“জন্ম ও মৃত্যুর মাঝে অফুরন্ত রেখা
মুহূর্তের…
মুহূর্ত ছাড়া সবই তো দৃশ্য, দৃশ্যের বুদবুদ!
কেউ ঘরের, কেউ আগুনের…
কেউ নিমগ্ন, কেউ হয়তো নিখুঁত!
জেনেছো অশ্রু, তাহলে বুকে ঢেউ
জেগে আছে অবধারিত..
হাতের ওপর হাত
যে কেউ রাখতে পারে,যে কেউ ধরতে পারে
যদি মুহূর্ত না হয়ে উঠতে পারো
শরীরে শরীরে ছুঁয়েছিলে
অথচ স্পর্শ তো অনুচ্চারিত…” (স্পর্শ। শুভঙ্কর দাস)
একটি কবিতার বই যখন পাঠকের মনের দরজা খুলে ভেতরে গিয়ে দেখিয়ে দেয়,যে তুমি শুধু মাত্র পাঠক নাও,তুমিই প্রথম যাত্রী, অক্ষরের, পৃথিবীর।তখন সেই কাব্যগ্রন্থটি কাগজের স্থাপত্য থাকে না,
হয়ে ওঠে কষ্টিপাথর, অনুভবের, আলোর।
তেমনই একটি কবিতার বই
অনুচ্চারিত শব্দের কোলাহল
কবি বিকাশ চন্দ
প্রকাশক।কবিতিকা।
প্রত্যেক কবিই নিঃসঙ্গ উদাসীন এক মনযাত্রী।তাঁর যাত্রাপথ গাঁয়ের মেঠোপথ বা পিচঢালা মসৃণ রাজপথের মতো বাস্তবিক নয়, তা হল মনের পথ।
যা দেখা যায় না,যার কোনো গন্তব্য নেই,মাইলফলক নেই,যানবাহন নেই,শুধু তরঙ্গ আছে,তাও নদীর মতো দৃশ্যমান নয়, সেই পথে কবিকে হাঁটতে হয়। তিনি অক্ষরের ওপর নির্ভর করে সেই পথের দর্শনীয় স্থান,স্থাপত্য এবং চিরচর্চিত সমাধি পর্যন্ত দেখাতে পারেন।তাই দেখি মনযাত্রী বিকাশ চন্দ সহসা উদ্ভাসের মতো বলে ওঠেন—
“আমরা সবাই একলা কখন একার অংশনামা
কে জানে কখন ঘরের ভিতর ভাঙে অজানা স্রোত
বাকি আছে শুধু কোটি কোটি মানুষের জন্ম ছায়া খোঁজা”
সেই খোঁজই সত্য।জীবনের কাছে আমরা বড়জোর কয়েক মুহুর্তকে দাবী করতে পারি,তার বেশি কোনোকিছু নয়। তাই এরকম মুহুর্তলেখা কবি ছাড়া কারও পক্ষে প্রতীয়মান করে তোলা অসম্ভব। আমাদের হাতে দুঃখ,অশ্রু ও অব্যক্ত কিছু অধিকার ছাড়া আর কী আছে?
মহাকবি মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্যে দুষ্ট ও পরনারীনিগ্রহী পুরুষসত্তা ছাড়াও যখন নবম সর্গে পুত্রহীন পিতা রাবণ পুত্রের চিতারোহণ সামনে দাঁড়িয়ে যে বিলাপ করে,তা পড়লে, অতি শত্রুরও হৃদয় বিগলিত হয়, অর্থাৎ পরিস্থিতি ও মুহুর্তে মারপ্যাঁচে অতি পরাক্রমশালী লঙ্কেশ্বও অসহায়,যখন তিনি বলেন–
“সেবিনু শিবেরে আমি বহু যত্ন করি
লভিতে কি এই ফল? কেমনে ফিরিব
হায় রে, কে কবে মোরে,ফিরব কেমনে
শূন্য লঙ্কাধামে আর
হা মাতঃ রাক্ষসলক্ষ্মি! কি পাপে লিখিলা
এ পীড়া দারুণ বিধি রাবণের ভালে?
যাঁকে বধ করার জন্য স্বয়ং ঈশ্বরকে অবতারিত হয়ে মাটিতে নেমে আসতে হয়, সেই বীর,বাহুবলীও অসহায় দুঃখ ও শোকের কাছে।
কারণ একথা সবচেয়ে বড় সত্য, আধার হিসেবে যাই হোক, ক্ষুদ্র চারাগাছ হোক বা আকাশছোঁয়া মহীরুহ ,ব্যক্তিগত শোক বা দুঃখের কাছে সকলেই নত তৃণসম।
এই চরম সত্যিটি কবির চোখে আগে পড়ে,অন্যরা বিচলিত বা বিক্ষুব্ধ হয়ে ভেঙে পড়েন,কবিও তাই,তবুও তিনি বলে চলেন,যেভাবে বিকাশ শ চন্দ বলেন—
” স্থির সময় জেনে গেছে ঈশ্বর আল্লা কতটা সফল
কতটা কান্নার উষ্ণতায় বুকে তাপে বরফ গলে
শিরশিরে হিমেল হাওয়ায় ভেসে যায়
অনুচ্চারিত শব্দের কোলাহল”
অনুচ্চকথা সকলেই শোনে এবং তার জন্য নিজের আয়না নিজেই ভেঙে ফেলে অথবা নতুন কোনো আয়না নির্মাণ করেন।কখনো সেই কোলাহলের ভেতর নিজস্ব মুখ বা মুখোশও দেখতে পান।
প্রত্যেক মানুষের সবচেয়ে বড় বন্ধু হল, তার স্বগোতক্তি। সেখানেই সে নিজের সকল অঙ্ক মেলাতে চেষ্টা করে,না-মেলানো অঙ্ক নিয়ে আক্ষেপ করে এবং অবিরাম ঝরতে থাকে কোনো পাহাড়ি ঝর্ণার মতো লোকচক্ষুর আড়ালে…
কিন্তু কবির তো শুধু স্বগোতক্তিতে থেমে থাকলে চলে না,তাকে মুহূর্তের মাধুরি ও মাধুকরী দুই তুলে ধরতে নদীর কাছে,পাহাড়ের কাছে,ঘাসের কাছে,গাছের কাছে,এমনি কোনো অজানা শত্রুর কাছেও..
কবি বিকাশ চন্দ তাই করেছেন নিষ্ঠার নিমগ্নতায়—
এক।
জন্মকথার গভীরে লুকানো দহন আশ্চর্য যন্ত্রণা
দুই
চিরায়ত মাটি জীবন জেগে থাকে চেনা মানুষের স্পর্শে
তিন
অন্তর্গত রক্ত ঋণ প্রতিদিন স্নান সেরে ফেলে আসা জল তলে
চার
নিভু নিভু প্রদীপের আলোয় কে পড়ে জন্মান্তর শ্লোক
পাঁচ
অজস্র যন্ত্রণায় গর্ভ জানে সন্তান গরিমা
ছয়
যত রাত তত গোপন কথা পাখি জানে বুকের অতলে
সাত
চোখের তারায় জলের শরীরে ভাসে জলজ রমণ
আট
স্বপ্নেরা উড়ে আসে নরম হাওয়ায় সে তো অর্জিত অধিকার
এই আত্মআয়না নির্মাণকারী কবিকে প্রণাম।তিনি বিকাশ চন্দ, চন্দনগাছের বিকশিত মহিমা বুকে নিয়ে এই সুপ্রাচীন বৃক্ষের মতো অন্যান্য গাছগুলোকে চন্দন করবেন বলে লিখে চলেছেন,নিরন্তর..
আপনি পাঠক হিসেবে যখন তাঁর কাব্যপাতায় পড়বেন এই ধরণের আলোকোজ্জ্বল চরণসিদ্ধি—
“নিরহংকার পায়ের ছাপ সাদা কাপড়ে রেখে দিতে হয় ঘরে”
সে পায়ের ছাপ আসলে কবির,কবি বিকাশ চন্দের…
পুনশ্চ –কবিতিকার কমলেশ নন্দ এবং প্রচ্ছদকার বিষ্ণু সামন্তকে অনুচ্চারিত হৃদয়ের শ্রদ্ধা।
জয়তু।
——————————–//————