শ্রীবিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীপাদ-এক আশ্চর্য‍্য মহাজীবন কথা:(পর্ব-১৭) : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

0
734

ডাক্তারি পরিভাষায় একটি রোগ আছে, যার নাম সোমনাম্বুলিজম (Somnambulism) । এই রোগে রুগী নিজের ঘুমের মধ্যে এমন সব ক্রিয়াকর্ম করে যে মনে হয় যেন সে জেগে রয়েছে ! একজন জাগ্রত মানুষের মত সে তখন হেঁটে-চলে বেড়ায়, এমন কী কথাও বলে । কিন্তু, আদপে সে ঘুমন্ত । তাঁর শরীর সেসময়ে কর্ম করে ঠিকই, কিন্তু সে সব কর্ম আসলে ঘুমের ঘোরে করে সে । সেই কর্মের ফল ঠিক বা ভুল—-এসব বিচার বিবেচনা করার বোধ থাকে না তখন তাঁর । পরে যখন ঘুমের ঘোর কেটে যায়, সে একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতই আবার হয়ে যায় । কী করছে আর কী না করছে—-সেসবের বিচারবোধ ফিরে আসে । অর্থাৎ, এক কথায় তাঁর জ্ঞানবোধ ফিরে আসে ।
বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজীর জীবনে শ্রীমন্ মহাপ্রভুকে নিয়ে এমনই এক ঘটনা ঘটেছিল যা জানলে মনে হবে এ নিশ্চয়ই সোমনাম্বুলিজম (Somnambulism) রোগেরই প্রতিফলন কোন । আমাদের মধ্যে তথাকথিত যুক্তিবাদী , বিজ্ঞাননিষ্ঠ বা নাস্তিক মনোভাবাপন্ন যাঁরা, তাঁরা তো যুক্তিই খোঁজেন সব ঘটনার । তাই না ! আসুন জানা যাক , সে ঘটনা।
তখন গোস্বামীজী অবস্থান করছেন ভারত আশ্রমে । প্রসঙ্গতঃ,ভারত আশ্রম বলতে কিন্তু স্বামী প্রণবানন্দের ‘ভারত সেবাশ্রম’ নয় । পূর্বের কোন একটি পর্বে আমরা ভারত আশ্রম সম্পর্কে জেনেছি। তবু মনে করিয়ে দেই আবার—– কেশবচন্দ্র সেনের পৃষ্ঠপোষকতায় স্থাপিত হয়েছিল ভারত আশ্রম ; কতগুলো ব্রাহ্ম পরিবার একসঙ্গে বসবাস করে একসঙ্গে দৈনিক উপাসনা, ধর্মগ্রন্থ পাঠ, সৎসঙ্গ, আহার-বিহারের শৃঙ্খলাপূর্ণ আচরণ যাজন দ্বারা আদর্শ ব্রাহ্ম পরিবার সংগঠন গড়তেন সেসময় । আর, এই আশ্রম প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কেশবচন্দ্রের দক্ষিণ হস্ত হয়ে প্রধান উদ্যোগী হয়েছিলেন গোস্বামীজীই ।
ফিরে আসি ঘটনায় এবার। ভারত আশ্রমে সেদিন রাত্রে উপাসনায় বসেছেন বিজয়কৃষ্ণ । ক্রমে ভাবসমুদ্রে নিমগ্ন হয়ে গেলেন তিনি । একসময় বাহ্যজ্ঞানও লুপ্ত হয়ে গেল । তিনি তখন দেখলেন শ্রীমন্ মহাপ্রভু তাঁর পার্ষদগণ সমেত এসে দাঁড়িয়েছেন । শ্রীঅদ্বৈত আচার্য‍্যও আছেন তাঁদের মধ্যে । আচার্য‍্য তাঁকে বললেন, “যাও স্নান করে আসো । মহাপ্রভু তোমায় দীক্ষা দেবেন ।” বিজয়কৃষ্ণ সোজা চলে গেলেন কুয়োতলায় । স্নান করে, ভিজে কাপড় পরিবর্তন করে ফিরে এলেন । তারপর মহাপ্রভু তাঁকে দীক্ষা দিলেন । পার্ষদবৃন্দ সকলে মহাখুশী হলেন বিজয়কৃষ্ণের এই দীক্ষা প্রাপ্তিতে । চারিদিকে আনন্দের বাতাবরণ তৈরি হল । তারপরই সপার্ষদ মহাপ্রভু অন্তর্ধান করলেন । আর সাথে সাথেই বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজীর ধ্যানভঙ্গ হল । সমস্ত ব্যাপারটাই তাঁর কাছে স্বপ্নের মত মনে হল । কিন্তু, এ কী ! তাঁর মাথা-গায় এমন শীতল অনুভূতি কেন হচ্ছে ! তিনি মাথায় হাত দিয়ে দেখলেন চুল ভেজা। আর স্নানের পর যেমন সর্বাঙ্গের অনুভূতি থাকে ঠিক তেমন অনুভব। কী মনে হতে বিজয়কৃষ্ণ সোজা চলে এলেন কুয়োতলায় । এসে দেখলেন তাঁর ভিজে কাপড় সেখানে পড়ে আছে । অতএব, তিনি স্নানও করেছেন একটু আগেই । তাহলে তাঁর স্বপ্ন কী স্বপ্ন নয় ! সত্য ঘটনা ! আশ্চর্য‍্য !
এই ঘটনার কিছুদিন পরই বেনারসে শৈবমন্ত্রে দীক্ষা হয় তৈলঙ্গস্বামীর থেকে গোস্বামীজীর, সেই অদ্ভুত ঘটনার কথা আমরা গত সপ্তাহে ১৬তম পর্বে জেনেছি । আর , পরবর্তীতে ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে যখন গয়ায় আকাশগঙ্গা পাহাড়ে ব্রহ্মানন্দ স্বামীর থেকে বিষ্ণুমন্ত্রে দীক্ষা হয় , তখন তাঁর মনে ছিল না বেনারসে পাওয়া শৈবমন্ত্রের কথা। সেবার বিজয়কৃষ্ণ যখন প্রথম দেখেন তৈলঙ্গস্বামীকে তখন বিস্ময়াভিভূত হয়ে গেলেন তাঁর কাণ্ড দেখে । এমন আজব ব্যাপার বিজয়কৃষ্ণ নিজের গোটা জীবনে দেখেননি। দেখেন কী তৈলঙ্গস্বামী প্রসাব করছেন আর প্রসাব ফেলছেন মা কালীর মুখে-বুকে-চরণে । বিজয়কৃষ্ণ এ দৃশ্যে আর চুপ থাকতে না পেরে বলে বসলেন, “করছেন কী ! করছেন কী এসব !” তৈলঙ্গস্বামী মুখ ফিরিয়ে বললেন শুধু, “গঙ্গাদোকম্” । বিজয়কৃষ্ণ কিছুই বুঝলেন না ।
তৈলঙ্গস্বামীর দীক্ষা প্রদানের ২০ বৎসর পর বিজয়কৃষ্ণ আবার গিয়েছিলেন বেনারসে । সেসময় তৈলঙ্গস্বামী হঠ্ যোগ সাধনা ত‍্যাগ করেছেন । এপর্যন্ত তাঁর অযাচক বৃত্তি ছিল , অর্থাৎ, কারোর থেকে কোন কিছু যাচনা করতেন না বা চাইতেন না। কেউ কোন আহার সেধে প্রদান করলে তবেই তা গ্রহণ করতেন।অযাচক বৃত্তি নিয়ে সাধনক্ষেত্রেই অবস্থান করতেন। কিন্তু , এখন অজগর বৃত্তি তাঁর । অজগর সর্প যেমন এক জায়গায় নিঃশ্চেষ্ট হয়ে পড়ে থাকে, আহার সংগ্রহের জন্যও কোথাও যায় না , সম্মুখে আহার এলে তবেই তা খায় । শুধু তাই নয় , অজগর সর্পের আর একটি স্বভাব হচ্ছে যতক্ষণ পর্যন্ত না দেহের প্রয়োজন হয় ততক্ষণ পর্যন্ত কিন্তু সে খাদ্য গ্রহণ করে না, তা সে যত ভালোই আহার্য্য সম্মুখে আসুক না কেন। অযাচক বৃত্তির সঙ্গে অজগর বৃত্তির পার্থক্য হল অযাচক বৃত্তিতে সাধক নানা স্থানে পরিভ্রমণ করেন কিন্তু অজগর বৃত্তিতে সাধক গমনাগমনও করেন না । তৈলঙ্গস্বামীরও এখন সেই অবস্থা। কোথাও গমনাগমন করেন না। তিনি একস্থানেই কেবল পড়ে থাকেন অজগর সর্পের মত। হঠ্ যোগ সাধনা ছেড়ে দিলে শরীর নাকি খারাপ হয়ে যায় । তৈলঙ্গস্বামীর ক্ষেত্রেও তেমনটা হয়েছিল। শরীর ভেঙ্গে গিয়েছিল খুব ।
বিজয়কৃষ্ণ এসে প্রণাম জানালেন তৈলঙ্গস্বামীকে। তিনি ফিরে ডান হাতের নীচ থেকে দেখালেন গোস্বামীজীকে । হয়তো বা অজগর বৃত্তির নিয়মে পড়ে অমন ভাবে দেখা। তারপর স্বামীজী মাটিতে লিখলেন, “ইয়াদ হ্যায় ?” গোস্বামীজী বললেন,“হ্যাঁ।” তৈলঙ্গস্বামী মুচকি হেসে শিষ্যের গায়ে হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করলেন । বিজয়কৃষ্ণ ফিরে এলেন নিজ বাসায় ।
(ক্রমশঃ)
—–ভক্তানুগ্রহ ভিখারিনী
রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক