যদি বলি, জেমস হিকি সরণি যাবেন?
ভুরুর মাঝে ভাঁজ পড়বে আপনাদের অনেকেরই। জায়গাটা আপনাদের জানা। অথচ বলবেন, সেটা আবার কোথায়?কলকাতায়, না কলকাতার বাইরে? নাকি একেবারে বিদেশে? আমি যদি বলি, ডেকার্স লেন। সংগে সংগে ঘটি-বাঙাল বাঙালি আর একেবারেই বাঙালি নন, এমন প্রবাসী অবাঙালি সাগ্রহে হৈ হৈ করে বলে উঠবেন “হ্যাঁ যাবতো, প্রায় রোজই যাই তো।” কেউ পূর্ববঙ্গীয় ভাষায় কইবেন, হ, হ এডা আবার কওনের কি আছে? রোজই তো টিফিন করোনের লাইগ্যা যাই ডেকার্স লেনে।আইজও যামু তো। তা মশাই খটমট নাম ব্যবহার করোনের কাম কি কন তো? সিধা ডেকার্স লেন কন না। হকল সময়ে হেঁয়ালি হক্কলের ভালা লাগে না।” প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে নন- ভেজে অভ্যস্ত অবাঙালি.. সে ও বলবে খুবই চিত্তাকর্ষক করে আধা বাংলা, সিকি
হিন্দিতে ছিটেফোঁটা ইংরিজির ফোড়ন দিয়ে মেটলি নামে চাপড়া ঘন্ট বানিয়ে, -“ক্যায়া ইয়ে নাম আপনে রেখেছেন? ডেকার্স লেন বললে তো বুঝে যেতাম খাওয়া দাওয়ার খাইবার পাসের বাত বলছেন। নাম চেঞ্জ মানে সবকুছ চেঞ্জ। ভালো লাগার ফিনিক্স পাখির মতো অকাল মৃত্যু। ” কি কাব্যিক ঢং। শুনলেরবীন্দ্রনাথ বেশি দিন বাঁচতেন না, অনেক আগেই বলতেন একটু অদলবদল করে, – নিয়েছি ছুটি, বিদায় দেহো ভাই, ভাষা সমৃদ্ধিতে আর আগ্রহ নাই। ভাবলাম, অবাঙালিটির জ্ঞান বড়ো ফড়ফড়ে আরশোলার মতো অল্প ওড়ে। শেক্সপিয়ার কে টেনে আনার মানে হয় না… নামে কি আসে যায়? কারণ আমিও জানি, লোকে জায়গাটাকে ডেকার্স লেন বলেই চেনে। অথচ আসল তথ্যের অনেকেই হদিস জানে না;- ভালো লাগে, ভালো লাগে- সেটাই তো যথেষ্ট।মূল উৎস নিয়ে টানাটানি করতে কতজন যায়? প্রথম ভারতীয় খবরের কাগজ বেঙ্গল গেজেটের প্রবক্তা জেমস অগাস্টাস হিকির নামে এই রাস্তার নাম হয় জেমস হিকি সরণি। এতো সরকারি নথিপত্রের নাম, এবং অনেক পরে এই নামকরণ। তারো অনেক আগে কলকাতার কালেক্টর ফিলিপ মাইনর ডেকার্স এই রাস্তায় নাবিকদের সাথে মিটিং করতেন। আর ইটিং ছাড়া কি মিটিং কোনকালে হয়, না হয়েছে? তাই খানাপিনার ঠেক গজিয়ে গেলো এখানে খুব দ্রুততার সাথে।
মাইনর ডেকার্স এর নামে এই রাস্তার পরিচিতি আজো ডেকার্স লেন। রাস্তাটা কোথায়? অফিস গো ওয়ার্স মানুষ জনের সকলেই জানে পথটা। তবে তারে বাঁধা সাইনবোর্ডে এখন যে প্রথমে লেখা জেমস হিকি সরণি, তাকে অবহেলা করে নীচে লেখা ডেকার্স লেন বলে ডাকতে এখনও ভালোবাসে। এটা রসনা তৃপ্তির পরম্পরার প্রতি আগ্রহ না, পোশাকি নামটা না ব্যবহার না করে ডাকনামে ডাকার আন্তরিকতা… কে জানে? তবে ভোজপুরি গানে যেমন দেশোয়ালী আন্তরিকতা থাকে, তেমনি ভোজনের সাথেও মানুষের আন্তরিকতা থাকে। তবে ডেকার্স লেনে দেশোয়ালী খাবারই শুধু বিক্রি হয় না, ভিন্ন দেশি, ভিন্ন প্রদেশি খাবারেরও বিক্রি বাটা চলে রমরমিয়ে।ধোসা ইডলি দক্ষিণী ডাল-বড়া সম্বর সহযোগে উত্তমম। আবার সুয়েজ খাল সাঁতরে ইতালির পাস্তাও ডেকার্স লেনের বাসিন্দা হয়ে গেছে। মিষ্টি আতরের গন্ধ ছড়িয়ে ডেকার্স লেন আপনাকে মোহময় হাতছানি দেয়। লাল কাপড়ে মোড়ানো ঢাকনা ঢাকা ডেকচি বা হাঁড়ি খুলে কয়েক হাতা বিরিয়ানি.. আহা স্বর্ণময় মুহুর্ত। তুলতুলে লালচে বা খয়েরি মুরগি বা মাটন আহ্লাদে গলে মুখে হজম লালার সাথে। হজম লালার নাম এনজাইম। সহজে হজম হয় বিরিয়ানি- মাংস। আবার লাল কাপড়ে মোড়া বাক্স। বেরিয়ে আসে কেশর কুলপি।স্বাদ- গন্ধে আরামদায়ক। গ্রীষ্মের দাবদাহ বলে, তৃষ্ণারও শান্তি সুন্দর কান্তি।
চিকেন স্টু- পাউরুটি, ভেজ নন ভেজ স্টুতে স্বল্প মাখনের ভাসানী… মনোহর। ডিম চোবানো টোস্ট যাকে আমরা ফেঞ্চ টোস্ট নাম দিয়েছি, তা’ পাওয়া যাবে ফরমায়েশ করলে।নয়তো সেঁকা পাউরুটির ওপর ওমলেটের আলোয়ান জড়ানো,সে’ও নয় নেহাৎ মন্দ। বিদেশি ফরম্যাট কে আমরা নিজেদের মতো করে নিজের করে নিয়েছি। আমাদের মূলমন্ত্র যে দিবে আর নিবে, মেলাবে, মিলিবে..” না এ আমাদের প্রায় দুশো বছর ব্রিটিশ রাজের দাসত্বের ফল নয়, এ আমাদের অপরকে আপন করার অপার মহিমা। এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরের এটাই মহিমা।তা এই মহিমার প্রভাব আমাদের খাদ্য রুচির অপারেশনেও পড়েছে।আমরা খুঁজে ফিরি নিত্য নতুন অন্য দেশীয় সুস্বাদু খাবারের ঠিকানা। খুঁজে পেতে পৌঁছে যাই সেই ঠেকে । ডেকার্স লেন তাই বাঙালি কে টান দেয়, বলে এসো, আজো আমি বসে আছি তোমার জন্য। প্রেমের এই আহ্বান উপেক্ষা করে,আগ্রহ রুদ্ধ করে..এমন বেরসিক আছে নাকি? ফাইলের আড়ালে আড়াল হয়ে থাকা অফিস- কেরাণী টিফিনের ঘন্টা শোনার জন্য উদগ্রীব থাকে। স্কুল নয়, ঘন্টা বাজে না,কিন্তু দেয়াল ঘড়ি তো চলে। কেরাণীর ফাইল কিছু সময়ের জন্য বন্ধ হয়।ঠান্ডি ঠান্ডি চেম্বারে অফিসের বড়ো সাহেব স্টেনোকে বলে, “আজ আর কোন দামি রেস্তোরাঁ নয়, কেরাণী কুলের টিফিন শেষ হলে চলো যাই ডেকার্স লেনে।কতটুকুই বা পথ পাড়ি দিতে হবে? কারোর অফিস কাছে, কারো বা একটু দূরে। তাতে কি হয়েছে? পাড়াটা তো
তো অফিস পাড়ারই। ধর্মতলার মোড় থেকে ট্রামলাইন বরাবর রাজভবনের দিকে এগোও গুটি গুটি… ব্যস বলো “ডেকার্স লেন চিচিং ফাঁক..” গলির মধ্যে ঢুকে দ্যাখো চোখের সামনে মনোলোভা প্রাণহরা সব খাবার। আরো একটু স্পেসিফিক্যালি বলি, রাজভবনের পুব দিকের গেটের উল্টো দিকে
এসস্প্যালেনেড ইস্ট ম্যানসন যার খোপে খোপে বহু বাসিন্দা আর একতলায় ইস্টার্ন রেলের পি. আর.ও অফিস আর সাউথ ইস্টার্ন রেলের রির্জাভেশন অফিস। এই বিল্ডিং ঘেঁষে ডেকার্স লেন।ঢুকলেই মনে হবে, ভূতের রাজা বলে চলেছে… ‘কাছে আয় কাছে আয় পকেট ফ্রেন্ডলি খাবার সব খেয়ে যা, খেয়ে যা। ‘ ফ্রিশ ফ্রাই গরম গরম, বাসন্তী পোলাওর কি বাহার। মাটনকষা খেয়ে মনে হয়.. সার্থক জনম আমার। ‘এগ বা চিকেন চাউমিন অর্ডার দিলেন না কি দাদা?’ এক কাস্টমারের আরেক কাস্টমার কে কাস্টমাইজড প্রশ্ন নয়, কিছুটা আগে নিজের স্যাটিসফেকশন জানাতে জানানোর ইচ্ছা,
” যা বানিয়েছে না একদম সুপার- ডুপার। ” অপর কাস্টমার উত্তর দেয়..
” ডেকার্স লেন সেফ জোন। হজমে নো গন্ডগোল। নো ফিয়ার, নো ডক্টর, নো ফালতু এক্সপেন্স।” ডেকার্স লেনে এক ভাঁড় চায়ে কি আফিমের গুণ আছে নাকি? কারণ প্রথম কাস্টমারের তো চা প্রায় শেষ, আর দ্বিতীয় কাস্টমার চাউমিন হ্যান্ডেল করে মুখে তোলার আগেই চায়ে চুমুক মেরে ফেলেছে।সময় কম; টিফিন ফুরিয়ে আসে। মনে হয় প্রাণ হরিয়ে, তৃষা হরিয়ে মোরে আরো ভাঁড় চা করো দান। মূল্য দেব না- এ কথা তো বলি নাই। পয়সা এখানে ফ্যাক্টর নয়, আগেই বলেছি,…কেরানীকুলেরও পকেট ভেরি ভেরি ফ্রেন্ডলি। তবে ভারি পকেটের সাথেও ডেকার্স লেনের দোস্তি গাঢ়। খাবার গুলো যে বড়ো সুস্বাদু।
কলকাতার রসনায় বাঙালির নস্টালজিয়া ডেকার্স লেন। ইতিহাস বলা যায়। তবে পুরাতত্ত্ব নয়, বা মিউজিয়ামের মমি নয়, ডাইনোসরদের মতো বিলুপ্ত নয় বা ডোডো পাখির মতো নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় নি। ডেকার্স লেন ইতিহাস বললাম এই কারণে যে এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে রয়েছে ইতিহাস, ঐতিহ্যবাহী এর অস্তিত্ব আজো বজায় রাখতে সচেষ্ট। করোনার বাড়বাড়ন্ত অবস্হায় চলেছিল খুব ঢিমেতালে, নিয়ন্ত্রণ বিধি ঢিলে হতে আবার যে কে সেই। আবার খাবারের গন্ধ, আবার হৈ চৈ, হাঁকডাক। থুতনি পর্যন্ত বা থুতনির নীচে নামানো মাস্ক নিয়ে ধোঁয়া ওঠা চায়ের সাথে পকোড়ায় কামড় কিংবা ডেভিল- ফিসরোলের অর্ডার দিয়ে দেরির জন্য ক্ষোভ, স্যালাড- সসের জন্য অনুরোধ … এটাই তো ডেকার্স লেন। ডেকার্স লেন লেখা বোর্ডের ডান হাতে নান ঘুগনী আর পুরি- সবজির দোকান, সঙ্গে শশা- পেঁয়াজ কুচি। এছাড়াও রয়েছে রিচ চিকেন চাপ। খদ্দেরদের ভিড় কম নয়। ” একদিন খেলে কি হয়? “- এই জাতীয় মনোভাব।
ডেকার্স লেনে সকাল থেকেই কর্মযজ্ঞ। যজ্ঞ বাড়ি যেনো। গামছায় ফুটছে চাউমিন, ফ্যান ঝাড়ার জন্য বড়ো ফুটো থালায় উল্টোনো ভাতের হাঁড়ি। ময়দা ঠাসাঠাসি, লেচি কেটে বেদনার সোহাগী চাপে প্রয়োজন মাফিক আকৃতি, বিশাল চাটুতে বিভিন্ন নামের চাটুকারিতা… তন্দুর, রুটি। তারপর লোহার জালে রেখে অভ্যস্ত হাত ঘুরিয়ে খদ্দেরের অর্ডার মতো তন্দুর কে পোড়ানো… কম বা বেশি।কড়ার উল্টো পিঠে রুমালী রুটি। দুধ উবলায়। গামছা পাত্রের কানায় ধরে পাশে নামানো হয় যুদ্ধ কালীন তৎপরতার সাথে,…”তাড়াতাড়ি কর রে, কাঠের বেঞ্চি ভরলো বলে। ” নোনতা ঝালের স্বাদে ডেকার্স লেনে মিষ্টির সহাবস্থান..
রসে ডগোমগো গুলাবজামুন, সর ফেলা রাবড়ি, পেঁপের হালুয়া, ক্ষীরের পুর পোরা মিষ্টি সিঙাড়া, স্পেশাল নিলে সাইজ জবরদস্ত। শীতে কমলা রঙের গাজরের হালুয়া। গরম দুধ আর মালাইদার লস্যি। মালামাল আনন্দ। এতো কিছু দরকার নেই আপনার? পেঁয়াজ টম্যাটো চীজ কর্ন আর চিকেন স্প্রেড দিয়ে বানানো স্যান্ডউইচ খেয়ে নিলেন গোটা দুই; ব্যস পেট ভর্তি আর মনটাও খুশি। মুখে মৌরি ফেলে হাঁটা দিন অফিসের দিকে। আপনার মনে পড়বে, আমীর খসরুর বিখ্যাত ফারসি পংক্তি… অপর ফিরদৌস বার রু-ই জামিন আস্ত -ও হামিন আস্ত-ও হামিন আস্ত। ” ফার্সি শব্দ গুলো নাই বা মনে থাকলো, বাংলা অনুবাদটা নিশ্চয়ই মনে আছে,
” পৃথিবীতে কোথাও যদি স্বর্গ থাকে, তবে এটিই সেটা”। ‘পৃথিবী’ বললে বাড়াবাড়ি হবে; তবে কলকাতায় সস্তায় রসনা তৃপ্তির ঠিকানাটা ডেকার্স লেন। ডেকার্স লেনে বহু বিখ্যাত ব্যক্তির আনাগোনা ছিল। ময়দানে বড়ো টিমের খেলা থাকলে ফিরতি পথে ডেকার্স লেনে ঢুঁ মারা সাপোর্টার খরিদ্দারের অভাব ছিল না। আজো একই ট্রাডিশন সমানে চলছে। উদর তৃপ্তির নস্টালজিয়া নিয়ে ডেকার্স লেন সগৌরবে নিজের ঐতিহ্য বজায় রেখে চলেছে।