প্রভুপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী— এক আশ্চর্য মহাজীবন কথা (পর্ব-৯) : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

0
436

………….অদ্বৈত গোস্বামী প্রভুর বংশজ বিজয়কৃষ্ণের মনে-বুদ্ধিতে-চিত্তে-রক্তের স্রোতে বরাবরই সেই জন্মসূত্রে পাওয়া ত‍্যাগ-বৈরাগ্য-নিষ্কাম ভক্তির প্রভাব বর্তমান ছিল। কিন্তু, সেই নিষ্কামতার মন ও নিজের ব্যক্তিগত উচিত-অনুচিত বুদ্ধিস্তম্ভে প্রতিষ্ঠিত থেকে তিনি একটানা ২৫ বৎসর ব্রাহ্মধর্ম যাজন করলেও তাঁর আত‍্যন্তিক ক্ষুধার নিরসন হচ্ছিল না । তাই বারে বারে বিভ্রান্ত মনে তিনি গুরুগ্রহণ ও গুরুত্যাগ করেছেন । যখনই তাঁর ব্যক্তিগত আদর্শ ক্ষুন্ন হয়েছে তখনই তিনি বিপরীত পথে হেঁটেছেন । আর তাতে এতটুকু কুণ্ঠা বোধ করেননি । বেশ কতগুলি ঘটনা পরম্পরা তাঁকে একটু একটু করে দূরে সরাচ্ছিল ব্রাহ্মধর্ম থেকে। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ প্রভাব বিস্তারকারী সেসব ঘটনাগুলি হল —–
১) উপবীত ত্যাগ বিষয়ে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের অমত।
২) কেশবচন্দ্রের নিজের প্রতি অবতারবাদ অঙ্গীকার।
৩) ১৮৭১ সালে কেশবচন্দ্র ‘Reconstruction of Native Society’—-‘দেশীয় সমাজের পুনর্গঠন’ শীর্ষক বক্তৃতায় ব্রাহ্মসমাজের আধ‍্যাত্মিক উন্নতির সাথে পাশ্চাত্য দেশের সংস্কৃতির প্রতি বিশেষ এক প্রকার মোহ বা অনুকরণের ঝোঁক প্রকাশ পেয়েছিল । যা ব্রাহ্মিকদের প্রভাবিত করে আর বিজয়কৃষ্ণকে হতাশ করে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রতি এই মোহ ।
৪) ১৮৮১ সালে মহামতি রাণাডে মহারাষ্ট্র থেকে পত্র লিখেছিলেন যাতে ব্রাহ্মসমাজের সকল নেতারা একসঙ্গে মিলে কাজ করে । মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের কাছে এই পত্র প্রেরণ করেছিলেন তিনি । কিন্তু, নেতাদের নিজস্ব ভিন্ন-ভিন্ন চিন্তাধারা, আত্ম-অহংকার তাঁদের একত্রীভূতকরণে বাধক হল । এর দরুণ, ধর্মশাস্ত্রকে নিরপেক্ষ জ্ঞান করে এক ঈশ্বরের সন্তান হবার যে আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন বিজয়কৃষ্ণ, তা ক্ষুণ্ন হল । তাঁর মনে হতে থাকল এতদিন ধরে যে প্রয়াস বা চেষ্টা তিনি করে এসেছেন তা কি আদৌ সফল হয়েছে ! আবার ব্রাহ্মসমাজে ক্রমশঃ অঙ্কুরোদগম হয়ে চলেছিল উচ্ছৃঙ্খলতার, ঔদ্ধত্যপনার, পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকে অনুকরণ করার তীব্র আসক্তির। আর হয়তো বা, আদর্শবাদী বিজয়কৃষ্ণের অন্তর মেনে নিতে পারছিল না এইসব ।
৫) আবার হিন্দু জাগরণ একটি তরঙ্গও সেসময় ক্রমশঃ শক্তিশালী হচ্ছিল । হিন্দুধর্মের পুনরুত্থান চলছিল নব আঙ্গিকে আধুনিক, যুক্তিশীল ভাবে, বিভেদমূলক মনের ভাবকে দূরে সরিয়ে রেখে । কলকাতার মনীষীরা ঠাকুর পরমহংস রামকৃষ্ণের উদার ভক্তিপথের প্রতি আকর্ষিত হচ্ছিলেন ।
পণ্ডিত শশধর তর্কচূড়ামণি, বাগ্মী শ্রীকৃষ্ণ প্রসন্ন সেন, ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়—— এঁনাদের মতো প্রখর পণ্ডিতগণ হিন্দুধর্মের দার্শনিক দিকটি ক্রমশঃ জনসমক্ষে তুলে ধরছিলেন তাঁদের লেখনী ও বক্তব্যের মাধ্যমে । ফলে রাজা রামমোহনের সমসাময়িক প্রতিদ্বন্দ্বী স্যার রাধাকান্তের পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দুধর্মের যে পুনরুত্থান ও রক্ষণকারীদল গড়ে উঠেছিল বা চলে আসছিল এতকাল ধরে সমান্তরালভাবে তা ক্রমশঃ শক্তিশালী হতে থাকে । মানুষ হিন্দুধর্মের প্রতিই তাঁদের আস্থা অটুট প্রমাণ করে । ব্রাহ্মধর্মাবলম্বীরা ক্রমশঃ ক্ষুদ্র গোষ্ঠীতে পরিণত হতে থাকে ।
৬) এই যুগ সন্ধিক্ষণে বিজয়কৃষ্ণ দীক্ষিত হলেন আকাশগঙ্গা পাহাড়ে পরমহংসজীর থেকে । ইনি তাঁকে প্রকৃত সত্যের সন্ধান দিলেন যার খোঁজ এতকাল ধরে অন্তরে অন্তরে করেছেন বিজয় ।
৭) শ্রীগুরুদেবের ভজন প্রভাব তাঁকে বিমুগ্ধ করল । তিনি হিন্দুধর্মের সাধনায় আকর্ষণ বোধ করলেন । অন্তরের ক্ষুধার নিবৃত্তি এখানেই সম্ভব—–এই উপলব্ধি করে শেষে মোহমুক্ত হলেন ব্রাহ্মধর্মের প্রতি ।
তাই, বিজয়কৃষ্ণ পাকাপাকি ভাবে ব্রাহ্মধর্ম পরিত্যাগ করে বৈষ্ণব ধর্মের সাধন-ভজনে ডুব দিলেন । জীবনের শেষ ২৪ বৎসর এই ধর্মেই যাজন করেছেন বৈষ্ণবকুল চূড়ামণি এই গোস্বামীপাদ।
এবার আমরা আস্বাদন করবো বৈষ্ণব বিজয়কৃষ্ণের জীবনধারা কথামৃত ।
——(ক্রমশঃ)
ভক্তকৃপাপ্রার্থিনী
রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক