ঝিঙে পটল (ধারাবাহিক, ১৯ তম পর্ব) : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

0
367

ঝিঙে বুঝতে পারলো, তার দাদা এখন কিছুতেই বিয়ে করবে না । বোনকে মানুষ করাই তার ধ্যান-জ্ঞান । বোনকে বিয়ে দিয়ে তারপর সে নিজের বিয়ের কথা ভাববে । তাই বিয়ে করার জন্য দাদাকে আর উত্ত্যক্ত করলো না । বরং ঝিঙে নিজের ভবিষ্যতের ভাবনায় নিমগ্ন রইলো ।
মাস্টার্স পড়ার পাশাপাশি ঝিঙের চাকরির দিকে ষোলোআনা ঝোঁক ! যার জন্য তার মাথা থেকে রূপ-চর্চা উধাও ! প্রতিদিন নিয়ম করে তার পড়াশুনা । এম-এ পড়ার পাশাপাশি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি । চাকরির পরীক্ষার বই ছাড়াও বিভিন্ন পত্রিকা, জার্নাল, ইত্যাদি পড়তে শুরু করলো । তার মূল টার্গেট, আই-এ-এস পরীক্ষায় সফল হওয়া ।
বন্ধু-বান্ধব যারাই ঝিঙের আই-এ-এস পরীক্ষার প্রস্তুতির কথা শুনছে, তারাই ঝিঙের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসছে । এমনকি পাড়া প্রতিবেশীও ঝিঙেকে কটাক্ষ করে নেতিবাচক কথা শোনাতে ছাড়ছে না । বোঝাতে চাইছে, “তোর দ্বারা আই-এ-এস পাশ ! কখনো সম্ভব না !” এইসব কথা শুনে ঝিঙে বরং না ঘাবড়িয়ে উল্টে তার জেদ বেড়ে গেলো । সেদিন শক্তিপুরের বান্ধবী দ্বীপালীর সঙ্গে দেখা । তাদের স্কুল থেকে কলেজ পর্যন্ত একসঙ্গে পড়াশুনা । বলা চলে ঝিঙের ভাল বন্ধু । বাজারসৌ স্টেশনের প্লাটফর্মে হঠাৎ তার সঙ্গে দেখা । সদ্য দ্বীপালীর বিয়ে হয়েছে । মাথার সিঁদুর ঝকঝকে উজ্জ্বল ! এক গাল হাসি দিয়ে ঝিঙেকে দ্বীপালীর জিজ্ঞাসা, “এখন তুই কী করছিস্‌ ?”
মাস্টার্সে ভর্তি হলাম ।
মাস্টার্স করে কী লাভ ? চাকরির যা বাজার, পাশ করে কী চাকরি পাবি ? চাকরি না পেলে বি-এ, এম-এ পাশের কোনো দাম নেই । এইসব কথা ভেবেই, আমি বিয়ের পিঁড়িতে বসতে রাজি হলাম । এখন বিন্দাস । ঘর সংসার নিয়ে বেশ আছি । কিন্তু তুই অন্তত বিয়ে করে ঘর সংসার করতে পারতিস । আমাদের মতো গাঁয়ের মেয়েদের বেশী পড়ে কী লাভ ?
দ্বীপালীর কথার উত্তরে ঝিঙে বলল, “তোর বিয়ের খবরে আমি ভীষণ খুশী । নিঃসন্দেহে ভাল খবর । কিন্তু আমার দাদা, আমাকে দাঁড় না করিয়ে বিয়ে দিতে রাজি নয় ।“
ছাড় তো তোর দাদার কথা ! জীবনটা তোর । সেই জীবনটাকে চালনা করার দায়িত্ব তোর নিজের ! বয়স হয়ে গেলে আমাদের মতো গ্রামীণ এলাকার মেয়েদের ক্ষেত্রে পাত্র পাওয়া দুষ্কর ? তুই কিন্তু না বুঝে বেশী ঝুঁকি নিচ্ছিস্‌ !
“এটাকে ঝুঁকি নেওয়া বলা চলে না দ্বীপালী ! আমিও চাই, আমার পায়ের তলার মাটি শক্ত হোক । সেই আঙ্গিকে আমার ইচ্ছা, ভবিষ্যতে আমি আই-এ-এস অফিসার হবো ।“ ঝিঙে স্পষ্টভাবে তার মনের বাসনা বান্ধবীর কাছে ব্যক্ত করলো ।
ঝিঙের “আই-এ-এস” হওয়ার স্বপ্নের কথা শুনে দ্বীপালীর কী হাসি ! হা হা করে তার উচ্চস্বরে হাসি ! হাসি আর থামছে না । ইতিমধ্যে তাদের ট্রেন প্লাটফর্মে ঢুকলো । ট্রেনের কামরায় উঠে পড়ায় দ্বীপালীর হাসি আর দেখা গেলো না । হাসির মাহাত্ম্য ঝিঙে বুঝতে পারলো না । তবে এটা বুঝলো, দ্বীপালীর উচ্চহাসি তাকে উপহাস করার হাসি ! হাসির অর্থ বুঝায়, তোর দ্বারা “আই-এ-এস” হওয়া কখনো সম্ভব না । ট্রেন চলে যাওয়ার পর ঝিঙে কিছুক্ষণ প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে রইলো । ঝিঙের ভাবনার শেষ নেই । যাদের এতকাল নিজের আপনজন ভেবে এসেছিলো সেইসব বন্ধুরা তার “আই-এ-এস” পরীক্ষার প্রচেষ্টার জন্য প্রশংসা তো করছেই না, বরং নিরুৎসাহ করে আনন্দ পাচ্ছে । এটাই ঝিঙের কাছে হৃদয়বিদারক !
একমাত্র তার দাদা অনবরত বোনের পাশে । দাদার দৃঢ় বিশ্বাস, বোন একদিন তার ঈপ্সিত সাফল্যের মুখ দেখবে । সেই কারণে পটল বোনকে সর্বক্ষণ উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে । পটল বারংবার একটা কথার উপর খুব জোর দিয়ে বোনকে বোঝাচ্ছে, “যেহেতু তোর টার্গেট নির্দিষ্ট । সুতরাং টার্গেট অনুযায়ী প্রচণ্ড খাটুনি দরকার । আর একটা কথা, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় পাশ করার ব্যাপারে গ্যারান্টি দেওয়া খুব কঠিন । সুতরাং আদাজল খেয়ে মেহনত করা এবং লেগে থাকা, খুবই জরুরি । হতাশায় ছিটকে বেরিয়ে গেলে সেটা পরাজয়ের লক্ষণ । দাঁত কামড়ে সাফল্যের জন্য লেগে থাকতে হবে । একবার না হোক, দ্বিতীয়বার প্রচেষ্টা নতুবা তৃতীয়বার । কিন্তু থামলে হবে না । যতক্ষণ ঈপ্সিত ফল না আসছে, ততক্ষণ কঠোর পরিশ্রমের সঙ্গে লেগে থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন ।“ দাদার কথাগুলি ঝিঙেকে খুব উৎসাহ জোগাচ্ছে ! যদিও ঝিঙে ঘাবড়ে যাওয়ার পাত্রী নয় ! পাশ করার ব্যাপারে ঝিঙের আন্তরিক প্রয়াস অব্যাহত ।
সাপ্তাহিক “এমপ্লয়মেন্ট নিউজ”এ ইউ-পি-এস-সি’র বিজ্ঞাপন দেখে ফর্ম ভরলো ঝিঙে । আই-এ-এস পরীক্ষা তিনটি ধাপে । প্রিলিমিনারি, মেন এবং মৌখিক পরীক্ষা । প্রি-পরীক্ষা জুন মাসের শেষে । ঝিঙে জানে, প্রি-পরীক্ষাতে দুটো বিষয়ের উপর পরীক্ষা এবং পুরোটাই অবজেক্টিভ । সেখানে একটি বাধ্যতামূলক ও অন্যটি ঐচ্ছিক বিষয় । ঝিঙের প্রিয় ঐচ্ছিক বিষয়, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ।
জুন মাসের ২৮ তারিখে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা । পরীক্ষা ভালই দিলো ।
কিন্তু রেজাল্ট বের হলে দেখা গেলো, পাশের তালিকায় ঝিঙের নাম নেই । ঝিঙে তখন বুঝতে পারলো, তাকে আরও খাটতে হবে । তাই এম-এ ফাইনাল দেওয়ার পরে একটা বছর সে আদাজল খেয়ে খাটলো । সঙ্গে ভাল প্রতিষ্ঠানের পোস্টাল কোচিং । সেইজন্য একটা বছর ঝিঙে কোনো চাকরির পরীক্ষায় বসলো না । ইতিমধ্যে স্টেশন বাজারে স্কুলের অঙ্কের স্যারের সঙ্গে দেখা । ঝিঙের অনুরোধে তিনি ঝিঙেদের বাড়িতে ঢুকলেন । ঝিঙের মুখে তার আই-এ-এস প্রস্তুতির কথা শুনে যারপরনাই আনন্দিত হলেন । তাঁর বক্তব্য, সাহস করে কেউ সর্বভারতীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় বসতে চায় না । অথচ অনেকের মধ্যে পাশ করার ক্ষমতা রয়েছে । সেখানে দাঁড়িয়ে ঝিঙের প্রয়াস অবলোকন করে অঙ্কের মাস্টার মশাই আশীর্বাদ করে বললেন, “তুমি চেষ্টা চালিয়ে যাও । ইতিবাচক ফল মিলবেই ।“ আর একটা কথা, “ধৈর্য হারাবে না । চেষ্টা চালিয়ে গেলে অবধারিতভাবে তোমার জয় হবেই ।“ তা ছাড়া তিনি ঝিঙেকে তৈরী হওয়ার জন্য অনেকগুলি টিপস দিলেন । যেগুলি পরীক্ষার ক্ষেত্রে ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক ।
অঙ্কের মাস্টার মশাইয়ের পরামর্শ পেয়ে ঝিঙে ভীষণ উৎসাহিত । এতদিন পর স্যার তাকে সঠিক পথ বাতলেছেন । তিনি ঝিঙেকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, “মেন পরীক্ষার বাধত্যমূলক অঙ্কের বিষয়ে তিনি ঝিঙেকে সমস্তরকম সহযোগিতা করবেন । তিনি সাধারণ জ্ঞানের কয়েকটি বই তাঁর বাড়ি থেকে সংগ্রহ করতে বললেন । তিনি এটাও কথা দিলেন, একদিন তাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে কলকাতার কলেজ স্ট্রিট মার্কেট থেকে কিছু বই কিনে দেবেন । প্রস্তুতির প্রেক্ষাপটে এটা ঝিঙের কাছে অতিরিক্ত পাওনা ।
পরের বছর প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় পাশ করলো । মেন পরীক্ষা সেপ্টেম্বরের শেষে । তিন মাস সময় হাতে । ঝিঙে ইতিমধ্যে অঙ্কের স্যারের সাথে কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে বেশ কয়েকটা লাইব্রেরী ঘুরে প্রয়োজনীয় বইগুলি সংগ্রহ করে এনেছে । চাকরির পরীক্ষা দিয়ে, ঝিঙের অভিজ্ঞতায় সে পরিষ্কার বুঝতে পারছে অ্যাকাডেমিক লাইন থেকে প্রতিযোগিতার লাইন অনেক তফাৎ এবং এখানে পাশ করা ভীষণ কষ্টসাধ্য । যাই হোক ঝিঙে মেন পরীক্ষার প্রস্তুতি শুরু করলো ।
হঠাৎ রূপক এম-এ পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়ে হাজির । এম-এ পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে । ঝিঙের রেজাল্টের খুশীতে রূপক অনেক মিষ্টি নিয়ে উপস্থিত । কিন্তু ঝিঙের এম-এ রেজাল্ট পেয়ে কোনো উচ্ছ্বাস নেই । তার মাথায় ঘুরছে আই-এ-এস পরীক্ষা । রূপকের সাথেও খোলামেলা আলাপ জমালো না । রূপকের আনা দুটি রসগোল্লা খেয়ে আবার পড়ার মধ্যে ডুবে গেলো ।
অক্টোবরের তিন তারিখ থেকে মেন পরীক্ষা শুরু । ইংরেজির ফার্স্ট পেপার ঝিঙের ভাল হল না । মন খারাপ । অঙ্কের স্যার প্রত্যেকদিন খোঁজ নিচ্ছেন । ঝিঙের মন খারাপের প্রেক্ষাপটে অঙ্কের স্যার বললেন, “এতে ঘাবড়িয়ো না ঝিঙে । একটি বিষয়ে কম নম্বর পেলেও তাতে দুঃখ নেই । কেননা সব বিষয়ের মার্ক একত্রিত হয়ে মেরিট লিস্ট তৈরী হয় । তুমি বরং পরের পরীক্ষাগুলির উপর নজর দাও ।“ অঙ্কের স্যারের কথায় ঝিঙে অনেকটাই চাঙ্গা !
কম্পালসরি সাবজেক্টগুলির মধ্যে অঙ্ক খুব ভাল দিলো । ঐচ্ছিক বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে ঝিঙে খুশী । মেন লিখিত পরীক্ষা দিয়ে ঝিঙের বিশ্বাস, সে মৌখিকে ডাক পাবে । পটল বোনকে খুব উৎসাহ দিয়ে চললো । পটল বোনকে বোঝাচ্ছে, “তুই যেভাবে লেগে রয়েছিস, তাতে তোর রেজাল্ট ইতিবাচক হবেই । আমার কথা মিলিয়ে নিস ।“
পটলের ভবিষ্যতবাণী ফলে গেলো । ঝিঙে মেন পরীক্ষায় পাশ করলো । তবে মার্কের স্কোর কম । অঙ্কের স্যারের কথায়, “এর পরে মৌখিক পরীক্ষা । সুতরাং ঘাবড়াবার কারণ নেই ।“
মৌখিক পরীক্ষা কলকাতায় । কলকাতা যাওয়ার আগে জানতে পারলো, রূপক ব্যাঙ্ক আধিকারিকের চাকরি পেয়েছে । পোস্টিং পাটনা । খুব শীঘ্র পাটনা চলে যাবে । কিন্তু রূপকের বাবার ইচ্ছা, ছেলে বাড়িতে থেকে ব্যবসা করুক । কিন্তু রূপকের জেদ, সে চাকরি করবে ।
কলকাতা যাওয়ার আগের সন্ধ্যাবেলায় রূপক ঝিঙেদের বাড়ি উপস্থিত । রূপককে দেখতে পেয়ে পটল বলল, “আজ রাত্রিতে গরীবের বাড়িতে খেয়ে যেতে হবে ।“
রূপক উত্তরে জানালো, “পরে একদিন খেয়ে যাবে ।“
“আজ কোনো অজুহাত শুনবো না । রাত্রির খাবার খেয়ে তবেই তোমাকে ছাড়া হবে ।“ চাপ দিলো পটল ।
অগত্যা খেতে বাধ্য হল ।
বাড়ি ফেরার সময় রূপক ঝিঙেকে বলল, “আমার ব্যাঙ্কের চাকরি বাড়ির সকলের অপছন্দ ! আমি চাকরিতে যাই, বাড়ির সকলে অনিচ্ছুক । বাড়ির সকলের ইচ্ছা, আমি বাড়িতে বসে ব্যবসা করি ।“
বাড়ির মত জেনে গেছো । এবার তোমার নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পালা ।
তারপর ঝিঙে কলকাতা পৌঁছালো । মৌখিক পরীক্ষা সকাল দশটা থেকে । তার অনেক আগেই ঝিঙে ইন্টারভিউ সেন্টারে রিপোর্টিং করলো । সেদিনের মেরিট লিস্টে তার পাঁচ নম্বরে নাম ।
ইন্টারভিউ ভাল দিলো ।
কিন্তু …………………?
 (চলবে )