প্রভুপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী— এক আশ্চর্য মহাজীবন কথা (পর্ব-১১) : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

0
316

প্রেতাত্মা—-“হ্যাঁ, উপায় আছে বটে! আমরা যত সম্পত্তি হরণ করেছি সেই পরিমাণ অর্থ যদি মন্দিরে ফিরিয়ে দেওয়া যায়, তবেই অপরাধের মোচন হবে। আমাদের দেশে সম্পত্তি আছে অনেক। আমাদের বংশজরা কেউ যদি সেই পরিমাণ অর্থ ক্ষতিপূরণ হিসেবে আমাদের নামে মন্দিরে দিয়ে দেয়, তাহলে হয়তো এই নিদারুণ যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হতে পারবো আমরা।”

প্রভুপাদ বললেন—“বেশ, তোমরা তোমাদের পরিবারের বা উত্তরাধিকারীদের ঠিকানা , নাম যদি জানাও তবে না হয় আমি পত্র লিখে তাঁদের জানাবো তোমাদের অবস্থার কথা। তাঁদেরকে অনুরোধ করবো যে সেই পরিমাণ অর্থ মন্দিরে যেন তাঁরা প্রদান করেন। তাহলে তোমাদের উদ্ধার হবে নিশ্চয়।”—–এই বলে তিনি তাঁদের উত্তরাধিকারীদের নাম-ধাম জেনে নিলেন এবং ফিরে এসে সেদিনই তাঁদের পত্র পাঠালেন সব জানিয়ে।
প্রভুপাদের বৃন্দাবন বাস শেষ হয়ে এসেছে। তাই তাঁকে বৃন্দাবন ত্যাগ করতেই হল। তিনি হরিদ্বারে চলে গেলেন। অতএব, সেই বৈষ্ণব প্রেতাত্মাদের পরিবারের লোকেরা মন্দিরে ক্ষতিপূরণের অর্থপ্রদান করেছিলেন কিনা তা আর জানা যায় নি।

আরেকদিনের ঘটনা। প্রভুপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী যমুনায় স্নান করছেন ব্রাহ্মমুহূর্তে। হঠাৎ সানুনাসিক সুরে তিনি কারোর অনুরোধের মত কিছু শুনলেন। তিনি বুঝলেন যে, যারা কথা বলছে তারা সাধারণ মানুষ নয়, প্রেতাত্মা তারা। তিনি বললেন–“কী বলতে চাও তোমরা? আবার বলো , পরিষ্কার করে।” তখন তিনি দেখলেন তাঁর চারপাশে বেশ কতগুলি হাওয়ার মত ধূসর কালো রঙের প্রেতাত্মাদের কায়াহীন কলেবর। তারা বললো,”প্রভুপাদ, আমাদের বড় কষ্ট। আপনি দয়া করে আমাদের দুঃখমোচন করুন ‌। আপনিই পারেন আমাদের উদ্ধার করতে। করুণা করুন প্রভু।”

তাদের কথা শুনে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীপাদ বললেন, “আমার তরফ থেকে যদি কিছু করা যায়, অবশ্যই তা করব আমি।কিন্তু, আমি কি করে তোমাদের দুঃখ দূর করবো, বলো ?”

প্রেতাত্মা—-“স্নানের পর আপনার জটা থেকে যে জল পড়বে, তা পান করলেই আমাদের এই কষ্ট দূর হবে, আমরা উদ্ধার হয়ে যাবো প্রেতযোনি থেকে। এবার আপনি যদি কৃপা করে অনুমতি দেন!”

এমন কাতরভাবে কথাগুলো বললো প্রেতাত্মারা যে প্রভুপাদের হৃদয় আর্দ্র হয়ে গেল তাদের দুঃখে। তিনি বললেন, “বেশ, এটুকুতেই যদি তোমাদের উদ্ধার হয়, কেন করব না !” তিনি যমুনায় ডুব দিলেন এবং ডুব দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন যখন, তখন তাঁর জটার জল নিংড়ে দিলেন প্রেতাত্মাদের। তারা হাত পেতে সেই জল গ্রহণ করে পান করলো। অত্যাশ্চর্য কাণ্ড ঘটে গেল তখনই প্রভুপাদের চোখের সামনে। জল পান করা মাত্র তাদের ধূসর কালো হাওয়ার মত কায়াহীন শরীর জ্যোতির্ময় রূপ ধারণ করলো। খোলস ত্যাগ করার মত তারা যেন ধূসর আবরণ খানা ফেলে দিয়ে প্রণাম জানিয়ে জ্যোতির ন্যায় মিলিয়ে গেল । আর তা দেখে প্রভুপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর মন এক অদ্ভুত পরিতৃপ্তিতে ভরে গেল। প্রসন্নতার পরশ খেলা করে গেল প্রাণে সেই অরুণোদয় কালে।

এবারের ঘটনা একটু অন্যরকম। বৃন্দাবনের কেশিঘাটে নারায়ণস্বামী নামে একজন সাধু থাকতেন। তাঁর প্রেতসিদ্ধি ছিল । তিনি প্রেতদেরকে বশ করে নানান আশ্চর্য্যকর অলৌকিক কান্ড করতেন এবং সাধারণ মানুষকে সেসব দেখিয়ে বিস্মিত করে দিতেন। সকলে অবাক হয়ে যেত তাঁর সাধন প্রভাবের কথা ভেবে। কিন্তু, তিনি যে প্রেতদের দ্বারা এসব করতেন তা কেউ জানতো না। এভাবে বৃন্দাবনে তাঁর বেশ প্রতিপত্তি হয়েছিল। নারায়ণস্বামীর এমনসব নানান অভাবনীয় কান্ডকারখানার কথা প্রভুপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীপাদও শুনলেন লোকমুখে। তিনি মনে মনে সম্মান জানালেন আর ভাবলেন তাহলে তো একদিন দর্শন করতে যেতেই হয় সেই সিদ্ধ নারায়ণস্বামী সাধুকে।

কিছুদিন পর গোস্বামীপাদ নিজেই গেলেন নারায়ণস্বামীর সঙ্গে আলাপ করতে। প্রভুপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর সুখ্যাতির কথাও নারায়ণস্বামী ইতিপূর্বে শুনেছেন। তাই প্রভুপাদ স্বয়ং আসায় সাধু খুব খুশী হলেন। যথেষ্ট সমীহ-সম্মান করেই বসতে দিলেন। বেশ কিছুক্ষণ ধর্মালাপও হল তাঁদের মধ্যে। বেশ আনন্দেই সময় কাটলো। বিদায়বেলায় প্রভুপাদকে সাধু নারায়ণস্বামী বললেন, “প্রভু, আপনি বরং আগামীকাল সন্ধ্যায় আমার আশ্রমে আবার আসুন । আমি আপনাকে কিছু দেখাবো।” গোস্বামীপাদ হাসিমুখে বললেন, “বেশ তো, আসবো না হয় !”

পরদিন সন্ধ্যার সময় প্রভুপাদ উপস্থিত হলেন নারায়ণস্বামীর আশ্রমে। সাধু তাঁকে যথেষ্ট খাতির-যত্ন করেই ঘরের বারান্দায় বসালেন। তারপর কিছুক্ষণ বাক্যালাপের পর বললেন, “এবার আপনি ঘরের দিকে তাকিয়ে থাকুন। দেখুন তো কিছু দেখতে পান কিনা !”

(ক্রমশঃ)