ঝিঙে পটল (ধারাবাহিক, অষ্টম পর্ব) : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

0
396

মনোহর বারোজন লেবারের একটা টীম নিয়ে পোড়াবাড়িটা পুরো ভেঙ্গে দিলো । কতিপয় কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা মৃদু আপত্তি জানিয়েছিলেন । তাঁরা পটলের কাছে জানতে চেয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “বাড়ি ভাঙ্গার অনুমতি তাকে কে দিয়েছে ? কেননা এই বাড়ির মালিক এখনও বেঁচে রয়েছেন । ফোনে তাঁদের সাথে বাড়ির মালিকের কথোপকথন নিয়মিত চলে ।“
পটল হাত জোড় করে তাঁদের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বলল, “আমি পঞ্চায়েতের অনুমতি মোতাবেক কাজে হাত দিয়েছি । এখানে আমি মুড়ির দোকান খুলতে চাই । ব্যবসা করে বেঁচে থাকতে চাই ।“
“নিজে জমি কিনে দোকান খুলতে পারতে । পরের জায়গার প্রতি লোভ কেন ?” একজন স্থানীয় বাসিন্দা ক্ষোভ উগড়ে দিলেন ।
কাকা, নিজের ক্ষমতা থাকলে আমি এই পোড়োবাড়িটা ভেঙ্গে দোকান খোলার চিন্তা করতাম না । সহায় সম্বলহীন আমাদের অবস্থা । স্টেশনের প্লাটফর্মেই আমাদের জীবনযাপন । নোনাই নদীর বাঁধে মাটি কাটার কাজ থেকে বিতাড়িত । কারণ বয়সগত কারণে আমি ছাঁটাই । মাটি কাটার কাজ করার ক্ষেত্রে অযোগ্য । এমতাবস্থায় আমাকে বিকল্প পথ বেছে নিতে হচ্ছে বাঁচার জন্য । আমি পঞ্চায়েতের কাছে পারমিশন নিয়ে রাখলাম, যাতে ভবিষ্যতে ফাঁকা জায়গায় দোকান করার জন্য কোনোরকম ঝুট-ঝামেলা পোহাতে না হয় ।
বেজার মুখে তাঁরা চলে গেলেন ।
কাজে মন দিলো পটল । মনোহর তখনও পুরো দমে কাজ করে যাচ্ছে । পোরোবাড়িটা ভেঙ্গে গাছ গাছালি সাফা । আশেপাশের এবরো-খেবরো জায়গা কোদাল দিয়ে সমান করলো । মনোহর ও তার টীম জায়গাটা পরিপাটিভাবে পরিষ্কার করার পর বোঝার উপায় নেই সেখানে একটা পোড়োবাড়ি ছিল । মনে হচ্ছে খোলা আকাশের নীচে ফাঁকা মাঠ ।
মনোহর পটলের দিকে তাকিয়ে বলল, “বলো, আমাদের আর কী করতে হবে ?”
আমি আর কী বলব । বলার আগেই তোমরা এতগুলি লোক মিলে সব কাজ সুন্দরভাবে গুছিয়ে সারলে । এতেই আমি প্রচণ্ড খুশী । সারাটা দিন তোমাদের বিনা পারিশ্রমিকে শ্রম দিতে হল, এইজন্য তোমাদেরকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা নেই । শুধু একটাই প্রার্থনা, ভবিষ্যতেও তোমরা এভাবে আমার পাশে থেকো ।
মনোহর দলবল নিয়ে সন্ধ্যা লাগার আগে বাড়ি ফিরে গেল ।
সারাদিন দাদার সাথে বোনটাও কাজে হাত লাগিয়েছে । তার এখন বড্ড খিদে । সন্ধ্যাবেলায় পটল টিউবওয়েলে স্নান সারলো । ঝিঙে দুপুরবেলায় এক ফাঁকে প্লাটফর্মে এসে স্নান সেরে গেছে । দুপুরে তাদের সেভাবে কিছুই খাওয়া হয়নি । মুড়ি ও ঘুগনি খেয়ে কাটাতে হয়েছে । তাই ঝিঙের এখন প্রচণ্ড খিদে ।
স্নান সেরে আসার সাথে সাথে ঝিঙে দাদাকে বলল, “দাদা এবার খেতে চল । আমার খুব খিদে পেয়েছে ।“
পটল পকেটে হাত দিয়ে দেখে তার পকেট শূন্য । যেটুকু পয়সা ছিল তাই দিয়ে মনোহরদের কাজের টীমকে আপ্যায়ন করতে ব্যয় হয়ে গেছে । অবশিষ্ট একটি পয়সাও নেই । বোনের আবদারে তাকে কী খাওয়াবে সে চিন্তায় পটলের নাভিশ্বাস !
বোনকে নিয়ে খুব ধীর গতিতে পটল রহমান চাচার খাবারের দোকানে পৌঁছালো । তখন সন্ধ্যারাত্রিতে রহমান চাচার দোকানে খরিদ্দারদের রুটি খাওয়ার ধুম । অনেক মানুষের জটলা । বোনকে দোকানের একদিকে দাঁড় করিয়ে রহমান চাচার কানের কাছে গিয়ে পটল বলল, “বোনটার খুব খিদে, অথচ পকেটে আমার পয়সা নেই । তুমি বোনকে অন্তত বাকীতে রুটি খাওয়াও, আমার খাওয়ার দরকার নেই ।“
রহমান চাচা খেকিয়ে উঠলো । রোজ তোমার বোনকে বাকীতে খাওয়ানোর জন্য কী আমি দোকান খুলেছি ? যতো সব আদিখ্যেতা ! ভাগো এখান থেকে । তোমাকে সাফ বলে দিলাম, আমি রোজ রোজ তোমার বোনকে বাকীতে খাওয়াতে পারব না ।
রোজ রোজ কোথায় চাচা ! এই নিয়ে পাঁচ দিন বাকীতে খাওয়া ।
তোমরা আছোই এখানে সাতদিন । তার মধ্যে পাঁচদিন বাকীতে খাওয়া । ব্যাপারটা কী সহজে ভাবা যায় ! আমার সাফ কথা, আমি বাপু আর বাকীতে খাওয়াতে পারব না । বেশী জ্বালাতন করো না । দেখতে পাচ্ছ, দোকানে অনেক খরিদ্দার । আমাকে দোকানের খরিদ্দার সামলাতে দাও ।
রহমানের ভাব গতিক অবলোকন করে পটল স্থান ত্যাগ করলো । রহমান চাচা একবারের জন্যেও পটলকে ডাকলো না । অথচ রহমান চাচা ভালভাবে জানে, ঝিঙের খিদে লাগলে ঠিক থাকতে পারে না । সবসময় আনচান করে । খিদেয় ছটফট করে । বোনের শুকনো মুখ দেখে পটল অদৃষ্টকেই দোষারোপ করতে থাকে । এবার তার চিন্তা, বোনকে সে কী খাওয়াবে ?
তখন হাওড়াগামী ফরাক্কা – হাওড়া মেল ট্রেন প্লাটফর্মে ঢুকলো । ঝিঙে পটলের হাত ধরে প্লাটফর্মে ফিরছে । এমন সময় নতুন দম্পতি ট্রেন থেকে নামলো । নেমেই “কুলি” “কুলি” করে চিৎকার ! কিন্তু বাজারসৌ স্টেশনে কোনো কুলি নেই । এমনকি রেলের নির্ধারিত কোনো কুলির বন্দোবস্ত নেই । তাঁদের সাথে দুটি বড় বড় ব্যাগ । ম্যাডামের হাতে একটি ও পিঠে একটি ব্যাগ । ভদ্রলোকের দুই হাতে দুটি মাঝারি সাইজের ব্যাগ । তাঁদের পক্ষে ঐ বড় দুটি ব্যাগ নেওয়া অসম্ভব । পটল গুটিগুটি পায়ে ভদ্রলোকের কাছে গিয়ে বলল, “আপনি ব্যাগ দুটি আমার মাথায় তুলে দিন । আমি বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে দিচ্ছি ।“ এই কথা শুনে ভদ্রলোক ব্যাগ নেওয়ার টেনশন থেকে মুক্ত হলেন । পটল ব্যাগ দুটি মাথায় নিয়ে রিক্সায় নামিয়ে দিলো ।
ভদ্রলোক মানি-ব্যাগ থেকে টাকা বের করতে যাবেন এমন সময় পটল ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বলল, “টাকা দিতে হবে না ।“
তা হয় না । তুমি প্লাটফর্ম থেকে এতটা দূর ব্যাগ বয়ে আনলে এটা তার পারিশ্রমিক !
“আমি কুলি নই । যদি পয়সা দেওয়ার ইচ্ছা একান্ত থাকে তবে আমার বোনকে কিছু খাবার কিনে দিন । বেচারা ভীষণ ক্ষুধার্ত ।“ বোনের দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোককে পটল অনুরোধ করলো ।
ভদ্রলোক বুঝতে পারলেন, দুইজনেই না খাওয়া । তাই মিষ্টির দোকানে ঢুকে দুটো পাউরুটি ও দশটা রসগোল্লা কিনে পটলের হাতে তুলে দিলেন ।
খাবার দেখে পটলের চোখ ছলছল ।
পরেরদিন ফাঁকা মাঠে ছাতা টাঙিয়ে পটল শুধুমাত্র মুড়ি নিয়ে বসলো । হোটেলের জগাইয়ের বদান্যতায় ঘুগনি বানানোর উপকরণ জুটলো । তারপরের দিন থেকে শুরু হল মুড়ি ও ঘুগনির দোকান ।
খুব ভোরে এসে দোকান খোলে পটল । প্রথমে এক কড়াই ঘুগনি বানিয়ে মুড়ি নিয়ে বেচাকেনা শুরু করে । পটলকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় তার ছোট বোন ঝিঙে । ভাই-বোন মিলে ভোর পাঁচটার মধ্যে দোকান খোলে । কেননা ঐ সময়ে অনেক রিক্সাওয়ালার সমারোহ ঘটে । যারা ট্রেনের নিত্য যাত্রী, তারাও ঐ সময়ে কিছু হাল্কা খাবার খোঁজ করেন । মুড়ি ঘুগনি ও জল খেয়ে তাদের সাময়িক ক্ষুধা নিবারণ । এইভাবে পটলের মুড়ির দোকান ক্রমশ উন্নতির দিকে ।
দোকান খোলার পর পটলের খাওয়ার অভাব হচ্ছে না । দোকান ভাল চলায় লভ্যাংশ বেশী না থাকলেও লোকসান নেই । যার জন্য পটলের পেটের চিন্তা ক্রমশ অবলুপ্তির পথে ।
 ( চলবে )