সাঁঝ আকাশে সন্ধ্যা নেই : সুভাষ চন্দ্র দাশ।

0
703

মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টা বেজে ৩০ মিনিটে এ চলে গেলেন বাংলার প্রবাদপ্রতিম সঙ্গীতশিল্পী ‘গীতশ্রী’ সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯০ বছর। দীর্ঘদিন বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভুগছিলেন তিনি। ফুসফুসে সংক্রমণ নিয়ে গত ২৭ জানুয়ারি এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন গীতশ্রী। রক্তচাপ ওঠা নামা করার পাশাপাশি হার্ট ফেলিওর ছিল। এরপর কোভিডে আক্রান্ত হওয়ায় তাঁকে স্থানান্তিরত করা হয় বাইপাসের ধারে একটি বেসরকারি হাসপাতালে। কিছুদিনের মধ্যেই কোভিডমুক্ত হন তিনি। কোমরের ভাঙা হাড়ের অস্ত্রোপচার হয় গত ১১ ফেব্রুয়ারি।
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় কলকাতার ঢাকুরিয়াতে ৪ অক্টোবর ১৯৩১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এবং মাতা হেমপ্রভা দেবীর ছয় সন্তানের মধ্যে তিনি কনিষ্ঠতম ছিলেন। তার পিতামহ একজন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন এবং পরিবারটি ১৯১১ সাল থেকে ঢাকুরিয়াতে বসবাস করতেন।

পণ্ডিত সন্তোষ কুমার বসু, অধ্যাপক এ টি ক্যানন এবং অধ্যাপক চিন্ময় লাহিড়ীর কাছে তিনি সঙ্গীতের প্রশিক্ষণ নেন। তবে তাঁর গুরু ছিলেন উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খান, তাঁর পুত্র উস্তাদ মুনাওয়ার আলী খান। যাঁর অধীনে তিনি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত আয়ত্ত করেছিলেন। মনোরমা শর্মা অনুসারে, ” নেপথ্য গানের উজ্জ্বল গৌরব অর্জনের পরেও একজন শাস্ত্রীয় গায়ক হিসাবে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় তাঁর জনপ্রিয়তা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছেন।”
যদিও তিনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে প্রশিক্ষিত, তবুও তাঁর বেশিরভাগ কাজ বাংলা আধুনিক গানে। ১৯৫০ সালে তারানা চলচ্চিত্রে একটি গান দিয়ে তিনি মুম্বাইতে হিন্দি গান গাওয়া শুরু করেন। তিনি ১৭টি হিন্দি চলচ্চিত্রে নেপথ্য গায়িকা হিসেবে গান গেয়েছিলেন। ব্যক্তিগত কারণে ১৯৫২ সালে তিনি তাঁর কলকাতা শহরের বাড়িতে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৬৬ সালে তিনি বাঙালি কবি শ্যামল গুপ্তকে বিয়ে করেন। শ্যামল গুপ্ত তাঁর অনেক গানের জন্য কথা লিখে দিয়েছিলেন।
তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় জুটি ছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।যাঁর সাথে প্রাথমিকভাবে বাঙালি চলচ্চিত্রগুলির জন্য নেপথ্য গায়িকা হিসাবে তিনি বেশ কয়েকটি গান গেয়েছিলেন। হেমন্ত ও সন্ধ্যা বাংলার মহানায়ক উত্তম কুমার এবং তাঁর অসংখ্য নায়িকা জোড়াগুলির নেপথ্য কণ্ঠস্বর হিসাবে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন তিনি। বিশেষত অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের কণ্ঠে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের রচনা ছাড়াও রবিন চট্টোপাধ্যায় ও নচিকেতা ঘোষের সঙ্গে তিনি অনেক কাজ করেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন, যুদ্ধের হাত থেকে বাঁচতে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গে আগত লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুদের জন্য তিনি ভারতীয় বাঙালি শিল্পীদের সঙ্গে গণ আন্দোলনে যোগ দেন এবং তাদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন। বাংলাদেশের জন্য বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করেন। তিনি বাংলাদেশের সংগীতশিল্পী সমর দাস যিনি বাংলাদেশে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন তাঁর সাহায্যার্থে বিভিন্ন দেশাত্মবোধক গান রেকর্ড করেন। কারাগারে বন্দি নতুন বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির উপলক্ষে তাঁর গাওয়া ‘বঙ্গবন্ধু তুমি ফিরে এলে’ গানটি মুক্তি পায় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর। প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারির উদ্‌যাপন উপলক্ষে ঢাকায় পল্টন ময়দানের একটি উন্মুক্ত কনসার্টে অনুষ্ঠান করার তিনি অন্যতম প্রথম বিদেশি শিল্পী।

১৯৭১ সালে ‘জয় জয়ন্তী’ এবং ‘নিশিপদ্ম’ ছবিতে গান গেয়ে শ্রেষ্ঠ গায়িকা হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। গান দুটি হল – আমাদের ছুটি ছুটি এবং ওরে সকল সোনা মলিন হল। এছাড়াও ২০১১ সালে ভারত সরকার তাঁকে ‘বঙ্গবিভূষণ’ উপাধিতে সম্মানিত করে। ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে পদ্মশ্রী পুরস্কারপ্রাপ্ত হিসেবে তার নাম ঘোষণা করা হয়। তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।