মন যাকে চায় : শতাব্দী মজুমদার।

0
396

ঢি ঢি পরে গিয়েছিল চারদিকে,শুধু পাড়াপড়শী তো নয় ,আত্মীয়স্বজন সর্বসাকুল‍্যে যে কজন ছিল তারা ছাড়াও মিডিয়ার ফেসবুক পেজের দৌলতে মুখরোচক কমেন্টের বন্যা বয়ে যাচ্ছিল।রাতারাতি ফেমাস হয়ে গিয়েছিলেন সুতীর্থবাবু।

-ছিঃ ছিঃ শেষে কি না কাজের লোকের সঙ্গে! দেখে তো এতোদিন ভদ্র মানুষ বলেই জানতুম।
– সত্তর বছরের বুড়ো তার আবার শখ কতো ,মেয়ের বয়সী যুবতীকে পটিয়ে ফেললো!
জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা চিরপরিচিত তার পাড়ায় জোরদার আলোচনা বা সমালোচনার প্রধান চরিত্র সুতীর্থবাবু।

আত্মীয় স্বজন কস্মিনকালেও যারা সুতীর্থ বাবুর খোঁজ খবর রাখেন নি ,এক্কেবারেই যোগাযোগে বিচ্ছিন্ন তাদের কাছেও বিষয়টা বেশ মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ালো।

“তখন পই পই করে জ‍্যাঠিমা বিয়ের কথা বললেও কিছুতেই রাজি হলোনা ,কত ভালো ভালো সম্বন্ধ সব আর শেষে এখন কি না এই কান্ড!” সুতীর্থ বাবুর পিসতুতো ভাইয়ের খুড়তুতো বোন সহ সমস্ত লতায় পাতায় পরমাত্মীয়রা এই একটা খবরেই যে যেদিকে ছিলেন ফোনাফুনিতে জোট বেঁধে নিলেন।আত্মীয়দের কাছে বাড়ির কাজের লোককে বিয়ে করাটাই সুতীর্থ বাবুর প্রধান অপরাধ হিসেবে গণ্য হলো।

ফেসবুক পেজের কমেন্ট সেকশনের বেশিরভাগটাই নোংরা মন্তব্য।সুতীর্থ বাবুর বয়সটাই সেখানে ভিলেন যেন।গর্হিত অপরাধ এই বয়সে বিয়ে করাটা তাও আবার পাত্রী অর্ধেক বয়সী।

সমস্ত কু মন্তব্য সুতীর্থ বাবুর কানে এসেছিল,লোকের কথায় বিশেষ পাত্তা ফাত্তা দিতেন না তিনি আর এখন পৌঢ়ত্বে পৌঁছে আরও তো নয়।

প্রমিলাদেবীও তথাকথিত সমাজের কটাক্ষ থেকে বিন্দুমাত্র বঞ্চিত হলেন না।সুবিধাবাদী ,লোভী,দুশ্চরিত্রা কত অপবাদ।বুড়ো মরলে সম্পত্তি নিয়ে ভাগবে নিশ্চিত ভবিষ্যৎবাণী হয়ে গিয়েছিল অথচ এসব ছাড়াও ভালোবাসা,শ্রদ্ধা,আস্থা ,নির্ভরতা এরকম আরও কত যে শব্দ হয় তা তো প্রমিলাদেবীরই মনের অভিধানে জমা ছিল।

কলেজে পড়তে পড়তে মা মারা যাওয়ার পর বাবা আর সুতীর্থবাবু।ভালো চাকরি পেয়েছিলেন ,নিজেও সুপুরুষ ছিলেন,বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয়ে গিয়েছিল।সুতীর্থবাবু মনে মনে নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখেছিলেন ভাবী স্ত্রীকে নিয়ে কিন্তু বিয়ের মাত্র সপ্তাহ খানেক আগে পাত্রী তার প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে গেল।এরকম ঘটনার পর সুতীর্থবাবু অন্য কোথাও আর কখনোই বিয়েতে মত দেন নি।
বাপ বেটায় দিব্যি ছিলেন কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর এক্কেবারে একলা হয়ে গিয়েছিলেন । যতদিন চাকরি জীবন ছিল তার অনেকটা সময় সেখানে কেটে যেত। রিটায়ারমেন্টের পর বয়সের সাথে সাথে একাকীত্ব বেড়ে গেল,অকৃতদার থাকার কারণে অনেকটাই একঘরে হয়ে উঠলেন।আত্মীয় বা প্রতিবেশীরা কেউই তার অস্তিত্বকে আমল দিত না সেভাবে ,তবুও জীবন কেটে যাচ্ছিল।

কয়েকমাস আগে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন সুতীর্থবাবু।বুকে পেসমেকার বসাতে হলো।হাসপাতাল থেকে বাড়ি আসার পর তার দেখভালের জন্য আয়া সেন্টার থেকে বছর পয়ত্রিশের প্রমীলাদেবী এসেছিলেন।উনি অসুস্থ মানুষটার সেবা যত্ন করে তাকে সুস্থ করে তুললেন।সে ও একা,স্বামী মারা গেছেন।

সেই কবে সুতীর্থবাবুর মা মারা যাওয়ার পর এমন পরম যত্ন আর তো তিনি সেভাবে পাননি।টাকার বিনিময়ে হলেও তিনি লক্ষ্য করেছেন, মেয়েটা যেন হৃদয় দিয়েই তাকে সেবা করে।দরিদ্র বিধবা একাকিনী মেয়েটার প্রতি প্রথমে তার স্নেহ মমতা থাকলেও কখন যেন তিনি অনুভব করলেন, “কখনো প্রমিলাদেবীর অনুপস্থিতি তাকে ভীষণভাবে অসহায় করে তুলবে।”

প্রমীলাদেবী স্বামীর মৃত্যুর পর বাপের বাড়িতে দাদার সংসারে থাকেন।সুতীর্থবাবুর সেবার দায়িত্ব পেয়ে তিনি যেন বর্ত্যে গেছেন ।মানুষ হিসেবে ভদ্রলোক ভীষন ভালো মনের। টাকা তার প্রয়োজন ঠিক ই কিন্তু মানুষটাকে সুস্থ করে তোলা যেন ভীষণ জরুরি ,একলা মানুষতো ,অসুস্থ থাকলে কে ই বা দেখবে!

প্রথমে প্রয়োজন তারপর সেসব ছাপিয়ে দুজনের মনেই যেন বসন্ত এসে পড়লো।জীবন যাপন অর্থবহ হয়ে ওঠলো।
সুতীর্থবাবু বাকি জীবনটুকু প্রমিলাদেবীকে নিজের কাছে রেখে দিতে চাইলেন।প্রমীলাদেবী থাকতে রাজি। এই মানুষটিকে ভালো রাখার দায়িত্ব যে তারই।

দুটিমন এক হয়ে যেতেই দুজনের চারহাত এক হতে বেশি সময় লাগে নি।

সুতীর্থবাবুরা দুইয়ে মিলে বেশ আছেন একে অন্যের পরিপূরক হয়ে। নিন্দুকেরা মুখে কুলুপ এঁটেছেন।অনেকেই আবার এখন বাহবা দেন তাদের দুজনকেই, ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্তের সমর্থনে।

আরে বয়সে বৃদ্ধ ,পাত্রীর বয়স আবার তার অর্ধেক ,কাজের লোক তা তে হয়েছেটা কি!মন যাকে চায়,প্রেমে পড়া মোটেও বারণ নয়।

সমাপ্ত