আমি মায়েরই রই; ভালোবাসার :: লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল।

0
433

কোনো আবছায়া নেই পবিত্রতায় । চোখের সম্মুখে প্রতিদিন প্রতিপল আমাদের ঠাকুর্দা নারাণ দাস গুণগুণ করতে করতে ভোর মাখছেন । অবশ্যই ষোল নাম বত্রিশ অক্ষর । কখনও চোখবন্ধ , মাঝে মাঝে শুধু রাস্তার বাঁক দেখে নিচ্ছেন অবচেতন চেতনায়। শিরশির বাতাস আর পাখির গান তারই সুরের সমবেত সঙ্গত । যদিও ধান রোয়ার প্রস্তুতি চলছে মাঠে মাঠে । পূবালী আভায় রাঙা প্রভাত সেই মাঠে বুলিয়ে দিচ্ছে তার নরম আদর । বাতাসের আনন্দ আর ধরে না । দু একটা রোগা সোঁতায় জলের চঞ্চল স্নায়ু । ধরে রাখতে চাইছে আকাশ আলো সুর । এই আত্মীয়তায় এবড়োখেবড়ো পথ সুন্দর । বাঁকের বাধায় সজনেফুলের সু্বাস , আঁকা আমবোলের আলপনা , আর সর্দি কাশির কুয়াশার ঋতু । শ্বাসত পথ এবং পাতা ঝরার ছন্দে তিনি পা ফেলছেন নিঃশব্দে – মগ্ন এ ভোরাই ।

আমি জন্মের পর থেকেই চলতে চলতে দেখতে শুরু করেছিলাম সব কিছু । আমি দেখতে পেয়েছি এই পথ ছাড়িয়ে যাচ্ছে ক্রমশ – প্রথম আকাশ প্রথম মাটি প্রথম মেঘ । যেমন ক’রে মায়ের হাত ছড়িয়ে যাচ্ছে দিগন্তের দিকে । যেমন করে ভালোবাসা শিহরিত হতে থাকে সরষে ক্ষেতের হলুদ বাজনায় । যেমন করে বেঁচে থাকার অপরিহার্য চাহিদাগুলো উচ্চারিত হতে থাকে ভাষায় ভাষায় । কোন কারণেই এর খেকে পৃথক করা যায় না নিজেকে । যদিও নিজস্ব কোন পালন নেই , কোন পর্যালোচনা নেই , শুধুমাত্র মায়ের কথাকে তরঙ্গায়িত করার আর্তি ; যাতে শুধুই রোদ্দুর , ম ম থেকে মা মা ।

এ ও তো মুক্তির চেতনা , এ ও তো খড়ের চালার বিনম্র সুর । এ ও বকসাদা আকাশের উদাসী অহংকার । গতিচঞ্চল বিশ্বের অদম্য পিপাসা । টানা প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ অশ্রুর নবজন্ম হচ্ছে বারবার ।
– এ পিপাসার কি শহীদ মিনার আছে ?
– নাবালের ঠিক উপরেই রয়েছে তো সেই স্বচ্ছন্দ উৎসর্গ ! রক্তে ভিজে আছে তার ভিত । কৃষ্ণচূড়া সরিয়ে দেখো ভুবনের আকুল উচ্চারণ । এ পিপাসার নাম অধিকার । এ পিপাসার নাম দুঃসহ রোমান্টিকতা । অবশেষে তার উপর ঝরে পড়ছে সমগ্র বিশ্বের ফুল।
– ভাষা কি শুধুই শব্দ সংযোগ ?
– সময়ের সাথে মানুষ বদলে গেলেও ভালবাসা চিরন্তন । সে শুধু এক মন থেকে আরেক মনে , এক ফাল্গুন থেকে আরেক বসন্তে রাংগিয়ে দিয়ে যায় আমাদের । দরজা জানালায় তার অপূর্ব চিত্র । অনুভবেরা ফুল ফুল হয়ে প্রাচ্য পাশ্চাত্যের ভরদুপুরে দাঁড়ায় । অস্থিরতা বাড়ে বারবার । অবাধ বিচরণে কেউ কেউ দিতে চায় পাঁচিল । এখনও । তবে তা মানবো কেন ? আমাদের হৃদয়ে আছেন তাঁরা, ১৪৪ ধারা ভাঙার উদাহরণ আছেন -আছেন তাঁদের বিচ্ছুরণ ।
– ভাষা কি ফেব্রুয়ারি মাস ?
– কীসের খোঁজে এত দীর্ঘতা জানি না কেউ কিংবা স্নায়ুর কাঁপন । রোগ অথবা কীটপতঙ্গের হাত থেকে বাঁচতে সার দিলাম কীটনাশক দিলাম আদরের গাছে । ফুল ফুটে ওঠে শুধু সময়ে । তারপর তার রং তার সুবাস ছড়িয়ে পড়ল মহাবিশ্বে।
– তবে পালন কী?
– অন্ধকার খাদের থেকে বেরিয়ে আসছে মধ্যরাতের সংকেত। এ অনুভূতিকে বাণে বাণে উন্মোচন করি বারবার । ঘুম ভাঙিয়ে বলে উঠি – দেখ্ দেখ্ , নীলাকাশ দেখ্ । কেমন অস্তিত্ব রক্ষা করছে অসীমে ।

নির্জন হলেই আকাশকে বলি – আমার ভালোবাসা নিস্ । তোর আলো ছুঁয়ে আছে আমার লোনা জলে ।
সে আমার চোখে চোখ রাখতে চায় । রাখেও । আমিও সেই প্রতিফলিত রশ্মির দিকে তাকিয়ে দেখতে থাকি শূন্যতার আনন্দ বিস্তার । উজ্জ্বল সেই দ্যুতিতে কেবল জ্বলজ্বল করে তারা ৷ দৃষ্টিতে বলতে থাকে – ভালোবাসি আমিও ।

মাকে বললাম – ক্ষিদে পেয়েছে । মা তড়িঘড়ি করে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে জামবাটি ভর্তি মুড়ি এনে দিয়ে বললেন – জল ঢেলে খেয়ে নে , পেট ঠাণ্ডা থাকবে ।
কখনও চোখ পাকিয়ে বলে – অনুভবকে সজাগ রাখবি তো। তা না, শুধুই বেনিয়ম ।

শ্যামলী, কোমরে জড়ানো আঁটোসাঁটো শাড়ি । কপালে সবুজ টিপ, মানানসই । খোঁপাটি বশ মানে না ; হদয়ও৷ ঝাঁট দিচ্ছে ঝরাপাতা । সরে যাচ্ছে জমাট নিথরতা । মাটির ফাটলে অংকুরিত হচ্ছে গড়িয়ে পড়া মুগবীজ। শীতশীত ভাবে দ্রুত হচ্ছে শ্বাসগতি । জায়গা করে নিতে থাকে ঠোঁট মুখ কান নাক প্রাণ । উঠোন থেকে রাস্তার দিকে উড়তে থাকে ধানচারার গন্ধ ।

ঋজু বৃক্ষেরা স্নিগ্ধ প্রার্থনায় মগ্ন । পাশ দিয়ে নয়ানজুলি আর শালুক ফুলের দোলন । কমলিলতার সাঁতারে সজীব আকর্ষণ ; মুখরতার নয় মুগ্ধতার ।
দে ছুট্ দে ছুট্ জীবনের সম্পূর্ণ পর্বাঙ্গে।
এই শুশ্রূষার কাছেই আমার হাসি কান্না , আমার প্রতিধ্বনি, আমার শ্লোগান । আমি ভাষার রই ; আমি বাংলার রই ; আমি মায়ের রই ।