আজ এই পর্বে আমরা জানবো বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজীর দীক্ষাগ্রহণ প্রসঙ্গে। ইতিপূর্বে আমরা জেনেছি যে , ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব পরলোকগত হবার পর ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজী বরাবরের মতো ব্রাহ্মধর্ম ত্যাগ করে বেড়িয়ে এলেন ; ব্রাহ্মপ্রভাব মুক্ত হলেন তিনি। এরপর শুরু হয় তাঁর ভক্তিজীবন। ব্রাহ্মধর্ম আচরণ কালেই অন্তরের শান্তির খোঁজ তিনি পাচ্ছিলেন না, তাঁর হৃদয় উচাটন হত , কীসের যেন এক হাতছানি তাঁকে ব্যাকুল করতো— কিন্তু, সন্ধান তার মিলছিল না। অন্তরে একটাই চিন্তা, একটাই ছটফটানি চলতো তাঁর , কী প্রাপ্ত হলে আমার হৃদয়ের এই নিঃস্বতা মিটবে ! প্রকৃত পরম সত্যের খোঁজ পাব কী করলে ! অন্তরের এই অভাব দূর হবে!
বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজীর দীক্ষাগুরু ছিলেন স্বামী পরমহংসজী আর সন্ন্যাসগুরু ছিলেন হরিহরানন্দ সরস্বতীজী। পরমহংসজীর প্রকৃত নাম ছিল ব্রহ্মানন্দ স্বামী। বিজয়কৃষ্ণ তাঁকে পরমহংসজী বলতেন । পাঞ্জাব প্রদেশের নানক পন্থী ব্রাহ্মণ ছিলেন তিনি। তবে তা প্রথম জীবনে। পরে বৈদিকপন্থা বা ঋষিপন্থায় তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করেন । সে সময়টা ছিল সিপাহী বিদ্রোহের কাল অর্থাৎ ওই ১৮৫৭ সাল নাগাদ । ব্রহ্মানন্দ স্বামী সাধনা করতেন কৈলাসের মানসসরোবরে।
যাহোক ফিরে আসি প্রসঙ্গে। ১২৯০বঙ্গাব্দে অর্থাৎ ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজী গিয়েছিলেন গয়ায় ব্রাহ্মধর্ম প্রচারে । সেখানে ব্রাহ্ম গোবিন্দচন্দ্র রক্ষিতের গৃহে অবস্থান করাকালীন জানতে পারেন যে আকাশগঙ্গা পাহাড়ে শ্রীরঘুবর দাস নামক একজন রামাৎ সাধু থাকেন ।তিনি নাকি উচ্চকোটির সিদ্ধপুরুষ । তাঁর বহু সুখ্যাতি শ্রবণ করে বিজয়কৃষ্ণ পরদিনই আকাশগঙ্গা পাহাড়ের সেই আশ্রমে গেলেন। সিদ্ধপুরুষের পাদপদ্মে লুটিয়ে পড়ে ভক্তি প্রার্থনা করলেন । তাঁর অন্তরের আকুল অবস্থা দেখে রঘুবর দাস তাঁকে অনেকানেক আশীর্বাদ করলেন ও সান্ত্বনা বাক্য বলে ক্রন্দনরত বিজয়কৃষ্ণকে শান্ত করলেন। বললেন, অতি শীঘ্রই সেই সন্ধান পাবেন যার খোঁজ বিজয়কৃষ্ণ মনে মনে করছেন এতদিন ধরে। বিজয়কৃষ্ণ রঘুবরদাসের সঙ্গ করতে থাকলেন প্রতিদিন। সেই সিদ্ধপুরুষের এমন সাধন প্রভাব ছিল যে আকাশে উড়ন্ত পক্ষী পর্যন্ত তাঁর আহ্বানে নীচে নেমে তাঁর কাঁধে বসে পড়তো ও কানজটা ছাড়িয়ে দিত । আবার ভয়ানক ব্যাঘ্র আশ্রম এ ঢুকে গেলে তাঁর আদেশ পেয়ে শান্ত হয়ে ফিরে যেত । এই আশ্রমের আরেকজন ব্রহ্মচারীর সঙ্গেও ভীষণ হৃদ্যতা হলো বিজয়কৃষ্ণের।
আকাশগঙ্গা আশ্রমের মনোরম পরিবেশে দিব্যানন্দে কাল কাটাতে থাকলেন বিজয়কৃষ্ণ। একদিন এক বালক এসে জানালো যে পাহাড়ের উপরে একজন সাধু নাকি বসে আছেন। সাধুর চরণদর্শন প্রাপ্ত হতে ব্রহ্মচারী বন্ধুটিকে সাথে নিয়ে বিজয়কৃষ্ণ পাহাড়ের আরো উপরে উঠে এলেন । একদম শীর্ষে বসে থাকা সেই সাধুর অঙ্গ থেকে প্রকৃতই সাধন জ্যোতিঃ নির্গত হচ্ছিল। তাঁর দিব্যকলেবর , সৌম্যপ্রভাব দর্শন করে মুগ্ধ হয়ে গেলেন তাঁরা উভয়েই । কিন্তু প্রণাম নিবেদন ও দু’চারটি কথা বলার পরেই সেই সাধু তাঁদের চলে যেতে বললেন সেখান থেকে । আদেশ উল্লঙ্ঘন না করে ফিরে এলেন তাঁরা।
এরপর থেকে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজীরা প্রতিদিনই সেখানে যেতেন সাধুদর্শন করতে । কিছুদিন পর ব্রহ্মচারীজী গেলেন বুদ্ধগয়া। তাই বিজয়কৃষ্ণ একাই গেলেন সেদিন সাধুর কাছে। কী জানি কী হল মনের আজ তাঁর! সাধুকে দর্শন মাত্র বিজযকৃষ্ণের বুক ফেটে ক্রন্দন এলো । তিনি রোদন করতে থাকলেন সরলপ্রাণ শিশুর মত। মহাত্মা কাছে ডাকলেন তাঁকে । কাছে আসতেই বিজয়কৃষ্ণকে নিজের কোলের উপর বসালেন অতি বাৎসল্য ভরে । তারপরই বিজয়কৃষ্ণের মাথায় হাত বুলিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে দীক্ষামন্ত্র প্রদান করে দিলেন । সঙ্গে সঙ্গে বিজয়কৃষ্ণের মনে হল কী যেন এক বিদ্যুৎশক্তি খেলে গেল তাঁর সর্ব শরীর দিয়ে । জোরে যেন এক ঝটকা খেলেন তিনি বজ্রশক্তির । সমস্ত শরীর যেন কেঁপে উঠল । এরপর সাধনপ্রণালী উপদেশ করলেন স্বামী ব্রহ্মানন্দ। বিজয়কৃষ্ণ কোনোমতে নিজেকে সামলিয়ে মহাত্মার চরণে প্রণাম নিবেদন করেই চেতনা হারিয়ে লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে । পরে যখন জ্ঞান ফিরল দেখলেন কেউ কোথাও নেই। তিনি একা পড়ে আছেন আকাশগঙ্গা পাহাড়ের শীর্ষে সেই নির্জন প্রদেশে।
তবে এই ঘটনার অনেক আগেই তিনি কিন্তু অপর এক মহাসাধক শ্রীতৈলঙ্গস্বামীর থেকে শিবমন্ত্রে দীক্ষাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন । সেই ঘটনাও বড় অদ্ভুত। পরবর্তী পর্বে আমরা জানবো তা।
–—ক্রমশঃ
ভক্তানুগ্রহ-প্রার্থিনী
রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক