কত আর বয়েস অখিলেশের, এই তো গতবছর রিটায়ার করলো স্টিল কন্টোল অফ ইন্ডিয়ার অফিসার হিসেবে। এই এক বছরেই সাত রাজ্যের বিরক্তি, সতেরো জনের ওপর। সতেরো মানে প্রায় সকল নিকটজনদের ওপর। তা’ নিকট জন বলতে তো কুল্লে সাতজন,নিজের বৌ সুষমা, মেয়ে নিশা, জামাই বিভাস, ছেলে অঙ্গার আর ছেলের বৌ লীনা, আর বহুদিনের পুরোনো ভৃত্য হরিদা। আরো আছে একজন, পদম…..ফাইফরমায়েশ খাটার বছর ষোলোর কিশোর ছেলে টা। থাকা খাওয়া তার এ বাড়িতেই। সতেরো টা কথার কথা। গৌরবার্থে বাড়বাড়ন্ত সংখ্যা।
এদের ঘিরেই অখিলেশের চারিপাশে আজকাল বিরক্তির পরিমন্ডল। সকলে অবাক হয়। আলোচনা হয়, মানুষটা কি রকম পাল্টে গেল! অঙ্গার আর লীনার সাথে সুষমার আলোচনা হয় সামনাসামনি। আর নিশা-বিভাসের সাথে ফোনে। নিশার সাথে খোলাখুলি, বিভাসের সাথে আভাসে। যদিও সুষমা জানে, বিভাসের কাছে রাখা ঢাকা কিছুই থাকে না নিশার দৌলতে। একে তো মেয়ের পেট পাতলা, তার ওপর তার ফিলোজফি, স্বামী- স্ত্রীর মধ্যে গোপনীয়তা আবার কি?
নিশা থাকে কানপুরের কাছে ফাফুন্দে। বছরে আসে একবার। গতবছর বাপের রিটায়ারমেন্টের পর বাপের বাড়ি এসে তার আক্কেল- গুড়ুম হয়ে গেছে।
” হ্যাঁ রে তোর নিত্য জিনসের প্যান্ট- শার্ট পরা চেহারা আর কতোদিন দেখতে হবে বলতো আমাকে? ” মেয়ে জবাব দিয়েছে, ” “তোমাকে আমায় নিত্য দেখতে হয় কবে? বছরে তো বড়জোর দিন দশেক। ” খাঁটি কথা, সত্য কথা। তবু বাপের মেজাজ সপ্তমে। সুষমার প্রতি উষ্মা, ” কি মেয়েকে মানুষের বহর!বাইরে উলঙ্গ হয়ে নৃত্য করুক। কলকাতায় শাড়ি পরতে পারে না?” মা- মেয়ে চুপ করে থাকে। থাকে না মুখ ফোঁড় জামাই। কদিন আগে নাইট- শোয়ে সিনেমা দেখে শালা- শালাজ আর নিজের বৌ সহ অনেক রাতে শ্বশুর বাড়ির কলিং বেল টিপে ঘুম ভাঙানোর জন্য শ্বশুরের গজগজানি ধোঁয়াচ্ছিল মনে মনে। আজ তার ছোটো এক ঝলক হেসে হেসে বলা কথায়,
” ছেলে-মেয়ে মানুষের দায়িত্ব আমার মা বলেন, ফিফটি- ফিফটি। ” অখিলেশ মনে মনে বলেন, ” ডেঁপো ছেলে। ” জামাই বলে বোধহয় রেয়াৎ করে ছোঁড়া শব্দ প্রয়োগে বিরত থাকেন। মুখে বলেন,
” তোমার মা এটা বলেননি, যে বড়োদের মুখের ওপর কথা বলতে নেই? ” বিভাস কথাটা বাড়তে দিতে চায়নি বোধহয়, তাই মশকরা করে সারেন্ডার করে, ” এই দেখেছেন, ফাদার ইন ল’, মায়ের পইপই করে শেখানো এই শিক্ষা টা কি রকম ভুলে গেলাম! ” সুষমা তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর কাছে কৃতজ্ঞতা জানান, সিচুয়েশন আন্ডার কন্ট্রোল। অখিলেশ রণে ভঙ্গ দিয়েছে লালচে চোখ নিয়ে। বেডরুমে সাত পাকের সাথীর ওপর বিষোদগার ঘটতে পারে, সুষমা জানে। তবে সে অশান্তি বেডরুমের চার দেয়াল পেরোবে না একতরফা হওয়ার কারণে।
সুষমা জানে কথায় কথা বাড়ে। দোরের মধ্যেকার খবর বাইরে গেলে সামাল দিতে প্রাণ যাবে। এই তো গত বছর সেই যে নিশা আর বিভাস গেছে, বছর ঘুরে গেছে, ফ্লাইটের টিকিট বুকিং এর কথা এখনো বলেনি ওরা। সুষমা জিজ্ঞাসা করেছিল। নিশা বলেছিল, ” কি জানি, তোমার জামাইের কি মতিগতি? আসলে বাবার যা মেজাজ.. ” কথাটা শেষ করেনি সে। বাপের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ করতে বেধেছে। এটা সত্যি হয়তো সুষমার শিক্ষার ফল। কিন্তু জামাই পরের ছেলে, সে শুনবে কেনো? যেমন শোনে না বৌমা লীনা। মুখে মুখে জবাব তার তৈরি। প্রথমে এরকম ছিল না। কিন্তু সে ও তো মানুষ। অখিলেশের গঞ্জনা কতদিন সহ্য করবে?
তা’ও যদি গঞ্জনার সত্যিকারের ভিত্তি কিছু থাকত। লীনা ভালো বৌমা। দ্বিরাগমনের পর শ্বশুর বাড়িতে ফিরে এসে এক বেলা হেঁশেলের দায়িত্ব নিয়েছে। অখিলেশের রিটায়ারমেন্টের বছর দেড়েক আগে অঙ্গার- লীনার বিয়ে হয়। তখন শ্বশুর বৌমার সব আচরণ, সব কাজের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আর আজ তার সব কাজেই খুঁত বার করে অখিলেশ। আচ্ছা জ্জ্বালা হয়েছে সুষমার, শ্যাম রাখি না কূল রাখি। অখিলেশ কে এ সময় ম্যানেজের দায়িত্ব সুষমার। নইলে তিল থেকে তাল হবে কখন।
এই তো সেদিন লীনা বলল, মা, শীতকালের ফুলকপি। হেভি টেস্ট। বাবা ভেটকি মাছ এনেছে, ফুল কপি আলু দিয়ে ঝোল করি? সুষমা বলেছে, বেশ তো, তোমার বাবা, অঙ্গার দুজনেই পছন্দ করে, করো না। ” ” কি মশলা দেবো মা? ” লীনা রান্না- বান্নায় পোক্ত। তার থেকে বড়ো কথা, ভালোবাসে রান্না করতে। তবু শ্বাশুড়ির কাছে নিত্য জেনে নেয় মশলার কথা। এটা ওর অভ্যাস। তা ‘ সুষমার মন্দ লাগে না লীনার এই ব্যবস্থা। রেস্ট আর সংসারের সেটিং… দুটোই বজায় থাকে। রিটায়ারমেন্টের আগে অখিলেশের এই বক্তব্য ছিল। আর রিটায়ারমেন্টের পর বক্তব্য, ” তোমার বৌমার ধড়িবাজি চাল এটা, তোমাকে সাইফার রেখে সংসারের চাবিকাঠি ট্যাঁকে গোঁজার ধান্দা। তুমি তো বোকার হাড়হদ্দ। কার কি মতলব কিৎসু বোঝো না।
সুষমার মনে হয়, তোমার মতো করে না বোঝাই মঙ্গল। কি ক্ষতি বাপু সামঞ্জস্য করে চললে? ” তা সকলের মাঝে সামঞ্জস্য করতে সুষমা বদ্ধপরিকর। তাই অখিলেশের যখন কারোর সাথে
লাগে, এবং প্রায় প্রতি ক্ষেত্রে অখিলেশের তৎপরতায়, তখন সুষমার সক্রিয় ভূমিকা মিটমাটের, যতদূর সম্ভব সকলের স্বার্থ আর সম্মান বজায় রেখে। এমনকি হরিদা আর পদমের বেলাতেও সুষমার এই একই এ্যাটিচ্যুড। তাই সকলের কাছে সুষমা অভয়দায়িনী দুর্গা। দুর্গে দুর্গে দুর্গতি নাশিনী। সুষমা অপরকে বরাভয় দেয়, কিন্তু অখিলেশের অযথা অভিযোগ মুখ বুজে সহ্য করে। মাত্রারিক্ত অভিযোগে কখনো সখনো মুখ খোলে। আর অখিলেশ তখন মাত্রারিক্তেরও মাত্রা ছাড়ায়।
যাকে বলে,Superlative degree. সুষমাও একটা মানুষ, একটানা কথা শোনাবারো যে একটা সীমানা আছে,সে কথা অখিলেশের মনে থাকে না। ভালো কথা এখন আর বলে না অখিলেশ। সুষমার কাছে তার দাবি,বাড়ির কর্তা হিসেবে তার যে সম্মান পাওনা,তা তাকে প্রত্যেকে দিক। আচ্ছা বিড়ম্বনা! প্রত্যেকেই অখিলেশ কে চিরকাল মান্যগণ্যি করে, আজো করে। অথচ অখিলেশের এই ক্ষোভ কেন, তা ভেবে পায় না সুষমা।সুষমার ভয় হয়, অখিলেশ যদি এভাবে ব্যবহার করে, তবে লোকে বেশিদিন তাকে বেশিদিন সম্মান করতে পারবে না।তার সাথে না হয় অখিলেশের সাত জন্মের বাঁধন। তা কাটা মুশকিল। ভালো লাগুক অথবা না লাগুক সুষমা অখিলেশ কে ত্যাগ করতে পারবে না। কিন্তু ছেলে -বৌমা বা মেয়ে- জামাই শুনবে কেনো? জন্ম দেয়ার ঋণ আজকাল কেউ শোধ করা কর্তব্য মনে করে? কিন্তু স্নেহ নিম্নগামী। সুষমা চায় সন্তান দের নিয়ে বাঁচতে। নিজের ভালো পাগলে বোঝে, কিন্তু অখিলেশ বোঝে না। বোঝে না, অঙ্গার তার বৌ নিয়ে আলাদা হতে পারে। সে সংগতি তার আছে। অখিলেশ বোঝে না, নিশা-বিভাসের ব্যাপারে নাক গলানো আর উচিত নয়। ওরা বড়ো হয়েছে। ঐ আলু ফুলকপি দিয়ে ভেটকি মাছ করা নিয়ে সেদিন খেতে বসে অখিলেশের তুলকালাম.. ” বারোশো টাকা দিয়ে দেড় কেজি ভেটকি আনলাম, তা কি এই ট্যালট্যালে আলুনি ঝোল খাওয়ার জন্যে? কেনো কালিয়া করলে কি হাত ক্ষয়ে যেতো?” মরমে মরে যেতে ইচ্ছে করে সুষমার। একদা রুচিশীল লোকটার কি ভাষা! বৌমার প্রতি মরমী শ্বাশুড়ি সুষমা বলে, ” কই খারাপ হয়েছে কোথায়? ট্যালট্যালে নিশ্চয়ই, এ রান্নার রকম তো এটাই, কিন্তু আলুনি তো নয়, বেশ সুস্বাদু। ” অখিলেশ বলে, “তোমার এতো প্রশ্রয়প্রাপ্ত হয়ে যা খুশি তাই হচ্ছে বাড়িতে। রিটায়ার্ড বরের টাকায় হরির লুঠ। ” লীনা মার্জিত স্বরে বলে, ” বাবা ভেটকি মাছ আপনার খুব প্রিয়,আমি জানি। এবার থেকে আপনার পছন্দ মতো ভেটকির প্রিপারেশন রেস্টুরেন্ট থেকে আনিয়ে নেবেন। ” অঙ্গার মাথা নীচু করে খেয়ে যায়। সুষমা বুঝতে পারে, সে কিছু বলি বলি করেও চেপে গেলো। ছুটির দিনে তার রিলাক্সশড মুডটা অফ। মুখে অমাবস্যার অন্ধকার। ডাইনিং টেবিল ছাড়ার আগে বলল সুষমা কে, ” মা কাল থেকে অফিস ফেরার সময় বাজার ঘুরে আসব।” সুষমা মেঘের মধ্যে সিঁদুর দেখে। অখিলেশ নির্বিকার চিত্তে ভাতের থালা শেষ করে। পিঁপড়া কাঁদিয়া যায় পাতে।
সুষমা ভয় পেয়েছে। ভাবে, এর একটা সমাধান না করতে পারলে, তার সাধের সংসার সে রক্ষা করতে পারবে না। পদম কে শোবার ঘর থেকে ছেলে- বৌমা কে ডাকতে বলে। তিন মাথা এক হয়ে পরামর্শ করে, কি করা যায়। অখিলেশ নিজের ঘরে। হয়তো ঘুমোচ্ছে, হয়তো না। তবে তার কানে কথা যাবে না। কারণ ওরা তিনজনে নীচু গলায় কথা বলছে, আর অখিলেশের আড়িপেতে কথা শোনার অভ্যাস নেই। তবে সাবধানের মার নেই। মানুষটার যখন এতো পরিবর্তন হয়েছে, তখন অনভ্যাসকে অভ্যাস করতে অসুবিধা কোথায়? পরামর্শ শেষে অঙ্গার বলে ইউরেকা! মা তুমি মন্দ পরামর্শ দাওনি। তা একবার দিদিকে জানাই।” অঙ্গার নিশাকে ফোন করে। নিশা বলে, ” বেশ প্রস্তাব। আমার কিন্তু অর্ধেক শেয়ার। ” কি ব্যাপার, কি বৃত্তান্ত বোঝা যাচ্ছে না। তবে এটুকু বোঝা যাচ্ছে অখিলেশের মতিগতি শোধনের একটা যুতসই প্ল্যান তৈরি।
পরের দিন সকলে টেনসড। প্ল্যানের মূল হোতা আর এক্সিকিউটর অর্থাৎ সুষমা আর অঙ্গার রীতিমতো নার্ভাস। সুষমা শুধু অস্ফূটে বলে, “কখন আনবি? ” অঙ্গার কাঁপা গলায় জবাব দেয়, “অফিস ফেরত। ” সুষমা বলে, হে বাবা লোকনাথ, রক্ষা করো। কেলেঙ্কারি যেনো অঙ্গারের বাবা না করে।
সন্ধ্যা সাতটা। অফিস ফেরত অঙ্গার তার বাবার সামনে। পর্দার আড়ালে সুষমা আর লীনা। ঐ তো অঙ্গার থরথর হাতে একটা বাক্স এগিয়ে দিচ্ছে অন্যহাতে ধরা পলিব্যাগ থেকে বের করে। ওর হাত ও রকম কাঁপছে কেনো? সুষমা আর লীনার বুকের মধ্যে হামান- দিস্তার আওয়াজ কেনো? কেনো আবার ? অঙ্গারের আনা বস্তু টায় অখিলেশের প্রতিক্রিয়া নিয়ে। মোবাইল কিনে এনেছে অঙ্গার, যা অখিলেশের দু চোখের বিষ। আজ কিন্তু অখিলেশ অঙ্গারের কথা মন দিয়ে শুনছে, ” বাবা, মোবাইল খুব ভালো জিনিস । দূর কে কাছে এনে দেয়। তুমি সিনেমা, খেলা দেখতে পারবে। নানা দেশের নানা ভিডিও দেখতে পারবে। বিশ্ব ঘুরে আসতে পারবে ঘরে বসে, মাত্র কিছু ডেটা খরচ করে। ইউটিউবে গান শুনতে পারবে। ফেসবুকে, মেসেঞ্জারে কত বন্ধু হবে তোমার। তাদের সাথে গল্প করতে পারবে। হোয়াটসঅ্যাপে ফরওয়ার্ড হবে কত ভালো ভালো মেসেজ, ছবি। ভিডিও পাঠাবে কত লোক। সময় কোথা দিয়ে কেটে যাবে, বুঝতেই পারবে না। অখিলেশের চোখ- মুখ আনন্দোজ্জ্বল। ” তুই কবে শেখাবি”? ” কবে কি, আজ থেকেই শেখাব।” বাপ আর ছেলে মনোযোগী শিক্ষক- ছাত্র। অনেক রাতে লীনা ডাকে, ” এবার খেতে আসুন বাবা, খেতে এসো তুমিও। ”
অখিলেশের জীবনে ইউ টার্ন।
আবার আগের অখিলেশে। কাউকে বকে না, কেউ আর ভয় পায় না তাকে। অখিলেশের সাথে কারই বা বিশেষ কথা হয়? অখিলেশের এখন সোস্যাল মিডিয়ায় বিশাল প্রতিপত্তি। কেউ বলে, দাদা, আপনি এখনো কি হ্যান্ডসম, কেউ বলে, আপনি কি ভালো কথা বলেন, সবাই বলে অখিলেশ রায় কি ভদ্রলোক। সবার খোঁজ খবর নিত্য নেয়া চাই। অখিলেশ সুষমা কে সকলের মেসেজ পড়ে শোনান। সুষমা বলে, “দেখেছ তো, ভালো ব্যবহার মানুষের ভালোবাসা এনে দেয়। কি রকম পাথুরে মানুষ হয়ে গিয়েছিলে তুমি বলোতো। ঐ যে গো মান্না দের ঐ গানটা আছে না, ” যদি পাথরে লেখো নাম, সে নাম ক্ষয়ে যাবে, যদি হৃদয়ে লেখো নাম, সে নাম রয়ে যাবে। আজ সোস্যাল মিডিয়া তোমাকে হৃদয়ে নাম লিখতে শিখিয়েছে। ” অখিলেশ সুষমা কে কাছে টেনে বলে,
” সত্যি।” অঙ্গার অন্য ঘরে লীনাকে কাছে টেনে নেয়, ” উফ বাঁচলাম, বাবার সুপার এ্যানুয়েশন সিনড্রোম দূর করার দুর্দান্ত দাওয়াই মা দিয়েছে। ” নিশা- বিভাস জানিয়েছে, আসছে মাসে কলকাতা আসছে। অখিলেশ হোয়াটস এ্যাপে,ফেসবুকে আর মেসেঞ্জারে সকলের খোঁজ খবর নিতে ব্যস্ত।21/10/2021.
245p.m
নিউ আলিপুর।