১২৬৫-৬৬ বঙ্গাব্দ। কলকাতার সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়নরত তখন যুবক বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজী। কলেজের সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত ছিল শ্রীশঙ্করাচার্যের ভাষ্যসহ বেদান্তদর্শন। অদ্বৈতবাদে তো ভগবানের সদচিদানন্দময় স্বরূপটিকে স্বীকার করা হয় না । সদচিদানন্দ বিগ্রহের অস্তিত্বের কোন মূল্য নেই তাই। সেখানে ব্রহ্ম ভিন্ন আর দ্বিতীয় কিছু নেই। যে জগৎ প্রত্যক্ষ হয় তা সব মায়া তাঁদের কাছে । তাঁরা বলেন জীব ও ব্রহ্ম—একই । কেবল অবিদ্যা বা মায়ার কবলিত হয়ে জীব নিজের স্বরূপ অনুধাবন করতে পারে না। যখন অবিদ্যার বন্ধন ছিন্ন হয় অর্থাৎ মায়া দূরীভূত হয় তখনই মানব নিজের ব্রহ্মত্বকে অনুভব করতে সক্ষম হয় , ব্রহ্মের সঙ্গে নিজের অভেদত্বকে অনুধাবন করে। এ কারণেই অদ্বৈতবাদী বা মায়াবাদীরা ‘অহং ব্রহ্ম’ ভাব নিয়ে ভগবানের বিগ্রহ পূজা বন্ধ করে দেন। কারণ , তখন তাঁদের মত বলে, উপাসনাটা করবো কাকে! আমিই তো সেই—অহং ব্রহ্মাস্মি, তুমিই তো সেই—তত্ত্বমসি। আমি,তুমি ,ব্রহ্ম তো সেই একই, অভেদ ,অদ্বিতীয়, অদ্বৈত! অতএব , পূজার্চনা নিষ্প্রয়োজন ।
শঙ্করাচার্যের বেদান্তভাষ্য অধ্যয়ন করতে করতে ঘোর বৈদান্তিক হয়ে উঠলেন বিজয়কৃষ্ণ । এতদিন ধরে তাঁর মনে হিন্দুধর্মের ভক্তিযোগের যে সংস্কার সঞ্চিত ছিল তা সমূলে উৎপাটিত হল । তিনি একে একে পূজা-অর্চনা সব বন্ধ করতে থাকলেন। গোস্বামীধারায় পৈতৃক ধর্মে তাঁর যে শ্রদ্ধা-ভক্তি-বিশ্বাস-নিষ্ঠা ছিল তা সবই হারিয়ে ফেললেন । ‘অহং ব্রহ্ম’ ভাব নিয়ে তিনি বিচরণ করতে থাকলেন। কিন্তু, এর ফলস্বরূপ হল কি, তাঁর মনে এত দিনের যে একটা বংশসূত্রে পাওয়া আধ্যাত্মিক শান্তি সর্বদা বিরাজ করত তা প্রায় লুপ্ত হয়ে গেল। ভিতরে-ভিতরে, অন্তরে-অন্তরে যত দিন যেতে থাকলো তত যেন তিনি নীরস, নিরানন্দ ,শুষ্ক আর রুক্ষ হতে থাকলেন । ব্রহ্মানন্দ যাকে বলা হয় তেমন কোন আনন্দের অনুভব তিনি কই আদৌ তো পাচ্ছেন না!
বাংলাদেশের রংপুর গ্রামের আমলাগাছি গ্রামে এসেছেন বিজয়কৃষ্ণ। রংপুরে একদিন প্রভুপাদ দৈববাণী শুনতে পেলেন । তাঁকে জলদগম্ভীর স্বরে কেউ বলছেন, “পরলোক চিন্তা করো।” বক্তাকে কোথাও খুঁজে না পাওয়ায় ভয় পেয়ে গেলেন বিজয়কৃষ্ণ। মনের মধ্যে দৃঢ়ভাবে স্থাপন করতে চাইছিলেন যে অদ্বৈতবাদকে এতদিন ধরে, এ ঘটনায় সে বৈদান্তিক মতের ভিত টলমল করে উঠলো। বুঝতে পারলেন যে অদ্বৈতবাদে বিশ্বাসী হওয়াটা হয়তো বা ঠিক হচ্ছে না।
রংপুরে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীপ্রভুদের বেশ কতগুলো শিষ্যঘর ছিল । একদিন গোবিন্দদাসী নামে এক শিষ্যা তাঁকে প্রণাম নিবেদন করে চরণে পড়ে বললেন , “প্রভু, ত্রিতাপ জ্বালায় দগ্ধ হয়ে মরছি। কৃপা করে উদ্ধার করুন আমায়।” তাঁর কাতরকন্ঠ যেন বিজয়কৃষ্ণের বুকে শেঁল হয়ে বিঁধলো। তিনি মনে মনে ভাবতে থাকলেন, “কাকে উদ্ধার করব আমি ! আমি নিজেই তো মায়াবদ্ধ জীব হয়ে পড়ে আছি। আমাকে কে উদ্ধার করে তার ঠিক নেই। হায়, হায় ! আর , এরা কি না আমি উদ্ধার করব সে আশায় বসে! না ,না, আমি গুরুগিরি করবো না ।”
এর কিছুদিন পর বগুড়াতে আসেন প্রভুপাদ । সেখানে শিববাটিতে বাসকারী তিনজন ব্রাহ্মভক্তের সঙ্গে আলাপ হলো—-হারাধন বর্মন, কিশোরীলাল রায় ও গোবিন্দচন্দ্র পাঁড়ে । গোস্বামিজীর বড় ভাল লাগল তাঁদের সঙ্গে কথা বলে । কারণ তাঁরা অত্যন্ত ভদ্র, মার্জিত, সাধু স্বভাবের ও ধর্মপ্রাণ ছিলেন । অদ্বৈতবাদকে অঙ্গীকার করার পর থেকে প্রভুপাদের মনে একটা অস্থিরভাব, শূন্যবোধ কাজ করছিল এতদিন। আজ তাতে যেন শান্তিবারি পড়লো। ধর্ম সম্বন্ধে আলোচনা হল তাঁদের সঙ্গে। কথাপ্রসঙ্গে ব্রাহ্মভক্তরা যখন জানতে পারলেন যে গোস্বামিজী পূজা-অর্চনা সব বন্ধ করে দিয়েছেন অদ্বৈতবাদী হয়ে তখন তাঁরা বিষন্ন হলেন ভীষণ এবং নানান ভাবে বোঝাতে থাকলেন যে—-এমনটা করা ঠিক নয়। পরমপুরুষ একজন কিন্তু প্রকৃতই আছেন যাঁকে উপাসনা করলে তাঁর উপস্থিতি অনুভূত হয়, শান্তি মেলে জীবনে। আমাদের উচিত সেই পরমপিতার শরণাগত হওয়া । উপাসনাহীন, আরাধনাহীন জীবন মূল্যহীন মরুভূমির মতো। এগুলোই একমাত্র পারে ত্রিতাপদগ্ধ জীবনকে শান্তি দিতে । ভক্তিহীন জীবন তো ভৎর্সনার যোগ্য!
এঁনাদেরর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা কথাবার্তার মধ্য দিয়ে বিজয়কৃষ্ণের মায়াবাদী মনের মোড় অন্যদিকে ঘুরতে থাকলো। তাঁর অদ্বৈতবাদ বিশ্বাসে ফাটল ধরলো। কিশোরীলাল হারাধন ও গোবিন্দচন্দ্র পরামর্শ দিলেন গোস্বামীজীকে , “মহাশয়, আপনি বরং ব্রাহ্মধর্মকে আশ্রয় করুন । কলকাতায় গিয়ে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সভায় যোগ দিন । সেখানে তাঁর ভাষণ শ্রবণ করুন। তাহলে বুঝবেন জীবনে আধ্যাত্মবাদের উদ্দেশ্য কী । উপাসনা, আরাধনা, প্রার্থনার শক্তি কেমন তা অনুভব করতে পারবেন হৃদয়ে । দেখবেন জীবনদর্শন পাল্টে গেছে আপনার।”
প্রভুপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামিজীর এতদিনের একটা ধারণা ছিল যে কলকাতায় ব্রাহ্মসমাজের সদস্যরা সব একপ্রকার জাতিনাশা মানুষ । এরা নিজেরা একত্র হয়ে বসে মদ-মাংস খেয়ে যথেচ্ছাচার করে আর ধর্মের নামে আধুনিকতা প্রমাণ করার চেষ্টা করে । ব্রাহ্মসমাজের কথা শুনলেই তাই তাঁর মনে কেমন একটা ঘৃণার উদ্রেক হত। কিন্তু, এই তিন ব্রাহ্মভক্তের সঙ্গে কথাবার্তা বলে তাঁদের ভাব বুঝে ,জীবনবোধ জেনে সে ধারণার অনেকটাই পরিবর্তন ঘটল। বরং ব্রাহ্মসমাজ সম্পর্কে জানতে আগ্রহ জন্ম নিল মনে। স্থির করলেন যে কলকাতায় গিয়ে না হয় মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষণ একবার শুনবেনই! কি এমন তিনি বলেন জানতে ইচ্ছা করলো । ব্রাহ্মধর্ম তাহলে কী !
——–ক্রমশঃ
ভক্তকৃপাপ্রার্থিনী
রাধাবিনোদিনী দাসী