ঝিঙে পটল (ধারাবাহিক, পঞ্চদশ পর্ব) : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

0
414

ঝিঙে দাদার কাঁধে মাথা রেখে বলল, “আমি আর স্কুলে যাব না দাদা ।“
পটল কথাটা শুনে চমকে উঠলো । প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বোনের দিকে তাকিয়ে বলল, “তা হয় না বোন । সামনে তোর হায়ার সেকেণ্ডারী পরীক্ষা ! এমতাবস্থায় তোর মুখে “স্কুলে না যাওয়ার কথা” মানায় না । তুই মনকে শক্ত কর । পরীক্ষার দিকে মন বসা । একদম ভয় পাবি না । তুই জানবি, তোর পাশে দাদা আছে । তোর ভয় কীসের ?”
আবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ঝিঙে বলল, “দাদা, স্কুলে যেতে আমার বড্ড ভয় করছে । আমি আর স্কুলে যাব না দাদা ।“
পটল বুঝতে পারছে, তার বোনের মন থেকে এখনও আতঙ্ক কাটেনি । এখনও মনে হচ্ছে, সেদিনকার অপ্রীতিকর ঘটনার জেরে সে রীতিমতো ভীতো, ভয়ে জড়োসড়ো । কিছুতেই হাল্কা হতে পারছে না । তাই পটল বোনকে আর বিরক্ত করলো না । বরং বোনকে বলল, “তুই একটু স্টেশন প্লাটফর্ম চত্বর দিয়ে ঘোরাঘুরি করে আয় । মনটা হাল্কা লাগবে ।“
দাদা, আমার শরীর ঠিক আছে । আমি ভাবছি, পড়া ছেড়ে দিয়ে তোমার সাথে ব্যবসা করবো ।
দূর বোকা ! অযথা কেন ভাবছিস ?
দাদা, স্কুলে যেতে আমার মন চাইছে না ।
“ঠিক আছে বোন । পরেরটা পরে ভাবা যাবে । তুই কাঁচা লঙ্কা দিয়ে ঝাল ঝাল করে মুড়ি মাখা । অনেকদিন তোর হাতে মাখানো মুড়ি খাওয়া হচ্ছে না । আজ জমিয়ে মুড়ি খাওয়া যাবে ।“ বোনকে হাল্কা করার জন্য পটল মুড়ি মাখানোর প্রস্তাব দিলো ।
পিয়াঁজ, আদা-কুচি, কাঁচা লঙ্কা কুচি, চানাচুর, বাদাম, ও সর্ষের তেল দিয়ে আচ্ছা করে মুড়ি মাখালো ঝিঙে । তারপর দুজনের মুড়ি খেতে বসা ।
দোকানের প্রতি পটল ঠিকমতো ধ্যান দিতে পারছে না । বোনটাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা, তার মরিয়া প্রয়াস । বোনের ভাললাগা, মন্দলাগা এই মুহূর্তে পটলের কাছে প্রাধান্য । যার জন্য তার প্রিয় খাবার সংগ্রহে পটল তটস্থ । ঝিঙের জন্য ভাল একটা জামা কিনতে পটল শক্তিপুর বাজারে ছুটলো । জামাটা ঝিঙের খুব পছন্দ । জামাটা গায়ে দিয়ে ঝিঙে দাদাকে জিজ্ঞাসা করলো, “জামাটার খুব দাম, তাই না দাদা ?“
আগে বল তোর জামাটা পছন্দ হয়েছে কিনা ?
আমার খুব পছন্দ !
তোর ভাল লেগেছে জেনে আমি খুব খুশী । দাম জেনে কী করবি ? তোর ভাল লাগার জন্যে, বলা চলে, তোর জামা কেনা সার্থক !
বোনের মুখে খুশীর ছাপ । তারপর হঠাৎ পটলের দিকে তাকিয়ে ঝিঙে বলল, “আচ্ছা দাদা !”
কিছু বলবি বোন ?
বলছি কী, স্কুলে না গেলে আমার কী কোনো ক্ষতি হবে ?
বোনের এই কথায় পটলের মন ভারাক্রান্ত ! বোনকে নিয়ে তার কতো আশা । শিক্ষিত হবে । বড় হবে । নিজের পায়ে দাঁড়াবে । তারপর তাকে বিয়ে দেবে । কিন্তু পড়াশুনার মাঝখানে পড়া ছেড়ে দিলে নিজের পায়ে নিজে কুড়ুল মারার ন্যায় ব্যাপারটা দাঁড়াবে । এতদিন ঘরদোড় সামলে যেভাবে ঝিঙে পড়াশুনা চালিয়েছে সেটা অবর্ণনীয় । তার মতো নিষ্ঠাবান মেয়ের পক্ষেই সম্ভব ! এখন মাঝপথে পড়া ছেড়ে দিলে বরং তাকে ভয়-ভীতি আরও পেয়ে বসবে । নিজের নিজস্ব অস্তিত্ব লোপ পাবে । তাতে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা !
পটল পরিষ্কার বুঝতে পারছে, অচেনা আগন্তুকগুলো তাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য ঝিঙের এখন স্কুলে যেতে ভয় ! তার মনের ভিতরে তখনও আতঙ্ক বর্তমান । তার সংশয়, ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলে ঝিঙের পক্ষে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে ! সেইজন্য একটা চাপা আতঙ্ক তার মনের ভিতর কাজ করছে । পটল ভেবে দেখলো, ঝিঙের কথার এখন উত্তর না দেওয়াই ভাল । সে একটু স্বাভাবিক হোক, তারপর এইসব বিষয়ে আলোচনা করা যাবে । কিন্তু বোনকে পড়া ছাড়ালে চলবে না । যেকোনো মূল্যে ঝিঙের পড়া চালিয়ে যেতে হবে ।
বেশ কয়েকদিন কেটে গেলো । পটল চুপচাপ । বোনের স্বাভাবিক জীবন গঠনে পটল ভীষণ চিন্তিত । কীভাবে তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরানো যায় !
হঠাৎ স্কুলের মাস্টার মশাই কণক স্যার পটলের দোকানে হাজির ।
কণক স্যারকে দেখে চমকে উঠলো পটল । তারপর হতচকিতের ন্যায় কৌতুহলি দৃষ্টতে স্যারকে জিজ্ঞাসা করলো, “স্যার, আপনি হঠাৎ !”
এলাম একটা দরকারে । হেড স্যার আমাকে পাঠালেন । ঝিঙে অনেকদিন স্কুলে যাচ্ছে না । অথচ হায়ার সেকেণ্ডারী পরীক্ষার ফর্ম পূরণ চলছে । তাকে ফর্ম ভরতে হবে । নতুবা ঝিঙে পরীক্ষায় বসতে পারবে না । তাই তড়িঘড়ি ছুটে আসা ! ফর্ম পূরণের শেষ তারিখ আগামীকাল । সুতরাং আগামীকালের মধ্যে ঝিঙের ফর্ম পূরণ করা চাই ।
কণক স্যার ঝিঙেকে স্কুলে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন । তিনি বারংবার ফর্ম পূরণের উপর জোর দিলেন । তাঁর মতে, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা একটা ছাত্র ছাত্রীর কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ । ভবিষ্যত জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সোপান । সুতরাং পটলকে উদ্দেশ্য করে পুনরায় স্যার বললেন, “আগামীকাল বোনকে অবশ্যই স্কুলে পাঠাবে । এটা আমাদের স্কুলের তরফ থেকে তোমাকে অনুরোধ ।“
কণক স্যার চলে গেলেন ।
স্যার চলে যাওয়ার পর ঝিঙের খুব কান্না ! সে পরীক্ষা দিতে নারাজ । কিছুতেই ফর্ম পূরণ করতে চাইছে না, বরং বলা ভাল, ফর্ম পূরণে তার অনীহা ।
ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলো পটল । বোনের মনমরা দৃশ্য দেখে পটল দুশ্চিন্তায় অস্থির ! তবে কী বোনটা পরীক্ষা দিতে রাজি হবে না ? বোনটার মাথায় হাত রেখে অনেক বোঝালো । তাতে কোনো কাজ হল না । ঝিঙে তার সিদ্ধান্তে অটল ।
পরেরদিন সকালবেলায় স্কুল খোলার সাথে সাথে পটল হেড স্যারের সঙ্গে দেখা করলো । বোনের সর্বশেষ পরিস্থিতি বুঝিয়ে বলল, “বোন তার কথা একদম শুনতে চাইছে না । এমতাবস্থায় আপনি একটা বিহিত করুন । নতুবা বোনটা অনেক পিছিয়ে পড়বে ! তীরে এসে তার তরী ডুববে !” জোড় হাতে পুনরায় হেড স্যারকে অনুনয় বিনয় করে পটল বলল, “আপনি সশরীরে ঝিঙের সামনে উপস্থিত হলে, হয় তো, তার সিদ্ধান্ত বদল করে ফর্ম পূরণ করতে পারে ।“
হেড স্যার মাথা চুলকালেন । তারপর পটলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি বাড়ি যাও । আমি তোমার পেছন পেছন যাচ্ছি ।“
হেড স্যার বাড়িতে আসায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলো ঝিঙে । ইচ্ছা করে হেড স্যার ও ঝিঙের মাঝখান থেকে পটল কাজের অছিলায় অন্যত্র চলে গেলো । হেড স্যার ঝিঙেকে বোঝালেন, “তুমি আমার মেয়ের মতো । তোমার উপর দিয়ে একটা বড় ঝড় বয়ে গেছে । এটা আমরা মানি । তাই বলে বেয়াদপদের ভয়ের কাছে তুমি মাথা নত করবে ?”
“স্যার আমার বড্ড ভয় করছে । যদি শয়তানগুলো পুনরায় আমার উপর হামলা করে ?” ভীত কন্ঠে ঝিঙে হেড স্যারকে বলল ।
সেটা আর হবে না । তুমি নিশ্চিন্ত থাকো । স্কুলে নিরাপত্তা বেষ্টনী আরও কঠোর করা হয়েছে । কেউ এসে আর দুস্কর্ম করে পালাতে পারবে না ।
হেড স্যারের কথার উপরে ঝিঙে অমত করতে পারলো না । হেড স্যার ব্যাগ থেকে ফর্ম বের করলেন । ঝিঙের হাতে ফর্ম দিয়ে বললেন, “ফর্মটা ভরে দাও ।“
ফর্ম পূরণ করে হেড স্যারের হাতে দিয়ে ঝিঙে বলল, “স্যার, আমার আর স্কুলে যেতে মন চায় না । সব সময় ভয়ে রয়েছি, আবার যদি দুস্কৃতিরা ধাওয়া করে ? আবার যদি আমাকে তুলে নিয়ে পালিয়ে যায় ?”
তুমি একদম চিন্তা করবে না । চারিদিকে এখন মজবুত সিকিউরিটি । আর কোনো অঘটন ঘটবে না ।
এই গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবে না স্যার । আমাকে মাফ করবেন স্যার । আমাদের মতো মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে কারও মাথাব্যাথা নেই । এমনকি সমাজ বা প্রশাসন কোনো পক্ষেরই নারীর নিরাপত্তা, মান-সম্ভ্রম নিয়ে হেলদোল নেই । বিভিন্নভাবে মার খাচ্ছি আমরা, আমাদের মতো মেয়েরা ।
হেড স্যার একদৃষ্টে ঝিঙের দিকে তাকিয়ে ! তাঁর উত্তর দেবার ভাষা নেই । যেভাবে ঝিঙে কিডন্যাপ হয়েছিল, সেটা নজিরবিহীন ! অথচ আজ পর্যন্ত অপরাধীরা অধরা । প্রশাসন কতটা নড়েচড়ে বসেছে, সে বিষয়ে হেড স্যার সন্দিহান ? থানা থেকে সমস্ত প্রশাসনিক স্তরে ব্যাপারটা লিখিতভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে । “ঝিঙেকে দিনের বেলায় স্কুল থেকে তুলে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া” সমাজের কাছে, প্রশাসনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হওয়া উচিত ছিল ! অথচ বিষয়টি ধামাচাপা দিতে একটা শ্রেণী সক্রিয় !
হেড স্যার মনোকষ্টে ব্যথিত । ঝিঙেকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোনো উল্লেখযোগ্য উদাহরণ নেই । হেড স্যার নিজেও জানেন, প্রশাসন তৎপর না হলে স্কুলের পক্ষে নারী পাচারকারীর গ্যাং ধরা অসম্ভব । অবশেষে ঝিঙের মাথায় হাত দিয়ে হেড স্যার বললেন, “কষ্ট পেয়ো না মা । শিগ্‌গির সমস্ত কিছু ঠিক হয়ে যাবে । নিরাপত্তা নিয়ে তোমার উদ্বিগ্নতা একদিন প্রশাসনের কাছে মর্যাদা পাবে । সুশীল নাগরিক জেগে উঠবে । আমরা সেইদিনের অপেক্ষায় দিন গুণছি । তুমি পড়াশুনায় মনোযোগ দাও । রেজাল্ট ভাল করা চাই ।“ তারপর হেড স্যার চলে গেলেন ।
হেড স্যার চলে যাওয়ার পর ঝিঙে প্রমাদ গুণতে থাকলো, কীভাবে পরীক্ষায় বসা না যায় । তার “পরীক্ষায় না বসার” সিদ্ধান্তটা মুখ ফুটে কাউকে বলতেও পারছে না । অথচ মানসিকভাবে দৃঢ়সংকল্প, সে পরীক্ষায় বসতে নারাজ !
 ( চলবে )