হাঁসুলি : সমীর ঘোষ।

0
474

প্রথম প্রথম জায়গাটার সঙ্গে অতনু একদম মানিয়ে নিতে পারছিল না। এই জায়গাতে যে মানুষ বসবাস করতে পারে এটা তার ভাবনারও অতীত ছিল। ডাক্তারী পাশ করে অতনু প্রথম এই গ্রামীণ হাসপাতাল এ চাকরি করতে এসেছে। এখানে এসে কিছুদিন থাকার পর ভেবেছিলো মাসের শেষে কিছু টাকার জন্য এই ধাপধাড়া গোবিন্দপুরে পড়ে থাকার চেয়ে চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজের শহর কোলকাতায় গিয়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করবে।
ছোট থেকে কোলকাতার জল-হাওয়ায় বড় হয়ে এই রকম একটা দুর্গম ব্যাকওয়ার্ড জায়গায় থাকাটা তার কাছে ছিল খুবই পীড়াদায়ক ।এখানে না আছে ভালো রাস্তা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিনোদনের জায়গা। পকেটে মোবাইল ফোন থাকলেও অধিকাংশ সময়ই সিগন্যাল থাকে না। চারদিকে ঘন জঙ্গল তার মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু বসতি। তার বেশিরভাগটাই আদিবাসী সম্প্রদায়।
অতনু ছাড়াও হাসপাতলে আরো দুজন স্টাফ। একজন ফার্মাসিস্ট আর একজন নাইটগার্ড ।
এখানকার সব মানুষগুলোর ঘরে বিজলিবাতি না জ্বললেও হাসপাতাল চত্বর এবং স্টাফ কোয়াটার্সে ইলেকট্রিক কানেকশন আছে।
এখানে এসে প্রথম প্রথম রাতে কোয়ার্টারে শুয়ে জঙ্গল থেকে ভেসে আসা বিভিন্ন জন্তুর ডাক শুনে ভয় পেত ।রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে ঘাপটি মেরে বিছানায় পড়ে থাকত। এখন গা সওয়া হয়ে গেছে।
অনেক আগে থেকেই তার ফার্মাসিস্ট ছেলেটা এখানে আছে ।সে-ই অতনুকে সাহস যুগিয়েছে। তারপর আস্তে আস্তে এখানকার প্রাকৃতিক বৈচিত্র আর মানুষগুলোর অকৃত্রিম ভালোবাসা ডাক্তার অতনু সান্যাল কে একেবারে একান্ত নিজেদের করে নিয়েছে। এখানকার মানুষগুলোর অনাড়ম্বর জীবনযাপন সহজ -সরল হাসি, লাজুক লাজুক চাহনিতে অতনু যেন কেমন বাঁধা পড়ে গেছে। তাই হাসপাতালে ডিউটির পরও নিজের কোয়ার্টারে বসে তাকে রোগি দেখতে হয়।
অবসর সময় ফার্মাসিস্ট ছেলেটার সঙ্গে গল্প করে। তার মুখে শোনে এখানকার মানুষ গুলোর জীবন-জীবিকার কথা। ভাবে এরা কত অল্পে খুশি অথচ এদেরকে খুশি করতে কারো তেমন মাথা ব্যাথা নাই। চিকিৎসার গুনে এখন এলাকায় অতনুর বেশ নাম হয়েছে। আগের ডাক্তারবাবু হাসপাতালে ওষুধ পত্র চুরি করে বিক্রি করে দিতো তাই এলাকার রোগিরা হাসপাতলে এলে তেমন কোন ওষুধ পেত না ফলে একসময় আদিবাসীদের কেউ অসুস্থ হলে তারা আর হাসপাতালে না এসে পার্শ্ববর্তী কোন গুণিন বা ওঝার দ্বারস্থ হতো।অতনু হাসপাতালে আসার পর সেইসব স্বঘোষিত গুনিন বা ওঝাদের প্রসার অনেকটাই কমে গেছে। তাই তারা এখন অতনুকে খুব একটা ভালো চোখে দেখে না।
সেদিন তখন প্রায় সন্ধ্যা। অতনু তার কোয়ার্টারসের সামনে একটা চেয়ারে বসে আছে। একজন তাগড়াই চেহারার আদিবাসী পুরুষ সঙ্গে একজন মহিলা নিয়ে হাজির হলো।
এখানে আসার পর থেকে অতনুর কোয়ার্টার সে এইরকম অনেকেই বিভিন্ন সময় আছে চিকিৎসার জন্য। এতে অবশ্য অতনুর কোন বিরক্তি নাই।
অতনু জিজ্ঞাসা করে – কি ব্যাপার?
যুবকটা বলে- ডাক্তার বাবু আমার নাম মঙ্গল টুডু এটা আমার বহু চম্পা বটে। হুই জঙ্গলের উধারে আমার ঘর ।
– কী হয়েছে তোমার? নিজের স্ত্রীকে দেখিয়ে বলে- আমার লয় গো ডাক্তার উকে দেখাতে আনলম।
– কী হয়েছে ওর?
– আজ পাঁচ বছর বিহা করলম।ইখনতক কুনু ছ্যেলা হল নাই ।তাই ভাবলম একবার তুমার সনে যুক্তি করি।
মহিলাটি মাথা নিচু করে অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে লাজুক চাউনিতে অতনুকে চুরি করে দেখছে।
অতনু জিজ্ঞাসা করে, – – – আগে কোনো ডাক্তার দেখিয়েছো?
– আজ্ঞে ডাক্তার লয় ওঝা দেখাইনচি।উরা বুলল ছ্যেলা হবেক লাই।উয়ার নাকি কীসব দোষ আচে বটে ।
অতনু মঙ্গলকে পরের দিন হাসপাতালে আসতে বলল। মঙ্গল আর চম্পা অতনুকে নমস্কার জানিয়ে চলে গেল। পরেরদিন হাসপাতলে আসতে অতনু মঙ্গল কে বোঝালো, তুমি তোমার বউকে নিয়ে সদর হাসপাতালে যাও সেখানে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আছে অনেক কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হবে যা এখানে সম্ভব নয়। অতনুর মুখের কথা শুনে মঙ্গল কেমন নীরব। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে চম্পাকে নিয়ে ফিরে গেল।
কয়েকদিন পরে চম্পা একা এসে অতনুর কোয়ার্টাসে হাজির ।
– কী হল! তুমি? গিয়েছিলে সদর হাসপাতালে?
চম্পার চোখে জল। – -ডাক্তারবাবু সদরে যাওয়ার অনেক খরচ। যাবো কি করে ঠিঙ্গে ট্যাকা নাই।
সব মেয়েরা মা হতে চায়। মা না হলে নারীর জীবনে পূর্ণতা আসে না। চম্পারও চোখে -মুখে মা হওয়ার প্রবল বাসনা। হোকনা সে আদিবাসী রমনীর তবু সে মানুষ। সেও চায় আর পাঁচটা মেয়ের মতো তারও কোল আলো করে থাক তার সন্তান।
পকেট থেকে একটা পাঁচশো টাকার নোট বের করে চম্পার হাতে দিয়ে অতনু বলে,
– যাও তোমার স্বামীকে নিয়ে কালই সদর হাসপাতালে যাবে।
চম্পা টাকাটা হাতে নিয়ে ছলছল চোখে চলে গেল।
কেমন একটা তৃপ্তি যেন অতনুর সারা দেহমনে ছড়িয়ে পড়লো।
সদর হাসপাতালে ডাক্তার দেখিয়ে ফিরে ডাক্তারবাবুর পরামর্শ মতো মঙ্গল আর চম্পা দুজনেই ওষুধপত্র খায় এবং প্রায় প্রতিদিনই তারা অতনুর সঙ্গে দেখা করতে আসে।
একসময় অতনুর সঙ্গে মঙ্গল আর চম্পাদের একটা পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। অতনুর কাছে মঙ্গল আর চম্পা কোলকাতার গল্প শোনে। চম্পার খুব শখ একবার কোলকাতা দেখার। মঙ্গল জীবনে একবারই কোলকাতা গিয়েছিল। অনেকের সঙ্গে রিজার্ভ বাসে চেপে পার্টির মিটিংয়ে।অবশ্য ব্রিগেড মাঠ ছাড়া আর কিছুই দেখেনি।
পৌষ পার্বণ। মঙ্গল আর চম্পা দুজনে এসে অতনুকে নিমন্ত্রণ করে গেছে। তাদের মহল্লায় সেরেং হবে, নাচ হবে। সবুজ গাছের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো ঢুকে সারা বনাঞ্চলটাতে এক রূপময় চিত্র। দূর থেকে ভেসে আসছে ধামসা মাদলের তাল।
অতনু ফার্মাসিস্ট ছেলেটাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল মঙ্গলদের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে। ধামসা মাদলের তালে তালে আদিবাসী রমণীদের নিত্য অতনু এই প্রথম দেখলো। অভাব এদের নিত্যসঙ্গী তবু আজ এই রাতে মানুষ গুলো প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর।
এতো লোকের মাঝে একজনকে অতনুর একদম ভালো লাগেনি। তার নাম পাকু। পাড়ার মোড়ল। সারা গায়ে ধেনোর দুর্গন্ধ মাথায় ঝাঁকড়া চুল ।লাল জবা ফুলের মতো চোখ দুটোতে নাই আদিবাসী সরলতা।
এই পাকু কথা’ই আদিবাসী মহল্লার শেষ কথা। তার কথাতেই মহল্লার সবাই ওঠাবসা করে। সদর থেকে নেতারা মিটিং করতে এলে তারা পাকুকে বেশ তোয়াজ করে যায়। পাকুও মাঝে মাঝে সদরে গিয়ে দু-চারদিন করে রাত কাটিয়ে আসে। এই পাকু একদিন হাসপাতালে দাদাগিরি ফলাতে এসে অতনুর দৃঢ় প্রতিবাদে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায়।
চম্পা যেদিন বুঝতে পারলো তার প্রতি পাকুর দুর্বলতা আছে সেদিন থেকে সে পাকুর সঙ্গে বেশ দূরত্ব বজায় রেখে চলে ।প্রতিবাদ করলে হয়তো হিতে – বিপরীত হতে পারে ভেবে মঙ্গলও পাকুকে কিছু বলার সাহস পায়নি ।
সেদিন মঙ্গলই লাজুক হাসি হেসে-হেসে তার বাবা হতে যাওয়ার সুখবরটা দিলো।
খবরটা শুনে অতনু বলে -এবার খুশিতো? এখন থেকে ওকে বেশি পরিশ্রম করতে দিওনা। একটু সাবধানে রাখবে। চম্পা এতোদিন পরে মা হতে চলেছ এই খবরটা চাউর হতেই চম্পাকে না পাওয়ার যন্ত্রনা উসুল করতে এবং ডাক্তার অতনু সান্যাল কে দেখে নিতে আসরে নামে পাকু। সহজ-সরল মঙ্গলের মনে সন্দেহের বীজ পুঁতে দেয়।
তাকে বোঝায় চম্পার গর্ভে যে সন্তান আছে সে তোর সন্তান নয় তার জন্মদাতা ওই শালা অতনু ডাক্তার।চম্পা তোকে ঠকিয়েছে ।মহল্লার সবাইকে বোঝায়, ওই শালা ডাক্তার এখানে থাকলে আমাদের আরো অনেক মেয়ের সর্বনাশ করবে।মে মানুষগুলো এতোদিন অতনুকে ভগবান ভাবতো তারাই এখন অতনু বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে শুরু করেছে।
স্বামীর মুখে কথাগুলো শুনে চম্পা কেমন হতবাক। একসময় স্বামী-স্ত্রীতে তুমুল ঝগড়া শুরু হয়ে যায়। কাঁদতে কাঁদতে চম্পা বলে অমন দেওতাপারা মানুষ
টাকে তু—-
হাজার চেষ্টা করেও চম্পা মঙ্গলের মন থেকে সন্দেহের বীজটা উপড়ে ফেলতে পারে না।
চম্পা বুঝতে পারে তাদের মহল্লায় এখন অতনু ডাক্তার আর তাকে নিয়ে সব সময় চাপা আলোচনা চলছে। যেকোনো সময় ওরা দলবেঁধে অতনুর উপর চড়াও হতে পারে। জাতিটা খুব একগুঁয়ে, একবার মাথায় যে ভূত চাপে সেটা সহজে মাথা থেকে নামাতে চায় না। একটু আগেই সন্ধ্যা হয়েছে।চম্পা হন্তদত হয়ে অতনুর কোয়াটার্সে এসে হাজির। চোখে মুখে কেমন একটা উদ্ভ্রান্ত চেহারা। অবাক হয়ে অতনু বলে,
-কী হলো এ সময়— কাচুমাচু করে চম্পা বলে,
– তুকে কটা কতা বলতে এলম ।
-কী কথা?
– তু ই তল্লাট থিকা চলি মা।
– তারমানে ?
-সবাই জানতে আমি নাকি তুর সনে পেরেম করি,আককাই করি। আমার পেটে নাকি তুর ছেল্যা জন্ম লিছে—- ।
অতনু যেন আকাশ থেকে পড়লো।
-ওই শয়তান পাকু সর্দার ই কতাটো সবকে বুঝাইনছে।
– কিন্তু এত মিথ্যা —-
– সি তো হামি জানচ্ছি আর মারাংবুরু যানচ্ছে। কিন্তুন ওই হড়গুলান নাই বুঝচ্ছে।
– মঙ্গল কী বলছে?
– কী বুলবেক।উ-বেহোড়টা আর মানুষ পারা আচে নাই। শয়তান পাকু ট্যাকায় দিনরাত হাঁ ড়িয়া গিলে পড়ে আছে। মরদগুলো এখন তুর ক্ষেতি করার লেগে ফিকির করছে।
– আমি তোমাদের পাড়ায় যাব।
– কুনো লাভ হবেনে। ওদের তুই চিনিস নাই। তাই বলচি সকাল হওয়ার আগে তুই ইখান থিক্যা চলে যা।
– তুমি কী করবে? -মারাংবুরু জানে আমি ইখন কুছু জানচ্ছি নি। চম্পার চোখে জল চিকচিক করছে। অতনু কী বলবে ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। একটা দমকা হাওয়া যেন তার সবকিছু এলোমেলো করে দিয়েছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই চম্পা হঠাৎ কাপড়ের ভিতর লুকিয়ে রাখা একটা রূপোর হাঁসুলি বের করে অতনুর দিকে বাড়িয়ে ধরে।
– ইটা ঠিঙ্গে রাখ দাদা। জড়ানো গলায় অতনু বলে,
– কী হবে এটা?
– যখুন তুর বিহা হুবে তখুন ইটা হামার রাঙাপারা বৌদিদিকে দিয়ে বুলবি, তুমার এক ননদ ছিল সে ইটা তোমার লেগে পাঠাইন দিছে।
অতনু এখন বোবা। চম্পার দুচোখে গঙ্গা-যমুনা।
দূরের জঙ্গল থেকে একটা কোনো জন্তুর বিকট চিৎকার ভেসে আসছে।