কিন্তু অল্পের জন্য ঝিঙে সিলেক্টেড হল না । আই-এ-এস পরীক্ষার পাশের চূড়ান্ত তালিকায় তার নাম নেই । আবার একটা বছরের অপেক্ষা । ঘাবড়ালো না ঝিঙে । পরের বার বসার জন্য ঝিঙে মানসিকভাবে প্রস্তুত ।
ঝিঙে বুঝতে পারলো, ইন্টারভিউয়ের সময় তাকে আরও স্মার্ট হতে হবে । সে একটা অতি সাধারণ পরিবারের মেয়ে । লড়াই করে তার বড় হওয়া । জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপে তার নানান বাধাবিঘ্ন । সামাজিকভাবে আজও অবহেলিত । সেভাবে তাদের সামাজিক মর্যাদা নেই । দাদা ব্যবসাটা গুছিয়ে করার জন্য এখন অনেকটা আর্থিক দিক দিয়ে স্বচ্ছল । তবুও ভিখারীর ন্যায় প্লাটফর্মে রাত কাটানোর মানুষদের আপন ভাবতে এখনও সমাজের মানুষের অনীহা । তা ছাড়া ঝিঙেদের পরিবার বলতে উল্লেখযোগ্য কিছু নেই । যার উপর ভিত্তি করে সে বলতে পারতো, তাদের পরিবার শিক্ষিত ও বনেদি পরিবার । সুতরাং সেখানেও তারা অনেক পিছিয়ে । আদব-কায়দা, কেতাবি চলন, চলনবলন শিখবে কোথা থেকে ?
এক বছর ড্রপ দিয়ে ভালভাবে তৈরী হয়েছিলো ঝিঙে । প্রস্তুতিতে তার ঢিলেমি মোটেই ছিলো না । তাই আই-এ-এসের তিনটি ধাপ এগিয়ে ঝিঙে আশা করেছিলো, তার কপালে অন্তত এবার শিকে ছিঁড়বে । কিন্তু তার আশার সে গুড়ে বালি !
হতাশ না হয়ে ঝিঙে আবার নতুন উদ্যমে উঠে দাঁড়াতে চাইছে ! কীভাবে আই-এ-এসের বৈতরণী পার হওয়া যায় ? ঝিঙের প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস, প্রিলিমিনারি ও মেন পরীক্ষায় তাকে আটকানো কঠিন । পাশ করবেই । এই মুহূর্তে তার সমস্যা, মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে । স্কুলের অঙ্কের স্যার এসেছিলেন । তিনি পরামর্শ দিয়েছেন, ভাল একটা কোচিং ইন্সটিটিউশনে ভর্তি হতে । মৌখিক পরীক্ষার বিভিন্ন আদব-কায়দা-কানুন শিখে নিতে । সে যেটা বুঝেছে,মৌখিক পরীক্ষায় স্মার্টনেসের সাথে সাথে ইন্টারভিউ বোর্ডে বসে উত্তর দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রচণ্ড সতর্ক থাকতে হবে । উত্তরটা “টু দা পয়েন্ট” হওয়া চাই । সেখানে অতিরিক্ত কিছু সংযোজন করা চলবে না ।
ভর্তি হল নামজাদা একটি কোচিং সেন্টারে । সেখানে বড়লোক মানুষের সন্তানদের আনাগোনা লক্ষণীয় । বেশীর ভাগ ছাত্র ছাত্রী স্পোকেন ইংলিশ শিখতে তাদের কোচিং সেন্টারে আগমন । গুটি কয়েক ছেলে মেয়ে ইন্টারভিউতে তৈরী হওয়ার জন্য কোচিং ইন্সটিটিউশনে ভর্তি । সপ্তাহে দুদিন ক্লাস । ঝিঙেদের ক্লাস শুরু হল । ঝিঙে কোচিং ক্লাসে ভীষণ মনোযোগী ।
বোনের পড়াশুনার জন্য পটল জলের মতো পয়সা খরচ করে যাচ্ছে । খরচার ক্ষেত্রে পটলের এতটুকু কার্পণ্য নেই । তবে কোচিং সেন্টারে ভর্তি হওয়া এবং পড়াশুনা চালানোতে খরচাটা বহন করা পটলের ক্ষেত্রে একটু বেশী । যার জন্য বোনের পড়াশুনার খরচা চালানোর ক্ষেত্রে পটলের আয়ের নিরিখে কষ্টসাধ্য বটে । তবুও বোনকে পটল অনবরত উৎসাহ দিচ্ছে, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে ।
বৃহস্পতিবার ঘুম থেকে উঠে ঝিঙে সকাল সকাল স্নান সারলো । তারপর ঠাকুরের পুজো দিয়ে সোজা রান্না ঘরে । বোনকে রান্না ঘরে ঢুকতে দেখে পটল অবাক ! কৌতুহল ধরে রাখতে না পেরে পটল বোনকে জিজ্ঞাসা করলো, “তুই এত সকাল সকাল রান্না করে কেন ?”
আজ সকাল ন’টা থেকে ক্লাস । উপর মহল থেকে একজন নামী অফিসার সাহেব আসবেন । তিনি আজ আমাদের ইন্টারভিউ নেবেন । সেই জন্য কোচিং স্কুল থেকে মোবাইলে ফোন করে আমাদের জানিয়ে দিয়েছে সকালে হাজিরা দিতে । ঠিক সময়ে হাজিরা দেওয়া নাকি নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে পড়ে । তাই সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে রান্না ঘরে ঢুকলাম ।
এমন সময় দোকানের খরিদ্দারেরা পটলকে ডাকতে শুরু করলো । পাঠকপাড়ার পচাঁদা মসুরির ডাল নেবে । তাঁর বক্তব্য, ডাল নিয়ে বাড়ি ফিরলে তাঁর গিন্নি কড়াইতে ডাল চাপাবে । সেই ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে তাঁর বড় ছেলে কারখানার কাজে বের হবে । সুতরাং তাঁর তাড়া আছে । কপালী কাকীমা সর্ষের তেল নেবেন । তাই তিনি দোকানে আসার পর পটলকে অনবরত ডেকে যাচ্ছেন । সেই তেল নিয়ে বাড়ি ফিরলে কাকু সর্ষের তেল মেখে পুকুরে স্নানে যাবেন । মোট জনা দশেক খরিদ্দার পটলের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে । অন্যদিকে তিন্নির বাবা এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে ট্রেন ধরবেন । বিভিন্ন খরিদ্দারদের বিভিন্ন রকম জিনিস কেনার লাইন !
অগত্যা পটলকে দোকানে ঢুকতে হল । শুধু ঝিঙেকে বলে এলো, “তুই খেয়ে বেরিয়ে যাস্ । কোনো কারণে ফিরতে দেরী হলে অবশ্যই জানিয়ে দিবি ।“
খরিদ্দারের ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ কুন্তীকে দেখে পটল ভ্যাবাচ্যাকা । কুন্তী নিশ্চয় তাকে অনেক অপ্রিয় কথা শোনাতে এসেছে !
কপালী কাকীমা কুন্তীর দিকে আড় চোখে তাকিয়ে বললেন, “সামনে ঠ্যাঁটার মতো দাঁড়িয়ে রয়েছো কেন বাছা ! সরে দাঁড়াও ! আর তা ছাড়া তোমাকে এই চত্বরে আগে কখনও দেখিনি ! কোথায় ঘর বাছা ! ঐভাবে পটলের দিকে হ্যাংলার মতো তাকিয়ে রয়েছো কেন ? তোমার মতলবটা কী শুনি ?”
“সর্ষের তেল কিনতে এসেছেন, সুতরাং তেল নিয়ে বাড়ি ফিরে যান । অহেতুক আমাকে বিরক্ত করছেন কেন ?” বেশ ঝাঁঝালো সুরে কুন্তী দু-কথা কাকীমাকে শুনিয়ে দিলো ।
“আ ! মরণ ! বলি, চ্যাটাং চ্যাটাং কথার বলিহারি কেন ? তুমি কোথাকার সুন্দরী, আমাকে কথা শোনাচ্ছো ।“ কাকীমাও রাগের সুরে বাঁকা চোখে কথাগুলি বললেন ।
ঠিক সেই মুহূর্তে পটল এক লিটারের সর্ষের তেলের প্যাকেট কপালী কাকীমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “কাকীমা একশ কুড়ি টাকা ?”
“তেলের দাম কী আবার পাঁচ টাকা বাড়লো পটল ? গত সপ্তাহের আগের সপ্তাহে একশ পনের টাকায় নিয়ে গেছিলাম ।“ কপালী কাকীমা এবার পটলের দিকে তাকিয়ে দাম নিয়ে তাঁর উষ্মা প্রকাশ করলেন ।
কাকীমা, তেলের দাম ‘হু হু’ করে বাড়ছে । শুনছি, আবার পাঁচ টাকা বাড়াবে । এইভাবে দাম বাড়ালে আমাদের মতো ছোট ব্যবসায়ীদের খুব অসুবিধা । খরিদ্দারদের বোঝাতেই দিন শেষ !
পটলের কথায় কাকীমার কোনো হেলদোল নেই । তিনি নিজের মতো আবার বললেন, “এভাবে দাম বাড়ালে শহর থেকে তেল কিনতে হবে !”
কাকীমা চলে গেলেন । তারপর সমস্ত খরিদ্দারদের ফাইফরমাস মিটিয়ে কুন্তির দিকে তাকিয়ে পটল জিজ্ঞাসা করলো, “আপনি হঠাৎ ?”
কুন্তীর সেই মায়াবী হাসি ! কিন্তু মুখে কোনো কথা নেই ।
সেই সময়ে স্টেশনের চাপরাশি কৃপাল সিংহ পটলের দোকানে এসে হাজির । তিনি ফরমাস করলো, “বেটা, এক কাপ চা খাওয়াও ?” চা খেতে চেয়ে কৃপাল সিংহ পায়ের উপর পা তুলে আরাম করে বসলো । কুন্তী অবাক দৃষ্টিতে পটলের দিকে তাকিয়ে !
কৃপাল সিংহের সামনে পটল কুন্তীর সঙ্গে কথা বলতে আড়ষ্ঠতাবোধ করলো । অথচ কুন্তীকে ফিরিয়ে দিতেও অনীহা ! কৃপাল সিংহ কুন্তীর দিকে তাকিয়ে বললো, “বেটা, ঐ বিটিয়া কী কিনতে এসেছে তাকে আগে দাও । তারপর আমাকে চা বানিয়ে দিলেই হবে । আমার তাড়া নেই । পরের ট্রেন স্টেশনে ঢুকতে এখনও অনেক দেরী । সুতরাং তোমার হাতের চা আরাম করে খেয়ে তবেই দোকান থেকে উঠবো ।“
তারপর এদিক-সেদিক তাকিয়ে পটলকে জিজ্ঞাসা করলো, “বহিনকে দেখছি না কেন ?”
বোন কলেজে গেছে ।
আজ রবিবার । কলেজ তো নেই । তা ছাড়া বহিন তো এম-এ পাশ করে গেছে । এখন কলেজ থাকার কথা নয় !
আপনাকে বলা হয়নি, বোনটা কোচিং স্কুলে ভর্তি হয়েছে । চাকরির মৌখিক পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্যে । জানেন তো, একটুর জন্য আই-এ-এস পরীক্ষায় ঝিঙে পাশ করতে পারলো না । সেই জন্য এবছর সবরকম প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষায় বসতে চাইছে ঝিঙে । তার জন্য কোচিং স্কুলে ভর্তি হওয়া ।
ঠিক আছে বেটা ।
মাটির ভাঁড়ে চা এগিয়ে দিয়ে কৃপাল সিংহকে বলল, “আশীর্বাদ করবেন যেনো তার মনোবাঞ্ছা পূরণ হয় ।“
মুখে কোনো কথা না বলে কুন্তী এক ঝলক হাসি দিয়ে বিদায় নিলো । তবে যাবার সময় চোখের ইশারায় বোঝাতে চাইলো সে পুনরায় আসবে ।
কুন্তীর সঙ্গে কথা বলতে না পারার জন্য পটলের মনটা খারাপ । কুন্তীর সঙ্গে সাক্ষাৎ, অথচ তার মনের লুকানো দুই একটা কথা বলতে পারলো না । কুন্তীকে দেখলে পটলের মনে হয় সে তার অনেক দিনের চেনা । একান্ত আপনজন ! তাকে দেখলে পটলের চোখে মুখে খুশীর বাতাবরণ ! হৃদমাঝারে অফুরন্ত আনন্দোচ্ছ্বাস ! ভাললাগার এক অবর্ণনীয় অনুভূতি !
অন্যদিকে কুন্তী চিন্তার সাগরে হাবুডুবু । পটলকে তার ভীষণ মনে ধরেছে । কর্মঠ ছেলে । তার চলমান জীবনে আলসেমির স্থান নেই । পটলের একটাই বোন । বোনটার বিয়ে হলে সে একজন মুক্ত পুরুষ ! চালু ব্যবসা । এহেন ছেলেকে পটাতে পারলে তার কেল্লা ফতে । সারা জীবন পায়ের উপর পা তুলে খাওয়া । আগের স্বামীটা ছিলো নোংরা স্বভাবের । মদ জুয়া তার নিত্য জীবনের অঙ্গ । তার উপর সন্নাসীপাড়ার বিধবার বেলেল্লাপনার জন্য স্বামীটা উচ্ছন্নে গিয়েছিলো । তার সঙ্গে আর একদিনও ঘর করা কুন্তীর পক্ষে সম্ভব হচ্ছিলো না । তাই কোর্টে গিয়ে ডিভোর্স পেপারে সই করে সোজা তার মাসির বাড়ি ! মাসির বাড়ি তালডাঙ্গায় । মাসী এখনও জানেন না, কুন্তী ডিভোর্সী । কুন্তীর সঙ্গে স্বামীর সম্পর্ক ছিন্ন !
কিন্তু মাসির বাড়ি এসে পটলকে দেখে কুন্তী আবার অনেক চাঙ্গা ! তার মরা গাঙে জোয়ার আসার মতো । পটলকে দেখার পর কুন্তীর স্বপ্ন দেখা শুরু । পটলকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন । ঘর সংসার করার স্বপ্ন !
কুন্তী দুপুরের খাওয়ার পর ভাবলো, পটলের বোন আজ কলেজে । সুতরাং পটল বাড়িতে একা । এখন পুনরায় পটলের দোকানে গেলে তার সঙ্গে দুদণ্ড বসে কথা বলা যাবে । তার মনের কথা খুলে বলার সুযোগ পেলেও পেতে পারে । যেই ভাবনা, সেই কাজ । মাসতুতো বোনের সাইকেল নিয়ে সোজা পটলের দোকানে । পটল তখন ভাত খেতে ঘরের ভিতরে ।
কুন্তী দোকানে ঢুকে হাঁক দিলো, “পটলদা, আপনি কোথায় ?”
“আমি খেতে বসেছি । খেয়ে দোকানে ঢুকছি ।“ খাওয়া অবস্থায় পটল উত্তর দিলো । কিন্তু বুঝতে পারলো না, কুন্তী তার জন্য অপেক্ষা করছে ।
ভাত খাওয়ার পর অভ্যাসবশত পটল খাটের উপর বসলো । তারপর সোজা বিছানায় গা এলিয়ে দিলো । শুয়ে শুয়ে বোনটার কথা ভাবছে । বেচারা দুপুরে কিছু খেলো কিনা ? বাড়িতে কখন ফিরবে ? বোনকে নিয়ে নানান চিন্তা তাকে গ্রাস করলো !
পটলকে দোকানে ঢুকতে না দেখে কুন্তী আবার ডাকলো, “পটলদা, দোকানে আসুন । খরিদ্দার দাঁড়িয়ে আছে । ভাত খেতে কতক্ষণ লাগে ?”
পটল এবার গলাটা চিনতে পারলো । নিজের মুখেই আওয়াজ করলো, “এটা অবধারিত কুন্তীর গলা । অর্থাৎ কুন্তী দোকানে তার অপেক্ষায় ?“
চটজলদি বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে ওঠে পটল । তারপর দাঁতটা ব্রাস । পটলের বরাবর অভ্যাস, খাওয়ার পর দাঁত ব্রাস করা । দাঁত ব্রাস করে যখন দোকান ঘরে ঢুকলো, জনা আটেক খরিদ্দার তখন ভিড় করে দোকানে দাঁড়িয়ে । কুন্তী এক কোনে বসে খবরের কাগজ পড়ায় মগ্ন । ঠিক সেই মুহুর্তে ঝিঙে বাড়িতে ফিরলো । দাদার কাছে এসে কানে ফিসফিস করে বললো, “দাদা, ফিসফ্রাই এনেছি । তুমি ভাল খাও । দোকানে কাজ হাল্কা হলে ভিতরে এসো, একসঙ্গে ফিসফ্রাই খাবো ।“
কুন্তী বুঝতে পারলো পটলের আজ নিভৃতে বসে তার সঙ্গে গল্প করার সময় বা সুযোগ কোনোটাই নেই । একদিকে তার আদরের বোন বাড়িতে হাজির । অন্যদিকে দোকানে ক্রমাগত খরিদ্দারদের ভিড় । সুতরাং তার কথা বলার ইচ্ছার জলাঞ্জলি ! অগত্যা পটলের কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, “আজ আমি আসি । পরে আবার আসবো ।“ তারপর তার চিরাচরিত এক ঝলক মুচকি হাসি ! রাস্তায় দাঁড়িয়ে কুন্তী তার অভাগা কপালের কথা ভাবছে । আজও পটলের সঙ্গে নিরালায় বসে দুটি কথা বলার প্রয়াস সফল হল না । সুতরাং পটলের সঙ্গে তার দেখা করার আন্তরিক প্রয়াস ব্যর্থ ! তাই ব্যর্থ মনোরথ হয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলো । কুন্তী ফিরে যাওয়ায় পটলেরও খুব আপশোশ । আজও কুন্তীর সাথে দু-দণ্ড কথা বলতে পারলো না । আজ পর্যন্ত সে কুন্তীকে ভালভাবে জানতেই পারলো না । শত চেষ্টা করেও কুন্তীর বাড়ি ঘর, নিজের পরিচয় সে জানতে পারেনি । জিজ্ঞাসা করলেই, কুন্তী বুদ্ধিদীপ্তভাবে উত্তরটা এড়িয়ে গেছে । সেই সময় সে অন্য প্রসঙ্গে ঢুকে যেতো । তবে পটল যেটা বুঝেছে, তাকে কুন্তীর ভাল লাগে । ভাল লাগা থেকেই তার প্রতিনিয়ত দোকানে আসা । অথচ পটল একদিন দোকান বন্ধ রেখে কুন্তীর সঙ্গে বেড়ানোর পরিকল্পনা করতে পারছে না । কেননা বোনের যতক্ষণ চাকরি ও বিয়ে না হচ্ছে, ততক্ষণ সে কোনো মেয়ের সাথে নিজেকে জড়াতে চাইছে না । তার ধারণা, তাতে ভবিষ্যতে উভইয়ের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটতে পারে !
“দাদা, একটি বারের জন্য ঘরে আয় । আমি ফিসফ্রাই গরম করেছি । দেরী করলে ঠাণ্ডা হয়ে যাবে ।“ বোনের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে ঝটপট ঘরে ঢুকলো । তখনও দোকানে খরিদ্দার দাঁড়ানো । সে জানে, বোনের ডাকে সত্বর না গেলে বোন তাকে উলট-পালট বকাঝকা করবে । তাই ঘরের ভিতর ঢুকে গরম গরম ফিসফ্রাই খেয়ে দোকানে পুনরায় ঢুকলো ।
তাদের “দাদা-বোন”এর মধুর সম্পর্ক সম্বন্ধে দোকানের খরিদ্দারেরা কমবেশী অবগত । যার জন্য পটলের এহেন টুকিটাকি ব্যাপারে খরিদ্দারেরা উতলা হন না । বরং ধৈর্যের পরিচয় দেন । পটলের মিষ্টি ব্যবহারের কারণেই খরিদ্দারেরা ধৈর্যশীল !
পরেরদিন কুন্তী আবার এসে হাজির । তখনও দোকানে খরিদ্দারদের ভিড় । ভিড় সামলাবার জন্য ঝিঙে দাদার সঙ্গে হাত লাগিয়েছে । খরিদ্দারদের বায়নার শেষ নেই । সবচেয়ে ট্রেনের সময় হলে দোকানের ভিড় প্রচণ্ড বাড়ে । সেটা জানে বলেই ঝিঙে ছুটে দাদার পাশে এসে দাঁড়ায় । দুজনে খরিদ্দার সামলাতে ব্যস্ত । অদূরে কুন্তীকে দেখতে পেয়ে ঝিঙে অবাক ! তরুণি ফ্যাল ফ্যাল করে দাদার দিকে তাকিয়ে রয়েছে । সাধারণ খরিদ্দার হলে দূরে দাঁড়িয়ে দাদার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকতো না । যুবতী এলাকার নয়, সে বিষয়ে ঝিঙে নিশ্চিত । চেহারা আহামরী কিছু না । কিন্তু ঘষা মাজার জন্য চেহারায় জেল্লা দিচ্ছে । তা ছাড়া চেহারায় যৌবনোচ্ছ্বটা অবর্ণনীয় ! তার সন্দেহজনক আচরণ দেখে ঝিঙে দাদাকে জিজ্ঞাসা করলো, “এই মেয়েটা রোজ রোজ দোকানে আসে কেন ? গতকালও দোকানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি । আজও দূরে দাঁড়িয়ে তোর দিকে তাকিয়ে । মনে হচ্ছে যবতী মেয়েটার অন্য কোনো মতলব আছে ?”
“ছাড় না ! কী নেবে জিজ্ঞাসা করে জিনিসটা ধরিয়ে দিয়ে বিদায় দে ।“ পটল বোনের কথায় এড়িয়ে গেলো ।
ঝিঙে কুন্তীকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলো, “আপনি কী নেবেন ?”
আমার একটু আপনার দাদার সঙ্গে দরকার ছিলো ?
দরকারটা নির্দ্বিধায় আমাকে বলতে পারেন ।
“দরকারটা দাদার সঙ্গে । তাই আজ আমি আসি । পরে একদিন দাদার সঙ্গে কথা বলে যাবো ।“ কুন্তী পালিয়ে ঝিঙের হাত থেকে বাঁচলো । এর পরে জেরা শুরু করলে তার হাল খারাপ হতে বাধ্য । মেয়েদের ষষ্ট ইন্দ্রিয় ভীষণ সজাগ । অচিরেই তার বিধবার ঘটনাটা জেনে ফেলবে । সেই ক্ষেত্রে তার হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা !
ঘুরে ঘুরে করুণ চোখে পটলের দিকে তাকাতে তাকাতে কুন্তী দোকান থেকে বিদায় নিলো । কুন্তীর তাকানোর দৃষ্টি দেখে ঝিঙের অনুমান, “ডালমে কুছ কালা হ্যায় ।“
( চলবে )