ঝিঙে পটল (ধারাবাহিক, চতুর্দশ পর্ব) : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

0
536

বোনকে ফিরে পেয়ে পটল খুশী বটে, কিন্তু ঝিঙে ? সে হতাশায় অবসাদে বিষণ্ণ ! তার মধ্যে সেই আবেগ উচ্ছ্বাস নিস্প্রভ ! ঝিঙে কেমন যেনো নিস্তেজ, বিষাদময় জীবনের ন্যায় । দাদার দিকে বড় বড় করে তাকিয়ে শুধু চোখের জল ফেলছে । সব সময় উদাস ! ঝিমিয়ে পড়েছে ঝিঙে । বোনের বিষণ্ণতা দেখে পটলের মনের ভিতর উথাল-পাতাল ! তবে কী তার বোন স্বাভাবিক নয় ? কী করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না পটল । বোনের জন্য তার মনটা হতাশায় ম্রিয়মান ! বোনকে কীভাবে স্বাভাবিক ছন্দে ফেরানো যায় সেই নিয়ে পটলের প্রয়াসের খামতি নেই । তবুও ঝিঙে চুপচাপ !
পটল তড়িঘড়ি ছুটলো, বোনের প্রিয় চকলেট কিনতে । দামী একটা চকলেট বোনের হাতে ধরিয়ে দিলো । তবুও সে নির্বিকার । অথচ আগে হলে, এই চকলেট হাতে পেলে বোনটা অনন্দে লাফিয়ে উঠতো । লক্ষ্মী মেয়ের মতো দাদার কথা শুনতো । সেই মেয়ে ভাল চকলেট পেয়েও উদাসীন । পটল বোনের চুপচাপ থাকাটা দেখে ভয় পেয়ে গেল । নিজেকে ঠিক রাখতে না পেরে বোনকে ধমকের সুরে বলল, “তুই এইভাবে থাকলে আমি বাঁচব কীভাবে ?” বলেই হাউ হাউ করে পটলের কান্না !
দাদার কান্না দেখে ঝিঙে ঠিক থাকতে পারলো না ! উঠে দাঁড়ালো । দাদার পাশে বসলো । দাদার চোখের জল মুছে দিলো ।
বোনের নীরবতা ভঙ্গ দেখে পটল খুশী । বোনকে বলল, “তুই বাথরুমে ঢুকে স্নান সেরে নে । আমি কই মাছের ঝোল রান্না করেছি । পেট ভরে খেয়ে নে । তারপর তোর বিশ্রাম দরকার ! তুই আর দেরী করিস না । শিগ্‌গির স্নানে ঢোক ।“ একরকম জোর করে বোনকে স্নানে পাঠালো পটল ।
তারপর দুজনে একসঙ্গে বসে ভাত খাওয়া । কই মাছের ঝোল ঝিঙের খুব প্রিয় । সেই কই মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে তার শান্তি ! দুজনে মিলে দোকানের বারান্দায় বসলো । ঝিঙে অনেকটা স্বাভাবিক । ভাত খাওয়ার পর ঝিঙের শারীরিক স্থিতি, অনেকটাই চনমনে । তবে মুখটা দেখলে মনে হয়, ঝিঙে এখনও স্বাভাবিক ছন্দে ফেরেনি । দাদার কাঁধে মাথা রেখে ঝিঙে চুপচাপ বসে রইলো ।
“দাদা, একটা কথা বলবো !” খুব আস্তে আস্তে পটলকে জিজ্ঞাসা করলো ।
বোনের মাথায় স্নেহমাখা হাত বুলিয়ে আদর করে পটল বলল, “হ্যাঁ, এখন বল্‌ কী বলবি ? আবার কিছু খাবি কী ?”
“না দাদা ! খাওয়ার ইচ্ছা নেই । পেট ভরে ভাত খেয়েছি । এর পরে আর খেতে পারবো না ।“ ঝিঙে পটলকে বলল ।
তাহলে কী বলবি ?
“আগে বলো, তুমি আমার কথায় রাগ করবে না ?” ঝিঙের আবদার দাদার কাছে ।
পটল বোনের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো, বোন কোনো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তার সঙ্গে আলোচনা করতে চায় । বোনকে হাসিখুশী রাখতে পটল মরিয়া । বোনের যে কোনো আবদার মেটাতে পটল তৈরী । তাই পটল বোনকে বলল, “তুই কী বলবি, বল আমাকে ?“
“দাদা, আমি ……………।” বলতে গিয়ে ঝিঙের চোখে জল ।
তুই অহেতুক টেনশন নিস না । আমাকে খুলে বল । সমস্যা ঝুলিয়ে রাখিস না ।
“দাদা, আমি আর স্কুলে যাবো না !” বলেই ঝিঙের কী কান্না !
পটল বুঝতে পারলো, বোনটার আতঙ্ক কাটেনি । ভয়ে এখনও জড়োসড়ো । পটল বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “তুই খুব পরিশ্রান্ত । তোর বিশ্রাম দরকার !” তারপর বোনকে একরকম জোর করে ঘরে নিয়ে শুয়ে দিলো । বোন না ঘুমানো পর্যন্ত পটল বোনের মাথার কাছে ঠায় বসে রইলো । বোন ঘুমানোর পর পটলের মনে শান্তি ।
ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসেও পটলের শান্তি নেই । বোনটার কথা তার মাথায় ঘোরাঘুরি করছে । কীভাবে বোনটাকে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফেরানো যায়, সেই দুশ্চিন্তায় পটল অস্থির !
এতক্ষণে দোকানের ঝাপ খুললো পটল । দোকানে কাজ করার মুড নেই । সে নিজেও অবসাদে মুহ্যমান । বোনটাকে কীভাবে সামলাবে সেই ভাবনাটাই তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে । বোনটাকে নিয়ে তার কত স্বপ্ন ! সে শিক্ষিত হবে । মানুষের মতো মানুষ হবে । পটল বুক ফুলিয়ে বলতে পারবে, তার বোন শিক্ষিত । পটল মনেপ্রাণে চায়, বোনটা নিজের পায়ে দাঁড়াক ! সেই কারণে নিজের সখ আহ্লাদ ত্যাগ করে বোনটাকে মানুষ করার তাগিদে তার ধ্যান জ্ঞান ।
পটলের মনে খটকা, “বোন তাকে কী বলতে চায় ?”
***************************
“পটল কড়া করে দুটো চা করো । আদা দিতে ভুলবে না । আজ জমিয়ে চা খেতে চাই ।“ স্টেশনের চাপরাশি, কৃপাল সিং পটলের উদ্দেশে বললেন । তাঁর সঙ্গে আরও একজন ভদ্রলোক রয়েছেন ।
“একটু বসুন । এখনি চা বানিয়ে দিচ্ছি ।“ চা বানাতে উনুনের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো পটল । পটলের চায়ের দোকানের একটাই বৈশিষ্ট্য, খরিদ্দার অর্ডার দেওয়ার পর চা বানিয়ে সেই চা পরিবেশন করা । অন্যান্যদের মতো আগেভাগে চা বানিয়ে কেটলি ভর্তি করে রাখে না । সঙ্গে সঙ্গে চা বানিয়ে দেওয়ার জন্য তার চায়ের দোকানে চা খাওয়ার খরিদ্দার সর্বক্ষণ বেশী ।
চা বানানোর সময় পটল আবার চিন্তান্বিত, “বোনটা তাকে কী বলতে চায় ?”
 ( চলবে )