অনুভূতিদেশে চাঁদের জোৎস্নায় স্নান সারেন যিনি : শুভঙ্কর দাস।

0
510

প্রস্তাবে কোনো ফুল নয়,পাখি নয়
শ্বাসটুকু রেখে গেলাম,বাতাসে
অভিমানে কেউ কি থাকে পাশে!
ভালোবেসে শস্য করেছি ক্ষত ও ক্ষয়।

শেষ পর্যন্ত মানুষকে যে ভূমি স্পর্শ করে জগৎ নতুন করে সৃষ্টি করতে হবে,তা ভালোবাসা।তাই ভালোবাসার কবিতাই মানুষের কবিত্বজন্মের সার্থকতম রূপটি প্রকাশ করতে পারে।তেমনই একজন সংসার হয়ে উঠুক বা সন্ন্যাস, গুহা হোক বা গৃহ, লালন হোক বা ফকির, সকলের জন্য সেই ভালোবাসাই সুধা হয়ে ওঠে,আশ্রয় হয়ে ওঠে এবং আশ্চর্য পারাপারও..
তারপর যে মানুষের অন্তরঙ্গ আলোর কোনো পারাপার নেই, সেই মানুষ মৃত।ব্যাকরণের পৃষ্ঠায় যতগুলি সর্বনাম কাছে, তার মধ্যে ‘তুমি’ এর মতো নরম,গভীর এবং সুশীতল সরোবর সর্বনাম আর নেই। তা ভালোবাসা থেকে নির্মিত হয়।
সকলের সেই ‘তুমি’ সরোবর থাকে না,অথবা থাকলেও তার ব্যবহার ইট-পাথরের মতো হয়ে গেছে, আবার হয়তো কোনোদিন ভেবে দেখেনি,’তুমি’ এর মতো অপূর্ব মধুময় সত্যিকারের জীবনীশক্তি!
সেই ‘তুমি’ শব্দের আমাদের কাছে ‘যা আছে, যা নেই’, তাই নিয়ে একটি আস্ত কাব্য রচনা করেছেন এই সময়কালের হৃদয়বান্ধব কবি রফিক-উল-ইসলাম।বইটির নাম ‘ অঘোরে ঘুমিয়ে চন্দ্রকণা’

চন্দ্রকণা অর্থাৎ অনুভূতিকণা।একটি নীলরঙের আকাশে মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি ও সাহস বেদানাতুর নারীর রূপে শুয়ে আছে।কে সে? চিত্রকবি দেবাশিস সাহা নিজের বুকের রঙে যাকে রাঙিয়ে দিয়েছে,সেই নারীরটির মুখ চেয়ে শুরু মানবসভ্যতা।কিন্তু তার এতো বেদনা কেন? কেন তার ঠোঁট ক্ষতবিক্ষত রক্তিম? কেন সে রক্তশূণ্য শরীরে শুয়ে আছে মাথার ওপর,তার উত্তর সন্ধান করেছেন বাউল কবি রফিক-উল-ইসলাম। বেদনাবিবেক কবি জীবনানন্দ একেই বুঝি বলেছিলেন—

“পর্দায়, গালিচায় রক্তাক্ত রৌদ্রের বিচ্ছুরিত স্বেদ
রক্তিম গেলাসে তরমুজ মদ
তোমার নগ্ন নির্জন হাত,

তোমার নগ্ন নির্জন হাত।”

সত্যি এই দ্বন্দ্বমুখর যান্ত্রিকতাবাদে কখন যে খোলা আকাশি ছাদের অনুভূতিগুলো অবহেলায় ও অব্যহারে ঘুমিয়ে পড়েছে,তা আমরা নিজেরাই জানি না।জীবনের যে গতিসূচক অনুভবকে বরণ করে,তাকে সজীব ও প্রাণবন্ত করে চমৎকার চাকা ঘুরছিল,তাই কখন গতানুগতিক অভ্যাস-অন্ধকার হয়ে উঠেছে, কেউ খোঁজ রাখে না! একে-অপরকে মুখ দেখে না,মুখোশ দেখে দেখে রান্নাবান্না করে,খায়,ঘুমায় এবং শ্মশানের হাওয়ার গতিবেগ মাপতে থাকে।সেই সময় একজন হৃদয় থেকে উঠে এসে লালনস্বরে বলে ওঠে—

“তোমার বুকের ওপর ঘুমিয়ে পড়ে যে আলো,
সে আজ চুপিচুপি এসে আমার ঘুম ভাঙাল।”

এই আমি হল কবি অর্থাৎ অনুভূতিদেশ।এবারের নান্দীপাঠ সেখান থেকে উৎসারিত।
মানুষ গুহা থেকে বেরিয়ে এসে প্রথমে মনে করল ক্ষুধার মুখে লাগাম পরাতে হবে।তারপর ভাবল,ক্ষুধাকে লাগাম পরালে হবে না,তাকেই জীবনীশক্তি করতে হবে।সেইভাবে সমাজ এলো,সভ্যতা এলো,বিনিময় এলো।দিনের শেষে বহু পরিশ্রমের ক্ষুধা নিবারণকারী সামগ্রীর সামনে বসে মানুষ কেঁদে ফেলল,দিনের পর দিন নিজেকে কেমন জন্তুর মতো মনে হতে লাগল।মনে হল পেটের জন্য জন্ম ও মৃত্যু। তাতে তার সুখ তো হলই না,বরং বাঁচার ক্লান্তি ও অসুখ বৃদ্ধি পেল।তখন সহসা যে ঝর্ণার জলে তৃষ্ণা মেটাতো,সেই ঝর্ণার জলে নিজের রূপ দেখতে পেল,সঙ্গে সঙ্গে তার চোখে উন্মোচিত হল প্রকৃতির রূপ।সে বুঝতে পারল,যে গাছের ফল সে ছিঁড়ে খেত বা যে হরিণের মাংস সে পুড়িয়ে খেত, আসলে তাই সৌন্দর্যের জগৎ তৈরি করে।অর্থাৎ ক্ষুধাই তাকে সুধার কাছে নিয়ে গেল।এতো অধিকৃত-নারীকে মানুষ জবরদস্তি করে বংশবিস্তারে এগিয়ে ছিল,কিন্তু যখন সে সেই নারীর কানে দুল হিসেবে ফুল এবং বসন হিসেবে হরিণের জিন উপহার দিল,তখন থেকে তার বাঁচার জগত বদলে গেল।মানুষ জানতে পারল,এতদিন সে যে জগতে বাস করত,তা আসলে তৃণের চেয়ে, ইন্দুর বিবরের চেয়ে, এমনি তার নিজের পায়ের ছাপে আঁকা জমির চেয়ে ছোট জগত।সে পাড়ি দিল এক সুবৃহৎ ও সুগভীর জগতে,তখন সে মনে মনে গুহার দেওয়ালে আঁকা ছবির পাশে উচ্চারণ করল—

“কে কার কাছে পৃথিবী হয়ে ওঠে,
কে যে কার অনন্তের ফুল-পাখি!
কার বুক থেকে কবিতা খুঁটে খুঁটে
আমি ভাঙা দেওয়ালে লিখে রাখি!”

এই যে নিজের বুক বা অপরের বুক থেকে কবিতার আলো ও অপেক্ষা যেদিন থেকে মানুষ পেল,সেদিন তার প্রাপ্তি হল ‘পরম আলাদিন’।সে চেঁচিয়ে বলতে লাগল,’ চাঁদে ঠোঁট লেগে খুল্ যা সিম্ সিম্…’
যা এতদিন মানুষ রূপকথার কাহিনিতে শুনে এসেছিল,সেই পোড়া অনুভূতির দরজা-জানালা খুঁজে পেয়ে মাটির মানুষ রূপকথার কলেমা করে তুলেছিল।
কাব্যের আত্মার সন্ধানে বেরিয়ে ভারতীয় আলংকারিকরা নানারকমের সংজ্ঞায় উপনিত হয়েছিলেন।শেষ পর্যন্ত প্রায় সকলেই এই সূত্র মেনে নিয়েছেন,’কাব্যের আত্মা ধ্বনি’।অভিনব গুপ্ত এর তিনটি রূপ দেখেছেন, বস্তুধ্বনি,অলংকারধ্বনি,রসধ্বনি।
হৃদয়বাদী কবি রফিক-বাউল সেই সুপ্রাচীন ধারা জাগিয়ে রেখেছেন,
বস্তুধ্বনি—

“আস্ত একটি নদীকে যদি তোমার আঁচলে বেঁধে দিই
তুমি কি পুরোপুরি নদীরই হয়ে যাবে?”
অর্থাৎ শব্দের বাজিকর খেলা।
আবার অলংকারধ্বনি—

“শেষ অবধি
তোমার পায়ের পাতায় চুম্বন দিয়েই দেখব
কোনও স্মরণীয় ঘুঙুর বেজে উঠছে কিনা!”

স্মরণীয় ঘুঙুর এই অলংকারই তো প্রেমের প্রাচীনত্বকে প্রতীকী করে তোলে সহজ সুরে।

রসধ্বনি প্রয়োগে দেখি—

“দিনের স্বপ্নেই যে দেখে ফেলেছি তোমাকে
দু-চোখ জানে শুধু সে-দেখার মানে!

কোন গান বাজে কোনখানে?”

এই গানই আমাদের প্রেমের পৃথিবীর কাছে পৌঁছে দেয়,যেমন মীরাকে বা লায়লাকে পৌঁছে দিয়েছিল নিজের হৃদয়পুরে।কিন্তু রফিক বাউল এই হৃদয়পথের যাত্রায় আরও একটি কথা পাতায় পাতায় প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন,তা হল,কাব্যের আত্মা হল অনুভূতি।
আলংকারিক লোচন বলেন,” ঘন্টানুরণনরূপত্বং তাবৎ অস্তি” অর্থাৎ উচ্চারিত শব্দ ও তার অর্থ-ই শেষ কথা নয়, তার রেশ হয়ে ওঠে যথার্থ কাব্যের আত্মা।আসলে সেই আশ্চর্য আবেদনের মতো,যে গান কানে যায় না শোনা/ সে গান যেথায় নিত্য বাজে”

তা সম্ভব হয়েছে অনুভূতির জন্য, সেই অনুভবের মাটি ও মেঘ নিয়ে রফিক বাউল নতুন লালন সংগীত রচনা করেছেন।এখানে হিন্দু বা মুসলিম, প্রার্থনা বা নামাজ, শয়তান বা ইবলিশ নয়, শুধু অনুভূতি, অনুভূতি এবং অনুভূতি।
তার কয়েকটি হৃদয়সংগীত শুনে নিন—

এক।
“ক্ষমতা তো আমি দিয়েছি ঈশ্বরের হাতে
আমাকে এইভাবে অসীম কষ্ট দেওয়ার ”

দুই

“তুমিই আমার
আবে-জমজম? বুক ভরা থাকা তসবিদানা?
শান্ত আতরদানি?”

তিন

“তোমার সব কথা, আর সব গান,
আমার ভাঙা ঘরে ভোরের আজান! ”

চার

“পাখিরা লিখবে কথা আকাশের গায়…/ তোমাকেই খুঁজে নেব ঠিক,ইশারায়… ”

পাঁচ

“হেরা গুহা থেকে নেমে,জানি ধমক দেবেন তিনি—
কীভাবে এমন ধনী হয়ে থাকো,বিনা পুঁজিতেই!”

এইভাবে রফিক বাউল একতারার সুরের মতো একটি হৃদয়সুর, ভালোবাসা, সন্ধান করেছেন সুবর্ণ জন্মের ঋণপরিশোধে।একটি শব্দ ‘প্রেম’, একেই চণ্ডীদাসের জগৎ মনে করে আলো,আকাশ,সময়, কবিতা,শরীর — এইসব নতুন করে সৃষ্টি করেছেন রফিক বাউল।হৃদয়বাদী কবির মনে হয়েছে সবকিছু সভ্যতায় আছে,আরও আরও নতুন কিছু এই সভ্যতাকে ঝা-চকচকে করে তুলবে,কিন্তু ঐ একটি শব্দ ছাড়া এই সভ্যতা শ্মশান, কবর বা কফিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।সেই সীমারেখা রফিক বাউল আত্মমগ্ন সিদ্ধিতে ভাঙতে চেয়েছেন কোনোকিছু না ভেঙেই!
তাই তো প্রেমের কাঙাল কবি বিনয় মজুমদার যেমন সকাতর ভাবেন—

“আমি মুগ্ধ, উড়ে গেছো,ফিরে এসো,ফিরে এসো, চাকা
রথ হয়ে,জয় হয়ে,চিরন্তন কাব্য হয়ে এসো।
আমরা বিশুদ্ধ দেশে গান হবো,প্রেম হবো,অবয়বহীন
সুর হয়ে লিপ্ত হবো পৃথিবীর সকল আকাশে”

আহ্! কী অনবদ্য কবির আকুতি।’ অবয়বহীন সুর’ সেই একই মধুর মাঙ্গলিক ইচ্ছে রফিক বাউলের—

“” তুমি বুকে এলে, একটি যুবক নদী
পথ ভুলে উঠে আসে হারানো খাতায়—
তোমার সৌরভ মাখে ঢেউ ভেঙে ভেঙে,
মহাকাব্য লিখে ফেলে দুটি নীলিমায়…”

এই সমচেতনা কোনো অনুসরণ নয়, এ হলো অনুভূতির এক তন্ময়তার পথরেখা।এই সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি শ্যামলকান্তি দাশ একটি অভিনব কাব্য -কৌশল প্রয়োগ করেন,তিনি রাক্ষসবাদী কবি।আমরা প্রায় সকলেই আমাদের সুখ-দুঃখের দিনগুলো ও আনন্দ-বেদনার রাতগুলো হয় রাজকুমার বা রাজকুমারীর মধ্য দিয়ে প্রকাশ করার চেষ্টা করি।যদি রাজপুরুষ চরিত্র না হলেও কোনো- না- কোনো নায়কোচিত চরিত্রেই সকল কথা ব্যক্ত করি।কিন্তু কবি শ্যামলকান্তি দাশ এখানেই অন্যের থেকে আলাদা,তিনি তাঁর সকল অনুভব রাক্ষসের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করেছেন,যা আমাদের কাছে অপাংক্তেয় অন্ধকার হয়ে থাকে সর্বদা।যেমন একটি কবিতায় শ্যামলকান্তি তো বলেই দিয়েছেন —
“কী সব রাক্ষস তুমি পুষেছ ঘরের মধ্যে
বরবাদ হয়ে গেল কবির জীবন”

সেই একই বেদনার চালচিত্র দেখি রফিক বাউলের একতারায় —

“আমাদের তো এই রাক্ষসজন্ম
এভাবেই বেঁচে থাকা,
আমার শুধুই চন্দ্রের বুকে প্রাণটি লুকিয়ে রাখা”

এই যে বেদনা সারিতে একই শরবিদ্ধ আত্মা,এখানেই ব্যক্তিগত নয়, সময়গত একটা ধারণা গড়ে ওঠে।তা এই আমাদের একটা আশ্রয় চাই,সত্যিকারের কৈফিয়তহীন,কন্টকশূন্য,ক্রুশকলোবরমুক্ত আশ্রয় চাই।
আর তা হল অনুভূতি। অনুভূতিদেশ।
আবার সেখানে পৌঁছাতে হলে একটাই পথ, ভালোবাসা। না,আর অন্য কোনো উপায়,কৌশল এবং কারুকার্য নেই।
রফিক বাউলের পুরো নাম রফিক-উল-ইসলাম,না,তা নয়,তাঁর পুরো নাম,রফিক-লালন-একতারা। তিনি অক্ষরের একতারা তুলে মানুষকে শোনাচ্ছেন সেই ভালোবাসা কবিতা। যে কবিতা আমাদের বাঁচতে সাহায্য করবে,পথ চলতে মন্ত্র যোগাবে,আহত মনের মাটি হবে এবং শেষ পর্যন্ত যাতে ফিরে এসে মুখ নিচু করে আত্মগোপন বা আত্মহত্যাকারী হতে না হয়,সেই বেসস্তে নিয়ে যেতে পারবে।কিন্তু বাউল কবি রফিক এও জানেন এই পথ বা মত অতি সহজ ও সরল নয়।কারণ বাঁচার আনাচে-কানাচে হিংস্র হায়নার মতো ওত পেতে বসে আছে সন্দেহ, ঈর্ষা এবং কলুষিত করার কায়দা-কানুন।তাহলে উপায়?
অন্নদাশঙ্কর অসাধারণ একটি কথা বলেন,” নিজেকে কারো কাছে আমরা যখন দিতে পারি,সেই দেওয়া ও পাওয়ার আনন্দ এবং উপলক্ষই আর্ট।জীবন একটা আর্ট।হাঁটা-চলা,কথা-বলা,বাঁচা মরা সবকিছুর মধ্যে আর্ট লুকিয়ে আছে।কিন্তু তার লক্ষ্য শুধু একটাই,নিজেকে দান করা”
নিজেকে সৌন্দর্যের সুবাসে বা আনন্দের নির্যাসে দান করা সবচেয়ে কঠিন কাজ।তার জন্য অপরিসীম আত্মনিবেদন ও অবিরাম হৃদয়চর্চা প্রয়োজন।তা ক’জন আর করতে পারে? সেই কথাই রফিক বাউল অনবদ্য ভঙ্গিতে বলতে পেরেছেন, যা পাঠ করার পর আর কিছুই বলার অপেক্ষা থাকে না—

“অনেক জন্ম গেল মানুষ হয়ে উঠতে,
ভালোবাসতে শেখার জন্য
একটু সময় দাও”

অঘোরে ঘুমিয়ে চন্দ্রকণা।
কবি রফিক উল ইসলাম
প্রচ্ছদ। দেবাশিস সাহা।
প্রকাশক।আবিষ্কার, কলকাতা -৯
মূল্য। দুইশত টাকা