তৃণ্ময় বেরা, ঝাড়গ্রাম: মুখ্যমন্ত্রীর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যাশ্রী প্রকল্প সারা বিশ্বে নাম কুড়িয়েছে। রাজ্যে রূপশ্রী প্রকল্প সাড়া ফেলেছে। নাবালিকার বিয়ে আটকাতে মুখ্যমন্ত্রী এই প্রকল্প চালু করেছেন। কিন্তু তারপরও নাবালিকার বিয়ে ঠেকানো যায়নি। এমনকি গত দু’বছরে করোনা মহামারি চালকালীন এই প্রবণতা উত্তরোত্তর বেড়েছে। স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় প্রচুর নাবালিকার বিয়ে দিয়েছেন পরিজনেরা। গ্রামাঞ্চলে মেয়েরা একটু বড় হওয়ায় পরিজনেরা তাড়াতাড়ি মেয়ের বিয়ে দিতে চান। বিশেষ করে ঝাড়গ্রাম জেলার গ্রামীণ এলাকায় নাবালিকার বিয়ের হার গত দু’বছরে অনেকটাই বেড়েছে। বহুক্ষেত্রে প্রশাসনও অসহায়। তাই বাধ্য হয়ে এবার কড়া পদক্ষেপ নিল প্রশাসন। ঝাড়গ্রাম জেলার এক বিডিওর অভিযোগের ভিত্তিতে মেয়েকে বিয়ে দেওয়ায় বাবাকে গ্রেফতার করল পুলিশ। নাবালিকাকে বিয়ে দেওয়ায় বাবা গ্রেফতার হওয়ার ঘটনা নজিরবিহীন। জেলার ওই ব্লকের বিডিও বলছেন, ‘‘আমরা আগেও অনেকক্ষেত্রে নাবালিকা বিয়ের খবর পেয়ে বিয়ে আটকেছি। এমনকি নাবালিকার বাবা-মা মুচলেকা দিয়ে থাকেন। কিন্তু কিছুদিন পর জানতে পারি মেয়েটি কোনও আত্মীয়র বাড়িতে রয়েছে। আরো কিছুদিন পর জানা যায়, নাবালিকার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তাই এবার নাবালিকার বিয়ে রুখতে কড়া পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।’’ জেলাশাসক জয়সি দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘নাবালিকা ও নাবালককে বিয়ে দেওয়া ক্রাইমের মত অপরাধ। তাতে ইন্ধন যোগানো অন্যায়। অন্যায় করলে শাস্তি পেতেই হবে। সেজন্য আমরা মামলা খবর পেলেই বিয়ে আটকানো হয়। পরবর্তী ক্ষেত্রে আইনত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’’
জানা গিয়েছে, জেলার একটি ব্লকের বাসিন্দা ওই নাবালিকার এদিন থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। ওই নাবালিকা গ্রাম লাগোয়া একটি হাইস্কুলে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ত। কিন্তু পরীক্ষার জন্য ফর্ম ফিলাপ না করায় ওই নাবালিকার অ্যাডমিট কার্ড আসেনি। যারজেরে সে পরীক্ষা দিতে পারেনি। এদিকে, ওই নাবালিকার পরিজনেরা গত ৩ মার্চ অনুষ্ঠান করেই বাড়িতে বিয়ে দেন। ওই নাবালিকার বিয়ে হয় ওড়িশা রাজ্যের একটি গ্রামে। বিয়ের পরই খবর পান ওই ব্লকের বিডিও। গত ১২ মার্চ বিডিও ওই নাবালিকার পরিবারের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। পুলিশ প্রোভিশেন ও চাইল্ড ম্যারেজ অ্যাক্ট, ২০০৬ (The prohibition of child marrige act, 2006) ধারায় মামলা রুজু করে পুলিশ। তারপরই পুলিশ নাবালিকার বাবাকে নোটিশ পাঠায়। কিন্তু নাবালিকার বাবা থানায় আসেননি। তারপর পুলিশ ওই নাবালিকার বাবাকে বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে। এদিন ধৃতকে ঝাড়গ্রাম এসিজেএম আদালতে তোলা হলে বিচারক জামিন মঞ্জুর করেন। নাবালিকার বাবা এদিন বলেন, ‘আমার তিন মেয়ে ও এক ছেলে। মেয়ে বড় হলে বিয়ে দেওয়ার চাপ থাকে। ভাল পাত্র পাওয়ায় বিয়ে দিয়েছিলাম। এরকম তো অনেকেই বিয়ে দেন। কিন্তু আমাকে গ্রেফতার করা হল।’’ কিন্তু জেলায় নাবালিকার বিয়ের ঘটনায় বাবাকে ঘটনা মনে করতে পারছেন না প্রশাসন, পুলিশ ও আইনজীবী মহল। ঝাড়গ্রামের বিশিষ্ট আইনজীবী কৌশিক সিনহা বলেন, ‘‘আমার কর্মজীবনে নাবালিকা বিয়ের ঘটনায় এরকম ভাবে অভিযোগ দায়ের ও নাবালিকার বাবাকে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠানো দেখা যায়নি। বিডিওর অভিযোগ দায়ের খুবই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। আগামী দিনে নাবালিকা বিয়ে বন্ধ করার ক্ষেত্রে মানুষজনকে অনেক বেশি সচেতন করবে। ’’ তবে ওই ব্লকের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘কয়েক বছরে কমপক্ষে ২৫টির বেশি নাবালিকার বিয়ে হয়েছে। কিন্তু মুচলেকা দিয়ে বিয়ে বন্ধ করা হলেও পরে লুকিয়ে বিয়ে দিয়ে দেন।’’ ঝাড়গ্রামে নাবালিকা ও বাল্য বিবাহ রোধে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা একটি সংস্থার কর্ণধার স্বাতী দত্ত বলেন, ‘‘নাবালিকার বিয়ে দেওয়ার পর পরিবারের লোকজনকে গ্রেফতারের ঘটনা ঝাড়গ্রাম জেলায় এই প্রথম ও নজিরবিহীন। যে হারে করোনা কালে বাল্যবিবাহ বেড়েছে সেই পরিস্থিতিতে গ্রেফতার খুবই প্রয়োজন ছিল। আইন বলে যে কিছু রয়েছে তা মানুষকে জানানো দরকার ছিল। এক্ষেত্রে পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকা খুবই সদর্থক।’’