এর মধ্যে আর একটা উৎপাত পটলকে ভাবিয়ে তুললো । তাদের জায়গাটা রাস্তা ঘেঁষে । সরকারি নির্দেশ মোতাবেক রাস্তা চওড়া করার পরিকল্পনা । রামনগর ঘাট থেকে বহরমপুর পর্যন্ত চার লেন রাস্তা তৈরী করার তোড়জোড় পরিকল্পনা । চার লেন বাস্তবায়িত করার নিরিখে মাপজোখ হয়ে গেছে । তাতে পটলের পুরো বাড়িটা ভাঙ্গা পড়বে । জগাইয়ের ভাতের হোটেল থাকবে না । পটল জানতে পেরেছে, রাস্তা সম্প্রসারণের কাজ খুব শীঘ্র শুরু হবে ।
ইতিমধ্যে স্থানীয় ব্লক অফিস থেকে পটলকে জানিয়ে গেছে, “রাস্তা সম্প্রসারণ একটি সরকারি পরিকল্পনা । খুব শীঘ্র কাজ শুরু হবে । তবে তার আগে আপনার সাথে আপনার জায়গার দামের রফা নিয়ে আলাপ আলোচনা হবে এবং আপনি আপনার জমির বিনিময়ে সরকারি তরফ থেকে ভাল একটা গ্রান্ট পাবেন ।“
পটলের চিন্তা অন্য জায়গায় । তার ব্যবসার স্থিতি এখন অনেক বেশী আশাপ্রদ । ব্যবসাটা শক্ত হাতে ধরার জন্য পটলের দোকানে বেচা কেনা খুব সন্তোষজনক । যদিও লাভের অঙ্ক বেশী নয়, কিন্তু আশেপাশের মানুষের আন্তরিকতা ও ভালবাসা তাদের বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা ! আর তা ছাড়া পটলের এক মাত্র বোন পড়াশুনা করে সুন্দরভাবে জীবনযাপন করছে । বলা চলে, তার স্বাভাবিক জীবনযাপন । পটলের একটাই চিন্তা, জমির জন্য সরকারি তরফ থেকে টাকা পেলেও এই রকম রাস্তার ধারে চালু জায়গায় জমি পাবে কিনা সন্দেহ ! খুব সমস্যায় পড়ে গেলো পটল ।
দাদার মুখে সব ঘটনা শুনে, ঝিঙে উতলা হয়ে উঠলো । রাস্তা সম্প্রসারণের কথা কানাঘুষো সে শুনেছে ঠিকই, কিন্তু এত চটজলদি রাস্তা তৈরীর কাজ শুরু হবে ঝিঙে কস্মিন্কালেও ভাবেনি । দাদাকে সান্ত্বনা দিয়ে ঝিঙে বলল, “আমি চাকরি পেলে তুমি আমার সঙ্গে থাকবে । তোমাকে উপায়ের জন্য আর হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটতে হবে না ।“
সেটা বললে হবে কী করে বোন ?
কেন, তুমি একথা বলছো কেন ?
তোর বিয়ে হবে । তুই ঘর বাঁধবি !
তাতে কী দাদা ।
সেখানে আমি তোদের অতিরিক্ত বোঝা হয়ে দাঁড়াবো । আর তা ছাড়া তুই তো জানিস, আমি নিজের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে পছন্দ করি । সুতরাং ঐসব অবাস্তব চিন্তা মাথা থেকে দূরে হঠিয়ে পড়াশুনায় মন লাগা ! তোকে সর্বভারতীয় পরীক্ষায় পাশ করতে হবে । এই দিকটার ঝুটঝামেলা আমি সামলাচ্ছি ।
তারপর কিছুদিনের মধ্যে সরকারি তরফ থেকে জমির দামের রফার জন্য পটলের ডাক পড়লো । আলোচনার টেবিলে যোগদানের জন্য পটলের সঙ্গে জোর করে ঝিঙে দল বাঁধলো । ঝিঙের ধারণা, তার দাদা একজন সহজ সরল সাদামাটা মানুষ । সোজা সরল মানুষকে তার ন্যায্য দাবি থেকে বঞ্চিত করা সহজ ! সেখানে দামের রফার নামে গোটা কয়েক টাকা ছুড়ে দিয়ে তাদের কষ্টার্জিত জমি বাড়ি অধিগ্রহণ করে নিতে পারে । আর তা ছাড়া সরকারি অফিসের আশপাশ দিয়ে অনেক সুযোগ সন্ধানী উটকো মানুষের ঘোরাফেরা । রাজনৈতিক দলের কথা সে মুখ দিয়ে উচ্চারণ করলো না । সুতরাং ন্যায্য দাম থেকে দাদা বঞ্চিত হতে পারে ভেবে ঝিঙে সিদ্ধান্ত নিলো, আলোচনার টেবিলে দাদার সঙ্গে সে উপস্থিত থাকবে ।“
ঝিঙের অনুমান সঠিক । এক শ্রেণীর স্বার্থান্বেষী চক্র বি-ডি-ও অফিসের আশপাশ দিয়ে ঘুরঘুর করছে । তাদের ধান্দা অন্য, নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি । দালালি করে তাদের মোটা টাকা উপার্জন ।
তারপর স্বার্থান্বেষী চক্রের একজন মানুষ পটলকে বোঝাচ্ছে, “এলাকার হিতার্থে রাস্তাটা বড় হচ্ছে । মানুষের কল্যাণকর কাজে পটল সামিল হলে সবাই পটলকে বাহ্বা দেবে ।“
এই কথা শুনে মাঝখান থেকে ঝিঙে সরাসরি মানুষটাকে প্রশ্ন করলো, “আপনার এসব কথার মানে কী ?”
মানে পটলকে জমিটা বিনা শর্তে ছাড়তে হবে ।
এটা আপনাদের অবাঞ্ছিত মামদোবাজি । এক ধরনের জুলুমবাজি । এইসব জুলুমবাজি করে আমাদের ঘাবড়াতে পারবেন না ।
তুমি কী করবে ?
“কী করবো, সেটা যথা সময়ে বুঝতে পারবেন ।“ এই কথা বলে ঝিঙে সোজা বি-ডি-ও’র চেম্বারে । তখন বি-ডি-ও সাহেব বিশিষ্টজনদের সাথে কথাবার্তায় ব্যস্ত । অতর্কিতে ঝিঙেকে চেম্বারে ঢুকতে দেখে সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনার কী প্রয়োজন ? হঠাৎ চেম্বারে ঢুকলেন ?”
স্যার, আমাদের বাড়ি ভেঙ্গে আপনারা রাস্তা সম্প্রসারণ করছেন । অথচ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যাপারে আপনাদের গড়িমসি ?
সাহেব ঝিঙেকে বসতে বললেন । কিন্তু ঝিঙে না বসে দাঁড়িয়ে রইলো । তারপর বি-ডি-ও সাহেব রাস্তা সম্প্রসারণের দায়িত্বে থাকা আধিকারিককে ডাকলেন । আধিকারিক সাহেব ঝিঙের সাথে পটলকে দেখে চিনতে পারলেন । তিনি বললেন, “হ্যাঁ স্যার । পটলবাবুর চালু দোকান । সেটা ভাঙ্গা পড়ছে । আজ আমি আসতে বলেছি, সরকারের সাথে তাদের জায়গার দামদরের বিষয়ে আলাপ আলোচনার জন্যে ।“
তাহলে পটলবাবুর সাথে কথা শুরু করুন ।
ঝিঙে সঙ্গে সঙ্গে বি-ড-ও সাহেবকে বললো, “স্যার, আলোচনায় আপনাকে থাকতে হবে ।“
জমির দামের নেগোশিয়েশনের ব্যাপারে যিনি দেখভাল করছেন, তিনি আপনাদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করবেন । আপনি অযথা উতলা হবেন না ম্যাডাম ।
স্যার, বাইরে একশ্রেণীর দালাল ঘোরাঘুরি করছে । যাদের কাজ হল আমাদের মতো মানুষদের ঠকানো । সুতরাং আলোচনার টেবিলে আপনি হাজির থাকলে অযথা উটকো ঝামেলার সম্মুখীন হতে হবে না ।
আপনি অফিসারের সঙ্গে আলোচনা করুন । অসুবিধা হলে আমি অবশ্যই যাব ।
স্যার, আপনি আলোচনায় থাকছেন না তাই আমি বলে যাচ্ছি আমাদের জায়গার দাম বারো লাখ টাকা ! বাড়ি ও জায়গার দাম বারো লাখ টাকা দিতে হবে ।
বি-ডি-ও সাহেব ঝিঙের প্রতি তাকিয়ে বললেন, “আপনি বসুন ।“
ঝিঙে সাহেবের টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারে বসলো । এবার সাহেব ঝিঙেকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কী করেন ?”
আমি সরকারি চাকরির চেষ্টা করছি ।
সরকারি চাকরির বিজ্ঞাপন কোথায় ? বিজ্ঞাপন না থাকলে আপনি চেষ্টা করবেন কীভাবে ?
ঝিঙে বুঝতে পারলো সাহেব তাকে আন্ডারেস্টিমেট করছেন । তাই পরিষ্কারভাবে বললো, “স্যার, আমি সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় দুটো ধাপ পেরিয়ে মৌখিক পরীক্ষায় এবছর আটকে গেছি । আশা করছি আগামী বছর আমার নামের পাশে আই-এ-এস লেখা থাকবে !”
বি-ডি-ও সাহেব নড়েচড়ে বসলেন । ঝিঙেকে দেখে বোঝার উপায় নেই, তার মধ্যে এতটা প্রতিভা ! তিনি ঝিঙেকে শান্ত গলায় বললেন, “আমার শুভেচ্ছা রইলো, আপনি সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় পাশ করুন ।“ তারপর আবার ঝিঙের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনার দাদাকে ডাকুন । এখানে বসেই আপনাদের জায়গার দাম স্থির করতে চাই ।“ তারপর বি-ডি-ও সাহেব সংশ্লিষ্ট অফিসারকে পাশে বসিয়ে আলোচনা মোতাবেক ঝিঙেদের জমির দাম দশ লাখ টাকা সাব্যস্ত করলেন । তারপর ঝিঙে ও পটলের স্বাক্ষর নিলেন এবং সেই চুক্তিপত্রে বি-ড-ও সাহেব নিজে আলোচক হিসাবে সই করলেন । তারপর সাহেব পটলকে বুঝিয়ে বললেন, “আমাদের লোকজন শীঘ্র কাজ শুরু করবে ।“
ঝিঙে তখন প্রশ্ন করলো, “টাকা না পেলে আমরা কীভাবে অন্যত্র জায়গা কিনবো ?”
“কয়েকটা দিন আপনাদের মানিয়ে চলতে হবে । টাকা পেয়ে গেলে আপনারা নিজস্ব ঘর বাড়ি গড়ে তুলবেন ।“ বলেই সাহেব চেম্বার ছেড়ে চলে গেলেন ।
জায়গার দামের ফয়সালা হওয়ার পর এক মাস কেটে গেলো । কিন্তু টাকা পাওয়ার কোনো হদিস নেই । তারপর বৈশাখ মাসের ঠিক মাঝখানে সরকারি বুলডোজার হাজির । রাস্তা প্রশস্ত করার প্রেক্ষাপটে শুরু হল রাস্তার পার্শ্ববর্তী ঘর বাড়ির ভাঙাচোরা । সকলের সাথে সাথে পটলদের বাসস্থানও ভাঙ্গা পড়লো । পটলের এতদিনকার হাড়ভাঙ্গা খাটুনির দফারফা ! আবার তারা গৃহহীন ! অথচ চুক্তিমতো সরকারের তরফ থেকে এক পয়সা মিললো না । আশেপাশে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলো, যেহেতু সরকারি হস্তক্ষেপ সুতরাং টাকা আদায়ে জুতোর সুকতলা ক্ষয় হতে বাধ্য ।
বেচারা পটল ! ঝিঙে হতাশ ! দোকান ঘর ভেঙ্গে চুরমার ! ভাই-বোন পুনরায় আশ্রয় নিলো স্টেশনের প্লাটফর্মে । পটল প্লাটফর্মে পাউরুটি ও ঘুগনির দোকান দিলো এবং সঙ্গে চায়ের ব্যবস্থা ।
ঝিঙেদের খবর পেয়ে রূপক প্লাটফর্মে এসে হাজির । সে বেচারা চাকরি ছেড়ে দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে । নতুবা প্রত্যেকদিন বাড়ি থেকে টেলিফোন, “বাড়ি ফিরে আয় ।“ রূপক এখন বেলডাঙ্গায় একটা রেস্টুরেন্ট এবং আর একটা কাপড়ের দোকান খুলে চুটিয়ে ব্যবসা করছে । ঝিঙেদের অসহায়তার খবর পাওয়া মাত্র স্টেশনের প্লাটফর্মে হাজির । এবার ঝিঙের প্রতি চাপ, “তোমরা আমার সাথে আমাদের বাড়ি চলো । যতদিন নতুন বাড়ি নির্মাণ না হচ্ছে, ততদিন আমাদের বাড়ি থাকতে হবে ।“
বেঁকে বসলো পটল । তারা রূপকদের বাড়িতে বোঝা হয়ে থাকতে গররাজি । তাই রূপকের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলো ।
কিন্তু রূপক নাছোড়বান্দা ! ঝিঙের কোনো কথা শুনলো না । কেননা স্টেশনের প্লাটফর্মে যৌবন বয়সে ঝিঙের থাকাটা নিরাপদ নয় । তাই একরকম জোর করে ঝিঙেকে রূপক তাদের বাড়িতে নিয়ে উঠলো ।
( চলবে )