“একটা জীবন জুড়ে কতখানি সুতো ছাড়া বা গুটিয়ে ফেলা যায়”
জীবনবোধের জন্মদিন আলোকিত ও আন্দোলিত করতে মানুষের অন্তরের যে উপহারটি সবিশেষ প্রয়োজন,তা কবিতা।বাংলা কবিতার চর্যাপদের “কাআ তরুবর পঞ্চবি ডাল “থেকে শুরু নিধুবাবুর টপ্পাতে নয়নের দোষ কেন/মনেরে বুঝায়ে বল নয়নের দোষ কেন/আঁখি কি মজাতে পারে না হলে মনমিলন”, আবার ঈশ্বর গুপ্তের “মিছা মণিমুক্তা হেম স্বদেশের প্রিয় প্রেম/তার চেয়ে রত্ন নাই আর” থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ” বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুলাম রেখে বরুণা বলেছিল/যেদিন আমায় সত্যিকারের ভালোবাসবে/সেদিন আমার বুকেও এরকম আতরের গন্ধ হবে”
এর ঠিক মাঝখানে একটা রাস্তার দরকার ছিল,দরকার ছিল একটা নদীর,একটা এমন পারাপারের, যা দিয়ে শুধু বৈতরণী পার হওয়া নয়,আবার যেন প্রত্যাবর্তনও করা যায়।এই মাঝখানের রাস্তাটা যাঁরা নির্মাণ করেছিলেন সযত্নে, সগৌরবে অথচ সবিনয়ে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন স্বরিত কবি সৌমিত বসু।যার কবিতাচেতনার মধ্যে গুহা ও গৃহস্থের আত্মিক বেদন ও ব্যাকুলতা স্পর্শপাতার মতো স্পষ্ট। তিনি সেইসব স্পর্শপাতা তুলেছেন,যা গাছের তলায় পড়েছিল বা যা ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করে পতনোন্মুখ ছিল,তিনি সেইসব পাতাগুলো কুড়িয়ে কুড়িয়ে নির্মাণ করেছে বাংলা কবিতার আশ্চর্য সজীব বৃক্ষ।যা প্রথমাবস্থায় মনে হয়েছিল, এতো শব্দের দেওয়াল,এতো জলশূন্য ঢেউয়ের বিম্ব,এতো নক্ষত্রহীন আকাশের মৃত আলো! প্রতিটি জন্মর যেনন দীক্ষা থাকে,নাড়ির মধ্যে থাকে অলৌকিক জন্মজয়ের মন্ত্র, তেমনি সৌমিত বসুর মতো কবির কবিতা যে নতুন বাঁকের সৃজন করেছে,তার পাঠের এক দীক্ষিত পথ আছে,তা নিমগন নৌকা হয়ে পার হলেই দেখা যায়,যা মনে হয়েছিল দেওয়াল,তা আসলে ফিরে আসার গৃহ,যা মনে হয়েছিল জলশূন্য, তা আসলে পিপসারা শান্তশীতল সরোবর,যা মনে হয়েছিল নক্ষত্রহীন আকাশ,তা আসলে নিজস্ব আয়নার অনুভব।এইভাবে সৌমিত বসু পূর্ব ও পরবর্তী পথের মাঝখানে নিজেই পথ হয়ে উঠছেন,তাই তিনি বলতে পারেন—
“আলোগুলো দেখো,কেমন অন্ধকারের গায়ে গা ঘষে চলেছে”
এতদিন আলো-অন্ধকারের যে সহজ ও সাবলীল বিন্যাস পাঠক দেখে আসতে অভ্যস্ত,সৌমিত বসু সেখানে বিদ্যুৎ আনলেন,তিনি বললেন,অন্ধকারকে মেরে নয়,আলো তার গা বেয়ে নিজেই পথ তৈরি করে নেয়,এই সত্য আমাদের বোধিত করে যেমন,চমকিত করে তেমনই!
হেমন্তের অরণ্যে পোস্টম্যান নয়,অরণ্য হয়ে উঠতে যে কবি,শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটা কবিতায় আছে —
“মানুষ যে ভাবে কাঁদে,তেমনি কি কাঁদে পশুপখি
একা থাকি,বড়ো একা থাকি ভিতরে
ভিতরে একা,অরণ্যের মধ্যিখানে একা
ঘরে ও বাহিরে একা”
এই কান্নার স্বরলিপি কবি সৌমিত বসুর কাব্যে ধ্বনিত হয়ে মধ্যম লয়ে,তিনি কাঁদছেন সেইভাবে যেভাবে শামুক বুকের মধ্যে মুক্তো গোপন করে! তিনি ঘরের নন,বাইরের নন,তার মাঝখানো চৌকাঠে দাঁড়িয়ে ঘর ও বাহিরকে ধরে রেখে অদৃশ্য সুতোর মতো, যা অধুনাী সভ্যতার একমাত্র সেতু ও সাহস, তাই কবি সৌমিত একইভাবে বলে ওঠেন—
“তোমার চিহ্ন আকাশ জুড়ে যাচ্ছে ভেসে
তোমার চিহ্ন নদীর বুকে সর্বসহা
জগৎজুড়ে আনন্দগান এই তুমি নেই
প্রভু আমায় তোমার মতো একলা করো”
শেষ পারাপারের কড়ি হাসতে হাসতে ছড়িয়ে দিয়ে বলে চললেন —-
‘আমার প্রভু একলা করো তোমার মতো
তোমার মতো পূর্ণ করো আমায় প্রভু’
কবির কৃষ্ণকথা সিরিজের এই অভিনব ভাবনা পাঠককে এমন এক স্বতন্ত্র পথের সন্ধান দেয়,যাতে চললেই অন্ধকার কেটে ওঠার আগেই বুকের পাখির ডাক শোনা যায় আর নদীর স্রোতে পা রাখলেই জলই নৌকা হয়ে পারাপার করে দেয়!
কবি সৌমিত বসু স্বরিত কবি।তিনি উপেক্ষিত আটপৌরে সরল গদ্যভঙ্গিকে নিজের কবিতার বাহন করেছেন।এবং কেন স্বরিত কবি? কারণ উদাত্ত ও অনুদাত্ত উচ্চারণের মাঝখানে এক স্বতন্ত্র ও স্বতস্ফূর্ত স্বর নির্মাণ করেছেন,তাই তিনি স্বরিত কবি।তাঁর উচ্চারিত স্বরের কয়েকটি স্রোত তুলে ধরলাম —-
১
” তোমাকে নিয়ে চিরজীবনের মতো পালিয়ে যেতে চাই
তোমাকে নিয়ে হারিয়ে যেতে চাই মহাশূন্যে, বিনির্মানে ”
২
“সকাল থেকে সন্ধে পেছনে পেছনে আসে সেই ডাক।কখনো হেঁটে কখনো বা চরকির হাত ধরে”
৩
“অল্প ভাড়ায় আপাতত সংসারটা গেঁথে নেওয়া তারপর উড়ান/ একদিন এই গ্রাম তোমাদের লজ্জা দেবে খুব”
৪
“সমস্তই সম্পর্কই বিবাহিত,সমস্ত সম্পর্কই
সূঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরিয়ে যাবার খেলা”
৫
“নৈঋত কোণ থেকে ধেয়ে আসা একটা জাতি চারপাশে গোল হয়ে ঘিরে আসা একটি স্নেহের ভেতরে দাঁড়িয়ে হাসছে”
এইভাবে কবিতার ভেতর আগুন ও আকাশ ভরে দিয়েছেন সৌমিত বসু।এই আগুন ও আকাশ আর পাঁচজনের দেখা উত্তাপ বা ডানার গন্ধমাখা নয়,এ এক আশ্চর্য সমাসের যাত্রাপথ।যেখানে দ্বন্দ্ব, কর্মধারয় এবং বহুব্রীহি জেগে মানুষের মতো।”কলকাতার যীশু” কাব্যে নীরেন্দ্রনাথ লিখেছিলেন —
“দেশ দেখাচ্ছ অন্ধকারে
এই যে নদী,ওই অরণ্য,ওইটে পাহাড়
এবং ওইটে মরুভূমি
দেশ দেখাচ্ছে অন্ধকারে মধ্যে তুমি
বার করেছ নতুন খেলা ”
নিজের দেশ দেখানোর খেলা কবি সৌমিত বন্ধ করতে চেয়েছেন,যা সত্যিকারের দেশ ও দেশজন এবং দেশহিত কাজ তাই কবিতায় তুলেছেন।সেখানে নিজেকে যদি পায়ের ধুলো বা মাথার রৌদ্রময় ঘর্ম অথবা ভিক্ষাজীবীর ফুটো পাত্র করে তুলতে হয়,তাতে তিনি কুন্ঠিত হননি,বরং ধুলার মধ্যে প্রমাণের মুদ্রা অঙ্কিত করে পদচিহ্ন করেছেন,রৌদ্রস্নাত মুখে বৃক্ষের আশ্বাস জাগিয়েছেন আবার ভিক্ষার থালাতে বৃন্দাবনের ভগবানকে এনেছেন ভালোবাসায়,ত্যাগে এবং তর্পণে।তাই তিনি এই সহজিয়া উচ্চারণ করতে পারেন —
“মা যেন ঘুড়ি
সংসারের মাঞ্জা মুখে শুধু উড়ে চলে
তবু পড়ে থাকে লাটাইয়ের দিকে,যেখানে হিসেব চলে
একটা জীবন জুড়ে কতখানি সুতো ছাড়া বা গুটিয়ে ফেলা যায়”
মায়ের কথাই তো স্বদেশ ও স্বাধীনতার কথা।তাই কবি সৌমিত অসংখ্য কবিতায় প্রতিধ্বনিত করে তুলেছেন।মাটিও তাঁর কবিতায় একটা জলজ্যান্ত মানুষের মতো,আবার মানুষ তাঁর কাছে কখনো আসবাব,কখনো পাথর,কখনো ঈশ্বর অথবা নিজের ছায়া,যাকে কবিতা ছাড়া আর কোনো তীর্থস্থানে দেখা যায় না!সহজ সূত্রে কবিতাকে বাঁধা যায় না,তবুও স্বরিত কবি সৌমিত বসুর কবিতার যে বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে, তা হল—-
১। তাঁর কবিতায় বার বার জড়বস্তু ওপর প্রাণ প্রতিষ্ঠিার এক অমোঘ লীলা প্রকাশিত এবং এইখানে তাঁর স্বতন্ত্রতা।
২।তিনি বেহুলাপালার লখিন্দর -মনন নন,স্বর্গযাত্রার ইন্দ্রসভার দেবতায়ও নয় তিনি চাঁদ সদাগরের তেজ,মনসার জেদ এবং মঙ্গলকাব্যের প্রেরণায় নতুন মঙ্গলকাব্য রচনা করেছেন ।
৩।শোষণ, ত্রাসন এবং অত্যাচারকে তিনি শুধু প্রকাশই করেননি,তিনি তার কীভাবে টুঁটি চেপে ধরে ভোর আনতে হবে তাও দেখিয়েছেন।
৪।কবিতা আত্মজীবনীর অংশ,সেকথাও মবে হয় সৌমিত বসুর কবিতা পড়লে।
৫। কবিতার আঙ্গিকে এক অভিনব দিক এই,গদ্যময়তার মধ্য অন্ত্য ছন্দের যে লোভনীয় হাতছনি একেবারে পরিহার করেছেন।সফলও হয়েছেন।
সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অঞ্চলের গাছগুলোর ডালপালা যেমন আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে,কিন্তু শিকড় থাকে জলের তলায়,স্বরিত কবি সৌমিত বসুর কবিতা তেমনই, —
“ধরো,একটা আকাশ আছে কোনো তারা নেই
তারাদের চিনিয়ে দেবার মতো হাতে কোনো শিক্ষক নেই
শুধু পালতোলা নৌকার মতো স্রোতের পক্ষে এক
ভয়াবহ সমর্পণলিপি,যতটা সম্ভব পড়ে ফেলি”
এইভাবে নিজেই নদী ও নিজেই নৌকা হয়ে পারাপার পড়ে ফেলার জন্য আমাদের সৌমিত বসুর কাছে, তাঁর কবিতার কাছে যেতে হয়,কারণ —-
“আমরা হেরে যাব না
আমরা মরে যাব না
আমরা ভেসে যাব না”