ক্যামেরার আড়ালে (অণু উপন্যাস, প্রথম পর্ব) : মানস সরকার।

0
375

রোজ হাসে। আজও হাসল দাদা। এতটাই তাজা সে হাসি, ক্লান্তির অনেকটাই উবে যায় তমালীর ভেতর থেকে। আগের মাসেই চাকরি জীবনের দেড় বছর পূর্ণ। এবং সেটা একই কোম্পানিতে। কলসেন্টারের চাকরিতে বিরল ঘটনা। ট্রেনিং শেষ করে যে–ব্যাচের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল, তাদের অনেকেই আজকে অন্য কোম্পানিতে। যখন-তখন টার্মিনেশানের ই-মেল তমালীর ভাগ্যে এখনও জোটেনি। টিমলিডার থেকে ম্যানেজমেন্ট–সবাইকার সুনজরে ওর নামটা। ‘এ’ বা ‘বি’ শিফ্‌ট বা ‘নাইট’-ডিউটির যে-কোনও সময়কে চাকরি জীবনের একটা চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়েছে। খুঁড়িয়ে চলা সংসারে ওর চাকরি আসলে একটা ক্র্যাচ। প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়ে দাদার সামনে এল তমালী। লাস্ট লোকাল ট্রেন। হাতে গোনা যাত্রী নামে চন্দননগরে। গমগমে স্টেশনটা এখন যেন ঘুমন্ত। আশেপাশে কোনও মানুষজনকেই দেখা যাচ্ছে না। ‘বি’ শিফ্‌ট ডিউটি থাকলে এটা অবশ্য খুব পরিচিত দৃশ্য। সাইকেলটা ঘুরিয়ে সিটের ওপর চেপে বসল দাদা। বলল, আজকে ট্রেনটা সময়ে ঢুকিয়েছে তো। নিজের ঘড়ি দেখল তমালী। বারোটা পঁচিশ। অল্প হেসে সাইকেলের কেরিয়ারটায় উঠে পড়ে ও।
– এ সপ্তাহটা কি তোর পুরোটাই ‘বি’ শিফ্‌ট? প্যাডেলে জোরে চাপ দিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল দাদা।

প্রশ্নটা কেন হল, তমালী জানে। সামনের সপ্তাহ থেকে দাদার কলেজের ফাইনাল পরীক্ষা শুরু। মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিক দু’টোতেই ছিল ফার্স্ট ডিভিশন। সাফল্যকে ধরে রাখার একটা জেদ আছে ওর মধ্যে। রাত জেগে পড়াশোনা শুরু করেছে। সামনে কলেজের পরীক্ষা। এত রাতে বোনকে আনতে এলে পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটাটা স্বাভাবিক। আশ্বস্ত করল তমালী, বুধবার থেকে ডে শিফ্‌ট শুরু। বস্‌ পারমিশন দিয়ে দিয়েছে। উত্তরটা দাদাকে খুশি করল কি না, বোঝা গেল না। ভাগারের ধারের রাস্তাটা শেষ হওয়ার আগে ব্রেক কষে সাইকেলটা দাঁড় করাল দাদা। রাস্তার মাঝখানে দু’টো ছেলে। কেরিয়ার থেকে নেমে পড়ে তমালী। পোস্টের আলো একটু দূরে। আলো-আঁধারিতেও বোঝা যাচ্ছিল, অল্প-অল্প টলছে ছেলেগুলো। – এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেন! রাস্তা ছাড়ুন, দাদার গলায় বিরক্তি উঠে এসেছে। – না ছাড়লে কী হবে? বুকের ভেতরে বরফের ছ্যাঁকা পাচ্ছে তমালী। খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে এ শহর। অপরাধের কালো ছায়ার কথা এখন শহরটার অলিতে-গলিতে শোনা যায়। ঠান্ডা মাথায় বেরিয়ে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। দাদার মাথা গরম। ওকে বেশি কথা বলতে দিলে হবে না। তমালী নরম হওয়ার চেষ্টা করল, আসলে অন্ধকার তো। ঠিক বুঝতে পারিনি, আপনারা এখানে দাঁড়িয়ে আছেন। ঠিক আছে, আমরা অন্যদিকটা দিয়ে –
– নাও! আরে আমরা তো তোমার জন্যই দাঁড়িয়ে আছি। মদের তীব্র গন্ধ আঘাত করে তমালীকে। একটু শক্ত হয়ে যায়। অন্য ছেলেটা এবার আরেকটু সরে আসে। খোঁচা খোঁচা দাড়িওলা মুখের অবয়বটা

অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। ভিলেন বলতে যা বোঝায়, এ মুখ সে মুখ নয়। অন্ধকারে এতক্ষণ দেখা যায়নি। হাতে একটা বোতল। নিশ্চয়ই মদের। হাত দিয়ে দাদাকে ঈশারা করে পেছন ফেরবার চেষ্টা করতেই তমালীর একটা হাতে টান পড়েছে। এটা অন্য ছেলেটা। সাইকেল থেকে নেমে দাদা ধাক্কা মেরে ছেলেটাকে সরিয়ে দিতেই হিরোগোছের ছেলেটি একলাফে দাদার সামনে, শালা, ঢ্যামনামি হচ্ছে? একা খাবে? ছেলেটার হাতে হঠাৎ করেই চলে এসেছে ছুরি। – এ কী করছেন দাদা! চিৎকার করে ওঠে তমালী, আমি আপনার বোনের মতো। – শালা, বোন মারাচ্ছ! ছুরি হাতে ছেলেটা এবার ক্ষেপে উঠেছে। – আপনি কিন্তু ভুল করছেন, রাগে দাদার গলা কাঁপছে, এ-টা আমার বোন। ফালতু কথা বলবেন না। তমালী আবার দাদার হাতে টান দিল, চলে আয়। – আর বললে কী করবি? ছুরি হাতে ছেলেটা দাদার আরও কাছে এগিয়ে আসে। – গুছিয়ে পেটাব। – আর তোকে কিমা বানাব। ওঁক করে একটা শব্দ। হুমড়ি খেয়ে সাইকেলের ওপর পড়ে গেল দাদা। যা বোঝার বুঝে নিয়েছে তমালী। দাদাকে এরা ছুরি মারল। একটু এগিয়ে একটি পুলিশ চৌকি আছে। পাগলের মতো সেদিকেই দৌড়ল।পুলিশ চৌকিটা আসলে ডিএম বাংলোর লাগোয়া। বাংলোর সিকিউরিটির জন্য। প্রচন্ড জোরে হাঁপাচ্ছিল তমালী। সারা শরীর জুড়ে তাপ, অথচ বুকের ভেতর বরফঠান্ডা হাতুড়ির আঘাত। চারদিক তাকিয়ে কাউকে না দেখতে পেয়ে হতাশা বাড়ছিল। চৌকির দরজা বন্ধ। কয়েক পা এগিয়ে দরজায় হাতের চেটো দিয়ে ধাক্কা মারল। কয়েক সেকেণ্ড অপেক্ষা করার পরও ভেতর থেকে আওয়াজ ভেসে এল না। বুঝতে পারছিল, এখানে অযথা সময় নষ্ট হচ্ছে। যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই ভেতর থেকে বিরক্তির আওয়াজ, কে! – একটু দরজাটা খুলবেন, এক সেকেণ্ড থেমে যোগ করল তমালী, খুব বিপদে পড়েছি। – বিপদ হলে থানায় যান। এখানে কী! – একটু খুলুন না, গলায় বাড়তি বিনয় আনার চেষ্টা করল তমালী, দু’জন ছেলে খুব বিরক্ত করছে। কোনও জবাব ভেসে আসে না। প্রায় মিনিটখানেক পর লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরা একজন লোক দরজা খুলল। প্রায় ধমকের সুরে বলে ওঠে, বললাম তো থানায় যান। – থানা তো এখান থেকে অনেক দূর। দাদাকে হঠাৎ করেই দু’জন ছেলে মারছে–ছুরি দিয়ে। আপনি একটু চলুন না প্লিজ। একটু গুটিয়ে যায় লোকটা, না, না, এ জায়গা ছেড়ে যাওয়ার পারমিশন নেই আমাদের কাছে। চোখে জল আসছিল তমালীর। থরথর করে কাঁপছিল সারা শরীর। ভেঙে পড়া গলায় বলল, একটু চলুন না প্লিজ, নইলে দাদাকে ওরা মেরে ফেলবে। ওর অবস্থা দেখে যেন এবার দয়া হয় লোকটার। প্রশ্ন করে, কোথায় হচ্ছে ঘটনাটা? – এই তো খুব কাছেই, তমালী এগিয়ে এসে হাত জড়ো করে ফ্যালে, আপনি একটু চলুন না।

– দেখুন, আমরা আসলে সিকিউরিটির দায়িত্বে। এটা করা যায় না, এক মুহুর্ত কী ভাবল লোকটা। তারপর বলল, একটু দাঁড়ান। ঘরের ভেতর থেকে হাত একটা কাগজ নিয়ে আবার বেরিয়ে আসে লোকটা। কাগজের টুকরো এগিয়ে ধরে বলে, এতে লোকাল থানার নম্বরটা লিখে দিলাম। আপনি একবার যোগাযোগ করুন। ফোর্স চলে আসবে। লোকটা ঢুকে যায় ঘরের ভেতর আবার। নিশ্চিত হল তমালী, কোনও সাহায্যই এখান থেকে মিলবে না। দাদার কথা মনে পড়তেই আবার উদভ্রান্তের মতো দৌড়তে শুরু করল। মোড়ের মাথায় আসতেই একটা আলো দেখতে পেল। একটু এগোতেই বুঝল একটা অটো। রাস্তার ওপরে দাঁড়িয়ে প্রাণপণে থামানোর চেষ্টা করল অটোটাকে। অটো থামলে ভেতরে ড্রাইভার ছাড়া আরও দু’জনকে চোখে পড়ল। একটু বয়স্ক লোকগুলোকে খুব একটা খারাপ মনে হল না। বেশ অবাক গলায় অটোর চালক জিজ্ঞাসা করল, কোথায় যাবেন? – দেখুন আ….মি ভীষণ বিপদে পড়েছি, রীতিমতো হাঁপাচ্ছিল তমালী, আপনারা দয়া করে এগিয়ে আসুন। না হলে, আমার দাদাকে ওরা মেরেই ফেলবে।
পেছনে বসা দুই যাত্রী নিজেদের মুখ চাওয়াচায়ি করছিলেন। অটোর চালককে দেখে তমালীর মনে হল, হঠাৎ করে এভাবে দাঁড় করানোয় খুব বিপদে পড়ে গেছে। এখানেও সময় নষ্ট হচ্ছে কি না, বুঝতে পারছিল না। – ঠিক আছে, আপনি আগে চলুন। আমরা দেখছি, বেশ গম্ভীর গলায় বললেন দু’জন ভদ্রলোকের একজন।
কৃতজ্ঞতার একটা দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়েই প্রায় দৌড়তে শুরু করল ও।
দূর থেকেই দেখতে পাচ্ছিল, অন্ধকার রাস্তার একদম মাঝাখানে পড়ে আছে দাদা। আশেপাশে কেউ নেই। অটোর আলোতে রাস্তার ওপরে পড়ে থাকা চ্যাটচ্যাটে পদার্থটা আসলে রক্ত, এক ঝলক তাকাতেই বোঝা যাচ্ছিল। লাল হয়ে ভিজে যাওয়া গেঞ্জিটার আসল রঙটা কী ছিল এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। অটো থেকে দু’জন ভদ্রলোকই নেমে পড়েছে। পেছন থেকে অটো চালক বলে উঠল, আমার টাকাটা দিয়ে দিন, আমি চলে যাব। – চুপ করে দাঁড়াও, ধমকে উঠেছেন একজন ভদ্রলোক, একে এক্ষুণি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। তারপর অপর ভদ্রলোককে উদ্দেশ্য করে বললেন, ওর মাথায় দিকটা ধরুন তো। অটোর পেছনের সিটে সংজ্ঞাহীন দেহটা নিয়ে উঠে পড়ে তমালী। শরীরটা থেকে আরও রক্ত নেমে আসছিল। মা আর বোনের কথা মনে পড়ছে। এর আগে কখনও নিজেকে এত অসহায় লাগেনি। বাবা মারা যাওয়ার সময়েও নয়। চোখে জল এসে যায় হঠাৎ।

ফাঁকা রাস্তা পেতেই নিজের অটোর গতি বাড়িয়ে দিল সমীর। ফাঁকা রাস্তায় অটোর গর্জন শুনতে ও অভ্যস্ত। হসপিটাল মোড় থেকে ভদ্রেশ্বর স্টেশন-অন্ততপক্ষে রোজ তিরিশ বার তো যাতায়াত করেই। অটোস্ট্যান্ড থেকে সব শেষে বেরোয়। ফাঁকা রাস্তায় শিশুতি রাতের চন্দননগরকে প্রত্যেকবার যেন নতুন করে আবিষ্কার করে। প্রায় প্রত্যেক রাতেই এক নতুন উত্তেজনা নিয়ে ঘরে ফেরা। দরজা খুলে দিয়েই মা আবার বিছানায় চলে যায়। নিজের ছোট্ট ঘরটায় টেবিলের ওপর ঢাকা দিয়ে রাখা রাতের খাবারটা নিজের সঙ্গে কথা বলতে বলতে শেষ করে। আর
তারপরেই গভীর ঘুমে তলিয়ে যাওয়া। কোনও কোনওদিন স্বপ্ন দ্যাখে, দু-দু’টো গাড়ি কিনেছে। গাড়ির ব্যবসায় পয়সার মুখ দেখছে। সকালবেলায় ঘুম আর স্বপ্নের রেশ কাটতে না কাটতেই আবার পৌঁছে যেতে হয় অটোস্ট্যান্ডে। বৈচিত্রহীন জীবনে একঘেয়েমির গন্ধে চারপাশের পরিবেশ যেন দমবন্ধকর হয়ে উঠছে। পেছনের সিটটা একবার আড়চোখে দেখে নিল। প্রচুর রক্ত লেগেছে। এখনই বাড়িতে গিয়ে ধোয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। দাগটা বসে গেলে মুশকিল। প্যাসেঞ্জার হয়তো উঠতেই চাইবে না। ভাড়ার টাকাটা তো পেলই না, পুলিশের প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে কি না কে জানে। দু’জন ভদ্রলোক বা মেয়েটার মধ্যে যে-কোনও কাউকে বললেই হয়তো টাকাটা পেয়ে যেতে পারত। কিন্তু সাতাশটা বছর জীবনে কাটানোর পরও এই পৃথিবীর সঙ্গে মানিয়ে চলার উপযুক্ত মানসিকতা এখনও তৈরি হল না। মিনিট পনেরো অপেক্ষা করার পরও যখন ভাড়ার টাকাটা দিতে কেউ এগিয়ে এল না, কাউকে কিছু না বলে নিজেই চলে এল বাড়ির পথে। নেতিয়ে পড়েছিল ছেলেটা। এত রক্ত অনেকদিন পর দেখল সমীর। বছর দু’য়েক আগে বাজারের সামনে বাইক অ্যাক্সিডেন্টেও এত রক্ত দ্যাখেনি। একমনে কেঁদে যাচ্ছিল মেয়েটা। ছেলেটার বোন। খুব দেরি করে চাকরি থেকে ফিরত। ঠিক কী করতে চেয়েছিল খুনি ছেলে দু’টো। আগে থেকেই কি মেয়েটাকে চিনত। খবরের কাগজ খুললেই তো আজকাল এইসব খবর। এত রাত করেই বা মেয়েটা ফিরত কেন! নিজেকে ধমকাল। রাত করে তো ও নিজেই ফিরে। শুধুমাত্র একটা মেয়ে বলেই কি বাড়তি সন্দেহ আসছে! এই মুহূর্তে মেয়েটা কী করছে! ভদ্রলোক দু’জনও এতক্ষণ নিশ্চয়ই মানে মানে সরে পড়েছে। ঝামেলায় আজকাল কেউই জড়াতে চায় না। তার ওপর উপকার করে ঝামেলায় জড়ানো–কল্পনারও বাইরে। নিজেও কি এই জন্যই চুপিচুপি পালিয়ে এল! তার মানে ও-ও সবার মতোই হয়ে গেল। তবে যে ইউনিয়নের প্রদীপদা বলে, সমীর নাকি সবার থেকে আলাদা। মেয়েটাকে দেখে অবশ্য একটু আলাদা মনে হচ্ছিল। কাঁদলেও মেয়েটার নাছোড়বান্দা মনোভাব বেশ চোখে পড়ছিল। বাড়ি বা পাড়া থেকে কেউ কেউ মেয়েটার কাছে পৌঁছে হয়তো দৌড়োদৌড়িও শুরু করে দিয়েছে। আবার এমনও

হতে পারে, মেয়েটা পাগলের মতো একাই ছোটাছুটি করছে। এসব ক্ষেত্রে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে কিছু করার খুব ইচ্ছে করে। ঝামেলার ভয়েই পিছিয়ে আসতে হয়। বাবার কথা মনে পড়ছে। বেঁচে থাকলে, এরকম অবস্থায় ঠিক কী করত। বাড়ি ফিরে কিছু খেয়ে বিছানায় ঘুমে এলিয়ে পড়ত! মা বা শঙ্কর কাকারা বাবার সম্পর্কে সে রকম কিছু বলে না। মানুষের উপকার করতে বার বার ছুটে যেত।
বাড়ি ঢোকার রাস্তাটা এসে গেছে। ব্রেকে পা দেয় সমীর। তলায় ঠোঁটটা একবার কামড়ে ধরে। অটো ঘুরিয়ে আবার হসপিটালের দিকে রওনা দেয়।

——-(ক্রমশ)