তারপর দাদা ও কুন্তীর ভাব-ভালবাসার দৃশ্য দেখে ঝিঙে মনস্থির করলো, তার প্লাটফর্মে থাকাটা যুক্তিযুক্ত নয় । কেননা দাদা ও কুন্তীর কথোপকথনে সে ব্যাঘাত ঘটাতে নারাজ । নিরালা দুজনে মন খুলে কিছু কথা বলছে বলুক । সেই কারণে বাড়ি ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো । কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে রূপকের টেলিফোন । টেলিফোন ধরা মাত্র লাইনটা কেটে গেলো । ফোনের লাইন কেটে গেলো, না রূপক লাইন কেটে দিলো বোঝা গেলো না । তারপর দাদার মোবাইলে আওয়াজ ! পটল মোবাইল খুলে দেখে, টেলিফোনটি রূপকের ! সত্বর রেস্পন্স করে বলল, “হ্যালো ।“
দাদা ! সুখবর !
সুখবরটা কী ?
ঝিঙে পাশ করেছে । সে এখন আই-এ-এস ।
রূপকের কাছে বোনের সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার পাশের খবর পেয়ে পটল আনন্দে আত্মহারা । দেশের সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা, আই-এ-এস । সেই পরীক্ষার পাশের খবরে পটল আন্দোচ্ছ্বাসে আহ্লাদিত । এত বড় সাফল্য ইতিপূর্বে বাজারসৌ স্টেশন চত্বরে কারও জীবনে ঘটেনি । সেই অর্থে এলাকায় ঝিঙের সাফল্য খুব মর্যাদা পেলো । আর পটলের অনেক দিনের স্বপ্ন সফল হল । সে কায়মনোবাক্যে চেয়েছিলো, বোন দেশের সর্বোচ্চ পরীক্ষায় পাশ করুক এবং তার বোন পাশ করে দেখিয়ে দিলো সততা, নিষ্ঠা ও আত্মবিশ্বাসের জয় অবশ্যাম্ভাবী ।
পরেরদিন গাঁয়ের মেয়ে ঝিঙের পাশের খবর বাংলা দৈনিকে ফটোসহ স্থান পেলো । জানাজানি হওয়াতে আশেপাশের গ্রাম থেকে মানুষেরা এসে ফুল দিয়ে ঝিঙেকে আশীর্বাদ করে গেলো । তার হাই স্কুলের মাস্টার মশাইয়েরাও ছুটে এলেন । ঝিঙেকে আশীর্বাদ করলেন । পটল বাজারসৌ স্টেশন বাজারের সন্টা ময়রাকে আগেভাগেই রসগোল্লার বায়না দিয়ে রেখেছিলো । প্রচুর মিষ্টি বিলি করলো পটল ।
পটলের চোখে জল । বোনের এই দিনটি দেখার জন্য পটলের জীবনে কতো ত্যাগ স্বীকার । তার জীবনের সোনালী দিনগুলি উধাও । উপার্জনের সমস্ত পয়সার জলাঞ্জলি । সে চেয়েছিলো, তার বোন পড়াশুনায় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রাখুক । সেইজন্য তার আয়ের সবটুকু অর্থ বোনের পড়াশুনায় নিঙরে দিয়েছে পটল । নিজে বিয়ে পর্যন্ত করেনি, পাছে নতুন বৌদি এসে ঝিঙের স্বপ্নকে ভেঙ্গে চুরমার করে দেয় । বোনের পড়াশুনার উন্নয়নের প্রতি তার দৃষ্টি ছিল প্রখর । তাই বোনটার সাফল্যে পটল যারপরনাই আনন্দিত । চোখে আনন্দাশ্রু । বারংবার পটলের মায়ের কথা মনে পড়ছে । মা বেঁচে থাকলে বোনের সাফল্যে ভীষণ খুশী হতেন ।
দেরাদুনে ট্রেনিং ।
ট্রেনিংয়ে চলে গেলো ঝিঙে ।
রূপক সঙ্গে থেকে ঝিঙেকে নিরাপদে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফিরলো । ইচ্ছে থাকলেও রূপকের পক্ষে ঝিঙের সঙ্গে থাকার উপায় নেই । কেননা ব্যবসার কাজে তার সর্বক্ষণ থাকা জরুরি ।
প্রথম পোস্টিং মহাকুমা শাসক হিসেবে নিজের মহাকুমায় ।
কী আশ্চর্য ! তাঁদের জমির মূল্য নির্ধারনের সময়ের বি-ডি-ও তাঁর চেম্বারে এসে হাজির !
ঝিঙেকে দেখে ভুত দেখার মতো তিনি চমকে গেলেন । পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “আপনার সাফল্যে আমরা গর্বিত ।“
“বসুন বি-ডি-ও সাহেব ।“ ঝিঙে দাঁড়িয়ে চেয়ারের দিকে হাত ইশারা করে বি-ডি-ও সাহেবকে বসতে বললেন । নিজের এলাকার বি-ডি-ও সাহেবকে যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দিলো ঝিঙে । বি-ডি-ও সাহেব ঝিঙের ব্যবহারে আহ্লাদিত ।
তারপর অফিসের গাড়ি নিয়ে প্রথমেই নিজের স্কুলে । তাঁর মহাকুমার অধীনেই পড়েছে ঝিঙের হাই স্কুল । হাই স্কুলে পা রাখার সাথে সাথে বেজে উঠলো শঙ্খ ধ্বনি । হেড মাস্টার মশাই ঝিঙের এস-ডি-ও হিসাবে স্কুলে প্রথম পদার্পন করাটাকে চির স্মরণীয় করে রাখার জন্য তাঁর নিজের উদ্যোগে অভিনব প্রয়াস । স্কুলের সমস্ত ছাত্র-ছাত্রী মার্চ করে ঝিঙেকে স্যালুট জানালো । সমস্ত মাস্টার মশাই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো । তাঁদের হাতে ফুলের থালা । তাঁরা একে একে ঝিঙেকে মাথায় ফুল দিয়ে আশীর্বাদ করলেন । দূরে দাঁড়ানো স্কুলে ঝাঁট দেওয়ার ফুলি মাসি । ঝিঙে ফুলি মাসিকে দেখা মাত্র পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো । ফুলি মাসি তাঁর চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না । ঝিঙের মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করে বললেন, “এই প্রথম কোনো মহাকুমা শাসকের মতো বড় মেম সাহেব আমার মতো নীচু জাতের ঝাড়ুদারকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো । এটা আমার জীবনে সবচেয়ে বড় সম্মান ।“
অন্যদিকে পটল বোনের বাংলোতে উঠলো না । সে তার নিজের ব্যবসা নিয়ে বেঁচে থাকতে চাইলো । সে নিজস্ব অস্ত্বিতে বিশ্বাসী । অস্ত্বিত্ব হারাতে পটল গররাজি । তাই ধীরে ধীরে বোনের সহযোগিতায় বাজারসৌ স্টেশন বাজারের মধ্যখানে দেড় কাঠা জমির উপর তিনতলা বাড়ি নির্মাণ করলো । রূপকের পরামর্শে নীচের তলায় রেস্টুরেন্ট খুললো পটল । দোতলায় নিজের থাকার জায়গা । বোন থাকার জন্য তিন তলাটা সংরক্ষিত । বিয়ের পরে ঝিঙে যখন বাড়ি আসবে তখন তার জন্য তিন তলা বরাদ্দ ।
তারপর ঝিঙে রূপককে ডেকে পাঠালো । কেননা দুজনে মিলে কুন্তীর সঙ্গে দেখা করবে ।
সেই অনুসারে রূপক ও ঝিঙে হঠাৎ কুন্তীর মাসির বাড়ি হাজির !
রূপক ও ঝিঙেকে একসঙ্গে দেখে কুন্তী ঘাবড়ে গিয়েছিলো । তাহলে কী পটল বোনকে পাঠিয়েছে তার সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করতে ।
“আমি দাদাকে না জানিয়ে এসেছি ।“ ঝিঙে কুন্তীকে বললো ।
কেন ? এভাবে আসা কেন ?
“আমি ও রূপক চাই, তুমি আমার দাদার জীবনে পাকাপাকিভাবে সহযোদ্ধা হও ! শুধুমাত্র এই কথাটা বলার জন্য তোমার মাসির বাড়ি আসা ।“ কুন্তী এতক্ষণে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো । সে কতো দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিলো, বোঝানো কষ্ট । কুন্তী পটলের সঙ্গে মেলামেশার পর পটলকে আপন করে পাওয়ার জন্য মরিয়া । পটল ছাড়া তার পক্ষে বেঁচে থাকা কঠিন । তাই নিয়ম করে প্রায় প্রতিদিন পটলের দোকানে হাজিরা দিতে আসা ! কিন্তু পটল মন থেকে সাড়া দিতে পারছিলো না একমাত্র বোনের জন্য । তার মতে, বোন আগে নিজের পায়ে দাঁড়াক । তারপর তার নিজের জীবনের ভাল-মন্দ নিয়ে স্বপ্ন দেখার সময় ! তাই কুন্তী উৎফুল্ল, কেননা ঝিঙে প্রস্তাব নিয়ে স্বয়ং উপস্থিত । কুন্তীকে দাদার বৌ করার প্রস্তাব নিয়ে তার সম্মুখে হাজির । এর চেয়ে আনন্দের কিছু হতে পারে না ।
খুশী মনে ঝিঙের কথায় কুন্তী মত দিলো ।
এবার রূপক ঝিঙেকে তাগাদা দিলো, “শিগ্গির বাড়ি চলো । তাদের এখন অনেক কাজ ! দুটো বিয়ে একদিনে । সুতরাং কাজটা হাল্কা নয় ।“
“যেখানে রূপক কর্তা রয়, সেখানে ঝিঙের নেই কোনো ভয় !” ঝিঙে উত্তরে জানালো ।
তারপর ঝিঙে ও রূপকের প্রাণখোলা হাসি !
—————–শেষ———————-