ঝিঙে পটল – (ধারাবাহিক, তৃতীয় পর্ব) : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

0
527

পটলের দোকান ঘর ভেঙে দেওয়ার পর এবং তাদের বাড়ি ঘর আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার পর মানসিক দুশ্চিন্তায় ময়মীর শারীরিক অবস্থার প্রচণ্ড অবনতি ঘটলো । এদিকে মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, অন্যদিকে ময়মীকে হাসপাতালে ভর্তি করানো দরকার, সব মিলিয়ে পটলের মানসিক অবস্থা অবসাদে ভরা । ঝিঙে তাদের বেঁচে থাকার ভবিষ্যৎ নিয়ে কতটা শঙ্কিত সেটা বোঝা না গেলেও তার চোখ মুখ দেখলে একটা জিনিস পরিষ্কার, সে বুঝতে পারছে দাদা ভীষণ সঙ্কটজনক অবস্থায় পড়েছে !
স্থানীয় প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মাকে ভর্তি করালো । তারপর বোনকে নিয়ে স্টেশনের প্লাটফর্মে আশ্রয় নিলো । পটলদের অবস্থা এখন পথের ভিখারীর ন্যায় ! সব হারিয়ে তাদের আশ্রয় স্টেশনের প্লাটফর্মে । অন্যদিকে হাসপাতালের ডাক্তারবাবু বললেন, ময়মীয় অবস্থা খুব খারাপ । তাকে হাসপাতালে রাখাটা নিরাপদ নয় । শিগ্‌গির কলকাতার সরকারি কোনো হাসপাতালে ভর্তি করানো দরকার । ময়মীকে সত্বর কেমো দিতে হবে । নতুবা খুব তাড়াতাড়ি কিডনিতে ক্যানসার ছড়িয়ে পড়বে । তখন অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে ।
অথৈ জলে পড়লো পটল । কলকাতার বিন্দুবিসর্গ সে চেনে না, জানে না । সে কীভাবে মাকে নিয়ে কলকাতার হাসপাতালে পৌঁছাবে ? তা ছাড়া মাকে নিয়ে কলকাতা যাওয়ার টাকা কোথায় ? অথচ মাকে ক্যানসার হাসপাতালে সত্বর ভর্তি না করালে তাকে বাঁচানো দুর্বিসহ । লিভারের পাশ দিয়ে অনেকটা ছড়িয়ে গেছে । ডাক্তারবাবুর অনুমান, ক্যানসার রোগটা পটলের মায়ের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাওয়ায় এখন কন্ট্রোল করা ভীষণ কঠিন । মারাত্মক রোগটি থেকে ময়মীকে বাঁচানো এই মুহূর্তে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তারবাবুদের পক্ষে অসাধ্য কাজ, বুঝতে পারলো পটল ।
পটল ডাক্তারবাবুর পা জড়িয়ে ধরে বলল, “স্যার, মাকে কলকাতায় ভর্তি করার একটা ব্যবস্থা করে দিন । নতুবা চোখের সামনে মাকে ইহলোক ছেড়ে চলে যাওয়ার দৃশ্য দেখা ছাড়া আমি কিছুই করতে পারব না । একটা পয়সা নেই । নিঃস্ব অবস্থায় আমাদের দিনাতিপাত । এমতাবস্থায় মায়ের কঠিন ব্যামো । আমার কল্পনার বাইরে ।“ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে পটল ।
ডাক্তারবাবু পটলকে দাঁড় করালো । তারপর ঠাণ্ডা মাথায় তিনি বললেন, “তুমি চলো আমার সাথে ।“
“কোথায় স্যার ?”
বেশী প্রশ্ন করো না । আমি একটা সংস্থার কাছে নিয়ে যাচ্ছি । তাঁদের কাজ, দুস্থ মানুষদের সেবা করা । চলো, তাঁদের কাছে তোমার দৈনদশার কথা বলি । দেখি, তাঁরা কতটা তোমাকে সহযোগিতা করতে পারে !
চ্যারিটেবল ট্রাস্ট । তাঁরা ডাক্তারবাবুর কাছে পটলদের দুরাবস্থার কথা জানতে পেরে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলো । তাঁদের প্রচেষ্টায় পটল তার মাকে কলকাতায় বেহালা শরশুনার কাছে সরকারি ক্যানসার হাসপাতালে ভর্তি করালো । শুরু হল ক্যানসারের যথাযথ চিকিৎসা ও আনুষঙ্গিক পরীক্ষা-নীরিক্ষা ।
পটলের সাথে তার ছোট বোন ঝিঙে ।
রাত্রি কোথায় কাটাবে সেই নিয়ে পটলের দুশ্চিন্তা । অবশেষে হাসপাতালের বারান্দায় ভাই-বোনে শুয়ে পড়ল । ভোরবেলা হাসপাতালের সিকিউরিটি স্টাফ পটল ও তার বোনকে ঘুম থেকে ডেকে বারান্দা থেকে সরে যেতে বললেন । পকেটে মাত্র দশ টাকা । ঐটাকা দিয়ে দুজনের দুকাপ চা । তারপর হাসপাতালের গেটে কিছুক্ষণ অপেক্ষা ! ট্রাস্টের আর্থিক সহযোগিতায় পটলের মায়ের চিকিৎসা ঠিকঠাক চলছে । হাসপাতালে অনেক অভিজ্ঞ ও ক্যানসার বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের আনাগোনা । পটলের মাকে সারিয়ে তোলার নিরিখে ডাক্তারবাবুদের অনলস প্রয়াস অনস্বীকার্য । পটল আশ্বস্ত এই কারণে যে, তার মায়ের চিকিৎসা সঠিকভাবে এগোচ্ছে !
কিন্তু চিকিৎসায় ময়মী সেভাবে সাড়া দিচ্ছে না । যতটুকু সাড়া দেওয়া দরকার, সেইটুকু সাড়া দিচ্ছে না । সেইজন্য ডাক্তারবাবুদের দুশ্চিন্তা অহরহ !
পটল ও ঝিঙে কালীঘাটে মা কালীর কাছে মায়ের আরোগ্য কামনায় হত্যে দিলো । তারা মাকে ফিরে পাওয়ার জন্য মা কালীর কাছে মাথা ঠুকলো । মন্দির থেকে বেরিয়ে এসে ঝিঙে পটলকে বলল, “মা কালী কি আমাদের কথা শুনেছে ?”
“হ্যাঁ শুনেছে । আমাদের মা ভাল হয়ে উঠবে ।“ পটল বোনকে সান্ত্বনা দিলো ।
কিন্তু দাদা, মা কালী আমাদের কথা শুনে মাথা নাড়লো না কেন ? বরং উল্টে মা কালী যেভাবে জিভ বের করা অবস্থায় ছিল, সেভাবেই রইল ।
দূর বোকা ! মা কালী কখনও নড়ে নাকি ? তাকে আমরা আমাদের উদ্বিগ্নতার কথা জানালাম, মা কালী নিশ্চয় আমাদের কথা শুনে মাকে ভাল করে দেবেন ।
দাদার কথা শুনে ঝিঙে শুধুমাত্র দাদার করুণ মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলো ।
তারপর পুনরায় তারা হাসপাতালে হাজির । ট্রাস্টের ভদ্রলোক পটলকে খুঁজে না পেয়ে টেনশনে ছিলেন । পটলকে দেখামাত্র বললেন, “তোমরা এখন খেতে চলো ।“ তারপর হোটেলে গিয়ে ডাল তরকারি দিয়ে পেট ভরে ভাত খেল ।
হঠাৎ ডাক্তারবাবু ট্রাস্টের ভদ্রলোককে ডাকলেন । পটলও ছুটে গেল । ডাক্তারবাবু তাঁদের উদ্বিগ্নতার কথা শোনালেন । ময়মী চিকিৎসায় সাড়া দিচ্ছে না । কেমো চলছে । কেমো নেওয়ার পরে রোগীর অবস্থার আরও অবনতি । ডাক্তারবাবুরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন, তবে কতটা সফলতা পাবেন সে ব্যাপারে সন্দিহান !
ট্রাস্টের ভদ্রলোক বাড়ি ফিরে যেতে পারছেন না । তার পকেটের টাকা নিঃশেষ হওয়ার পথে । তিনিও রোগীর গতিপ্রকৃতি দেখে হতাশ ! দুর্ভাগ্যজনক গতিপ্রকৃতি ! ক্রমশ বাঁচার আশা কমতির দিকে ?
তারপর সাতদিন যমে-মানুষে টানাটানি !
অতঃপর ঝিঙে পটলের জীবনে ছন্দ পতন ! তারা এখন মাতৃহীন ।
পটল মাকে হারিয়ে দিশেহারা ! কোথায় যাবে, কীভাবে বাঁচবে, সেই চিন্তায় অস্থির । মা তাদের অকূলপাথারে ফেলে দিয়ে চলে যাবে পটল কস্মিন্‌কালেও ভাবেনি । মাকে হারিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে পটল । জোরে কাঁদলে বোনকে সামলাতে পারবে না । পটলের কান্না দেখে ঝিঙেও উচ্চ স্বরে রোদন শুরু করলো । একদিকে ঝিঙের কান্না, অন্যদিকে পটলের ফুঁপিয়ে কান্না ! পরিবেশটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল ।
কেঁদে সমস্যার সমাধান হবে না । পটল হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে, তাকে গতর খাটিয়ে উপার্জনের ব্যবস্থা করতে হবে ।
মাকে হারিয়ে তারা এখন আর বিলাসপুর গাঁয়ে ফিরে যেতে চায় না । যে গাঁয়ের মানুষ তাদের বিপদের সময়ে পাশে দাঁড়ালো না, সেই গাঁয়ে পুনরায় ফিরে যেতে পটলের মনে সায় দিলো না । গাঁয়ের মোড়ল ইচ্ছা করে অহেতুক বিপদের মধ্যে পটলকে ফেলে দিলো । অথচ নির্লজ্জ মোড়লের অন্যায্য বিচারের প্রতিবাদে গাঁয়ের মানুষ সোচ্চার হল না । ফলে অনেক স্বপ্ন দেখা সাধের প্রস্তাবিত চায়ের দোকানের বাঁশখুটি মানুষে ভেঙে দিলো । চায়ের দোকানের মাধ্যমে উপার্জনের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হল না । তার উপর মাকে হারালো । মা তাকে একটা শিক্ষাই ভালভাবে দিয়েছে, “পরিশ্রমের বিকল্প নেই । পরিশ্রম করে সৎ পথে বাঁচার মতো আনন্দ কোথাও নেই । তাই গতর খাটিয়ে উপার্জন করা তোমার জীবনের মূল লক্ষ্য হোক ।“
গাঁয়ের মানুষ একটা সময় ময়মীর চরিত্রে নিয়ে প্রচণ্ড জ্বালাতন করতো । গাঁয়ের সবাই জানে, ময়মীর মরদ তাকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে অন্য মেয়েছেলের সাথে পালিয়ে গেছে । জমি নেই, ব্যবসা নেই । উপায়ের কোনো পথ নেই । তাহলে ময়মীর সংসার চলে কীভাবে ? দেখতে খাসা মেয়েছেলে । নিশ্চয় গতর বেঁচে সংসার চালায় । আরও কতকিছু ! পটল মায়ের নিন্দা শুনতে পারতো না, অথচ নিন্দুকদের বিরূদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করতে পারতো না । কিন্তু ভিতরে ভিতরে নিন্দুকদের বিরূদ্ধে আক্রোশ জমতো । একবার মা কালীর পুজোর দিন ময়মী নির্জলা উপোস । রাত্রি ১১টায় আমাবস্যা শুরু । জোগাড়যন্ত্র করে পুরোহিত ঠাকুরের পুজোয় বসতে প্রায় রাত ১২টা । অনেক সময় ধরে পুরোহিত ঠাকুর পুজো করলেন । পুজো শেষ হল ভোর সাড়ে চারটেতে । তারপর অঞ্জলি । ময়মী এগিয়ে গেল অঞ্জলি দিতে । কিন্তু বাঁধা দিলো গাঁয়ের রত্নেশ্বর কাকা । তিনি ময়মীকে অঞ্জলি দিতে বাধা দিয়ে বললেন, “ময়মী বিধবা মেয়েছেলে । শাস্ত্র মতে বিধবাদের মা কালীর পুজোর জিনিসপত্র ছোঁয়া বারণ । বিধবারা পুজোয় অঞ্জলি দিলে পুজাটাই নষ্ট । সুতরাং ময়মীর অঞ্জলি দেওয়া যাবে না ।
ময়মী হতাশ ! মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলো । পুরোহিত ঠাকুর অঞ্জলি মন্ত্র পাঠ করাচ্ছেন, “আগে হাতে গঙ্গা জল নিয়ে তিনবার শ্রীবিষ্ণু উচ্চারণ করুন ।“ এবার আমার সঙ্গে মন্ত্রোচ্চারণ করুন । ঠিক তখন পটল তার মায়ের কাছে হাজির । মায়ের বেজার মুখ দেখে জিজ্ঞাসা করলো, “মা, তুমি হতাশ হয়ে বসে রয়েছো কেন ? ঐদিকে অঞ্জলি চলছে । তুমি কী মা-কালীর পায়ে অঞ্জলি দেবে না ?”
রত্নেশ্বর কাকা এগিয়ে পটলকে বললেন, “তোমার মা বিধবা । মা কালীর পুজোতে অঞ্জলি দিতে পারবে না ।“
আপনি কীভাবে জানলেন, বিধবারা মা কালীর পুজোতে অঞ্জলি দিতে পারবে না । নাকি আপনাদের মনগড়া সিদ্ধান্ত ?
আমি শাস্ত্রের কথা বলছি ।
পটল রীতিমতো রেগে গিয়ে মেজাজে বলল, “আপনি কী শাস্ত্র দেখাতে পারবেন যেখানে লেখা রয়েছে ঘোর অমাবস্যার রাত্রিতে মা কালীর পুজোতে বিধবারা অঞ্জলি দিতে পারবে না ।“
বড্ড বেহায়া ছেলে তো ? গাঁয়ের বয়োজ্যোষ্ঠ মানুষের কথা বিশ্বাস হচ্ছে না । তোমার আস্পর্ধা তো কম নয় !
ধমকাচ্ছেন কেন ? আমার মা সারাদিন ও রাত্রি নির্জলা উপোস রইলো, আর তাকে কিনা নানান বাহানায় পুজোতে অঞ্জলি দিতে দিচ্ছেন না ? এটা অন্যায় ?
তুমি আমাকে ন্যায় অন্যায় শেখাচ্ছো ? এখান থেকে মা ও ছেলে না পালালে আমি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দেবো ।
রেগে গিয়ে পটল হাতের কাছের ইটের টুকরো ছুড়ে মারল রত্নেশ্বর কাকার মাথা নিশানা করে ।
মাথা ফেটে রক্ত ঝরছে ।
ততক্ষণে পটল চম্পট !
ময়মী সেখান থেকে অনেক আগেই পালিয়েছে ।
পরে গাঁয়ের মোড়ল মাতবরেরা ময়মী ও পটলকে ডেকে এনে ভীষণ অপমান করলেন । ময়মীকে সেদিন মোড়লেরা বিলাসপুর গ্রামের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করার হুমকী দিয়েছিলেন । কিন্তু শেষ পর্যন্ত মোড়লদের চোটপাট বেশীদূর গড়ায়নি ।
এইরকমভাবে ময়মী বিভিন্ন সময়ে গাঁয়ের মানুষের নানাবিধ রোষে পড়েছিল । কেউ তাদের পাশে দাঁড়ায়নি ।
পটল এইসব কথা যতভাবে ততই মনে কষ্ট পায় । তাই মাকে হারিয়ে তাদের বিলাসপুর গ্রামে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা উধাও ।
ভাই বোন মিলে মনের দুঃখে শালিকডাঙার বাঁকে এসে দাঁড়ালো । জন্ম থেকে দেখা এই বাঁক । পটলের কত সুখ দুঃখের সাথী শালিকডাঙার বাঁক । তাদের এই বাঁক দিয়েই অন্যত্র ছুটতে হত । তাই জায়গাটা ভোলার নয় । সম্প্রতি তার চায়ের দোকান খোলা নিয়ে যেসব টানাপোড়েন চলল তাতে শালিকডাঙার স্মৃতি পটলের জীবনে সম্ভবত অমর হয়ে থাকবে ।
“দাদা, বাড়ি কখন যাবি ?” ঝিঙে জিজ্ঞাসা করল ।
বোনের কথায় পটলের সম্বিৎ ফিরলো । তারপর ছলছল চোখে বোনের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমাদের বিলাসপুরের বাড়িতে আর ফিরে যাওয়া হবে না । আমাদের বাড়ি ঘর পুড়ে ছাই ! গাঁয়ে থাকার জায়গা নেই । ঘর বাড়ি কিচ্ছু নেই । আমরা এখান থেকে চলে যাব বোন । অনেক দূরে চলে যাব । এখানকার মানুষ আমাদের আপন ভাবলো না । বরং আমাদের উপর অযথা অন্যায় করলো । জন্ম থেকে যে গ্রামটা তার স্বপ্নের গাঁ ছিল, সেই গাঁ ছেড়ে দিয়ে ভিন্‌ গাঁয়ে বাঁচতে চায় পটল । মায়ের দেখানো পথেই গতর খাটিয়ে বেঁচে থাকতে চায় । সততাই তার জীবনের মূল লক্ষ্য ।
“দাদা, বড্ড খিদে পেয়েছে ।“ পেটে হাত দিয়ে ঝিঙে দাদাকে বলল ।
একটু সবুর কর বোন । আমরা স্টেশনের কাছে ননী ময়রার দোকান থেকে পরোটা ও তরকারি খেয়ে নেবো ।
ননী ময়রার দোকানের পরোটার কথা শুনে ঝিঙের জিভে জল । ননী ময়রার দোকানের পরোটা স্বাদে গন্ধে অতুলনীয় । আগে কয়েকবার ঝিঙে পরোটা খেয়েছে । যার জন্য পরোটার কথা উঠতেই ঝিঙে আনন্দে আত্মহারা । তাই পটলের দিকে তাকিয়ে ঝিঙে বলল, “আজ পেট পুরে পরোটা খাব দাদা ।“
বোনের কথা শুনে এক ঝলক শুকনো হাসি দিলো পটল ।
খবর পেল, বাজারসৌ স্টেশনে রেলের অনেক কাজ হচ্ছে । প্লাটফর্মের সংখ্যা বাড়ছে । স্টেশন মাস্টারের ঘর ভেঙে বড় আকারের হচ্ছে । প্লাটফর্মে ওভারব্রিজের কাজ সমানে চলছে । স্থানীয় অনেক মানুষ রেলের কর্মযজ্ঞে নিয়োজিত । পটল ভাবল, বাজারসৌ স্টেশনে গেলে গায়ে গতরে খেটে বাঁচার পথ পাওয়া যাবে । তারপর বোনকে নিয়ে ছুটলো বাজারসৌ স্টেশন ।
সেখানে পৌঁছে পটলের অন্য অভিজ্ঞতা । প্লাটফর্ম বাড়ছে, ঘটনা সত্যি । ওভারব্রীজ হচ্ছে সেটাও বাস্তব । প্রচুর কাজ । অনেক লোকজন কাজ করছে । বেশীর ভাগ শ্রমিক ভিন প্রদেশের । বিহারের লোক বেশী । বাঙালীরা সংখ্যায় কম । তবে প্লাটফর্মের গোটা কাজের কন্ট্রাক্টর একজন । তিনি আবার বহরমপুর শহরের লোক । সাব-কন্ট্রাক্টর অনেকগুলি । কাজ অনুযায়ী সাব-কন্ট্রাক্টরদের কাজ নির্দ্দিষ্ট । সাব-কন্ট্রাক্টরের অধীনে অনেক দালাল । যেহেতু বড় প্রজেক্ট, তাই দালালদের দুষ্টচক্র খুব সক্রিয় । দালালেরা কাজের শ্রমিকদের যোগাড় করে । তারপর তাদের রেলের কাজে দিনমজুরিতে কাজে লাগায় এবং দিনমজুরদের বেতন থেকে দালালেরা কমিশন আদায় করে । উল্টো পাল্টা করলেই শ্রমিকদের কপালে জোটে অকথ্য নির্যাতন । অর্থাৎ মজুরী দৈনিক ৪৫০/-টাকা হলে দালারেরা সেখান থকে কমিশন বাবদ ন্যূনতম একশত টাকা আদায় করবেই ।
দালালের অধীনের কাজ কারবার পটলের ভাল লাগল না । যেখানে খেটে পুরো টাকা পাওয়া যাবে না, সেখানে খাটবার প্রতি তার প্রচণ্ড অনীহা !
কয়েকদিন চলার মতো চ্যারিটেবল ট্রাষ্ট থেকে কিছু টাকা পটলের হাতে গুঁজে দিয়েছিল । সেই টাকা শেষ হওয়ার পথে । সত্বর কাজ করে উপায় না করলে ভিক্ষার আশ্রয় নেওয়া ছাড়া বাঁচার পথ পাওয়া যাবে না । পটলের ভিক্ষাবৃত্তি না-পসন্দ । না খেয়ে থাকবে, তবুও ভিক্ষা করে খাবার যোগাড় করা তার ইচ্ছাবিরূদ্ধ !
বাজারসৌ স্টেশনের প্লাটফর্মে থাকার জায়গা হিসাবে নিরাপদ । অন্যান্য দূরের মজুরেরা সেখানে রাত কাটাচ্ছে । এমনকি ত্রিপল টাঙিয়ে তাদের রান্না ও খাওয়া-দাওয়া পুরোদমে চলছে । পটল ঘোরাঘুরি করে জানতে পারলো, নোনাই নদীর বাঁধ মেরামত চলছে । সেখানে ১০০দিনের কাজ পাওয়া যাচ্ছে । পটল ঠিক করলো, পরের দিন নোনাই নদীর বাঁধ মেরামতির কাজে লাগবে । সেখানে দালালির চক্র নেই । খাটুনির উপর ন্যায্য পয়সা ।
অগত্যা পটল বাজারসৌ স্টেশনের প্লাটফর্মে বোনকে নিয়ে রাত্রিতে শুয়ে রইলো ।
 চলবে