারণে সেই ব্যতিক্রম। আমার আজকের গল্প সেই রকম একটা ব্যতিক্রম নিয়ে।
এ এক অন্য দুর্গার গল্প।
কলকাতার খুব কাছেই উত্তর চব্বিশ পরগনার রাজেন্দ্রপুর। এই রাজেন্দ্রপুরেরই একটা গ্রামের নাম সুন্দর গ্রাম. বিদ্যেধরী নদীর তীরে অবস্থিত এই সবুজ ঘেরা গ্রাম সার্থক নামা। এই গ্রামের অবস্থাপন্ন পরিবার বলতে দাসপরিবার। অর্থের প্রতুলতা তো রয়েছেই, বংশ লতিকার গরিমাও কম নয়। স্বাভাবিকভাবেই গ্রামে দাসপরিবারের প্রতিপত্তি বেশি। অবশ্য আজকের সুন্দর গ্রামের বাসিন্দাদের জীবন নির্বাহের মান মোটামুটি ভালো. কলকাতা বা অন্যত্র কর্মের সুবাদে শুধু মাত্র ক্ষেত- খামার আর হাল-বলদের ওপর তাদের ভরণপোষণ নির্ভর করে না। শিক্ষার ছোঁয়ায় তাদের জীবনের মানে বদলে গেছে। তারা শিখেছে স্বচ্ছলভাবে স্বচ্ছন্দে বাঁচার উপায়। তাই আজ সুন্দর গ্রামের প্রকৃতি না পাল্টালেও, মানুষজনের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছে। বিদ্যেধরীর জলে ভেসে এসেছে শহরের ছোঁয়াচ। তাই সুন্দর গ্রামে আজকাল দু-চারটে বারোয়ারি পুজো হয়, আলোর কম্পিটিশনও চলে,.. তবুও দাসবাড়ির পুজোর আকর্ষণ অম্লান। স্হানীয় লোকজনের ধারণা, ষষ্ঠীর বোধনের সাথে সাথে মা দুর্গার জীবন্ত অধিষ্টান হয় দাসবাড়ির পুজোর দালানে। সামনের মাঠে সামিয়ানার তলায় তাই নানা বয়েসের পুরুষ – নারীর ভিড়। সারাদিন ধরে চলে পুজোর কাজকর্ম, আড্ডা গুলতানি আর রান্নার তদারকি। সারা গ্রামের মানুষের পাত পড়ে চারদিন এই দাসবাড়ির অন্দরের গোলঘরে।
আজ অষ্টমী। পুষ্পান্জলি শুরু হয় নি এখনো।যে যার নিজের রুচিতে সাজগোজ করে পুজোমন্ডপে জমিয়ে বসেছে। মেয়ে- বৌরা পুরোহিত কে পুজোর কাজে হাত লাগিয়েছে। বয়স্ক মহিলারা উপদেশ – নির্দেশ দিতে ব্যস্ত। বয়স্ক পুরুষদের ব্যস্ততা একাল- সেকাল নিয়ে আলাপ আলোচনায়। আর কম বয়সী পুরুষরা কেউ বাইরের কাজে, কেউ ভেতরের কাজের হিসাবে দৌড়াদৌড়ি করছে।
দাসবাড়ির দেউড়ির নহবতে বাজছে সানাই…. রাত পুইয়েছে এক শারদ প্রাতে। মন্ডপ আলো করে মা হাসছেন। মায়ের অঙ্গাভরণে আলোর রোশনাই। রোশনাই অল্পবয়সী মেয়েদের চোখে- মুখে। আজ বিকেলে কে কি পড়বে…. তা নিয়ে জল্পনা কল্পনা। কেউ বালুচরী, কেউ সিল্ক কেউ আবার চান্দেরী। সব কটা কলকাতার বিখ্যাত দোকানের। একজন বলে, “তোরা বাবা পোশাকের প্ল্যান কর, আমি বাবার সাথে যাব সন্ধ্যা- রাতে কলকাতা। মেট্রো চেপে ঠাকুর দেখব সারা রাত।
বাবা বলছে আমিনিয়ায় বিরিয়ানি খাওয়াবে।” অন্য একটি মেয়ে বলে, “কলকাতায় তো বেজায় ভিড় হবে, সামাল দিতে পারবি তো নিজেকে? ” গরবিনী বলে ঔদ্ধত্য নিয়ে , ” কষ্ট না করলে কি আর কেষ্ট মেলে?”
অন্যরা উত্তপ্ত আবহাওয়ায় জল ঢালে…..” কাল সকালে প্যান্ডেলে আসবি তো? ” এই একটা আন্তরিক প্রশ্নে ওঁ শান্তি। কে আর অপ্রীতিকর পরিবেশ চায় পুজোর দিনে?কিন্তু অশান্তি তো একটা ঘটলই পুজোর দিনে, তাও আবার পুজোর অষ্টমীর সকালে. আচ্ছা বয়েস, অর্থ আর পারিবারিক দম্ভ মানুষ কে কতটা নিষ্ঠুর করতে পারে?
দাসবাড়ির সামিয়ানার তলায় এককোণে এক মেয়ে, পরণে আধো ময়লা শাড়ি,হাতার কাছে বেশ খানিকটা ছেঁড়া ব্লাউজ, উস্কোখুস্কো চুলে একমনে কোঁচড়ে রাখা শিউলি ফুল তুলে মালা গেঁথে চলেছে। বয়েস? আন্দাজ ষোল – সতেরো তো হবেই. কালই তো ওর মা সদু ওর বাবা বাদল কে বলছিল রাতে, ” মেয়েডারে এট্টা শাড়ি কিনে দ্যাও না। সনাতন ব্যাপারী কাল আসবে মঞ্জু মার শাড়ি খান দিতে। দুগ্গার একখানও আস্ত শাড়ি নেই।” বাদল বলে, সাধ কি হয় না দুগ্গোর মা? কিন্তু শোলার কাজ করে মাকে ডাকের সাজ পরানো যায়, মেয়েডারে সাজানো যায় না।” কিন্তু অতবড়ো মেয়ে, ওরকম ভাবে ঘুরে ফিরে। শেয়াল – কুকুরের তো অভাব নাই কুনখানে”
বাদল কোন জবাব দেয় না। অক্ষম বাপের জবাব দেবার কি আর থাকতে পারে? দুর্গা ঘুমোয় নি। বাপের কথা শুনে কষ্ট পায় না। মা দুর্গার ওপর তার দারুণ ভরসা। সে বিশ্বাস করে মা দুর্গার কৃপায় একদিন তাদের অবস্থা সে ফেরাবে। বাবা – মা কে সুখে রাখবে। কিন্তু কি ভাবে? তার হদিস মা দুর্গা এখনও দেয় নি। দুগ্গা গ্রামের অবৈতনিক বিদ্যালয় যায় আসে। আর স্বপ্ন দেখে মা দুর্গা তাকে অনেক লেখা পড়া শিখিয়ে বড়ো চাকরি পাইয়ে দেবে. তাদের সুদিন আসবে।
দুগ্গার মালা গাঁথা শেষ। পুরুতমশাইরে ডাক দেয়, “ও দাদু শিউলির মালাটারে মা দুগ্গার গলায় দ্যাও না দুলিয়ে গো। বড়ো যতনে গেঁথেছি। পুরুত কিছু বলার আগেই দাসগিন্নি নথ নাড়িয়ে বলে,” কি আপদ! দূর হ এখান থেকে। নোংরা বাসী কাপড়। এখনি ছোঁয়া – নেপা হয়ে যাবে. ঐ মালাটাকে দোলাব মায়ের গলায়। মা অপবিত্র হয়ে যাবে না? ” ” না গো ঠাকুমা নেয়ে- ধুয়ে ফুল কুড়িয়েছি। আমাদের উঠোনে শিউলি গাছ ভরে ফুল ফুটেছে. অনেক ফুল পড়েছিল গাছের তলায়। পরিষ্কার করে নিকোয় মা রোজ।”” তুই মিথ্যে কথা বলছিস। নেয়েছিস তো তোর চুল উস্কোখুস্কো কেন? ” দুগ্গা নীচু স্বরে বলে,” ঘরে নারকেল তেল বাড়ন্ত। চিরুনী গেছে ভেঙে। বাবা আনলি তবে চুল আঁচড়াবো মা- বেটি মিলে।” পুরুত দাসগিন্নির দিকে তাকায় সন্মতির আশায় , ” মা দেব পরিয়ে মালাটা? ” দাসগিন্নির গম্ভীর নির্দেশ আসে,” পুরুত মশাই আপনি নিজের কাজ করুন।” তারপর হাঁক দেন, ” এই কে আছিস কাছে – পিঠে….. দুগ্গারে বার করে দে. ” দুগ্গা বলে,” আমারে কারোরি বার করতি হবে না গো ঠাকুমা। দুগ্গা এমনি চলে যাচ্ছে। তবে মা দুগ্গারে বলি যাচ্ছে সে, আমার হাত থিকি মালা তোমারে একদিন নিতি হবে, যদি তুমি হও আমারো মা। ”
দুগ্গা ছুটে দাসবাড়ির চৌহদ্দি পার হয়েছে। পুজোর দালানের বাইরের চত্বরের এককোণে পড়ে আছে ওর গাঁথা শিউলির মালা। শরতের আকাশের হালকা ভাঙা মেঘ জমাট বাঁধে। অসময়ের বৃষ্টির ঝরঝর শব্দে দুগ্গার গাঁথা শিউলির মালার কান্না মিশে যায়। শরতের শুভ্রতা ম্লান হয় মানুষের মনের কালিমায়।
এ গল্পটা এখানেই শেষ হলে হতে পারতো, কিন্তু তা তো হলো না। কারণ জীবন প্রবাহ সব সময় নিয়ম মেনে চলে না। আর মা দুর্গার ইচ্ছেও নয় সেটা। মা দুর্গা চাননি সবকিছু নিয়ম মেনে স্বাভাবিক ভাবে হোক. পাঁচ বছর আগে দুর্গা পুজোর অষ্টমীর দিন দাসবাড়িতে অপমানিত হওয়ার পর আর দুগ্গাকে দেখা যায় নি, তার মা- বাবা কেও নয়। গরীবের থাকা না থাকাতে গ্রামের বাসিন্দাদের সে ভাবে মাথা ব্যাথা হয় নি। তবুও সন্দেহ আর জল্পনা- কল্পনা শুরু হয়েছিল বটে, কিন্তু দানা বাঁধার আগেই থেমে গেছে। এই গতির যুগে মানুষ ছুটছে নিজের ধান্দায়। গ্রামের মানুষজনও এর বাইরে নয়। অতশত দুগ্গার ব্যাপারে মাথা ঘামাবার সময় কোথায়, যাদের দুগ্রাস ভাতের সংস্হান নেই ? প্রায়ই তো ওদের তেল নুন চাল ধার দিতে হত ফেরত পাওয়ার আশা না করে। দাসগিন্নীর ভাষায় ‘আপদ বালাই গেছে, ভালো হয়েছে।’
বছর পাঁচ বাদে আজ আবার হিমের পরশ বুলিয়ে শরত এসেছে। নিয়ম মতো মা দুর্গাও এসেছেন. দাসবাড়িতে ঢাকের কাঠি পড়েছে। শুরু হয়েছে প্রতি বছরের মতো দুর্গা পুজোর আয়োজন। সেদিনের মতো আজো অষ্টমী। সমস্ত পরিবেশ এক। কিছু লোকজনের মুখের পরিবর্তন হয়েছে. গ্রামের কোন কোন মেয়ে শ্বশুর বাড়ি চলে গেছে, অন্য কোন মেয়ে বিয়ে হয়ে ঘর- বসত করতে এসেছে এই গ্রামে। অবশ্য পুরুত একই রয়েছে, একই রয়েছে দাসগিন্নী। তবে বয়েসের ভার কিছু ছাপ ফেলেছে তাদের চেহারায়, তাদের চলন- বলনে। নয়তো এই সব ছোটো খাটো পরিবর্তন ছাড়া দাসবাড়িতে পুজোর চিত্রপট একই। মা দুর্গাও একই ভাবে বিরাজমানা। পুরোহিত পুষ্পান্জলির মন্ত্র পড়ছেন নিষ্টাভরে..
“আয়ুর্দ্দেহি যশো দেহি ভাগ্যং ভগবতী দেহি মে.ধনং দেহি পুত্রান দেহি, সর্ব্ব কামাংশ্চ দেহি মে” জমায়েতের মধ্যে শুদ্ধভাবে পুনরুচ্চারণের প্রচেষ্টা। ভক্তির নেই খামতি।
পুষ্পান্জলির পর্ব শেষ। সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এক সালংকারা নারী
অলক্তরঞ্জিত খালি চরণে সে এগিয়ে আসছে গজেন্দ্রগামিনী ছন্দে। পিছনে চারদাসীর হাতে পুজোর সম্ভার। দাসবাড়ির দুর্গা প্রতিমার সামনে এসে দাঁড়ায় সেই সুন্দর রমনী। সমবেত সকলের চোখে সমীহের সাথে কৌতূহল… কে এই নারী? নিশ্চয়ই কোন সম্ভ্রান্ত ঘরের বৌ… নারী মহলে ফিসফিস। একবার ফিরে তাকায় সালংকারা সুন্দরী. চিলতে হাসি ঠোঁটের কোণে। মুহূর্তে মেলায়. দাসীর হাত থেকে লাল ভেলভেটের বাক্স নেয় একটা. ক্লিপ খোলে। সোনার শিউলির লম্বা মালা। এগিয়ে দেয়, পুরুতের দিকে ” দাদু পরিয়ে দাও এ মালা মা দুর্গার গলায়।” পুরুত শিউরেছে, এ যে বেশ কয়েক বছর আগে এক মেয়ের আকুতি! তবে কি… মুখটা তো চেনা – চেনা, তবে অনেক পরিবর্তন। পুরুত আজও চেয়েছে, দাসগিন্নীর পানে.. ” পরাবো মা?” দাসগিন্নী বিগলিত, ” নিশ্চয়ই পরাবেন ঠাকুর মশাই। মায়ের জন্য আনা জিনিস ফেরাই কি করে? ” নারী তখন করজোড়ে চোখ বন্ধ করে মা দুর্গাকে মনে মনে বলে, ” পাঁচ বছর আগে তুমি আমার গাঁথা শিউলির মালা পরো নি, যে মালায় যৌবন ছুঁই ছুঁই এক পবিত্র মেয়ের অকৃত্রিম ভক্তি ছিল। আর আজ এই দুর্গা বারবধু। তার দেয়া সোনার শিউলির মালা তুমি কি মনে কর অপবিত্র, অশুচি? তাহলে আজো এ মালা পরো না তুমি। চোখ খুলে নারী দেখে পুরুতদাদুর পরানো মালা গলায় মা যেন হাসছেন আর বলছেন,” দুগ্গা আজ তোর দিন। তুই এদের জানিয়ে দে, আমার পুজোয় পবিত্র – অপবিত্র বলে কিছু হয় না। আমার পুজোয় সকলের সাদর অংশ গ্রহণ আমার কামনা. এই দিনের অপেক্ষায় আমি ছিলাম।
দাসগিন্নী জিজ্ঞেস করেছেন, ” তুমি কে মা?” সেদিনের দুগ্গা সদম্ভে জানিয়েছে, ” আমি বাদল শোলাকারের মেয়ে দুগ্গা।” তবে সে আমার পূর্বাশ্রমের পরিচয়। আজ আমি বিজুরী- বাঈ। বনেদী বাঈজী। মুজরো করি নিজের বাড়িতে। ডাক পেলে লক্ষ্নৌ পাটনাও যাই। ঠিকানা কলকাতার বৌ বাজারের সোনা পট্টি। এই জিনিস গুলো দিয়ে গেলাম। পুজোর কাজে লাগিও। বেশ্যা বাড়ির মাটি তো মায়ের কাঠামো তৈরির কাজে লাগে.
আর জেনো মানুষ মানুষই হয়। পবিত্রতা – অপবিত্রতা দেহে নয়, মনে জন্মায়। দৃপ্ত পদক্ষেপে বেরিয়ে যায় দুগ্গা সকলের স্তম্ভিত দৃষ্টির সামনে দিয়ে. এ এক অন্য দুর্গা।
Block: P, 846. Newalipore.
Kolkata 700053
Mobile No : 7044058223