শ্রীবিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীপাদ-এক আশ্চর্য‍্য মহাজীবন কথা:(পর্ব-১৯) : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

0
657

বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীপাদ সন্ন্যাস আশ্রম গ্রহণ করার পর বৃন্দাবনে এসেছিলেন ১২৯৬ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ ১৮৮৯ সালে। গোপীনাথ বাগে দাউজীর মন্দিরে তিনি প্রায় এক বৎসর বাস করেছিলেন তখন । এসময় গৌরশিরোমণি মহাশয়ের সঙ্গে তাঁর বিশেষ হৃদ্যতা হয়। পরম ভাগবত, সিদ্ধ-বৈষ্ণব শিরোমণি মহাশয় ও বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীপাদের পারস্পরিক ইষ্টগোষ্ঠীতে প্রেমতরঙ্গের প্রবল প্রভাবে যেন প্রেমসিন্ধু উথলিত হত । একে অপরের হৃদয়ের কথা আদান-প্রদানে পরম সুখ অনুভব করতেন। হৃদয়ের কপাট উদ্ঘাটন করে মনের কথা বলতেন তাঁরা। সার্থক মণি-কাঞ্চনের যোগ হলো যেন তাঁদের মিলনে।
বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীপাদ বৃন্দাবনে আসার পরে একদিন অদ্বৈত আচার্য তাঁকে স্বপ্নদর্শন দিয়ে মালা-তিলক ধারণ করার আদেশ দিলেন। আদেশ অনুযায়ী কর্ম করলেন তিনি। আবার রুদ্রাক্ষের মালাও কন্ঠে ধারণ করতেন । একারণেই বৃন্দাবনে তাঁকে নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হলো। প্রবন্ধের শুরুতেই আমরা সেসব কথা জেনেছি। বিজয়কৃষ্ণ কিভাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে যুক্তি দেখিয়েছিলেন তাও জেনেছি ‌। তাই সে প্রসঙ্গের ইতি টানলাম এখানে।
একদিন শ্রীবৃন্দাবনে নগরকীর্তন বেরিয়েছে তখন। খোল ,করতাল, ঝাঁঝের অপূর্ব অনুরণনে ,ধ্বনি-প্রতিধ্বনিতে ব্রজের দিব্য পরিবেশ আরো বেশি মধুর লাগছে । কীর্তনের সুর বহুদূর থেকে ভেসে আসছে। প্রভুপাদ কর্ণ পেতে তা শ্রবণ করার চেষ্টা করছেন। আহা কি অপূর্ব আবেশ হরিনামের! প্রকৃতই মধুমাখা হরিনাম ! প্রভুপাদ এখন শৌচাগারে বসে আছেন । যখন কীর্তনের দল তাঁর বাসার সামনের পথে এল, প্রভুপাদের ভাবাবেশ এমন প্রচন্ডভাবে হলো যে তিনি আর স্থির থাকতে পারলেন না ।শৌচাগার থেকে বেরিয়ে এসে সংকীর্তনের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিলেন। দু’বাহু ঊর্ধ্বে উত্তোলিত করে তালে তাল মিলিয়ে সংকীর্তন দলের সাথে চলতে থাকলেন । এত আনন্দ, এত আনন্দ(!)—দেহে আর ধরে রাখতে পারছেন না যেন । মনে মনে ভাবছেন , “হায় রে , আমি কতই না মন্দমতির ছিলাম। ভক্তিযোগের এমন আনন্দ পারাবারে নিমজ্জিত না হয়ে শুষ্ক ব্রহ্মজ্ঞানচর্চায় ব্যস্ত ছিলাম এতকাল ! বাস্তবিক শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতের কথার সত্যতা উপলব্ধি করলাম আজ —–
অরসজ্ঞ কাক চুষে জ্ঞান নিম্বফলে।
রসজ্ঞ কোকিল খায় প্রেমাম্র-মুকুলে।।
অভাগিয়া জ্ঞানী আস্বাদয়ে শুষ্ক-জ্ঞান।
কৃষ্ণপ্রেমামৃত পান করে ভাগ্যবান।।”
সংকীর্তনের দল একসময় তাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছালো। গোস্বামীজীও সাথে সাথে অ0ত দূর অবধিই এসেছেন। সেখানে কীর্তন অন্তে হরির লুট হলো। হরির লুট খেয়ে নিজ বাসায় ফিরে এলেন তিনি। কিন্তু বাসায় ফিরতেই তাঁর এক অদ্ভুত কথা স্মরণে এল। আর স্মরণে আসামাত্রই তিনি অত্যন্ত লজ্জিত বোধ করতে থাকলেন । তিনি তো শৌচকার্য অসমাপ্ত রেখে ওই দশাতেই ছুটে গিয়ে কীর্তনে যোগ দিয়েছিলেন। “হায়, হায়! এমন বুদ্ধিভ্রষ্ট হল আমার !” ——– এসব নানা ভাবনায় ভাবিত হলেন গোস্বামীজী। তারপর শৌচকর্ম সমাপ্ত করলেন।
বিকেলে যখন গৌরশিরোমণি মহাশয় ইষ্টগোষ্ঠী করতে এলেন , তখন তাঁকে সব খুলে বললেন বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজী। প্রথমে খুব হাসতে থাকলেন গৌরশিরোমণি , তারপর বললেন —”প্রভু, দেখুন ভাগবতের কথা কেমন সত্য প্রমাণিত হলো আরো একবার। সেখানে বলা হয়েছে, সাধক প্রথমে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেন , পরে যোগে পরমাত্মা রূপে তাঁকে প্রাপ্ত করেন এবং শেষে ভক্তিযোগে ভগবানের নামসিন্ধুতে নিমগ্ন হন।
আপনি তো ভাগবতের সেই অবস্থা লাভ করেছেন। আর তাই আপনার শৌচ-অশৌচ জ্ঞান চলে গেছে। নামামৃত পানে বিভোর হয়েছেন, মত্ত হয়েছেন । মত্ত হলে শৌচ-অশৌচ বোধ যে থাকবে না তা তো স্বাভাবিক, তাই না ?”
তখন গৌরশিরোমণি মহাশয়ের কথা শুনে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীপাদ খুব হাসতে থাকলেন।

(ক্রমশঃ)
ভক্ত-পদধূলি-প্রার্থীনী
রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক