পরেরদিন সকালে সোজা নোনাই নদীর বাঁধে । স্টেশনের প্লাটফর্মে বোন একা থাকতে পারবে না ভেবে পটল ঝিঙেকেও সঙ্গে নিলো । অনেকটা দূর । বাজারসৌ স্টেশন থেকে কিছুটা হাঁটার পর “বাবলা” নদী । ঐ এলাকার বিশালাকায় বাবলা নদী । নদী পার হওয়াটা খুব কষ্টকর ! খেয়া নৌকায় পারাপার । পার হওয়ার পর গৌরীনগর গ্রামের পশ্চিম দিকে বিশাল কৃষি জমির মাঠ । সেই মাঠ শেষে নোনাই নদী । হাঁটা পথে দুই কিলোমিটার । মাঠের শেষ প্রান্তে নোনাই নদীর বাঁধ । বাঁধ বরাবর খানিকটা হাঁটলে মাঠের মাঝখানে স্লুইস গেট । গেটের মেরামতির কাজ চলছে । সাথে সাথে বাঁধে মাটি ফেলার কাজ চলছে । সামনে বর্ষাকাল । বর্ষাকালে মাঠের আমন ধানের চাষ বাঁচাতে নদী বাঁধের মেরামতির কাজ চলছে । বোনকে নিয়ে স্লুইস গেটের কাছে পৌঁছালো পটল ।
তদারকি করার মানুষটির বিরাট ভুঁড়ি । তাঁর পরনে আবার ডোরাকাটা চেক লুঙ্গি । নাম গদাই । সবাই গদাই খুড়ো নামে ডাকে । গদাই খুড়ো কড়া মেজাজে সবাইকে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছেন । গদাই খুড়োর পাশে গিয়ে পটল কাঁচুমাচু হয়ে কাজের জন্য অনুরোধ করল । ভুঁড়িওয়ালা মানুষটি অল্প বয়সের পটলকে দেখে অবাক ! তার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি কে হে ছোকরা ? নোনাই নদীর বাঁধে নতুন দেখছি ! তুমি কী মাটি টানতে পারবে ? প্রচণ্ড ভারী । এইটুকু ছেলে, কাজ করতে পারবে তো ?”
হ্যাঁ পারব ।
“ঝুড়িতে করে মাটি টানতে পারলে আমার আপত্তি নেই । দক্ষিণ দিকে মাটি ফেলার কাজে লেগে যাও । তবে একটা কথা, এখানে কোনো জলখাবার বা খাবার পাওয়া যাবে না । চারটের পরে ছুটি ।“ এই কথা বলার পর তিনি মনোহরকে ডাকলেন, “এই মনোহর । ছেলেটা কাজ করতে চায় । তুমি দক্ষিণ দিকে কাজে যাচ্ছ । সুতরাং তাকে কাজটা বুঝিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব তোমার ।“
পটলের সঙ্গে ঝিঙেকে দেখতে পেয়ে গদাই খুড়ো জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার সঙ্গে দেখছি ?”
আমার বোন । ঝিঙে ।
গদাই খুড়ো তাঁর ভুঁড়িতে হাত দিয়ে ব্যঙ্গোক্তি করে বললেন, “তুমি বোনকে কাজ শেখাবে নাকি ?”
গদাই খুড়োর রসাত্মক কথা শোনার পর উপস্থিত বাঁধের কাজের মানুষদের মধ্যে হাসির সোরগোল !
কাকা, আমার বাড়ি ঘর কিছু নেই । মা বাবা কেউ নেই । বোনের কাছে আমিই তার মা বাবা । তাই আমি যেখানে যাই, বোনকে সঙ্গে নিয়ে যাই ।
পটলের কথা শোনার পর উপস্থিত সবাই চুপ ! পটলের প্রতি তাদের এখন করুণ দৃষ্টি !
গদাই খুড়ো পটলকে আর কিছু বলতে পারলেন না । তিনিও চুপচাপ । তারপর সমস্ত মানুষ যে যার কাজে যোগ দিলো ।
ছোট নদী । কিন্তু বাবলা নদীর ভূয়াল রূপ সকলের জানা । বাবলা নদীর জল বাড়লে বর্ষাকালে নোনাই নদীর ভয়াবহ আকার, গৌরীনগর গ্রামবাসীদের উদ্বেগের কারণ । নোনাই নদী ঘেঁষে গৌরীনগর গ্রামের চাষের জমি । সেই চাষের মাঠ শেষে নদী ঘেঁষে নোনাই নদীর বাঁধ । মাঠের ঠিক মধ্যেখানে নদীর বাঁধের গেট । স্লুইস গেট । মাঠের সমস্ত জল ঐ স্লুইস গেট দিয়ে নিষ্কাশন হয় । কিন্তু বর্ষাকালে নোনাই নদীতে জল বোঝাই থাকে । মাঠে বর্ষার জমা জল বের করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় । তখন স্লুইস গেট বন্ধ থাকে । সেই সময় আমন ধানের প্রচুর ক্ষতি হয় । কিছু আবাদী আমন ধানের জমি বর্ষার জলে ডুবে যায় । উপরন্তু আরও একটা উৎপাত । বাঁধ ভেঙ্গে নোনাই নদীর জল মাঠে ঢুকলে আরও বিপদ ! সেই বিপদের কথা মাথায় রেখে নদীর বাঁধের মেরামতি ।
প্রচুর সংখ্যায় মানুষ কাজ করছে । ব্লকের বি-ডি-ও সাহেব ভিজিটে আসবেন । সেই কারণে কাজের গতি তুঙ্গে । মাঠ ঘেঁষে নোনাই নদীর সম্পূর্ণ বাঁধটার সংস্কার হচ্ছে । গৌরীনগরের মানুষ বিশেষ করে পঞ্চায়েতের লোক ঘন ঘন স্পটে এসে তদারকি করছেন । সেই বাঁধের দক্ষিণ দিকে মনোহরের তদারকিতে পটলকে নিয়ে বারোজন লোক কাজ করছে । ছয়জন কোদাল দিয়ে পুকুর থেকে মাটি কেটে ঝুড়িতে ভরছে, অন্য ছয়জন লোক সেই মাটির ঝুড়ি মাথায় নিয়ে বাঁধে মাটি ফেলছে । ঘামঝরা কাজ । প্রচণ্ড মেহনতের কাজ । ইতিপূর্বে পটলের জীবনে মাটি টানার অভিজ্ঞতা নেই । সে খাটুনিতে ভয় পায় না । কিন্তু তার মতো অল্প বয়সের ছেলের পক্ষে মাটি টানার কাজ ভীষণ কষ্টকর । তাই বারোটা বাজতে না বাজতেই পটল অমানুষিক খাটুনিতে হাঁপিয়ে উঠল ।
মনোহর পটলের শারীরিক স্থিতি দেখে চমকে উঠল ! এই ছেলে কি করে সারাটা দিন কাজ করবে ? যেভাবে পটল পরিশ্রান্ত হয়ে ঘামছে তাতে তার পক্ষে বেশীক্ষণ কাজ করা অসম্ভব ! অথচ পটলের সাংসারিক কাহিনী শুনে মনোহর পটলকে ভালবেসে ফেলেছে । ক্ষণিকের মধ্যে তাকে আপন করে নিয়েছে । তাই মনোহর পটলের কাজে বিরক্ত না হয়ে বরং স্নেহমাখা কন্ঠে বলল, “পটল, তুমি এবার একটু জিরিয়ে নাও ।“
পটল মাথা থেকে গামছাটা খুলে গায়ের ঘাম মুছলো । তারপর বোনের দিকে তাকিয়ে দেখে সে আপনমনে একা একা কিৎ কিৎ খেলছে । নদীর জলে চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে ডুমুর গাছের নীচে বসলো । পটলের ঝুড়িতে মাটি কাটার লোকটাকে মনোহর বলল পটলের ঝুড়িতে হাফ ঝুড়ি মাটি দিতে । তাহলে তার শরীরে বেশী ধকল সইতে হবে না । হাল্কা কাজ থাকলে সারা দিন তার পক্ষে মাটি টানা সমস্যা হবে না । প্রথমদিনেই তাকে তাড়িয়ে দিলে পটল বাঁচবে কীভাবে ?
ঘড়িতে দেড়টা । মনোহর মাটি টানার প্রত্যেককে খাবার খেয়ে নিতে বলল । সকলে নদী থেকে হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসলো । যে যার পুটুলি থেকে খাবার বের করে খেতে শুরু করলো । মনোহর বুঝতে পারলো, পটলের কাছে কোনো খাবার নেই । মনোহর লক্ষ করলো, পটল অন্যের আনা জল ঢগ ঢগ করে খাচ্ছে । সম্ভবত জল খেয়েই পটলের শান্তি । পটলের জল খাওয়ার দৃশ্য দেখে মনোহরের বিবেক জেগে উঠলো । পটলকে ডাকলো, “তুমি বোনকে ডাকো । বাড়ি থেকে আমাকে কয়েকটা রুটি দিয়েছে । তরকারি তেমন কিছু নয় । আলু সেদ্ধ ও লঙ্কার আচার । তুমি ও তোমার বোন মিলে খাও ।“
মনোহরের ভালবাসা দেখে পটলের চোখে জল । এত সুন্দরভাবে আজ পর্যন্ত কেউ তাকে ভালবাসেনি । যাই হোক ভাই-বোন মিলে রুটি খেল । রুটি খেয়ে তাদের শান্তি । বোনটাও অনেক তরতাজা ! সকলের খাওয়া হয়ে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম । তারপর আবার মাটি কাটা ও টানা শুরু । বাঁধে ঠিকঠাক মাটি না দিলে বর্ষাকালে বাঁধ ভেঙ্গে নোনাই নদীর জল হু হু করে মাঠে ঢুকে পড়ার সম্ভাবনা । মাঠে জল ঢুকলে মানুষের কষ্টের আমন ধান নষ্ট হয়ে যেতে বাধ্য । আমন ধানে গ্রামবাসীদের সারা বৎসর সংসার চলে । সুতরাং গৌরীনগরের গ্রামবাসীরা কোনোরকম ঝুঁকি নিতে রাজি নয় । বর্ষার আগেভাগেই বাঁধ মেরামতির কাজ সেরে রাখতে চায় । তাই বাঁধ মেরামতির কাজের ব্যাপারে তাঁরা যথেষ্ট সযত্ন ও তৎপর । যারজন্য তদবির তদারকি করে সরকারি অনুদান আদায় করে । এবছরও বাঁধ মেরামতির জন্য ভাল টাকা গ্রান্ট পেয়েছে । সেই টাকার সরকারি কাজ চলছে । স্লুইস গেট ঠিক না রাখলে আখেরে গ্রামবাসীদের ক্ষতি । অনেক সময় প্রচণ্ড বর্ষার কারণে নোনাই নদী ভয়াবহ আকার নেয় । সেই সময় স্লুইস গেট ছাপিয়ে মাঠে জল ঢুকে । সেই কারণে স্লুইস গেটের উপরের রাস্তাটা এবার অনেক উঁচু করে তৈরী করার পরিকল্পনা । সব মিলিয়ে বর্ষার আগে কয়েক মাসের কাজ ।
তারপর চারটের পর ছুটি । দুজনে হেঁটে বাজারসৌ স্টেশন ফিরলো । মাঝখানে বাবলা নদীতে খেয়া পার । পরিশ্রান্ত হয়ে ফিরেছে পটল । সারাদিন মাটি টানার কাজ । তার উপর এতটা পথ হাঁটা । বোনকে নিয়ে অতিরিক্ত খাটুনি । মাঝখানে দুবার বোনকে কোলে নিতে হয়েছে । সারাদিনের খাটুনিতে পরিশ্রান্ত হওয়ার জন্য পৌঁছেই স্টেশনের প্লাটফর্মে শুয়ে পড়লো পটল । দাদার মাথার কাছে ঝিঙেও শুয়ে পড়লো । শুয়ে পড়ার সাথে সাথে ঘুম । নিমেষেই ঘুমিয়ে পড়লো দুজনে । তারপর ঘুম ভাঙ্গল স্টেশনের চাপরাশি কৃপাল সিংহের ডাকে । কৃপাল সিং তাদের অন্যত্র শুয়ে থাকার পরামর্শ দিলো ।
ঘুম থেকে উঠে ঝিঙে পটলকে বলল, “দাদা খিদে পেয়েছে ?”
দাদা পড়লো মহা ফাঁপড়ে । রাত তখন ১১টা । স্টেশন চত্বরের সব দোকান বন্ধ । একমাত্র স্টেশন ঘেঁষে চায়ের দোকান খোলা । রান্না করে খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই । এখনও রান্নার মতো তাদের পরিস্থিতি আসেনি । সদ্য তারা স্টেশনের অতিথি । স্টেশনের হালহকিকৎ এখনও তাদের করায়ত্ব হয়নি । স্টেশনে থাকার ব্যাপারটা পুরোপুরি বুঝতে পারলে রান্নার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে ।
“দাদা, পাউরুটি পাওয়া যাবে ?“ পটল চায়ের দোকানে জিজ্ঞাসা করলো ।
এত রাত্রে পাউরুটি ? পাউরুটি শেষ ।
তবে খাওয়ার মতো কি আছে ?
আমার চায়ের দোকানে বিস্কুট ও চা ছাড়া আর কিছু নেই ।
“আচ্ছা দাদা !” কিছু বলার জন্য পটল চায়ের দোকানদারের দিকে তাকালো ।
“বলো কী বলবে ?” এবার চায়ের দোকানদার পটলের উত্তর শোনার জন্য তার দিকে তাকিয়ে রইলো ।
খাওয়ার জন্য কোথাও রুটি তরকারি কী পাওয়া যাবে ?
“বাস রাস্তার উপরে জগাইয়ের হোটেল খোলা থাকলে রুটি পাওয়ার একটা সম্ভাবনা রয়েছে । তোমরা বরং তাড়াতাড়ি পাকা রাস্তায় গিয়ে খোঁজ নাও ?” চায়ের দোকানের মালিক পটলকে পরামর্শ দিলো ।
বোনকে নিয়ে পটল ছুটলো বাস রাস্তায় । স্টেশনের প্লাটফর্ম থেকে নামার পর পুরো রাস্তাটাই শুনশান । রাস্তায় লোকজন নেই । কয়েকটা কুকুর রাস্তার উপরে গড়াগড়ি খাচ্ছে । রাস্তার দুপাশের সমস্ত দোকানের ঝাঁপ বন্ধ । কিছুটা এগিয়ে পটল লক্ষ করলো একটা মুদিখানার দোকান খোলা । মুদিখানার দোকানের মালিক বসে বসে নগদ টাকা গুনছেন । একটু এগিয়েই বাস রাস্তা । বাস রাস্তার ঠিক মোড়ে ঝুঁপড়ির মধ্যে জগাইয়ের ভাত খাওয়ার হোটেল । বেঞ্চে বসে খাওয়ার আয়োজন । লো-বেঞ্চে বসে হাই-বেঞ্চে ভাতের থালা রেখে খাওয়ার ব্যবস্থাপনা । রাত্রিতে সেখানে বাসের ড্রাইভার, বাসের খালাসী, ভ্যান রিক্সাওয়ালা, শেষ ট্রেনের যাত্রীরা সাধারণত খাবার খান । হোটেলে তখনও বিজলী বাতি জ্বলছে । দুজন লোক বসে ভাত খাচ্ছেন । জগাই উনুনে কড়াইতে ডিমের ওমলেট বানাতা ব্যস্ত !
এত রাত্রিতে পটল ও ঝিঙেকে দেখে জগাই অবাক ! পটলকে দেখে জগাই অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “বাজারসৌতে তোমাদের আগে কখনও দেখেনি ?“
আমরা দুদিন আগেই স্টেশনে এসেছি । এখানে নতুন । কথা না বাড়িয়ে আমাদের খাবার দিন । আমার বোনের বড্ড খিদে পেয়েছে । ভাত, ডাল ও তরকারি হলেই আমাদের খাওয়া হয়ে যাবে ।
তবে বাছা ! তরকারি হবে না । আমি ভাত ও ডাল দিচ্ছি, সঙ্গে ডিমের ওমলেট ।
পটল উত্তরে বলল, “তাতেই আমাদের খাওয়া হয়ে যাবে ।“
মাটি টানার প্রথম দিনের কাজের মজুরির পয়সায় পেট ভরে ভাত খেয়ে দুজনে খুব খুশী ।
তারপর প্লাটফর্মে গাছের নীচে প্যাসেঞ্জারদের জন্য বানানো বেঞ্চে তারা দুজন শুয়ে পড়লো । শুয়ে পড়ার সাথে সাথেই তাদের ঘুম । পরেরদিন সকালে আবার যেতে হবে নোনাই নদীর বাঁধে । তাই ভোরে উঠতে হবে ।
ঠিক ভোর চারটেতে প্লাটফর্মে মানুষদের সোরগোল । প্রথম ট্রেন ভোর সাড়ে চারটেতে । যারা হাওড়া যাবেন তাঁরা বাজারসৌ থেকে প্রথম ট্রেন ধরেন । তারপর কাটোয়ায় নেমে কাটোয়া থেকে ফার্স্ট কাটোয়া-হাওড়া লোকাল ধরে সোজা কলকাতা । বড় বাজারে অনেকে ব্যবসার তাগিদে যান । স্থানীয় অনেক ছোট ছোট ব্যবসায়ী কলকাতার বড় বাজার থেকে মাল কিনে শেষের ট্রেনে বাড়ি ফেরেন । এটা ওখানকার মানুষের নিত্যদিনের কড়চা !
(চলবে)