……… প্রসঙ্গতঃ জানাই, বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী উপবীত ত্যাগ করলেও তিনি কিন্তু কখনো গায়ত্রী মন্ত্র জপ ত্যাগ করেননি। আজীবন প্রতিদিন তা করে গেছেন নিষ্ঠা ভরে।
১৮৬৮ খ্রীষ্টাব্দে ব্রহ্মধর্মানুরাগী অনেকে কেশবচন্দ্র সেনকে অবতার বলে ঘোষণা করলেন । মুঙ্গেরেতে ভক্তিতে আপ্লুত হয়ে ব্রাহ্মিকরা নিজেদের কেশ দিয়ে কেশবচন্দ্রের চরণ মুছিয়ে দিতে থাকলেন , চরণ-ধোয়া জল পান করতে থাকলেন ও হাত জোড় করে মুক্তি প্রার্থনা করতে থাকলেন। এমন কি বলতে থাকলেন যে কেশববাবু স্বয়ং ভগবান। আর, কেশবচন্দ্র নিজের মুখে বলে বসলেন,‘ভক্তির স্রোত আমি বন্ধ করতে চাই না।মানুষের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করিতে ইচ্ছা করি না ’। তখন সে কথা জেনে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ উক্তি করলেন, “যে দেশে মাছ, কচ্ছপ অবতার, সে দেশে কেশবের হঠাৎ অবতার হতে ইচ্ছা হল কেন ?” রাজনারায়ণ বসু ঘোর প্রতিবাদ করলেন কেশবচন্দ্রের এমন অবতারবাদের । কারণ অনেকেই আবার কেশবচন্দ্র সেনের এমন অবতার হয়ে ওঠার ব্যাপার মেনে নিতে পারলেন না । ফলে সম্মিলিত ক্ষোভ, অসন্তুষ্টি, প্রতিবাদ এক আন্দোলনের সৃষ্টি করলো । বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী তখন এই আন্দোলনের পুরোধা হয়ে প্রাণপণে চেষ্টা করলেন অবতারবাদ ভাবনা যাতে ব্রাহ্মধর্মে অনুপ্রবেশ না করে তার। তিনি মুঙ্গের থেকে কলকাতায় চলে এলেন আর শ্রীযদুনাথ চক্রবর্ত্তীর সাথে মিলিত হয়ে ‘সোমপ্রকাশ’ ও ‘ইন্ডিয়ান ডেলিনিউস’ সংবাদপত্রে এই অবতারবাদের তীব্র প্রতিবাদ করলেন। শুধু তাই নয়, বিতৃষ্ণায় ব্রাহ্মধর্ম ত্যাগ করে শান্তিপুরে চলে এসে ডাক্তারি শুরু করে দিলেন। এসময় শ্রীশ্যামসুন্দরজীউ তাঁর সঙ্গে নানান লীলা করেন । সেসব আমরা পরে জানবো।
কেশবচন্দ্রের বিরুদ্ধে ব্রাহ্মধর্মে আন্দোলন যখন চূড়ান্ত রূপ নেয়, ব্রাহ্মধর্মের নিন্দা হতে থাকে বিভিন্ন সংবাদ পত্রে আর কেশবচন্দ্র নিজের ভুল বুঝতে পারেন—তখন তিনি তাঁকে নিয়ে আদিখ্যেতা করার সব পন্থা বন্ধ করে দেন আর পত্র পাঠান বিজয়কৃষ্ণকে যাতে অবিলম্বে বিজয়কৃষ্ণ কলকাতায় ফিরে এসে সেই আন্দোলন রোখেন আর ব্রাহ্মধর্মের মান রক্ষা করেন। বিজয়কৃষ্ণ চাইলে এই সুযোগের সদ্ ব্যবহার করতে পারতেন , নিজের একটি নতুন দল গঠন করতে পারতেন। কিন্তু , তিনি তা করেননি। তিনি কেশবচন্দ্রের আহ্বানে সাড়া দিয়ে কলকাতায় ফিরে এলেন ও গণ্ডগোল মেটাবার জন্য ‘ধর্মতত্ত্ব’ পত্রিকায় একটি বৃহৎ খোলা পত্র লিখলেন এই জানিয়ে যে—- তাঁর যে সকল ব্রাহ্মিক ভাইয়েরা কেশবচন্দ্রকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করেছিলেন , তাঁরা কেবলমাত্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতেই অমনটা করেছেন। কেশবচন্দ্রের প্রতি ঈশ্বরবাদ স্থাপন করা উদ্দেশ্য ছিল না তাঁদের।
ফলতঃ, ব্রাহ্মধর্মের ভিতরে ও বাইরে ওঠা ঝড় শান্ত হল একসময়। পরবর্ত্তীতে দেখা যায়, ১৮৭৬ খ্রীস্টাব্দে কেশবচন্দ্রকেই গুরুপদে বরণ করে নেন বিজয়কৃষ্ণ। দীক্ষা নিলেন তাঁর থেকে । আবার যখন কুচবিহারে বিবাহ আন্দোলনকে (পরে আসবো বিবাহ আন্দোলন সম্পর্কে) কেন্দ্র করে কেশবচন্দ্র সেনের মতাদর্শ মেনে নিতে পারলেন না, তখন পরের বৎসর অর্থাৎ ১৮৭৭ সালেই কেশবচন্দ্রকে পরিত্যাগ করলেন তিনি। অর্থাৎ, দ্বিতীয় বারের জন্য গুরুত্যাগী হলেন । এভাবে নিজের বিবেকবোধের স্বাতন্ত্রতায় এক নজির সৃষ্টি করে ফেললেন নিজের অজান্তেই বিজয়কৃষ্ণ ।
১৮৭৮ সালে এরপর পন্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী, আনন্দমোহন বসু—— এঁনাদের অগ্রগামী হয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ’ । যে সমাজে উপবীত ধারণের মত সংস্কার নেই, অবতারবাদ নেই, জাতিভেদ বা উচ্চ-নীচ ভাব নেই , যা অতি সাধারণ, বাহুল্য মুক্ত, সরল এবং স্বচ্ছ ।
১৮৭৮ থেকে ১৮৮১ খ্রীঃ পর্যন্ত এই চার বৎসর ধরে সমগ্র বঙ্গদেশ জুড়ে ব্রাহ্মধর্মের ব্যাপক প্রচার চালালেন বিজয়কৃষ্ণ । কিন্তু, এতসব করেও মন যেন কেমন ফাঁকা-ফাঁকা লাগে তাঁর । কীসের যেন অভাববোধ সর্বক্ষণ তাঁকে তাড়া করে নিয়ে বেড়ায় । পরম শান্তির সন্ধান যেন করতে থাকে তাঁর হৃদয় । কে দেবে তাঁকে সেই সন্ধান ? কোথায় গেলে, কার কাছ থেকে তিনি পাবেন স্নিগ্ধ আশ্রয়——— এই ভাবনায় মাঝে মধ্যেই বিভোর হয়ে যান তিনি । আর, তাই ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের সাথে সাথে ১৮৮২ সাল থেকে তিনি শ্রীগুরু অন্বেষণে ভ্রমণ করতে থাকলেন । অবশেষে গয়ায় আকাশগঙ্গা পাহাড়ে লব্ধ হলেন বহু প্রতীক্ষিত, বহু আকাঙ্খিত শ্রীগুরুদর্শন । গুরু পরমহংস বাবাজীর থেকে ১৮৮৩ সালে আষাঢ় মাসে দীক্ষা প্রাপ্তি হল তাঁর । ১৮৮৬ সালে কলকাতা সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের প্রচারপদ ত্যাগ করলেন । ইতিপূর্বে ১৮৮৪ তে পরলোক গমন করেছেন কেশবচন্দ্র । ১৮৮৬ তে ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসের পরলোক গমনের পর প্রকাশ্যে ১৮৮৭ সালে পূর্ববাঙ্গলা ব্রাহ্মসমাজ বরাবরের মতো ত্যাগ করে ব্রাহ্মধর্ম মুক্ত হলেন বিজয়কৃষ্ণ । প্রসঙ্গতঃ, যে বৎসর দীক্ষা হয় অর্থাৎ ১৮৮৩ তেই গুরুদেবের আজ্ঞায় কাশীতে স্বামী শ্রীহরিহরানন্দ সরস্বতীর থেকে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন তিনি ।
একটানা ১৮৬২ থেকে ১৮৮৭ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত টানা ২৫ বৎসর বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজী ব্রাহ্মধর্মের একনিষ্ঠ সেবক রূপে এই ধর্মের প্রচার-প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন । মূলতঃ তাঁরই প্রচেষ্টায় ওদিকে পূর্ববঙ্গ আর এদিকে উত্তর-পশ্চিম ভারতে ব্রাহ্মধর্ম বিস্তার লাভ করে । তিনি দীক্ষা নেওয়ার পর ১৮৬৩ সালে ব্রাহ্মসমাজের প্রচারক পদের দায়িত্ব নিয়েছিলেন । ১৮৬৬ তে ব্রাহ্মধর্মকে বিস্তৃত করার লক্ষ্যে ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ’ স্থাপিত হয় কেশবচন্দ্র সেনের পৃষ্ঠপোষকতায় । আর, যাঁরা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের আদর্শ রয়ে যান নাম হয় ‘আদি ব্রহ্ম সমাজ’ । প্রকৃতপক্ষে পূর্ববঙ্গের ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করে যে ভাবে ব্রাহ্ম ধর্মের প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তৃত হয়েছিল এবং কেশবচন্দ্র সেন যেভাবে প্রসিদ্ধি প্রাপ্ত হয়েছিলেন —-তার প্রধান কারণ কিন্তু বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজীই ।
প্রবন্ধের শুরুতেই প্রথম পর্বে লিখেছিলাম যে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজীর জীবনে বৈপরীত্যের এত বাহার ও বৈচিত্র্য যে বিস্মিত করে তা আমাদের । যেমন ধরুন, ‘তত্ত্বকৌমুদী’ পত্রিকায় ‘সাধারণের নিকট নিবেদন’ বলে ঢাকা “প্রচারকনিবাস’ হইতে ২৪শে জ্যৈষ্ঠ (১৮০৮ শক /১৮৮৬ খ্রি.)” পত্রে লেখেন-
“আমি জাতিভেদ ও পৌত্তিলকতা অসত্য বলে মনে করি এবং আমি তাহার বিরোধী । … সকল প্রকার অবতারবাদ, অভ্রান্ত গুরুবাদ ও মধ্যবর্তীবাদে মানবাত্মার অধোগতি হয়, বিশ্বাস করি ।”
অথচ ঐ বছরই এ মাসে ৪ঠা জ্যৈষ্ঠর পদত্যাগ পত্রে স্পষ্ট ভাবে বলেছেন-
“কালি, দূর্গা বা অন্য প্রতিমার সম্মুখে যদি আমার ব্রহ্ম স্ফূর্তি হয় তবে আত্মহারা হইয়া যাই এবং আমার ইষ্টদেবতাকে প্রণাম করিয়া হয়তো সেইখানেই গড়াগড়ি দিয়া চরিতার্থ হই। ব্রহ্মলাভ কেবল মানুষের চেষ্টায় বা সাধনে হয় না । এই শক্তিকে জাগ্রত করিবার জন্য একজন জাগ্রত শক্তিশালী মানুষ্যের আবশ্যক ।”
এই পত্র মাত্র তিন সপ্তাহ পূর্বে প্রকাশিত ওপরেরটির । এখন প্রশ্ন হল যে,.১৮৬৮খ্রীস্টাব্দে কেশবচন্দ্রের অবতারবাদ এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন যে বিজয়কৃষ্ণ, তিনি কেন ১৮৭৬ খ্রীস্টাব্দে তাঁর থেকে দীক্ষা নিলেন, আর কেনই বা ক্রমশঃ ভক্তিপথের দিকে এগোতে এগোতে বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করলেন ?
ভক্তকৃপাপ্রার্থিনী
রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক