“এইমাত্র নদী নেমে গেল মনের
শেষ ধাপে,শুকনো পাতার মতো রৌদ্র কাঁপে
মানুষের জন্ম! এ কি কোনো দৈব অভিশাপে!
জানে না জীবন অথবা মৃত্যু!
তার মাঝে এই তো অক্ষরের সন্তান-সন্ততি
সঙ্গে আরও একটু শ্বাসের হাতটি বাড়াস…
নৌকাজন্ম যখন,একটু স্রোতের দিকটা ঘুরে যাস…
জেগে উঠে দেখি,মানুষে বুকে-চোখে ভরে আছে
শুধু মুখোশের লাশ,সাক্ষী দগ্ধ পলাশ! “( পলাশ।শুভঙ্কর দাস)
একটি মানুষ আপাদমস্তক সাহিত্যের সঙ্গী,সাহিত্যের সহযোগী এবং সাহিত্যিকের পরমবন্ধু। এবার আপনার মনে হল,তাহলে একটি দেখা করাই যেতে পারে।আপনি পূর্বেই ভেবে রেখেছেন, সাহিত্য-অন্তপ্রাণ মানে গিয়ে দেখব,রাশি রাশি বই খুলে পড়ছেন অথবা কোনো শ্বেতপাথরের টেবিলে উদাস বাউলের মতো কলমটি ধরে মানুষের জীবনকে ফুটিয়ে তুলছেন সাদা পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠায়,বা ভাবলেন,গিয়েই কথা বলা শুরু করলেই তিনি সাহিত্যের অতীত গৌরব, বর্তমান দুরবস্থা এবং ভবিষ্যৎ ভয়াবহতা নিয়ে সুদীর্ঘ বক্তব্য বা উপদেশ দেবেন!
না,তা কিছুই হবে না।
একটি বর্ণময় আন্তরিক সাহিত্যসভা চলছে..
সেই মানুষটি এই সভার প্রাণপুরুষ এবং সর্বময়কর্তা,তিনি কোথায়?
আপনি গিয়েই বুঝলেন,এখানে সাহিত্যের একটি যাগযজ্ঞ হচ্ছে।
নিশ্চিত মঞ্চের ওপর বসে থাকা কোনো একজন ব্যক্তি তিনি হবেন,কিন্তু কাকে জিজ্ঞেস করি?
অথবা যিনি মাইক্রোফোন ধরে সারা সভাকে শব্দশাসনে রেখেছেন,তিনিও হতে পারেন!
অথবা এই তো এতগুলো বইপ্রকাশ হল,এঁদের মধ্যে তিনি একজন হবেন নিশ্চিত।
এইভাবে খুঁজতে খুঁজতে আপনি দেখবেন এবং বিস্মিত হয়ে উঠবেন,ও হরি!
সাহিত্যবাগানে ঢোকার মুখে একটি সাধারণ মানের জামা-প্যান্ট ও খালি পায়ে অভ্যর্থণা করছিলেন এবং আপনি পা ধোবেন বলে,যিনি পুকুর থেকে জল তুলে দিলেন,তারপর আপনার পথক্লান্তি দূর করার জন্য নিজের হাতে ডাব কেটে আপনাকে খাওয়ালেন, আবার আপনার প্রাতরাশের জন্য ঠোঙাভর্তি মুড়ি-চানাচুর-নারকেল দিলেন এবং আপনাকে হাসিমুখে সভাস্থলের চেয়ার পর্যন্ত বসিয়ে আন্তরিকভাবে বলে উঠলেন,এখানে সাহিত্য নিয়ে আনন্দ করুন এবং বাড়ি যাওয়ার কোনো চিন্তা করবেন না,এখানেই থাকুন এবং সব রকমের সাহিত্য-সেবা এখান থেকেই গ্রহণ করুন।
এবং তা শুধু কথার কথা নয়, একেবারে সত্য ও সুন্দর।
তিনি ভূতনাথ পাণিগ্রাহী।
সাহিত্য-প্রাণ সকল মানুষের জন্য প্রাণপাত করতে রাজি আছেন।
তাহলে প্রশ্ন,কী পড়েন?
—কেন মানুষ পড়ি।এর থেকে ভালো বই আজ পর্যন্ত ছাপা হয়নি
কখন লেখেন?
—ঐ যে ঘুমোনোর আগে জেগে থাকতে লিখি,এখন তো জেগে থাকাটাই আসল কাজ
এই পথে কোনো পথপ্রদর্শক আছে?
— আছেন,আসুন দেখাচ্ছি,বলেই আপনাকে নিয়ে যাবেন,তাঁর তৈরি সাহিত্যবাগান,যার নাম সংলাপ।
সেই সংলাপের আদি এবং একমাত্র সভাপতি দর্শনে।
যিনি ভূতনাথের নাথ।
গিয়ে দেখবেন, শ্বেতপাথরের মর্মরমূর্তি। সেই সদাহাস্যজ্বল আনন্দময় পাগলা ঠাকুর।যিনি বলতেন,তোমাদের চৈতন্য হোক..
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ।
এরপর দেখবেন,ভূতনাথ পাণিগ্রাহী কোনো ভূমিকা ছাড়াই সেই মূর্তির পাদতলে বসে, আপনাকে ইঙ্গিত করে বলবেন,ইনিই সব।
এবার আপনি বুঝে যাবেন,কেন এই সাহিত্যপুরুষ অন্যের থেকে আলাদা।
সেই অক্ষর মাটির চাষা শান্ত-সৌম্য মনে একের পর গ্রন্থ রচনা করে চলেছেন।তার সংখ্যা প্রায় কুড়িটি।
এবার যে গ্রন্থটি হাতে এলেনা,তার নাম দগ্ধ পলাশ।
এ হল ভূতনাথের আশ্চর্য স্বগোতক্তির স্বতঃস্ফূর্ত ধারা।
যে সাহিত্যিক বই নয়, মানুষ পড়েন।যিনি মঞ্চ নয়,মাটিতে বসে বক্তব্য দেন,যিনি মনে করেন,গাঁয়ের চটে-ঘেরা চা-দোকানের আলোচনায় যে দর্শন উঠে আসে,তা বড় বড় দার্শনিকের বইয়েও নেই!
সেই মানুষটি যেন নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলে চলেছেন,এই বইটিতে।
বইটির কোনো শুরু নেই,শেষ নেই,একেবারে আমাদের কথা বলার মতো।কোনো সূচিপাতা নেই!
এই বইতে তিনি একটি আশ্চর্য আয়না নির্মাণ করে একের পর এক ছবি অক্ষরে খোদিত করছেন।সেইসঙ্গে যিনি পড়বেন, তাঁকেও অন্তর্গত আয়না করে দিচ্ছেন।
কয়েকটি দৃষ্টান্ত না দিলে ভূতনাথ-দর্পণ বোঝা যাবে না!
এক
লেখাপড়া
লেখাপড়া করা যদি খাওয়া, সঙ্গম আর শুধু বেঁচে থাকাই উদ্দেশ্য হয়, তাহলে ওটা না করাই ভালো! কারণ বাবুর কুকুরেও তো লেখাপড়া না করে,অক্লেশে বরং আরামের বেঁচে থাকে!
কবিতা
আমি জন্ম হলাম।যন্ত্রণা শুধু শুধু দিলাম স্রষ্টাকে।স্পর্শ করলোই না কেউ! দেখলোই না কেউ মুখে তুলে!
কারণ আমি হেমু মুর্মুর মেয়ে যে,নাম? কবিতা।
আত্মমর্যাদা
অর্ধশোয়া জামরুলের পাশে দাঁড়ালাম।কাজ হয়ে যুবতী লাল ফল শয্যায়!হাত বাড়াতেই!
বলল,নির্ভরতা লজ্জার।এভাবেও বাঁচা যায়।মুখ্য বিষয় আত্মমর্যাদা।
ফুল
যে ফুল ফুটুক, ভেতরে ওগুলো ওর শিশির নয়! কান্না! পোকা থেকে দেবতা সবারই চাই! ফুলের,বলি তার আবার চাওয়া কী? রক্ত করলেও সর্বমঙ্গল্যে!
সে যে ফুল ফুটুক। ভেতরে ওগুলো ওর শিরশির নয়! কান্না।
প্রেম
হৃদয় তপ্ত দগ্ধ না হলে,প্রেমের পরশ কি সহজে মেলে?
বৃদ্ধ
বৃদ্ধ কাঁপা হাতটি দিয়ে ঝাকালো হঠাৎ
বলল,বেঁচে আছি
শব্দহীন আমার মুখ!
আকাশে দেখি দলছুট একটি পাখি উড়ে যাচ্ছে, কেবল আজ একা!
এইরকম জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে মানুষের মনের অসংখ্য সিঁড়ি, সহবাস এবং সাধনাকে ভূতনাথ আপন অভিজ্ঞতা ও আলোক মিশিয়ে তুলে ধরেছেন।
এ যে সেই ঠাকুরের রসে-বশে থাকা।
ঠাকুর বার বার বলতেন,কলিযুগে নারদীয় ভক্তি।
জীবিকার সন্ধানে ছুটে চলা মানুষের হাতে যে সময়ের বড় অভাব।তাই শাস্ত্রে যে সকল কর্মের কথা আছে,তার সময় কই?
তাই ঠাকুরের নিদান,ঈশ্বর ও সংসার দুইহাতে ধরে এগিয়ে যেতে হবে,আর তাতে একটাই জিনিস দরকার,তা হল,মন ও মুখ এক করতে হবে।
মন ও মুখের এক করার সেই অমোঘ আয়না নির্মাণের চেষ্টা করেছেন সাহিত্যসাহসী ভূতনাথ পাণিগ্রাহী।
তাঁকে প্রণাম।
————————–//——————