বর্ষাকাল।রাত্রিবেলা।বাইরে বৃষ্টি পড়ছে।ছেলেকে গল্প শোনাচ্ছি।আমাদের ছোটবেলার গল্প।
বৃষ্টির সন্ধে।লোডশেডিং। হ্যারিকেনের আলো জ্বেলে পড়তে বসার গল্প।সেই কেরোসিনের গন্ধ,কাঁচের ফানুস।সলতেটাকে উস্কে দিয়ে আলোর জ্যোতি বাড়ানো আবার কখনো কমিয়ে নিভু নিভু করে ভুতুড়ে গা ছমছমে পরিবেশ তৈরী।পোকাদের উৎপাত। গল্প জমে ওঠার আগেই থামিয়ে দিয়ে ছেলে বললে-
“হ্যারিকেন কী?”
থমকে গিয়ে খেয়াল হলো,তাইতো আমাদের এই আধুনিক শহুরে জীবনে তো হ্যারিকেন নেই।ছেলে হ্যারিকেন দেখেনি কোনদিন।এমনিতেই লোডশেডিং বেশ কম,আলে কালে হলেও ইনভার্টার বা চার্জার লাইটের প্রভাবে হ্যারিকেন যে কখন সংসার থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে খেয়ালও করিনি।
মনে পড়লো এইরকমভাবেই আমাদের ঘরোয়া জীবন থেকে কতকিছুই যে অদৃশ্য হয়ে গেছে,আমাদেরই গোচরে বা অগোচরে,তার হিসাব নেই।
ছোটবেলায় ঠাকুমাকে দেখতাম সংসারের কাজ শেষ করে বসতো পানের সরঞ্জাম নিয়ে,ছোট বড় কত রকমের যে নানান আকারের পাত্র -কোনটায় পান, কোনটায় চুন, কত রকমের কত মশলা।জাঁতি দিয়ে ছোট ছোট সুপুরি কেটে যে ছোট্ট পাত্রটিতে রাখা হতো, তার ঢাকনাটি ছিল ভারী সুন্দর। একটি মেয়ের মুখ।ঠাকুমার মুখেই শোনা, সেই পাত্রটির নাকি একটি দোসর ছিল বা পুরুষ সঙ্গী। আমাদের গ্রামে বন্যা হতো খুব।কোন এক বন্যায় সেই দোসর যায় ভেসে।রয়ে যায় একা নায়িকাটি।সেই কথা শুনে ছোটবেলায় সেই মেয়েটির দুঃখে মন বারেবারে আদ্র হয়ে উঠতো।ঠাকুমার চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই পানের সাজ সরঞ্জাম, জাঁতি সবই গেছে হারিয়ে।শুধু সেই নায়িকাটি কেমন করে যেন এবারেও বেঁচে গেছে।সে এখন আমার আলমারীতেই থাকে আর নিজের সুখের দিনের স্মৃতিতে ভেসে চলে একা একা।
আমার মায়ের বিয়ের যৌতুকে যে বাসনপত্র এসেছিল তাতেও ছিল পানের সরঞ্জাম। আগে নাকি এইরকমই নিয়ম ছিল।পান হলো সমৃদ্ধির প্রতীক,প্রজননের প্রতীক।তাই বাঙালী বিবাহে পানের ব্যবহার প্রচলিত এবং সেই পানের ডাবর যৌতুক সামগ্রী হিসাবে দেওয়াও ছিল প্রথা।যৌতুকে বাসনপত্র বর্তমানে দেওয়া হলেও তাতে পানের ডাবর বা সাজসরঞ্জাম একেবারেই অপাংক্তেয়।
যেমন অপাংক্তেয় খেজুর পাতায় বোনা চ্যাটাই বা পাটি।শীতের রোদ পিঠে নিয়ে, দোক্তাপান চিবুতে চিবুতে খেজুর পাতার চ্যাটাই বুনতো মধুর মা।পাড়ায় তাকে সবাই সেই নামেই চিনতো।তালপাতাতেও বেশ কাজ হতো।পাতা কুড়িয়ে নিয়ে এসে, তাকে রোদে ফেলে শুকিয়ে নেওয়া হতো প্রথমে,তারপর তাকে চিরে চিরে মেয়েদের বিনুনি বাঁধার মতন করে কেমন আশ্চর্য দক্ষতায় চোখের নিমেষে বোনা হয়ে যেত এক একটা চ্যাটাই।ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কাছে তার চাহিদা ছিল খুউউব।গ্রামের ইস্কুলে তো আর তখন বসার বেঞ্চ ছিল না ঐ চ্যাটাই বা আসনই ছিল ভরসা।
আসনবোনা নিয়ে তো বাড়ীর মেয়েদের মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলতো।কে কত ভালো ডিজাইন বানাতে পারে সেই নিয়ে রেষারেষি। চটের উপর উলের ফোঁড়ে ফোঁড়ে সেজে উঠতো জোড়া জোড়া সবুজ টিয়া, লাল গোলাপ থেকে শুরু করে পুতুল, হাতি কিংবা ‘এসো বসো আহারে।’ আরো একটা জিনিসের চল ছিল খুব-সাদা কাপড়ে সূচসূতোর কাজে ফুটিয়ে তোলা হতো নানান প্রবাদ প্রবচন,নীতিবাক্য -‘ সংসার সুখের হয় রমনীর গুনে’ তারপর তাকে বাঁধিয়ে সাজিয়ে রাখা হতো বাড়ীর বসবার ঘরে।মেয়ের বিয়ের দেখাশোনার সময় পাত্রপক্ষের সামনে সাজিয়ে রাখা হতো মেয়ের হাতের কাজ।আর কাঁথা শিল্পের কথা লিখতে গেলে তো সম্পূর্ণ আলাদা করে লিখতে হবে।
বাড়ীতে অতিথি এলে বাইরে থেকে মিষ্টি আনানোর চল খুব একটা ছিল না বরং মেয়ে বৌরা নিজেই ঘরের গরুর দুধ জ্বাল দিয়ে, নারকেল কুড়ে বানাতো হরেক স্বাদের মিষ্টি। বাঙালী বাড়ীর হেঁশেল খুঁজলে হয়তো আজও পাওয়া যাবে সেই সব হারিয়ে যাওয়া কাঠের ছাঁছ-যাতে ফেলে গড়ে উঠতো হরেক আকারের মিষ্টি।কত রকমের আকার তাদের ফুল,শঙ্খ, মাছ আরো কত কী।না, সেগুলো আর ব্যবহার হয় না।
এইরকম লোভনীয় খাবারগুলোই বাড়ীর ছেলেপুলের নাগাল থেকে সরিয়ে রাখতে গিন্নীদের ভরসা ছিল শিকা।দড়ি দিয়ে শিকা বানিয়ে তারমধ্যে হাঁড়িতে করে খাবার তুলে রাখা হতো গৃহস্থবাড়ীতে।নানান গল্প উপন্যাস এবং লোককথায় এই শিকা থেকে খাবার পেরে খাওয়ার অনেক মজার গল্প শোনা যায়।বাংলার একটা বিখ্যাত প্রবাদও আছে এই নিয়ে-‘বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়া। ‘প্রবাদ রয়ে গেলেও শিকা সত্যি সত্যিই শিকায় উঠে গেছে।আজ আর তার নাগাল পাওয়া যায় না।
টেলিভিশন বিহীন সেইসব যুগের মেয়েদের বিকেলগুলো দিব্যি কাটতো ঢেঁকি ভেঙে। ঢেঁকি ভাঙা চালের ভাত যে না খেয়েছে তাকে বোঝানো অসাধ্য এর স্বাদ।গ্রামের সবার বাড়ীতেই যে ঢেঁকি থাকতো তা তো নয়,অবস্থাপন্ন কয়েকটি বাড়ীতেই তা ছিল।বিকেল হলে মেয়ে বৌরা সেখানেই জড়ো হতো চাল,চিঁড়ে কোটার লক্ষ্যে। সঙ্গে সঙ্গে চলতো গল্প-গান।এখন ঢেঁকি শুধুমাত্র দুর্গাপূজার সাজানো গ্রামের মন্ডপের একটি সজ্জামাত্র কিংবা কোন থিম রিসর্টের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।
শুধুমাত্র বাংলার হেঁশেল থেকেই যে কত প্রযুক্তি হারিয়ে গেছে,তা বোধহয় গুনে শেষ করা যাবে না।তেমনই একটি হলো শিল-নোড়া। অবলুপ্ত না হলেও একে অনায়াসে অবলুপ্তপ্রায় বলাই যায়।কিছু বছর আগেও দুপুরবেলা শোনা যেত ‘শিল কাটাবে গো, শিল’-মিক্সির ঘরঘর শব্দের দাপটে সেই আওয়াজ চাপা পড়ে গেছে।হারিয়ে গেছে সেই দারুন দারুন আল্পনা আঁকা শিলগুলো।এখনো হয়তো রান্নাঘরের এক কোনায় অবহেলায় পড়ে আছে,আর কয়েকবছর পর কী হবে? তা বলা অসাধ্য নয়।
আলপনার কথায় মনে এলো সুন্দর সুন্দর আলপনা দেওয়া বিয়ের পিঁড়ির কথা।একজনের বাড়ীতে থাকলে অন্যজন তা চেয়ে নিয়ে যেতো বাড়ীতে ছেলে বা মেয়ের বিয়ে লাগলে।এর জন্য ডেকরেটার্সের কাছে যাবার দরকার ছিল না।বিয়ের পিঁড়ি তো অবশ্যই তখন বাঙালীর রান্নাঘরেও নিত্যকার ব্যবহারের জন্য দেখা মিলতো পিঁড়ির।পিঁড়িতে বসে ভাত খাচ্ছেন বাড়ীর কর্তাটি আর গিন্নী তালপাতার পাখাটি নিয়ে বসে বাতাস করছেন।এ ভারী চেনা ছবি ছিল।এখন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই ছবি ফিকে হতে হতে একেবারেই মুছে গেছে।
কাজল পড়লে দৃষ্টি ভালো হবে-এ বহু পুরানো বিশ্বাস। বাঙালী তখন অনলাইনের অফার দেখে বিদেশী কোম্পানির কাজলের অর্ডার দিতো না।ভারী সুন্দর ঘরোয়া প্রযুক্তির মাধ্যমে নিজেই কাজল পেতে নিতো।সারারাত ধরে প্রদীপ জ্বালিয়ে, তার ওপর প্লেট পেতে কাজল বানাতো,একটু ঘি মিশিয়ে দিলে তা বেশ সুন্দর হতো।অনেক সময় কপূর্র দিয়েও কাজল পাতা হতো।মায়েরা ভালোবেসে বড় করে কাজলের টিকা দিতো সন্তানের কপালে।তরুণী বৌ বা ষোড়শী কন্যাটি চোখে কাজল টেনে চুপিচুপি নিজেকে দেখে নিতো আর্শীতে।
হারিয়ে গেছে সেই কাজলনয়নী মেয়েটি, হারিয়ে গেছে সেই সখীর দল যারা ঢেঁকিতে পাড় দিতে দিতে গাইতো বিরহের বা আনন্দের গান,হারিয়ে গেছে সেই গিন্নীটি যে নানারকমের মিষ্টি গড়ে তুলে রাখতো শিকায় সারাবছরের জন্য নাতি-নাতনীদের পছন্দ বলে।হারিয়ে গেছে বাঙালীর ধানের গোলা,লক্ষীপুজোর আলপনা,শীতলপাটি আর পা ছড়িয়ে বসে আসনে একের পর এক নকশা ফুটিয়ে তোলা মেয়ের দল।হারিয়ে গেছে লাল নীল রঙের দিনগুলো, রয়ে গেছে শুধু কিছু ছবি,জীবনের জলছবি।