যদি প্রেম আসে : শতাব্দী মজুমদার।

0
467

-নীলুর জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল ,যদিও পাল্টি ঘরেই বিয়ে হয়েছিল। নীলুর শ্বশুরবাড়ি অবস্থাপন্ন , স্বামী সে আমলে বড় চাকরি করতো। দেখে ভালো মানুষ মনে হলেও সন্ধ্যে হলেই সে অন্যমানুষ হয়ে যেত ,মদ আর মাছভাজা খেতে খেতে নীলুকে বেনারসি শাড়ি ,গয়না টয়না পরার আবদার করতো আর তারপর নীলু যদি বলতো ,”এই প্রচন্ড গরমে ওই ভারী শাড়ি পরে থাকবো কি করে”!
সঙ্গে সঙ্গে কোমরের বেল্ট খুলে …

-ইস্, শব্দটা আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল।

নবনীতাদি নীলুর গল্প বলছিলেন।সপ্তাহ দুয়েক আমি এই স্কুলে জয়েন করেছি।
নবনীতাদি হেডমিস্ট্রেস কিন্তু প্রথম দিনই বড়দি বলতে বারণ করেছিলেন।আলাপে ভীষণ ফ্রেন্ডলি মনে হয়েছিল।স্কুলের করিডরে সুন্দরী এক মহিলার পোট্রেট ,নীলাম্বরীদেবী।আমি দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম।নবনীতাদি বলেছিলেন অনেক গল্প আছে ,পরে সময় করে বলবো , এনার জীবন কাহিনী সিনেমাকেও হার মানাবে।

তারপর থেকে স্কুলে টিচার্সরুমের করিডর দিয়ে যাতায়াতের সময় আমি বেশ কয়েকবার ওই ছবিটির সামনে থমকে দাঁড়িয়ে গেছি ,
পরমাসুন্দরী!আর যিনি এঁকেছেন এমন ছবি, সেই শিল্পীকেও মনে মনে সম্ভ্রম জানিয়েছি।

আজ নবনীতাদি স্কুল ছুটির ঠিক আগে আমার অফ পিরিয়ডে তার রুমে আমাকে ডেকেছিলেন বোধহয় আমার সঙ্গে ভালোকরে পরিচিত হতে।একথা সেকথার পর নীলাম্বরীদেবী অর্থাৎ নীলুর জীবন কাহিনী বলতে শুরু করলেন।

-আরও ছিল,নীলুকে একদিন তার স্বামী জমিয়ে কইতেল রান্না করতে বলে ,খাওয়ার সময় কেন পাঠারমাংস রান্না হয়নি তাই নিয়ে হুলুস্থুল বাঁধিয়ে দিল, নীলু তো ভয়ে সবসময় তটস্থ হয়ে থাকতো।

-নীলু গান গাইতে পারতো না একদম, বেসুরো ছিল কিন্তু স্বামীকে তার রোজ গান গেয়ে শোনাতেই হবে।সেজেগুজে বসে গান না গাইলেই তিনি মাঝ রাতেই গাড়ি নিয়ে সোজা বাড়ির বাইরে অন্য কোথাও রাত কাটাতে চলে যেতেন ।

-স্যাডিস্টিক ছিলেন বোধহয় ভদ্রলোক, আমি বলে ফেললাম।
-হ্যাঁ তা তো ছিলেনই , রাতের ঘটনা সকালে মনে থাকতো না , নীলুর হাতে পায়ে ধরে আবার মাঝে মাঝে ক্ষমাও চাইতেন।নবনীতাদি বললেন,

-নীলুর দম বন্ধ হয়ে আসতো সেই পরিবেশে ,পালিয়ে যেতে ইচ্ছে হতো কিন্তু
কোথায়ই বা যাবে আর ! সেই সময় বাপের বাড়ি ফেরৎ যাওয়াটা যেমন সম্মানের ছিল না তেমন নীলুর স্বামীও বোধহয় তাকে সহজে ছেড়ে দিতেন না।বড় চাকুরে বলে এমনিতেই তাকে সবাই মান্য করতো, নীলুর বাপের বাড়ির লোকজনও মানিয়ে গুছিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিত কিন্তু নীলু সত্যিই বোধহয় আর পারছিলনা , ভয়ঙ্কর মানুষটার হাত থেকে রেহাই চাইছিল তবুও নিরুপায় হয়ে একপ্রকার মানিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছিল।

ধুর এসব কি শুনছি,অনেক টানাপোড়েনের পর দীর্ঘদিনের প্রেম কিছুদিন আগেই ভেঙেছে আমার।মন ভালো ছিলোনা ,দূরের স্কুলের এই চাকরিটা পেয়ে সব ভুলতে চাইছি। মেয়েদের অত্যাচারিত হওয়ার চিরাচরিত সেই গল্প শুনতে সত্যিই ভালো লাগছিল না,তবুও…

-নীলু ছবি আঁকতো ভালো।কিন্তু ওর স্বামী রং ,তুলি সব নষ্ট করে দিয়েছিল তাই লুকিয়েও আর ছবি আঁকা হতো না । ছবিটা আঁকতে পারলেও বোধহয় নীলু কিছুটা ভালো থাকতো।

-এরপর একটা ঘটনা ঘটলো।নীলু তখন ন’মাসের অন্তঃসত্ত্বা।সেদিন শরীরটা খারাপ ছিল তবুও শীতের রাতে নীলুর স্বামী আবদার করলো নীলুকে সেজেগুজে গাড়ি চড়ে বেড়াতে যেতে হবে।নীলু বাধ্য হলো রাজি হতে কারণ মারধোর খেলে ওর পেটের সন্তানের ক্ষতি হবে এই ভেবে।

কিছুটা ঘোরাঘুরির পর নীলুর ভীষণ শরীর খারাপ লাগছিল তখন গাড়ি ঘুরিয়ে তারা বাড়ির পথ ধরলো ।মাঝরাতে রাস্তায় ডাকাত দল পথ আটকালো। নীলুর গয়নাগাটি সব একে একে ডাকাতেরা খুলে নিতে থাকলো। নীলুর স্বামী ভয়ে নিজের প্রাণ বাঁচাতে গাড়ি নিয়ে পালালো নীলুকে ফেলে রেখে। এদিকে নিলুর প্রসব যন্ত্রনা শুরু হলো ,ওই ডাকাত দলের এক ডাকাতের নীলুর যন্ত্রনা কাতর মুখ দেখে খুব কষ্ট হলো সে নীলুকে নিজের ঘরে নিয়ে গেল আর সেখানেই নীলু কন্যা সন্তানের জন্ম দিল।

এবার আমি শুনতে মনোযোগী হয়ে নড়ে চড়ে বসলাম।

-নীলুর স্বামী ভেবেছিল নীলু মরে গেছে। তাই বোধহয় আর খোঁজ করেনি,খোঁজ পায়ওনি কারণ পাশের গ্রামে সেই ডাকাতের ঘরে নীলু একপ্রকার গা ঢাকা দিয়েই ছিল।আর এ ঘটনার পর সে বেশিদিন বাঁচেওনি ,লিভারের অসুখে মারা গিয়েছিল নীলুর স্বামী।

-তারপর কি হলো দিদি?

মন্ত্রমুগ্ধের মতো এ কাহিনী আমি শুনছি।গল্পের মোড় যে অন্য দিকে ঘুরে গেছে একেবারে।

– সিধুর ঘরে নীলুর সন্তান বড় হতে লাগলো।সেই ঘরে নীলু অবাক হয়ে সিধুর হাতে আঁকা অনেক ছবি দেখেছিল।ডাকাত তাহলে শিল্পী আর তাই বোধহয় তার মন এতো নরম ।সিধু আর নীলুর মধ্যে বন্ধুত্ব তৈরি হতে সময় লাগলো না।শিশুটিকে কোলে নিলে সিধুর মধ্যে অদ্ভুত সুখানুভূতি তৈরি হতো।

-নীলু বুঝতো এই মানুষটির প্রতি তার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।পেশায় ডাকাত হলেও মানুষ ভালো ,সে না থাকলে সেই রাতে তার আর তার সন্তানের যে কি হতো!অতীতকে ভুলে বর্তমানটুকু নিয়ে নীলু বাঁচার চেষ্টা করলো।

-সিধু বুঝেছিল নীলু ভালো ঘরের তাই তার পেশা নিয়ে তারমধ্যে এক লজ্বাবোধ তৈরি হলো।সে ঠিক করলো জীবনে আর কখনো ডাকাত দলে ভিড়বে না ,অন্য ভাবে বাঁচবে।

-সিধুর মতো মানুষকে কখন যেন নীলু ভালোবেসে
ফেললো।

-নীলু বললো ,চলো আমরা আরো দূরে কোথাও চলে যাই। দুজনে ছবি আঁকবো আর তা দিয়ে রোজগার করে আমরা ঠিক চালিয়ে নিতে পারবো।

-হলোও তাই,নীলুর ভালোবাসায় সিধু ছবি আঁকায় মন দিল , সম্পূর্ণ নতুন একটা জীবন পেল যেন ,ধারালো অস্ত্র ছেড়ে আবার সে নতুন উদ্যমে তুলি ধরলো। নীলুও নতুন করে তুলিতে আঁচড় কাটলো।শিল্পী হিসেবে অল্পদিনে দুজনেই বেশ নাম করে ফেললো।তবে ওরা বিয়ে না করলেও আজীবন একসঙ্গে ছিল ।

-বাহ!এ তো সেই রত্নাকরদস্যুর বাল্মীকি হয়ে ওঠার কাহিনীর মতো।আমি বললাম।

-হ্যাঁ ,প্রেম মানুষকে বদলে দিতে পারে। আসলে প্রেম যেমন ধ্বংস করতেও পারে তেমন গড়তেও পারে। অন্য ডাকাতেরা নীলুর সব গয়নাগাটি নিয়ে গেলেও সিধু ডাকাত কিন্তু সব ফেলে তার প্রেম কে ঘরে এনে তুলেছিল।নবনীতাদি বলে চললেন,

-এই বাড়িটি ওদের ছিল আর সিধু ডাকাত শিল্পী হয়ে তার প্রেয়সীর এই ছবিটি এঁকেছিল।নীলাম্বরী দেবীর প্রবাসী কন্যা ওদের দুজনের মৃত্যুর পর এই বাড়িটিকে স্কুল করবার জন্য দান করে গিয়েছিলেন স্কুলের নামও তাই নীলাম্বরী বালিকা বিদ্যালয়।

-ওই যে পাশে সিদ্ধেশ্বর ইনস্টিটিউশন দেখছো, ওটি ছিল শিল্পী হওয়ার পর সিধু অর্থাৎ সিদ্ধেশ্বরবাবু আর নীলাম্বরীদেবীর স্টুডিও, ওই স্টুডিও সংলগ্ন জমিতে আরও ঘর তুলে পরবর্তীতে বয়েজ স্কুল নির্মাণ করা হয়।

আমি আবিষ্ট হয়ে শুনছিলাম এই প্রেম কাহিনী।ছুটির ঘন্টা পড়ে গেছে ,হেডমিস্ট্রেসের রুম থেকে বেরিয়ে এলাম।

স্কুলের কাছেই ঘর ভাড়া নিয়েছি, ফিরছি হেঁটে হেঁটে।আচ্ছা নবনীতাদি কি মন পড়তে পারেন!কিছু কি বুঝেছিলেন তেত্রিশ পেরিয়েও আমি সিঙ্গল কেন !তাই এমন একটা প্রেমের গল্প বলে প্রেমের প্রতি আমার আস্থা ফিরিয়ে দিলেন। নাহ্!এমনটা বোধহয় নয়,উনি হয়তো এমনিই বলেছেন,স্কুল নির্মাণের ইতিহাস প্রসঙ্গে।

যাইহোক প্রেম আছেই ,বার বার প্রেম জীবনে আসে ,হয়তো কোনোটা ক্লিক করে সারা জীবনের জন্য মনে এঁটে যায়।

যদি প্রেম আসে তবে এমন প্রেম আসুক ,আমি অপেক্ষা করবো আবারও প্রেমের জন্য, সিধু ডাকাতের মতো একজন প্রেমিকের যে সব কিছু ফেলে শুধু আমার মনটাকে ছিনিয়ে নেবে আরও একটি রূপকথার জন্য।

সমাপ্ত