নেপাল ভ্রমণ – একটি বিরল অভিজ্ঞতা (প্রথম পর্ব) : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

0
1731

ভ্রমণের ব্যবহারিক অর্থ নানানরকম । যেমন প্রাতকালীন ভ্রমণ, বৈকালিন ভ্রমণ, নদীর পারে ভ্রমণ, জ্যেৎস্নার আলোয় ভ্রমণ, ট্রেনে-বাসে-উড়োজাহাজে-জলযানে ভ্রমণ, ইত্যাদি । আক্ষরিক অর্থে আমরা যেটা বুঝি ভ্রমণ অর্থ বেড়ানো, ঘোরাঘুরি, এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যাওয়া, অর্থাৎ পর্যটন করা । অন্য অর্থে দেশ ভ্রমণ । এছাড়া ভ্রমণ অর্থ যেটা বুঝি, সেটা হচ্ছে চিত্তবিনোদন, পর্যটন ও অবকাশ যাপন । ভ্রমণ মানুষের জীবনে আনে বৃহত্তের আহ্বান । আনে অজানা সৌন্দর্যের সংবাদ । অচেনার সান্ন্যিধে মানুষ পায় বিষ্ময়ের শিহরণ । তাই ভ্রমণ শুধুমাত্র দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বিদেশ ভ্রমণও সমানভাবে উল্লেখযোগ্য । তবে এটাও ঘটনা, মানুষের মধ্যে ভ্রমণের আবশ্যিক দিক নিজের দেশকে জানবার, বোঝবার, দেখার । নিজের জন্মস্থানের গাঁ-গঞ্জ-শহর-নগর থেকে বেরিয়ে দেশের ও বিদেশের অন্যত্র ভ্রমণের মাধ্যমে জানাটা ভ্রমণের মুখ্য উদ্দেশ্য । তা ছাড়া দিনের পর দিন একই পরিবেশের জীবন যাপন থেকে ক্ষণিকের মুক্তি । একটু বৈচিত্রের আস্বাদনের উপলব্ধি, যে বৈচিত্র আমাদের দেয় অপরিসীম আনন্দ ।
এই ভূখণ্ডকে জানবার জন্য প্রয়োজন দেশ ভ্রমণ । ইতিহাস ও ভুগোলের বাইরে অবাধ উন্মুক্ত খোলা আকাশের নীচে জীবন্ত দেশটি দেখে, তার অধিবাসীদের প্রত্যক্ষ স্পর্শ লাভ করে, তাদের জীবনধারা সম্পর্কে আমরা যে জ্ঞান লাভ করি, সেই জ্ঞানই প্রকৃত জ্ঞান । হৃদয়ের প্রসারতা ও মনের গতি আনে ভ্রমণ । তারই প্রেক্ষাপটে বেরিয়ে পড়লাম নেপাল ভ্রমণে । নেপাল হচ্ছে ভগবান বুদ্ধের জন্মদেশ । এইজন্য এই দেশকে ইংরেজিতে বলে, Nepal —the Birth place of Lord Buddha. তা ছাড়া তুষারশুভ্র পর্বতমালা, ঘনসবুজ বনানীর উপত্যকা, জীব বৈচিত্র্য আর ঐতিহ্যময় সংস্কৃতিতে ঘেরা দেশ নেপাল । মন্দিরময় শহর কাঠমান্ডু । ৭২৩ খ্রিষ্টাব্দে রাজা গুণ কামদেব কাঠমান্ডু শহরটি গড়ে তোলেন । জনশ্রুতি রয়েছে, সংস্কৃত “কাষ্ঠ-মন্ডপ” শব্দটি থেকেই কাঠমান্ডু শব্দের উৎপত্তি ।
কলকাতা থেকে বিমানে সোজা কাঠমান্ডু । কাঠমান্ডু নেপালের রাজধানী ও জনপ্রিয় শহর । কাঠমান্ডুর হোটেলে রাত্রি নিবাস । ভোরবেলায় মাউন্ট এভারেস্ট দর্শনে বেরিয়ে পড়লাম । ৮৮৪৮ মিটার উচ্চতা । এয়ারপোর্ট থেকে গুণা এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট । ডান-দিক ও বা-দিক মিলে দশজন-দশজন মোট কুড়িজন যাত্রী । একজন এয়ারহোস্টেস ও একজন পাইলট । ফ্লাইটটি উঠে গেল মাউন্টেন এভারেস্টের চূড়ায় । ফ্লাইটের জানালা দিয়ে অপূর্ব দৃশ্য । আগে নানানভাবে মাউন্টেন এভারেস্ট দেখার চেষ্টা করেছি, কিন্তু সেইগুলি দেখার মধ্যে ছিল অসম্পূর্ণতা । এবার প্রত্যেকটা পাহাড়ের চূড়ার দৃশ্য হৃদয়ে লেগে থাকার মতো । প্রতিটা ধাপে ধাপে বোঝাচ্ছিলেন এয়ারহোস্টেস ম্যাডাম । খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য এই প্রথম । হিমালয়ের দৃশ্য দেখে অভিভূত । এত সুন্দর হিমালয়ের রূপ, সেটা ভোরের সকালে অনেকটাই উপলব্ধি করতে পারলাম । বরফের জমাট বাঁধে নাকি নভেম্বরের শেষে এবং ডিসেম্বরে । তখন মাউন্ট এভারেস্টের দৃশ্য আরও মনোমুগ্ধকর !
প্রাতরাশ সেরে বেরিয়ে পড়লাম পশুপতি মন্দিরের উদ্দেশে । শোনা যায়, পশুপতি দেবতা নাকি খুব জাগ্রত । মন্দিরটি বলা চলে কাঠমান্ডু শহরের মধ্যেই । তবে মন্দির থেকে এয়ারপোর্ট কাছে । মূলত প্রভু শিবের মন্দির । এটি একটি হিন্দুদের পবিত্র মন্দির । কথিত আছে, একবার শিব ও পার্বতী হিমালয়ের কোলে অবস্থিত বাগমতী নদীর তীরে ভ্রমণ করতে এসেছিলেন যেটা মৃগস্থলি নামে পরিচিত । নদী তারবর্তী উপত্যাকায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে দুজনে হরিণের বেশ ধরে এলাকায় ঘুরে বেড়াতে থাকেন । এখানে ভগবান শংকর মৃগরূপ ধারন করেন । নেপাল মাহাত্ম্যে যেটা বলা হয়েছে সেটা বাংলায় তর্জমা করলে দাড়ায়, এই শ্লেষ্মাত্মক বনক্ষেত্রে আমি ঈশ্বর মৃগরূপ ধারন করে বিচরণ করেছি । সেহেতু ভবিষ্যতে এই বিচরণ ক্ষেত্র পশুপতি নামে বিশ্বমাঝারে পরিচিত হবে । আজ সেই পশুপতি মন্দিরে দূরদূরান্ত থেকে অনেক দর্শনার্থীরা ভিড় করছেন এবং পুজা দিচ্ছেন । একটা হৃদয় ছোঁয়া পরিবেশ ! সদর দরজা দিয়ে ঢোকার মুখের বাদিকে জ্বলছে ধুপবাতি ও প্রদীপের প্রজ্জ্বলন । ভিতরে ছবি তোলা নিষিদ্ধ । তাই দর্শনার্থীরা মূল ফটকের বাইরে দাঁড়িয়ে ফটো তোলার ইচ্ছা পুরণ করছেন ।
তারপর গেলাম পাঠান দরবারে । রাজা প্রতাপ মল্লের সময়ে কাঠমান্ডু দরবার ক্ষেত্র ব্যাপকভাবে নির্মিত হয় । রাজা প্রতাপ মল্ল ছিলেন ধার্মিক ও পণ্ডিত ব্যক্তি । তিনি ছিলেন শিল্পের প্রতি অনুরাগী । এছাড়া তিনি পনেরোটি ভাষা জানতেন । ভাষা জানাটা তাঁর গর্বের জায়গা । প্রতাপ মল্ল স্থাপনা নির্মাণের প্রতিও আগ্রহী ছিলেন, একারণে রাজা হিসাবে অভিষেকের পরেই তিনি তাঁর প্রাসাদের সম্প্রসারনের কাজ শুরু করেন ।
রাজা প্রতাপ তার প্রাসাদ নির্মাণের সময় একটি ছোট প্রবেশ পথ নির্মাণ করেন। প্রবেশ পথের দরজাটি বিভিন্ন কারুকার্যমণ্ডিত ছিল । তাতে বিভিন্ন দেবতার প্রতিমা স্থান পেয়েছিল। দরজাটি পরবর্তিতে মোহান চকে স্থানান্তরিত হয়। এর সামনে একটি হনুমানের মূর্তি স্থাপিত হয়, কারণ ভাবা হয়েছিল হনুমান রাজার সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করবে এবং তার আবাসকে রক্ষা করবে । এই প্রবেশ পথ দিয়ে নাসাই চকে যাওয়া যেত, নাসাই চকে সবধরনের রাজকীয় অনুষ্ঠান, পরিবেশনা ইত্যাদি হত । এই নাসাই চক দীর্ঘদিন পর্যন্ত রাজকীয় উঠোন ছিল । ধারণা করা হয় এই উঠোনের নীচে অনেক সম্পত্তি ছিল । সেসময় রাজা প্রতাপ ‘সুন্দরী চক’ নামেও একটি উঠোন নির্মাণ করেন। এখানে তিনি প্রস্তরখণ্ডে পনেরোটি ভাষায় লিখিত খণ্ড স্থাপন করেন । রাজা প্রতাপ কেবল তার ঐশ্বর্য প্রকাশের জন্যই এত স্থাপনা নির্মাণ করেননি, তার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ছিল দেব-দেবীর প্রতি আরাধনা । তিনি নতুন মন্দির নির্মাণে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন, এছাড়া পুরনো অনেক মন্দিরকে সম্প্রসারিত ও সংস্কার করেন । প্রাসাদের পাশেই তিনি একটি কৃষ্ণ মন্দির নির্মাণ করেন ১৬৪৯ সালে, যার নাম ভামসাগোপালা । এই মন্দিরটি তিনি তার দুই স্ত্রীকে উৎসর্গ করেন, একজন রূপমতি এবং অন্যজন রাজামতি। এই দুইজনেই একই বছরে মারা যান। মূল চককে তিনি সম্পূর্ণরূপে সংস্কার করেন । ১৬৭০ সালে তালেজু মন্দিরের জন্য তিনি বেশ কয়েকটি ধাতুর দরজা নির্মাণের ব্যবস্থা করেন ।
১৬৭৪ সালে রাজা প্রতাপ মল্ল মারা যাওয়ার পরে দরবার ক্ষেত্র উন্নয়নের গুরুত্ব কমে যায়। তার উত্তরাধীকারীগণ ক্ষমতা ধরে রাখতে ব্যর্থ হন এবং সেসময়কার মন্ত্রীগণ ক্ষমতা গ্রহণ করেন । তাদের হাতে ক্ষমতা চলে যাওয়ার পর শিল্প ও সংস্কৃতির উপর গুরুত্ব হ্রাস পায় । রাজার মৃত্যুর পরের এই তিন দশকে সাংস্কৃতিক উন্নয়নের ধারা ক্রমেই হ্রাস পেতে থাকে । এসময় শহরে অল্প কয়েকটি স্থাপনা নির্মিত হয় । এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থিভেন্দ্র মল্ল নির্মিত দাসাভাতারা মন্দির, যা ভগবান বিষ্ণুকে উৎসর্গ করে নির্মিত । পরবর্তিতে গারুদার একটি বিশালাকার মূর্তি এর সামনে স্থাপিত হয় । এছাড়া পার্থিভেন্দ্র মল্ল তার পরিবারের ছবিসহ একটি স্তম্ভ তালেজু মন্দিরের সামনে নির্মাণ করেন । ১৬৯২ সালে রাজা প্রতাপ মল্লের বিপত্নীক স্ত্রী রাণী রাধিলাসমি ভগবান শিভাকে উৎসর্গ করে একটি মন্দির নির্মাণ করেন । এটি মাজু দেভাল নামে পরিচিত এবং দরবার ক্ষেত্রের গারুদা মূর্তিটির পাশে অবস্থিত। মন্দিরটি নয়টি প্ল্যাটফর্মের উপর অবস্থিত এবং এটি দরবারের অন্যতম শীর্ষ স্থাপনা ।
এখন শহরের অন্যতম জায়গায় অবস্থিত এই পাঠান দরবার । জনগণের দর্শনের জন্য উন্মুক্ত । তবে দরবারে সংস্কারের কাজ এখনও পুরোদমে চলছে । প্রচুর দর্শনার্থীর সমাগম ।
তারপর গেলাম বৌদ্ধনাথ স্তূপে । বৌদ্ধনাথ স্তূপের চোখ দুটি অভিনব । বৌদ্ধনাথ নেপালের কাঠমান্ডুর একটি স্তূপ । কাঠমান্ডুর কেন্দ্র এবং উত্তর-পূর্ব সীমা থেকে প্রায় ১১ কিমি দূরে অবস্থিত । উচ্চতায় ৩৬ মিটার । এই স্তূপের বিশাল মণ্ডালার জন্য এটি নেপালের বৃহত্তম গোলাকার স্তূপগুলির মধ্যে অন্যতম । শোনা যায়, তিব্বত থেকে আসা বড় শরণার্থী জনগোষ্ঠীর আগমনে বৌদ্ধের আশেপাশে ৫০টির বেশী গুম্ফা (তিব্বতীয় বিহার) রয়েছে । স্তূপের আশপাশ দিয়ে বাজারের দ্রব্য সামগ্রী দর্শনার্থীদের নজরকাড়া ।
তারপর বুধানীলকন্ঠ । কাঠমান্ডু থেকে প্রায় দশ কিমি দূরে শিবপুরী পর্বতমালার পাদদেশে “বুধানীলকন্ঠ” । পৃথিবীর বৃহত্তম শায়িত বিষ্ণুমূর্তি । চতুষ্কোণ জলাশয়ের মধ্যে অনন্তশয়নে রয়েছে বিষ্ণুর আঠার ফুট একটি মূর্তি । একখণ্ড বিশালাকার কালো পাথর কেটে তৈরি । সব থেকে আশ্চর্যের বিষয়, এই ধরনের কালো পাথর কিন্তু নেপালের এই উপত্যকায় পাওয়া যায় না । পুরাতত্ববিদদের মতে, রাজমহল পাহাড় থেকে প্রাপ্ত এই কালো পাথর যেটা ইংরেজিতে “Rajmahal schist” নামে পরিচিত । এখন প্রশ্ন, এই বিরাটাকার পাথর এখানে এল কীভাবে ? আর একটিমাত্র পাথরকে খোদাই করে মূর্তি বানালেন কারা ? সেখানকার বৃদ্ধ পুজারী মাথা চুলকিয়ে জানালেন, একাদশ শতাব্দীতে এক চাষি চাষ করতে এসে দেখলেন মাটি ফেটে রক্ত বের হচ্ছে ! কৌতুহলবশত তিনি ডাকলেন গ্রামবাসীদের । শুরু হল খোঁড়াখুঁড়ি । আর মাটি খুঁড়তেই বের হল আজকের এই বিষ্ণুমূর্তি । ঐতিহাসিকদের মতে, দশম শতাব্দীতে রাজা বিজয়কামদের নেপালে নাগ ও বাসুকি পুজা শুরু করেন । তাঁর আমলে বেশ কিছু বিষ্ণুমূর্তি তৈরি হয়েছিল । এটি তার মধ্যে অন্যতম । অনন্তশয্যায় শায়িত বিষ্ণুর নাম “বুধানীলকন্ঠ” । আমরা জানি নীলকন্ঠ মানে শিব ! সেখানে ভ্রমণ করে আমরা খুব খুশী ।
স্বয়ম্ভূনাথ নেপালের প্রাচীনতম ধর্মীয় স্থানগুলির মধ্যে একটি । স্বয়ম্ভূনাথ হল কাঠমান্ডু শহরের পশ্চিমে কাঠমান্ডু উপত্যকার একটি টিলার চূড়ায় অবস্থিত প্রাচীন ধর্মীয় কমপ্লেক্স । কমপ্লেক্সটিতে একটি স্তূপ, বিভিন্ন মঠ এবং মন্দির রয়েছে, যেগুলি তৈরি হয়েছিল লিচাভি যুগের সময়ে । সাম্প্রতিক সংযোজন হচ্ছে একটি তিবতি বিহার, জাদুঘর এবং গ্রন্থাগার । কমপ্লেক্সটির দুটি প্রবেশ পথ — একটি দীর্ঘ সিঁড়ি যা সরাসরি মন্দিরের মূল প্লাটফর্মের দিকে গেছে যেটা পাহাড়ের শীর্ষ থেকে পূর্বদিকে এবং আর একটা, দক্ষিণ থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম প্রবেশ পথে । পাহাড়ের চারিদিকে একটা গাড়ির রাস্তা, সিঁড়ির শীর্ষে পৌঁছানোর দর্শনীয় স্থান “বজ্র” । কাঠমান্ডুর শক্তিশালী রাজা প্রতাপ মল্লা, যিনি ১৭তম শতাব্দীতে পূর্ব সিঁড়িটি নির্মাণ করেছিলেন । স্থানটি বৌদ্ধ ও হিন্দুদের কাছে সম্মানের । যদিও ২০১৫ সালের ভূমিকম্পে এই কমপ্লেক্সটির যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল । এখন স্তূপটিতে দর্শনার্থীদের কাছে খুব জনপ্রিয় । (তথ্যসূত্রঃ সংগৃহীত ও স্থানীয় মানুষদের সাথে কথোপকথনে সংগৃহীত )
 ( ক্রমশ )