পুবদিকের হৃদয় এবং একজন হৃদয়সন্ধানী কবি : শুভঙ্কর দাস।

0
434

“আঁতুড়ঘরে এক চিলতে রোদ মায়ের আঁচলের স্পর্শের মতো ছুঁয়ে যায়,শিশুপৃথিবী…
এই সূচনা প্রথম যাত্রাপথের…
ফিরে যেতে একাই একদিন, রেখে যাবে,আরও একটু আলো,হৃদয়ের…

সেই দিক যদি পূর্ব হয়,তাহলে বুঝবে প্রতিটি জন্ম আসলে অনন্তের…

শুধু মা আর সূর্য জানে,নিজেদের মতো”

একজন কবিহৃদয় শেষ পর্যন্ত যে শক্তি নিয়ে বেঁচে থাকে,তা হল অপর হৃদয়ের আলো ও উষ্ণতা। মা যেমন আঁতুড়ঘরের প্রতিটি মুহূর্ত চেতন-অবচেতনে গর্ভধারণের প্রথম সময়কাল থেকে মনে মনে এঁকে রাখেন,কবিও সেই মাতৃহৃদয়অনুভবী।
নিজের ভেতর নিজেই আশ্চর্য অনুভবে লক্ষ্য করেন,সামান্য ঘষামাজার গতানুগতিক জীবন-যাপনের গতি ও গ্রহণ কীভাবে অপর হৃদয়ের সন্ধানে পরিবর্তন, পরিমার্জন এবং প্রকাশিত হয়ে চলেছে।এই ক্রমাগত আবেগ ও আবেশের মুখ একমাত্র দর্শন করতে পারে, বোধ।
বোধই হল মাতৃগর্ভের মতো জন্মচক্রের আধার।এখানে শিশুসন্তানের মতো জন্ম নেয় চিন্তা। চেতনা।উপলব্ধি।
যা কবিপ্রাণকে অস্থির করে তোলে,আবার তাই কবির একমাত্র অস্তিত্ব।
সেই ভাবনা কবি সমীররঞ্জন খাঁড়ার কবিতাও আছে—

“শুধু এক পরমান্ন আজও পাহারা দেয়
জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি
মা নামক এক আগুনপ্রেম”

ঘুম থেকে উঠে ঘুমোতে যাওয়ার মাঝখানে যে বিচিত্র ও বিভিন্ন অভিজ্ঞতার প্রপিতামহ ঝুলি ভরে ওঠে,তাই বোধকে খাদ্য ও পুষ্টি জোগায়।সেখান থেকে নির্মিত হয় একের পর এক নতুন দরজা।তাই করে চলেছেন কবি সমীররঞ্জন খাঁড়া।তিনি সবিনয়ে সহৃদয়ে অপর হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ করার চেষ্টা করছেন,অনুভব করছেন এবং তাকেই নিজের ভেতর জারিত করে প্রকাশ করছেন দরজা।
হা,দরজা।
এই দরজা খোলার কাজটি পাঠক করবেন,কিন্তু তার আগে দরজা নির্মাণ করা প্রয়োজন। তাই ধ্বনিত সমীরণে —

“সূর্যের আলো যেমন দিনের জন্ম দেয়
রাত্রির আঁধার আনে নক্ষত্রের দল
তেমনি মানুষও হৃদয়-আকাশ রচনা করে কাহিনি হয়ে ওঠে”

এ কাহিনির সূচনা হয়েছিল সেই অ্যামিবা থেকে…
তারপর জঙ্গল,গুহা,তপোবন,কুরুক্ষেত্র এবং সিংহাসনের পর সিংহাসন পেরিয়ে জন্ম নিল মাটির অভিমুখ। কিন্তু সেখানেও শিকলের পর শিকল,তাই কেটে তৈরি হল এক তেরঙা পতাকার দেশ,স্বদেশবাসী এবং আত্মবলিদানের ওপর আত্মপ্রকাশ। এইসব ইতিহাসের পাতার ভেতর কালো কালো অক্ষরের কারাগারে বন্দী হয়ে যখন দম আটকে গিয়ে গিয়েছিল, তখন কবিতা এসে তাকে জাগিয়ে তুলল,বোঝাল,অনুভূতি মরে গেলে হৃদয় মরে যায়…
আর হৃদয় মরে গেলে সূর্য নিভে যায়…
তাই সূর্যের আলোর দিকে যাত্রা প্রয়োজন এই অন্ধকারে, এই অসুখে…
কবি সমীররঞ্জন খাঁড়া যেন সেই চিরায়ত সত্যকে তুলে ধরার জন্য কবিতার আশ্রয়ে প্রকাশিত হয়েছেন—

“অচিন দেশের কোন্ অন্ধকার গুহা থেকে করো বিদীর্ণ অতি পরিচিত হৃদয়ের ভার,অজানা সময়ে হানো দ্বারে দুর্বিষহ অকস্মাৎ! কেন, কেন তুমি জীবনের সব আকাঙ্ক্ষা করো ম্লান নিষ্ঠুর কষাঘাতে? জানি আমি নই,নাও তুমি শাশ্বত এই ধরিত্রীর”

শাশ্বত ধরিত্রীর জন্য সযতনে নির্মিত সব ছেড়ে চলে যেতে হবে,তাহলে কীসের জন্য এই অনুসন্ধান? এই কবিতা? এই জীবনবোধ!
সাহিত্যিক জর্জ অরওয়েলের একটি অসাধারণ অনুভব আছে,তার হল,আমাদের জীবিতকালেই কোনো বিরাট পরিবর্তন দেখতে পাওয়ার সম্ভবনা কম। আমাদের আসল জীবন আছে ভবিষ্যতের গর্ভে। সে ভবিষ্যৎ ঠিক কতদিন পরে,তাও আমরা জানি না।দশ বছরও হতে পারে,হাজার বছরও হতে পারে।তবুও শুভচিন্তার আর যুক্তিবোধের এলাকাটা অল্প অল্প করে বাড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে ”

দুটি চেতনা,শুভচিন্তা এবং যুক্তিবোধ।
এই ধারণার ওপর দাঁড়িয়ে আছে সুমনন কবি সমীররঞ্জন খাঁড়া প্রণীত কাব্যটি “পুবের দিকে হেঁটে চলেছি”
কবিতার বইটির নামকরণের মধ্যে সেই শুভচিন্তা ও যুক্তিবোধের মাত্রামিল লক্ষ্যনীয়।
কিন্তু কবি সমীররঞ্জন খাঁড়া তা কীভাবে ব্যক্ত করেছেন,তা একটু পড়ে নিই আসুন—

এক

“অক্ষর আলোয় বদলে নিই অন্ধকার গলিপথ ”

দুই

“আমি জ্বরের চাদর দু-হাত ঠেলে/এগিয়ে চলেছি পুবের দিকে”

তিন

“অশ্রুকণায় হৃদয় আকাশ হয় ”

চার

” জন্মভিখিরিও সিংহাসন খুঁজে পায়
যদি পরমান্নের ছোঁয়া হৃদয়ে লাগে।”

পাঁচ

“জন্মের মধ্যে ক্ষয় আছে জানি
তবুও জন্মের জন্য জীবন প্রখরতর হয়।”

এই ভাবে ধীরে ধীরে ক্ষয় সরিয়ে জয়, ভয় হারিয়ে ভালোবাসা, ক্ষতি সারিয়ে জ্যোতি,প্রত্যাখ্যান ফেলে প্রস্তাব এবং আগুনকে আলো করার সহৃদয় সন্ধানে কবি সমীররঞ্জন ধুলো-বালি পথ হাঁটছেন।হলদিয়া শিল্পনগরীর শিশু পরিচর্যা ও আরোগ্যলাভের বরাভয় তাঁর হাতে,তিনি সেই শিশুহৃদয়কে সযত্নে ও সতর্কতায় সুস্থ রাখতে দিনরাত ছুটে বেড়াচ্ছেন। তার মধ্যেই তাঁর অনুভবী দৃষ্টি পড়ে এইভাবে যে,শিশুটি পেল নতুন ছাড়পত্র, তা কি সত্যি বেঁচে থাকার পৃথিবীর! সেই কতদিন আগে কত সহজ ভাষায় কিশোর কবি বলেছিলেন—

“চলে যাব— তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার ”

সত্যি এই অঙ্গীকার বুকে হাত রেখে ক’জন করতে পারে? যখন কবি সুকান্ত একথা লিখছিলেন,সেই অসহায় ও অবহেলিত শিশুপৃথিবীর কি কোনো উন্নতি হয়েছে? কোনো পরিবর্তন হয়েছে? এখনও অসংখ্য পথশিশু ও কিশোর-কিশোরী সভ্যতার যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে মরছে,এখনও ব্যস্ত রাজপথের ধারে হোটেলে নিয়ন বাতির নিচে বাসন মাজছে কোনো খালি-গায়ের বালক,এখনও চকলেট বা মোতির গহনার কারখানার বিভৎস অন্ধকারে ছোট ছোট হাতগুলো চিরে যাচ্ছে, শ্রমে ও লালসায়… এখনও অসংখ্য শিশু-কিশোরী চালান হয়ে যাচ্ছে পর্ণগ্রাফির জ্বলন্ত আগুনে…
তাই সুকান্তের কবিতা অমলিন,তার আবেদন চির-প্রতিবাদের…
মানুষের যেমন কষ্ট পেলে যেমন আর্তনাদ করে,এই কবিতা সেই আর্তনাদের দলিল।
কবি সমীররঞ্জন সেই আর্তচিৎকারকে আত্মবেদী করে কবিতা রচনা করছেন।
তিনি আসলে চিকিৎসা করতে করতে এটাও ভেবেছেন,এই সব অসংখ্য শিশু সুস্থ হয়ে ফিরে যাক সেই সুকান্তের কবিতার মতো সুন্দর পৃথিবীতে… ” তাইতো এখানে আজ ঘনিষ্ঠ স্বপ্নের কাছাকাছি / মনে হয় শুধু তোমারই মধ্যে আমরা যে বেঁচে আছি”

এই একাত্মবোধ। তাই কবিতা হয়ে ধরা পড়েছে সমীররঞ্জনের কবিতায়।তিনিও একান্তভাবে চাইছেন—

“আমার অক্ষরগুলো চাতক পাখির মতো বর্ষা খোঁজে ”

অথবা

“এসো, তুমি বীজমন্ত্রের বিধাতা হয়ে/ শস্যগোলা তরণী পূর্ণ পৃথিবী করে”

অথবা

” অশ্রুভর্তি থালা লড়াইয়ের সিংহাসন হয়ে ওঠে”

এই চেতনা ও বোধ কবি সমীররঞ্জনের শক্তি ও সাহস।তাঁর কবিসত্তার পূর্ণ আনন্দ ও আলো এই পথেই…
এই কবিতার পরতে পরতে একজন সহৃদয় মানবতার প্রতীক হয়ে অক্ষর সাজিয়েছেন কবি।তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে এক সহানুভূতিশীলতা ও সুসমপর্ণবোধ রয়েছে। তিনি নিজে যেন সেই ধারণার বাইরে নয়, এ যেন মাটিতে নেমে মাটি দিয়েই মনের মিনার নির্মাণ করার সুপ্রচেষ্টা।ভক্ত কবীরের একটি দোঁহা আছে—

” তিনকা কবহুঁ না নিদিয়ে, জো পাঁয়ন তর হোয়
কবহুঁ উড়ি আঁখিন পরৈ, পির ঘনেরি হোয়!”
অর্থাৎ অতি ক্ষুদ্র জিনিস বলে অবহেলা করা উচিত নয়। তিনকা অর্থাৎ খড়কুটো বলে পায়ের তলায় চাপা দিয়ে অবহেলা করা উচিত নয়, যে কোনো মুহূর্তে চোখে এসে পড়লে, খুবই কষ্টের কারণ হতে পারে।অর্থাৎ কোনো মানুষকে ছোট বা অবহেলা করা উচিত নয়। ”
সুমনন কবি সমীররঞ্জনের কবিতায় কবীরের দোঁহার প্রভাব আছে,তিনি অতি ক্ষুদ্র জিনিস ও চোখে পড়ে না,এমন অনুভবকে অতি যত্নে তুলে এনেছেন।তাঁর অনুভব সূর্যের আলো শুধু আলো নয়, বরং

” ঘুম ভাঙতেই দেখে–চাকুরির নিয়োগপত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে তার অন্ধ ছেলে
এক চিলতে রোদ এসে আলো করে দেয় উঠোন”

এই আলো,যা মানুষের বুকের মধ্যে আছে,তাই তিনি সন্ধান করছেন পুবের দিকে হেঁটে হেঁটে… আসলে তিনি এইভাবে কবিতায় হাঁটতে হাঁটতে একদিন নিজেই একটি দিক হয়ে উঠবেন,তাই তিনি এত সুন্দর করে আঁকেন বিশ্বাস —

“পুবের দিকে হেঁটে চলেছি
পশ্চিমি হাওয়ার বাঁকে
ঠাকুর দেবতা ঈশ্বর নয়
মানুষই সীমানা আঁকে”

প্রচ্ছদে কবি ও শিল্পী ভগীরথ সর্দার অনবদ্য ভঙ্গিতে পুবদিকের যাত্রাপথ ও যাত্রী অঙ্কন করেছে,যা এই কাব্যটির প্রাণপ্রতিমা আলোকিত। লিপি প্রকাশনা সযতনে ও সুন্দরতায় প্রকাশ করেছেন,তার জন্য বিশুদ্ধ হাততালি অবশ্যই প্রাপ্য।
এই কাব্য যে নতুন প্রজন্মের জন্য নতুন পৃথিবী নির্মাণ, তাই অতি সুন্দরভাবে প্রকাশিত উৎসর্গপত্রে…
সেখানে লেখা,” প্রিয় পুত্র অর্চিস্মানকে, যে বাবার পেশাগত শত ব্যস্ততায় মনে করিয়ে দেয়,’তুমি কিন্তু অনেকদিন কবিতা লেখোনি’

এই সঞ্চারিত আলোকরেখা,এ-ই তো নতুন পৃথিবীর দরজা।শুধু খোলার জন্য অসংখ্য অগণিত অর্চিস্মানের জন্য বাসযোগ্য সুকান্ত পৃথিবী তৈরি করে যেতে হবে,সে মাটিতে হোক বা কবিতায়…

পুবের দিকে হেঁটে চলেছি
কবি সমীররঞ্জন খাঁড়া
প্রকাশকাল।নভেম্বর ২০২১
প্রচ্ছদ। ভগীরথ সর্দার
প্রকাশনা। লিপি
মূল্য। আশি টাকা।