আমরা পূর্বের পর্বগুলিতে জেনেছি যে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী দীক্ষা নিয়েছেন ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে ব্রহ্মানন্দ স্বামীর থেকে। আর তিনি সম্পূর্ণভাবে ব্রাহ্ম ধর্মের প্রভাব মুক্ত হন ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে। স্বভাবতঃই মনে প্রশ্ন আসতে পারে , যখন তিনি দীক্ষা গ্রহণ করেই ফেললেন তখন কেন এত দিন সময় লেগে গেল ব্রাহ্মধর্ম পুরোপুরি পরিত্যাগ করতে। এর উত্তরে জানাই ব্রহ্মানন্দই তাঁকে নিষেধ করেছিলেন সেই মুহূর্তে ব্রাহ্মধর্মকে সম্পূর্ণভাবে বর্জন করতে নিজের জীবন থেকে । দীক্ষা প্রদানের কিছুকাল পর বিজয়কৃষ্ণকে তিনি বলেছিলেন, “বিশ্বনাথধাম কাশীতে যাও। সেখানে হরিহরানন্দ সরস্বতী নামে একজন সন্ন্যাসী আছেন। তুমি তাঁর থেকে সন্ন্যাস গ্রহণ করো। তোমার ব্রাহ্মসমাজে গমন, ব্রাহ্মণেতর জাতির হাতে অন্ন ভোজন, উপবীত ত্যাগ ইত্যাদি সারা জীবনের যাবতীয় প্রসঙ্গ সব তাঁকে খুলে বলবে ; তারপর তিনি যেমন যেমন আদেশ করবেন সেই মতো কাজ করবে। নিজের কল্যাণ যদি চাও তবে তাঁর নির্দেশ নির্বিচারে পালন করবে। ”
শ্রীগুরুর অনুগত শিষ্যের মত বিজয়কৃষ্ণ বারাণসী গিয়েছিলেন তাঁর ব্রহ্মচারী বান্ধবকে সঙ্গে নিয়ে। হরিহরানন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সবটা বলেছিলেন। হরিহরানন্দ বলেছিলেন, “দেখো তুমি এমন এক বৃহৎ আধার যে, তোমার ক্ষেত্রে নিয়ম-নীতি পালনের আবশ্যকতা পড়ে না। কিন্তু শাস্ত্র ও সদাচারের মর্য্যাদা রক্ষা করা তোমার কর্তব্য । তাই তোমায় প্রায়শ্চিত্ত করে উপবীত ধারণ করতে হবে। অন্যথায় তোমায় আমি সন্ন্যাস প্রদান করতে পারব না। কারণ আমি শাস্ত্রকে ভীষণভাবে মর্য্যাদা দেই।”
উপবীত ধারণের কথা শুনে বিজয়কৃষ্ণ যেন চমকে উঠলেন। নিজের অন্তরের যে বিশ্বাসকে সম্মান জানাতে তিনি এতদিন ধরে উপবীত পরিত্যাগ করে আছেন, আজ সেই বিশ্বাসকে বর্জন করে উপবীতকে আপন করতে হবে ! এ যে তার আদর্শের অননুকূল কর্ম করা হবে ! না, না ! এ কর্ম তিনি কখনোই করতে পারবেন না ! (পূর্বের পর্বয় আমরা জেনেছি কেন তিনি উপবীত ত্যাগ করেছেন)
বিজয়কৃষ্ণের মনে যখন এ জাতীয় আদর্শ বিষয়ক অনুকুল-প্রতিকূল তুফান উঠলো উপবীতকে কেন্দ্র করে , তখন সাধনবিজ্ঞ, অভিজ্ঞ হরিহরানন্দজীর নজর এড়ালো না তা। বিজয়কৃষ্ণের অন্তরের ঝড়ের আভাস পেয়ে তিনি তখন বাৎসল্য ভরে বোঝানোর ভঙ্গীতে বললেন, “দেখো বাবা, ব্রাহ্মণদের ক্ষেত্রে সন্ন্যাসের নিয়ম হল শিখা-সূত্র ত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করতে হয় । তোমার যদি উপবীত না-ই থাকে তবে তুমি ত্যাগ করবেটা কী ! সন্ন্যাস গ্রহণ করবে কেমন করে তবে ? এবার তুমিই বলো গুরু-আজ্ঞা পালন করতে প্রায়শ্চিত্ত করে উপবীত ধারণ করবে নাকি নিজের আদর্শে অটুট থাকবে ?”
বিজয়কৃষ্ণ অনুধাবন করলেন হরিহরানন্দের আদেশের উদ্দেশ্য। বাক্য নেই তাঁর মুখে। কথায় বলে মৌনতা সম্মতির লক্ষণ। হরিহরানন্দ উপলব্ধি করলেন যে তাঁর বোঝানো মনে ধরেছে বিজয়কৃষ্ণের। তাই তিনি তখন বললেন, “বুঝলে বাবা, এজন্যই তোমায় প্রায়শ্চিত্ত করে উপবীত ধারণ করতে বললাম!”
বিজয়কৃষ্ণ বিষয়ের গুরুত্ব বোঝার মত করে সম্মতি সূচক মাথা নাড়লেন। এরপর নির্দিষ্ট দিনে স্বামীজি তাঁকে প্রায়শ্চিত্ত করিয়ে উপবীত প্রদান করলেন। শাস্ত্রানুসারে বিরোজা হোম করিয়ে শিখা-সূত্র পরিত্যাগ করিয়ে সন্ন্যাস আশ্রম প্রদান করলেন।
সন্ন্যাস গ্রহণ করার পর বিজয়কৃষ্ণ সংসার পরিত্যাগ করতে চাইলেন । কিন্তু, দীক্ষাগুরু পরমহংসজী (ব্রহ্মানন্দ স্বামী) তাঁকে বারণ করলেন । তিনি বললেন, “না , না , তুমি স্ত্রী-পুত্র-পরিজনকে পরিত্যাগ করবে না। এদের সঙ্গে থেকেই সাধন করো । এতেই তোমার মঙ্গল । কোন প্রয়োজন নেই এদেরকে ত্যাগ করে বেরিয়ে এসে একান্তে সন্ন্যাসী হয়ে থাকার। সংসারে থেকেই সন্ন্যাস ধর্ম পালন করবে তুমি । আর তোমায় ব্রাহ্মধর্মও এই মুহূর্তে ত্যাগ করতে হবে না । যেমন যুক্ত আছো তেমনই থাকো। দেখবে একসময় সব নিজে থেকেই একে একে খসে যাবে। ঠিক যেমনভাবে সাপের খোলস ত্যাগ হয় তেমন ভাবে নিজে থেকেই ছেড়ে যাবে ।”
আর এ কারণেই আমরা বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজীর জীবন পর্য্যালোচনা করলে দেখতে পাই বিষ্ণুমন্ত্রে দীক্ষিত হবার পরও তিনি ব্রাহ্মধর্ম প্রচারক হিসেবে নিজ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন । মহাজীবন বোধ হয় এমনই হয়—- যা আমাদের মত সাধারণেদের জীবনের নির্দিষ্ট নিয়মে বাধা ছকের সাথে মেলে না।
(ক্রমশঃ)
ভক্ত-পদধূলি-প্রার্থীনী
রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।