সুভাষ চন্দ্র দাশ,ক্যানিং – গঙ্গা, কুন্তি ও সরস্বতী’র সঙ্গমস্থল এর জন্য বিখ্যাত হুগলির ত্রিবেণী। তেমনই সুন্দরবনের প্রত্যন্ত উত্তর চুনাখালি গ্রামের রক্ষাকর্তা তিনদেবী মনসা,শীতলা ও রক্ষাকালী। আনুমানিক প্রায় ১৫০ বছর আগেই জঙ্গল পরিষ্কার করে মানবজাতি বসবাস করার সময় ব্যাপক ভাবে কঠিন পরিস্থিতির সম্মূখীন হতে হয়েছিল সুন্দরবন এলাকার বাসন্তীর উত্তর চুনাখালির মন্ডল পাড়ার কয়েক হাজার পরিবার কে। সুন্দরবনের বিদ্যাধরী নদী সংলগ্ন এই এলাকা পরিষ্কার জনবসতী গড়ে উঠেছিল ।সঠিক চিকিৎসা পরিষেবা না থাকায় তৎকালীন সময়ে সাপের উপদ্রব,ভূত-পেত্নীর ভয়,হাম-বসন্ত আর কলেরার তান্ডবে প্রচুর মানুষের সলিল সমাধি ঘটেছিল।
ভয়ে আতঙ্কে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে গ্রামের মোড়ল-মাতব্বররা একত্রিত হয়। আলোচনা হয় গ্রাম কে মহামারীর হাত থেকে বাঁচাতে তিন গ্রাম্য দেবীর মূর্তি তৈরী করে পূজো-অর্চনা করা হবে।
সেই মতো গ্রামের একটি ফাঁকা এলাকা চিহ্নিত করা হয়। সেখানেই ত্রিকোণ পুকুর খনন করে তার পাড়ে তালপাতার ছাউনি দিয়ে তৈরী করা হয় মন্দির(কুঁড়ে ঘর)।
সাপের কামড় থেকে পরিত্রাণ পেতে মন্দির মনসা দেবী,হাম-বসন্ত-ওলাওঠা কিংবা কলেরা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য দেবী শীতলা এবং জঙ্গল দস্যু ও ভূতপেত্নীর উপদ্রবের হাত থেকে রক্ষাপেতে রক্ষাকালী প্রতিমা তালপাতার ছাউনির মাটির মন্দির রেখে গ্রামের মঙ্গল কামনায় শুরু হয় পুজো।বলা বাহুল্য গ্রাম থেকে সমস্ত ভয় লোপ পেতে শুরু করে।
এমন খবর এলাকা ছাড়িয়ে বিভিন্ন প্রান্তে চাউর হতেই জনপ্রিয়তা বাড়ে গ্রামে অধিষ্ঠিত ত্রিকোণ পুকুরপাড়ের তিন দেবী।সাধারণ মানুষ নিজেদের মঙ্গল কামনায় মানত করতে থাকেন। মানত পূরণ হওয়ায় সাধার মানুষের দানের টাকায় তালপাতা ছাউনির কুঁড়ে ঘর থেকে পাকা মন্দির তৈরী হয়। সেখানেও তিন দেবীর মহিমা অবিচল।ত্রিকোণ পুকুরের ন্যায় মন্দিরের তিনটি চূড়া ও তৈরী করা হয়েছে।প্রতিদিন পুজোর পাশাপাশি বছরে ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণ পক্ষের প্রথম মঙ্গলবার মহাধূমধাম করে তিন দেবীর পূজো অনুষ্ঠিত হয়।পূর্ব পূরুষের নিয়ম নীতি অনুযায়ী পূজোর দিন গ্রামের প্রতিটি পরিবারে অরন্ধন পালিত হয়। সর্পদেবী মনসার তুষ্ট করতে পূজো অনুষ্ঠিত হয় সকালে। হাম,বসন্ত,কলেরার নিরাময়ের জন্য শীতলা দেবীর পুজো হয় দুপুরে।ভূত-পেত্নী-দস্যুদের থেকে রক্ষা পেতে রাতেই তৈরী করা হয় রক্ষাকালী প্রতিমা। পূজো হয় মহাধূমধাম ভাবেই। যদিও সূর্যাস্তের আগেই গ্রাম সংলগ্ন বিদ্যাধরী নদীতে কালী প্রতিমা বিষর্জন করা হয়।
বছরে নির্দিষ্ট বাৎসরিক পূজোর সময় মানত শোধ করা কিংবা মানত করার জন্য ত্রিকোণ পুকুরে স্নান করে মন্দিরের চার পাশে গন্ডি দেন মহিলারা। পোড়ানো হয় ধুনো।এছাড়াও রক্ষাকালীকে সন্তুষ্ট করতে অনেকেই পাঁঠা বলি দিয়ে থাকেন।বাৎসরিক পূজো দেখতে ভীড় জমায় সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকার হাজার হাজার মানুষজন। এমনকি রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষজন আসেন পুজো দিতে এবং পূজো দেখতে।মন্দিরের নির্দিষ্ট কমিটি থাকলেও মন্দির পূজো পার্বণ অনুষ্ঠিত হয় ভক্তদের দান করা অর্থে।
মঙ্গলবার রাতে শতাব্দী প্রাচীন পুজোর আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন বিশিষ্ট সমাজসেবী বাপ্পাদিত্য নস্কর।
উপস্থিত ছিলেন সমাজসেবী দেবাশীষ বৈরাগী,জেলাপরিষদ সদস্যা নিলীমা মিস্ত্রী বিশাল,স্থানীয় পঞ্চায়েত উপ প্রধান নরেশ নস্কর,অরবিন্দু নস্কর, অমৃত সরকার,হরিপদ হালদার,সন্দীপ হালদার সহ অন্যান্যরা।
পূজো কমিটিরর কোষাধ্যক্ষ প্রদীপ হালদার জানিয়েছেন ‘মায়ের অপার মহিমা।কিভাবে এমন মন্দির গড়ে উঠেছে আমরা জানি না। বাপ-ঠাকুর্দার কাছে শোনা।সাধারণ ভক্তদের দানেই মন্দিরের পূজোপার্বন সহ সমস্ত রকম অনুষ্ঠান হয়।ত্রিবেণী সঙ্গমের মতো ত্রিকোণ পুকুর পাড়ে তিনটি চূড়া বিশিষ্ট তিন দেবীর মন্দির যা সুন্দরবনের বুকে বিরল দৃষ্টান্ত।