এক মুঠো ধুলো মুখের ওপর এসে পড়তেই সজাগ হলাম ,আসলে গল্পে মত্ত ছিলাম আমরা। তৃষিতা বলে উঠলো ,
-ঝড় উঠেছে রে ।
হাওয়ার ঝাপটা লাগছে শরীরে ,আহ্! প্রচন্ড গরমের পর এই উদ্দাম হাওয়ায় কি যে প্রশান্তি!
-অবশেষে কাল বৈশাখী এলো,শ্রাবনী বললো।
আমি এই আশঙ্কাটাই করছিলাম ,ঝড় বৃষ্টিতে খুব ভয় আমার কিন্তু ছেলের কোচিং ক্লাস ,সপ্তাহে একদিন ওকে কোচিং এ দিয়ে বসে থাকতেই হয়।সে না হয় বসাই যায় ,গল্পে গল্পে দারুন সময় কেটে যায় কিন্তু বৈশাখ মাস ,ঝড় এলে যাবো টা কোথায়! আজকাল বাজ পড়ে খুব ,তাছাড়া গাছের ডাল পালাও তো ভেঙে পড়তে পারে! যতটা উৎসাহ নিয়ে তৃষিতা আর শ্রাবনীর সঙ্গে গল্পে মেতে ছিলাম সে উৎসাহে ভাটা পড়ে গেল প্রচন্ড দুশ্চিন্তায় ।এক্ষুনি বৃষ্টি নামবে ,এবার ভিজবো নির্ঘাত ,সঙ্গে ফোনটাও ভিজবে।
মাঝারি মাপের একটা মাঠের এক কোনে সিমেন্টের বসার জায়গা ,ওপরে টিনের ছাউনি ,পাশেই তালা বন্ধ ক্লাব ঘর ।মাঝে মাঝে দেখেছি ক্লাব ঘর খোলা থাকে ,টিভি চলে বা ক্যারাম খেলা হয়।মাস দুয়েক ধরে আমরা ছেলেমেয়েদের পড়তে দিয়ে ঘন্টা দুয়েক ওই ছাউনি দেওয়া সিমেন্টের বসার জায়গাটায় বসে থাকি । দলে আমরা পাঁচজন থাকলেও দুজন আসে নি। মনে মনে ভাবলাম যা দুর্যোগ শুরু হয়েছে ওরা না এসে ভালোই করেছে।
আমরা যেখানে আছি সেই জায়গাটা নিরাপদ নয় বুঝতে পারছি । আসে পাশে বড় গাছ আছে তারা যেভাবে দুলছে হওয়ার দাপটে, ভয় লাগছে।কয়েকটা ছেলে কে দেখলাম এরই মধ্যে আম কুড়োতে চলে এসেছে ক্লাব সংলগ্ন আমগাছটি থেকে টুপটাপ আম পড়ছে।
হাওয়া তো চলছেই,উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে সব।সঙ্গে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আর মেঘ ডাকছে।যেন মহা প্রলয় আসন্ন।এরই মধ্যে ঝুপ করে দোসর হলো বৃষ্টি।বৃষ্টি পড়ছে ঝমঝমিয়ে।ছেলেগুলো এবার পালালো।বৃষ্টির ছাঁট আমাদের গায়ে এসে লাগছে ।আমরা তিনজনই বেশ জড়োসড়ো।
-কোথায় যাবো এবার!ক্লাব ঘরটাও যদি খোলা থাকতো! আমি বললাম।
তৃষিতা বললো,
-কিছু লাভ হতো না অচেনা পুরুষ মানুষদের মাঝে ভিজতে ভিজতে আমাদের ঢুকে পরাটা ঠিক হতো না ,দিনকাল একদম ভালো না।
শ্রাবনী আশ্বাস দিয়ে বললো ,
-দেখ না এক্ষুনি কমে যাবে ,এ ঝড় বৃষ্টি বেশিক্ষন চলবেনা। যদিও বৃষ্টির প্রবল ছাঁটে আমরা একটু একটু করে ভিজতে শুরু করেছি ।
সন্ধ্যে নেমে গেছে ,হালকা অন্ধকারে বিদ্যুতের ঝলকানি , প্রবল বৃষ্টি আর হিমেল হাওয়া ।আচ্ছা বিপদ তো!হ্যাঁ ,এটা কলকাতা শহর হলেও কেমন একটা পাড়া পাড়া ব্যাপার আছে ,আসলে এখানে ফ্ল্যাটের আধিক্য কম, সবই প্রায় বসত বাড়ি।তবে যা হয় বাড়িগুলো লোকজনের অভাবে সন্ধ্যাবেলায় বেশ শুনশান আর ঝড়জলের মধ্যে জানালা দরজা সব বন্ধ। পাড়ার মধ্যেই এই ক্লাব বালক সমিতি। ভাবছিলাম সময় থাকতে যদি কোনো বাড়িতে বলে বারান্দায় অন্তত আশ্রয় নেওয়া যেত সেটা বুদ্ধির কাজ হতো।শ্রাবনী বোধহয় আমার মনের কথাটা আন্দাজ করলো।বললো,
– আগেই যদি ওই বাড়িগুলোর দিকে ছুট লাগাতাম ভালো হতো।
তৃষিতা বললো ,
-পাগল নাকি !যা দিনকাল কেউই ঢুকতে দিত না।দেখিস না ঝড় জলে আশ্রয় চেয়ে ডাকাতি করে মেরে ধরে পালায় ,কে বিশ্বাস করবে আমাদের!
আমার হাসি পেল এবার, এই বিপদের মধ্যেও।তৃষিতা বোধহয় কাউকেই বিশ্বাস করে না।
শ্রাবনী এবার মজার ছলে বললো,
-“এমন ঝড় জলের রাতে কিন্তু তেনাদের দেখা পাওয়া যায়।”
আমি বুঝতে পারছি সবারই টেনশন হচ্ছে।শ্রাবনী তাই এসব আজগুবি কথা বলে আলোচনাটা অন্যদিকে টেনে নিয়ে টেনশন কমাতে চাইছে।
বিদ্যুতের ঝলকানি আর মেঘের তর্জন গর্জন ,যেন আসে পাশে বাজ পড়ছে , প্রচন্ড আওয়াজ,কি দুর্যোগের মধ্যে পড়লাম রে বাবা!
শ্রাবনী বলে উঠলো,
-ঠাকুর কে ডাক,ঠাকুর ই রক্ষা করবেন আমাদের।
তৃষিতা ঠাকুরের উদ্দেশ্যে প্রণাম ঠুকলো।
আমি বললাম ,
-ফোন গুলো ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেল,এখন কোনো কল রিসিভ করবি না,বিপদ ঘটতে পারে।
এরই মধ্যে এই দুর্যোগ মাথায় নিয়ে ছাতা মাথায় একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক এসে ক্লাব ঘরের তালা খুললেন। আমি ভাবলাম যাকবাবা এবার যদি ক্লাব ঘরের ভিতরে আমরা ঢুকতে পারি। ভদ্রলোক আমাদের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বললেন ,
-আপনারা ভিতরে এসে বসতে পারেন ।
আমরা তো ওনার প্রস্তাব লুফে নিলাম ছুটে ক্লাব ঘরের মধ্যে গিয়ে ঢুকলাম।যাক বাবা নিশ্চিন্ত হলাম ,বজ্রাঘাতে মরবো না তাহলে কিন্তু ক্লাব ঘর অন্ধকার কেন?কারেন্ট তো আছে,বাইরে আলো দেখা যাচ্ছে ,হাইমাস্ট এর আলো ক্লাব ঘরের দরজা দিয়ে ঢুকছে তাতে ক্লাবঘরের ভিতর পুরোপুরি স্পষ্ট না হলেও আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে।
তৃষিতা বলে ফেললো,
– অন্ধকার কেন?কারেন্ট আছে তো!
ভদ্রলোক মুখে কিছু না বলে প্লাস্টিকের চেয়ার
টেনে এগিয়ে দিতে গেলেন আমাদের বসার জন্য।শ্রাবনী এগিয়ে এসে আপত্তি করলো ,
-একি মেসোমশায় আপনি কেন,আমরাই নিয়ে নিচ্ছি।
ভদ্রলোকের প্রায় সত্তরের কাছাকাছি বয়স কিন্তু শক্ত সমর্থ বলেই মনে বলো।
আমি চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললাম,
– মাথার ওপর ছাদ পেয়েছি এই যথেষ্ট,তাছাড়া দরজা তো খোলা বাইরে থেকে যা আলো আসছে তাতে সব দেখতে পাচ্ছি।
তৃষিতা আমাদের কানের কাছে মুখ এনে বললো, -না না ভয়ের কিছু নেই ,দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভদ্র মানুষ।
শ্রাবনী বললো,
– যাক বাবা কাউকে তো বিশ্বাস করলি!
আমি হেসে ফেললাম।আবার আমরা নিজেদের গল্পে মেতে উঠলাম।ঝড় জল যাই চলুক এবার নিশ্চিন্ত মনে বাকি সময়টুকু কাটিয়ে দিতে পারবো।আমাদের ছেলেমেয়েরাও কোচিং এ স্যারের বাড়ি নিরাপদেই আছে সেটাও জানি। ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপ্টানি গায়ে এসে লাগছে ,বিদ্যুৎ এর ঝলকানি আর মেঘের নিনাদে আধো অন্ধকার ক্লাব ঘরে আমাদের কলকাকলি,বৃদ্ধ কি বিরক্ত হচ্ছেন !ভাবতেই দেখি ভদ্রলোক আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন বললেন ,
-দরজাটা বন্ধ করে দিন বৃষ্টির ছাঁট আসছে।
অগত্যা আমরা মুখ চাওয়াচাই করলাম।এতো পুরো অন্ধকার হয়ে যাবে! শ্রাবনী মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে রেখে দরজা বন্ধ করে দিল আর তখনই ঘরে আলো জ্বলে উঠলো।টিউব লাইটের পরিষ্কার আলোয় আমরা বৃদ্ধকে দেখতে পেলাম না এঘরে।ভিতরে আরেকটি ঘর আছে দেখা যাচ্ছে যদিও ও ঘরে আলো নেই ,বৃদ্ধ হয়তো ওই ঘরে চলে গেলেন,অতি ভদ্র মানুষ তো!
সত্যিই বাবার বয়সী মানুষটির প্রতি আমি একরকম সম্ভ্রম বোধ করলাম।মুগ্ধ করলো ওনার ভদ্র ব্যবহার ।এখনো পৃথিবীতে কত ভালো মানুষ যে আছেন !পরোপকারী আন্তরিক মানুষগুলোর জন্যই পৃথিবী এতো সুন্দর।নাহ!এবার আমাদের উঠতে হবে কোচিং ক্লাস শেষ হওয়ার সময় হয়ে গেছে।বাইরে ঝড় কমেছে।মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকানি আর টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে ।বাইরে বেরোতে পারবো,আর বোধহয় অসুবিধা হবে না।
মেসোমশায়কে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে পড়বো ভেবে ডাকলাম ওনাকে মেসোমশায় সম্বোধনে,সাড়া নেই।
তৃষিতা বললো ,
-কানে কম শোনেন বোধহয় গিয়ে বলে আয়।শ্রাবনী সামনের দরজা খুলে ফেলেছে বাইরে যাওয়ার জন্য ,আমি ভিতরের ঘরের দিকে যেতেই আবার ঘরের আলোটা নিভে গেল,ভিতরের ঘরে উঁকি দেওয়া হলো না,দাঁড়িয়ে পড়লাম আর তখনই মেসোমশায় আমাদের সামনে এলেন এবং বললেন ,
-হ্যাঁ, এবার আসুন আপনারা।
পরের সপ্তাহে আমরা পাঁচজন ছেলে মেয়েদের কোচিং ক্লাসে ঢুকিয়ে আবার সেই ক্লাব ঘরের পাশে সিমেন্টে বাঁধানো টিনের ছাউনি দেওয়া জায়গাটায় গল্পের ঝুলি নিয়ে বসলাম।বর, বাচ্চা, শাশুড়ি ,ননদ ,কাজের লোক ,ছেলে মেয়েদের স্কুলের টিচার ,প্রতিবেশী সবই আলোচনার বিষয়। পি এন পিসি জমে উঠতে না উঠতেই ছেলেমেয়েদের কোচিং ছুটি হওয়ার সময় হয়ে এলো। উঠে পড়লাম ,কাছেই একটা দোকান থেকে চা খেয়ে কোচিং এর সামনে গিয়ে দাঁড়াব।শ্লথ পায়ে হাঁটতে গিয়ে ক্লাবের মাঠের একদিকে যা চোখে পড়লো তা আসার সময় বা উল্টো দিকে মুখ করে বসে থাকায় আমাদের চোখে পড়েনি। থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম ,বিশেষত আমরা তিনজন।
-আগের দিনের ভদ্রলোক না! মারা গেছেন! বিস্ময় ভরা গলায় তৃষিতা বলে উঠলো।
-হ্যাঁ ,উনিই তো সেই মেসোমশায়।শ্রাবনী ভালো করে ছবি টা দেখে নিয়ে নিশ্চিত হয়েই বললো।
ক্লাবের একপাশে একটা চেয়ারে মালা দেওয়া সেই ভদ্রলোকের ই ছবি।গোপীন্দ্র কিশোর দত্ত,সম্পাদক বালক সমিতি ,জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ লেখা।মৃত্যুর তারিখ মাত্র সাত দিন আগের, ঠিক দেখছি তো!ওনার সঙ্গে তো সাত দিন আগেই দেখা হলো।তাহলে তাহলে কি!আমি শ্রাবনীর হাত চেপে ধরেছি ,তৃষিতাও আমাদের খুব কাছে চলে এসেছে।বাকি দুজন কিছু না বুঝে প্রশ্ন করে চলেছে ,
-কি হলো রে তোদের?
“কখন মারা গেলেন ভদ্রলোক?”আমাদের তিনজনের মাথায় হয়তো একই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল।
আমি বললাম,
– চল দেরি হয়ে যাবে ,আগে চা খাই।
চা এর দোকানদারকে শ্রাবনী জিজ্ঞাসা করেই ফেললো ক্লাব সেক্রেটারি গোপীন্দ্র কিশোর বাবুর কথা।
” এই তো আজ শনিবার ঠিক আগের শনিবার নিজের বাড়ির বাথরুমে সকালে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন।হাসপাতালে দেওয়া হয়েছিল কিন্তু সন্ধ্যায় সব শেষ।সেদিন কি প্রচন্ড ঝড় জল হয়েছিল তারমধ্যে খবর আসতেই পাড়ার সব ছুটেছিলাম হাসপাতালে।আসলে উনি আমাদের বাবার মতো ছিলেন,এতো ভালো মানুষ হয় না দিদি।সবার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তেন ,আমার যে কত উপকার করেছেন বলে শেষ করা যাবে না।”
শরীর খারাপ লাগছিল ,সামনে নিলাম ।সেদিনের ঘটনা তাহলে কি…..?
এ হেন ভালো মানুষের সঙ্গে তার মৃত্যুর পরে দেখা হয়ে যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা মোটেও ভয়ের নয় ,তাই সবটা শোনার পর এই সন্ধেরাতে গা ছম ছম করলো না একটুও , বরং ভালো লাগছিল এই ভেবে যে সেদিন মৃত্যুর পরও ভদ্রলোক আমাদের বিপদ থেকে কিভাবে সুরক্ষিত রেখেছিলেন।
তৃষিতা বললো,
– দিনকাল যা পড়েছে না কে মানুষ আর কে ভূত সত্যিই বিশ্বাস করা যায় না।
আমি আর শ্রাবনী বিরক্ত হলাম, ভূত কথাটা মোটেও ভালো লাগলো না বিশেষত ওই ভালো মানুষটি সম্পর্কে।
ওর কথায় আমল না দিয়ে শ্রাবনী বলে উঠলো ,
-ভালো মানুষেরা মৃত্যুর পরও ভালো কাজ করে থাকেন।
এই কথায় সহমত হয়ে আমি বললাম,
“মেসোমশায় যেখানেই থাকুন আপনার মতো মানুষের ভালো হোক।”
সমাপ্ত।