কেরামতি : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

0
572

“সারা দিন তুমি বাড়িতে নেই ! আনাচে কানাচে তোমার হদিস নেই । বন্ধু বান্ধবদের কাছে তোমার খোঁজ নেই । তা হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে কোথা থেকে ফিরলে ?” কম্পকণার উদ্দেশে লক্ষণবাবু কিছুটা বিরক্তির স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন ।
বাবার মুখের উপর কী উত্তর দেবে কম্পকণা ভেবে পাচ্ছিলো না । তাই খানিকটা আমতা আমতা করে কম্পকণা উত্তর দিলো, “বাবা, আমি আমলাই গ্রামের লাগোয়া কার্পাসডাঙ্গা গাঁয়ে গিয়েছিলাম । সেখানে আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিলো ।“
“সেখানে গুরুত্বপূর্ণ কাজটা কী শুনি ? যে কাজটার কথা তুমি বাড়িতে জানিয়ে যেতে পারলে না । তুমি এম-এ পাশ করলে, অথচ চাকরির প্রচেষ্টার প্রতি হেলদোল নেই । চাকরির চেষ্টার প্রতি তোমার চূড়ান্ত অবহেলা ! তোমার বিয়ের বয়স হয়েছে, অথচ বিয়ের কথা বললেই তোমার সেই এক কথার পুনরাবৃত্তি “নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বিয়ে করবো” । অথচ এগ্রাম-সেগ্রাম ঘোরাঘুরিতে ষোলোআনা সক্রিয় । সেখানে কোনো শীথিলতা নেই !
“বাবা, তুমি তো জানো, আমলাই পার হলেই কার্পাসডাঙ্গা গ্রাম । পুরোটাই আদিবাসী অধ্যুষিত । প্রায় দেড় শত বাসিন্দা । গাঁয়ে বেশীর ভাগ মানুষ গরীব । কসরত করে তাদের জীবনযাপন । বসবাসরত মানুষ প্রায় প্রত্যেকেই দিনমজুর । “দিন-আনি-দিন-খাই” তাদের সাংসারিক অবস্থা । গ্রামবাসীর বাড়ি-ঘরের অবস্থা তথৈ-ব-চ । বেশীর ভাগ মানুষের ঘর-বাড়ি হোগলা পাতার বেড়া ও তাল পাতার ছাউনির । যদিও তার মধ্যে কয়েকজনের মাটির বাড়ি এবং কিছু বাড়িতে পাট কাঠির বেড়া ও খড়ের ছাউনি । বিজলী বাতি আজও গ্রামবাসীর কাছে অধরা । রাস্তা-ঘাটের অবস্থা শোচনীয় । প্রাথমিক বিদ্যালয়ও দূরে । একেতেই গরীব মানুষের বসবাস তার উপর প্রাথমিক স্কুল অনেক দূরে, যার জন্য লেখাপড়ার চিন্তাভাবনা দূরঅস্ত । প্রত্যেকের দুজন-তিনজন সন্তান । অথচ স্কুলে যাওয়ার ছেলে-মেয়ে হাতে গোনা কয়েকজন । প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই । স্টেশনের কাছাকাছি একটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে বটে, সেখানেও অর্ধেকদিন ডাক্তার থাকে না । গাঁয়ের কয়েক ঘর আদিবাসী বাজারে মাছ বিক্রি করে সংসার চালায় । কয়েক ঘর মানুষ স্কুলে, পঞ্চায়েত অফিসে, স্টেশনে, ঝাড়ুঁদারের কাজ করে । আর অন্যান্য গ্রামবাসী পরের জমিতে দিন-মজুর খেটে সংসার অতিবাহিত করে । ভোরে উঠে তারা কাজে ছোটে, আর বাড়ি ফেরে রাত্রিতে । বাড়ির বৌয়েরা পরের বাড়ি ফাইফরমাশ খাটে । এমনকি চাষের জমিতে ধান রোয়ার কাজ পর্যন্ত করে । কয়েকজন ভ্যানরিক্সা টেনে সংসার চালায় ।“ এতগুলি কথা বলার পর কম্পকণা থামলো । থামলে কী হবে, তার শারীরিক ভাষা বুঝিয়ে দিচ্ছে আরও কথা বলার ছিলো । অনেক দুঃখ কষ্টের মধ্যে ঐ গ্রামের মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপন । কম্পকণার মূল উদ্দেশ্য, “গাঁয়ের মানুষদের পাশে দাঁড়ানো ! তাদের মধ্যে শিক্ষার আলো প্রবেশ করানো ?”
“কার্পাসডাঙ্গা গাঁয়ের ফিরিস্তি শুনে আমার কী লাভ !”
বাবা ! তুমি ভালভাবেই জানো, আমি সমাজ কল্যাণ কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে ভালবাসি । রাত দিন সেটাই আমার ধ্যান-জ্ঞান ।
সমাজ কল্যাণের সঙ্গে কার্পাসডাঙ্গা গ্রামের হালহকিকতের কী সম্পর্ক ?
সম্পর্কের কথাই তো তোমাকে জানাতে চাইছি ? হালহকিকতের কথা তোমার জানা প্রয়োজন !
( ২ )
ঠিক আছে । তাড়াতাড়ি তোমার কথা শেষ করো । আমাকে আবার দোকানে ছুটতে হবে । তোমার মায়ের ফরমাশ — ঘরে মসুরির ডাল, পাঁচফোড়ন ও জিরের গুড়ো বাড়ন্ত । সুতরাং সেগুলি আনতে যেতে হবে ।
“কার্পাসডাঙ্গা গ্রামে প্রায় একশত বাচ্চা ছেলে-মেয়ে নিয়ে আমি স্কুল খুলেছি । তাদের একটিই জ্বলন্ত সমস্যা, বাবা-মায়ের আর্থিক অনটন । ঘরে তাদের খাবারের আকাল । অভিভাবকেরা বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানোর চেয়ে বরং রুটি-রোজগারের জন্য কাজে পাঠাতে বেশী আগ্রহী । সুতরাং তুমি বুঝতে পারছো, ঐ আদিবাসী মানুষগুলির মানসিক স্থিতি কোন্‌ পর্যায়ে ?” লক্ষণবাবুর দিকে তাকিয়ে কম্পকণা বললো ! তাই তাদের আর্থিক উন্নয়ন নিয়ে সর্বাগ্রে ভাবা প্রয়োজন । সেই জন্য আজ অভিভাবকদের নিয়ে বসেছিলাম । সেখানে সাব্যস্ত হয়, প্রত্যেক বাচ্চার মায়েদের রুটি-রোজগারের জন্য কিছু একটা কাজ করতে হবে । আমার সঙ্গে আমার বন্ধু অর্ণব ছিলো । সে কতকগুলি স্বল্প রোজগারের প্রস্তাব দিয়েছে যেমন খেপলা জাল বোনা, মাছ ধরা, গরুর গোবর থেকে ঘুটে তৈরী করা, হাঁস-মুরগী-ছাগল পালন, বাড়ির পাশের জমিতে প্রয়োজনীয় সব্জির চাষ, এমনকি সেলাই মেশিনে সেলাই করা । আদিবাসী মানুষেরা আমাদের প্রস্তাবে সহমত পোষণ করেছেন । ইতিমধ্যে আমরা সকল গ্রামবাসীর স্বাক্ষর সংগ্রহ করে গাঁয়ে বিজলী বাতির জন্য এবং সত্বর গাঁয়ে প্রাথমিক স্কুল খোলার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছি । তা ছাড়া আমরা গ্রামের দুইজন আদিবাসী গ্রামবাসীকে নিয়ে জেলা সমাহর্তার সঙ্গে দেখা করে গ্রামের উন্নয়নের উপর নজর দিতে অনুরোধ জানিয়েছি । স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পাওয়ার পর ঐ কার্পাসডাঙ্গা আদিবাসী গ্রাম আমি বেছে নিয়েছি সেখানকার মানুষকে সমাজের মূল স্রোতে আনার জন্য । তাদের মধ্যে এখনও একটা হীনম্মন্যতা কাজ করছে । কেননা তাঁরা রাষ্ট্র ও সমাজের কাছে নীচু জাতের । তারা পিছলে বর্গের । সুতরাং শিক্ষা-দীক্ষা, আধুনিক সমাজ-সভ্যতায় বিচরণ, তাঁদের কাছে নিছকই উপহাসের সমতুল । পুরোটাই হাস্যকর । এখানেই আমাদের প্রয়াস, তাদের চিরাচরিত মানসিকতার বিলোপসাধন । হীনম্মন্যতা থেকে তাঁদেরকে আধুনিক চিন্তাভাবনার মধ্যে উত্তরন । আর্থিকভাবে তাদেরকে স্বাবলন করা । কতটা কী হবে জানি না, তবে উন্নয়নে আমাদের নিরলস প্রয়াস অক্ষুন্ন থাকবে এবিষয়ে নিঃসন্দেহ ।
লক্ষণবাবু মেয়ের কথা শুনে আশ্বস্ত হতে পারলেন না, বরং আগাগোড়া গম্ভীর রইলেন । তাই আর একবার স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন, যেটাই করো পরের পেটে ভাত জোগানোর চিন্তার আগে নিজের পেটের ভাতের চিন্তা সর্বাগ্রে । কথাটা মনে রেখো । তারপর সমাজ নিয়ে মাতামাতি, লাফালাফি, চিন্তাভাবনা সব কিছুই করতে পারবে ।
হঠাৎ অর্ণবের টেলিফোন !
অর্ণবের টেলিফোন দেখে কম্পকণা খানিকটা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “হঠাৎ ফোন করলে ? কোনো খারাপ খবর কী ?”
উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কিছু নয় । আমি একটি হাই স্কুলে করণিক পদে ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম । আমাদের ব্লকের গোয়ালপাড়া গ্রামে । সেই চাকরিটা হয়ে গেছে । সমস্যা যেটা, সেটা হচ্ছে কালই জয়েন করতে হবে ।
অর্ণবের কথা শুনে কম্পকণা হতচকিত হয়ে বললো, কার্পাসডাঙ্গার এত বড় প্রোজেক্ট আমি একা কীভাবে সামলাবো সেটা আমার মাথায় ঢুকছে না । তুমি তো জানো, আমলাই গ্রামের মানুষ কিছুতেই আদিবাসীদের ভাল চান না, এমনকি আদিবাসী গ্রামের মানুষদের ভাল চোখে দেখেন না । আমলাই গ্রামের কিছু মানুষের অবাঞ্ছিত চিন্তাভাবনা, আদিবাসীরা শিক্ষিত হলে আখেরে তাঁদের ক্ষতি । তাই তাঁদের আক্রোশ, আদিবাসীরা যে তিমিরে রয়েছে সেই তিমিরেই থাক্‌ । বরং দরকার হলে আদিবাসী ছেলে-মেয়েরা গোল্লায় যাক, তবুও তাদের স্কুলে যাওয়ার পথ সুগম করবে না । আদিবাসীরা শিক্ষিত হলে, তাঁদের বাড়ি বাড়ি কারা ঝাড়ু দেবে । বাড়িতে ফাইফরমাশ খাটার লোক পাওয়া দুষ্কর হবে । এহেন পরিস্থিতিতে আমি কীভাবে একা সামাল দেবো সেটাই ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছি না ।
তুমি তোমার মতো এগিয়ে যাও । তা ছাড়া আমার স্কুল কাছেই । বাড়ি থেকে যাতায়াত । সুতরাং তোমার পাশে আমি সর্বক্ষণ থাকবই । জয় তোমার হবেই ।

( ৩ )
তারপর বেশ কিছুদিন কেটে যাওয়ার পরে হঠাৎ কার্পাসডাঙ্গার বনমালী টুডুর বয়স্থা মেয়ে, ললিতাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না । আনাচে-কানাচে শোনা যাচ্ছে, নারী পাচারকারীরা তাকে তুলে নিয়ে গেছে । ভিন্‌ দেশে চালান করে দেওয়া দুষ্কৃতিদের উদ্দেশ্য । ইদানীং নাকি নারী পাচারকারীরা ভীষণ সক্রিয় ।
খবর পেয়ে তক্ষুণি ছুটলো কম্পকণা । কোনোমতে থানায় পৌঁছে এফ-আই-আর করলো । তারপর শুরু হল বনমালী টুডুর মেয়ের তল্লাশী । প্রথমটায় পুলিশি তল্লাশীতে ঢিলেঢালা । কিন্তু পরবর্তিতে পুলিশ আদা জল খেয়ে বনমালী টুডুর মেয়েকে উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়লো ।
বনমালী টুডুর মেয়েকে উদ্ধারে কম্পকণা রীতিমতো উদ্বিগ্ন । কার্পাসডাঙার মানুষদের নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঝাঁপিয়ে পড়লো কম্পকণা । প্রচণ্ড ছোটাছুটি । নানান অফিসে দরবার ! মেয়েটাকে উদ্ধার করা কম্পকণার জীবনে এখন একটা বড় চ্যালেঞ্জ !
তখন সন্ধ্যা । অন্ধকার পুরোটা হয়নি । কার্পাসডাঙা থেকে সাইকেলে বাড়ি ফিরছে কম্পকণা । থানা থেকে সোজা গিয়েছিলো কার্পাসডাঙ্গায় বনমালী টুডুর বাড়ি । সেখান থেকে ফিরতে সূর্য ডুবে গেলো । কার্পাসডাঙ্গা থেকে কম্পকণাদের বাড়ি প্রায় দুই কিলোমিটার । অন্ধকারে মেয়েদের চলাফেরার ক্ষেত্রে রাস্তাটা ভীষণ ঝঞ্ঝাটপূর্ণ । তাই সাইকেল নিয়ে জোরে ছুটছে কম্পকণা । হঠাৎ কয়েকজন দুষ্কৃতি গামছায় মুখ ঢেকে কম্পকণার রাস্তা আটকে বিশ্রী ভাষায় বলল, ”এবার তোকে কোন নাগর বাঁচাবে ? থানায় নালিশ করা । আদিবাসীদের ক্ষেপিয়ে তোলা । স্কুল খুলে পণ্ডিতি দেখানো ।“ বলেই কম্পকণার হাত ধরে টানতে যাবে এমন সময় কম্পকণা সজোরে দুষ্কৃতির হাতে আচমকা আঘাত ! তারপর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে কম্পকণার চিৎকার, “বাঁচাও ! বাচাও !”
কম্পকণা গ্রাম বাংলায় মানুষ হওয়ার সুবাদে প্রচণ্ড সাহসী । সহজে ঘাবড়ে যাওয়ার মেয়ে নয় । তার ক্যারাটের কায়দা কানুন কলেজে পড়ার সময়েই রপ্ত করা । এব্যাপারে তার দাদা উৎসাহ জুগিয়েছিলো । তাৎক্ষণিকভাবে নিজেকে বাঁচানোর কৌশল তার আয়ত্বে । যার জন্য ক্যারাটের কানুনের প্রক্রিয়ায় আগন্তুকের হাতে আঘাত দিয়ে কম্পকণা হাত ছাড়াতে সক্ষম হল ।
ইতিমধ্যে তার চিৎকার শুনে কাছাকাছি গাঁয়ের মানুষ ছুটে আসছে । অন্যদিকে খবর পেয়ে কম্পকণার দাদা বোনকে বাঁচাতে সক্রিয় হয়ে উঠলো । সঙ্গে সঙ্গে তার ফোন কার্পাসডাঙার গ্রামবাসীদের । ফোন পেয়ে কার্পাসডাঙ্গার গোটা গ্রামবাসী হাতে মশাল জ্বালিয়ে রীতিমত দৌড়াচ্ছে । দুইদিক থেকে গ্রামবাসীর দল প্রায় কাছাকাছি । দুষ্কৃতিরা বিপদের সম্ভাবনা আঁচ করতে পেরে তাদের এলোপাথাড়ি দৌড় । পালিয়ে বাঁচার জন্য প্রাণপন চেষ্টা । কিন্তু কার্পাসডাঙ্গার মানুষেরা ছাড়বার পাত্র নয় । তাদের প্রিয় দিদিমণির প্রতি অশালীন আচরণ । মোটর বাইকে উঠার আগেই একজন দুষ্কৃতি কার্পাসডাঙ্গা গ্রামবাসীদের হাতে ধরা পড়লো । সেই সময় পুলিশ পৌঁছানোর কারণে দুস্কৃতিটা গণধোলাই থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পেলো ।
কম্পকণা পরে জানতে পেরেছিলো, ধরা পড়া দুষ্কৃতির জন্যেই বনমালী টুডুর মেয়েকে উদ্ধার করা তরান্বিত হয়েছিলো ।
কম্পকণা বাড়ি ফিরে দেখে, অর্ণব তার অপেক্ষায় অপেক্ষারত ।
অর্ণবকে দেখে কম্পকণা হেসে বললো, আর কয়েকটা দিন সবুর করো । কেননা কার্পাসডাঙ্গার কাজ দ্রূতগতিতে এগোচ্ছে । প্রাথমিক স্কুল ও পোষ্ট অফিস খোলার পথে । সরকারি একশদিনের কাজ তারা পাচ্ছে । তাদের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য এখন বিকাশের পথে । সুতরাং ……!
তারপর বিমর্ষ মুখে অর্ণবের উত্তর, যথা আজ্ঞা ।
——————০——————
এ১০ক্স/৩৪, কল্যাণী-৭৪১২৩৫ / মো –+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪