সকালের প্রাতরাশ সেরে রওনা দিলাম পোখরার (Pokhara) উদ্দেশে । অনেকটা রাস্তা । পুরোটাই পাহাড়ি রাস্তা । একেবেকেঁ ঘুরে ঘুরে রাস্তা । রাস্তার ডানদিকে পাহাড় এবং বা-দিকে পাহাড়ের নীচের অংশ । পাহাড়, পর্বত, নদী, গাছ-গাছালি ইত্যাদি নিয়ে পাহাড়ে অপূর্ব প্রাকৃতিক সম্ভার । বা-দিকে কোনো কারণে গাড়ি পড়ে গেলে উল্টাতে উল্টাতে সোজা পাহাড়ের নীচে । বা-দিকে নীচে তাকালে ভীষণ ভয় ! স্থানীয় এলাকার ড্রাইভার । পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালাতে খুব দক্ষ । ফলে অনুভব করছিলাম, পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাটা খুব কম । তবুও উল্টোদিকের গাড়িকে পাশ (side) দিতে গিয়ে মাঝে মধ্যে ড্রাইভারকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে । দুদিকের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে চললাম ।
পোখরা যাওয়ার পথে মনোকামনা মন্দির । কাঠমান্ডু থেকে ১৪০ কিলোমিটার পশ্চিমে । প্রথমেই সিদ্ধান্ত নেওয়া ছিল, পোখরা ঢোকার আগে মনকামনা মন্দিরে মনকামনা দেবীর দর্শন । ড্রাইভার তাড়া দিচ্ছে । সেখানে নাকি দুপুরের খাওয়ার আগে ঢুকতে না পারলে বিশাল লাইনের খপ্পরে পড়তে হবে । সেই ক্ষেত্রে রাত্রি অবধারিত । পাহাড়ি রাস্তায়, দিনের বেলায় ভ্রমণ যথেষ্ট নিরাপদ । রাত্রি হলে পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালানো ঝুঁকিবহুল ! আর তা ছাড়া পাহাড়ি রাস্তায় রাত্রিতে সফর করাটার ক্ষেত্রে আমাদের তীব্র আপত্তি ছিল । যার জন্য ড্রাইভারের পরামর্শমতো আমরা যতটা সম্ভব সকালের দিকে রওনা দিলাম ।
নেপালের গোর্খা জেলায় অবস্থিত মনোকামনা মন্দির । হিন্দু ধর্মের একটি অন্যতম শক্তিপীঠ বলে গণ্য । মনের অভীষ্ঠ কামনা পূর্ণ করেন, এই অভিমতের প্রেক্ষিতে অধিষ্ঠাত্রী দেবীর নাম । রাম শাহের রাণী স্বয়ং মনোকামনা দেবীর অবতার ছিলেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে । দশহরার দিন দেবীর পুজার জন্য প্রচুর ভক্তসমাগম ঘটে । বড় উৎসব হচ্ছে দুর্গা-অষ্টমীতে । জনশ্রুতি আছে, গোর্খার রাণী মনোকামনার ঐশ্ব্যরিক শক্তির অধিকারী ছিলেন । কথিত আছে, একদিন রাম শাহ তার নিজের স্ত্রীকে ভগবতী রূপে এবং তাঁর স্ত্রীর ভক্ত লক্ষণ থাপাকে সিংহ রূপে দর্শন করেন । তারপর হঠাৎ রাম শাহের রহস্যজনক মৃত্যু ঘটে । সেই সময় সমাজ জীবনে সতী-দাহের প্রথা রমরমা । যার জন্য রাম শাহ মারা গেলে তাঁর স্ত্রীকে রাম শাহের সাথে সহমরণে যেতে হয়েছিল । সহমরণে যাওয়ার আগে রাম শাহের স্ত্রী তাঁর ভক্ত লক্ষণ থাপাকে বলে গিয়েছিলেন, তিনি শীঘ্রই ফিরে আসবেন । পরবর্তীতে রাম শাহ ও রাণী মারা যাওয়ার ঠিক ছয় মাস পর একজন কৃষক চাষ করবার সময় জমিতে হঠাৎ পাথরখণ্ড পান । সেই পাথরখণ্ড থেকে রক্ত ও দুধের ধারা বইছিল । তাই স্থানীয় মানুষের অনুমান, রাম শাহের স্ত্রী পুনরায় ফিরে এসেছেন । স্পটে ছুটে যান লক্ষণ থাপা । তারপর লক্ষণ থাপার উদ্যোগে সেই স্থানে শুরু হয় ভগবতী দেবীর পুজা পাঠ । ঐ পবিত্র ভূমি পরবর্তীতে পরিণত হল মন্দির প্রাঙ্গন । শোনা যায়, দুর্গা ও কালির মিশ্ররূপে এখানে তিনি ভগবতী দেবী । ভগবতী দেবীকে শুদ্ধ চিত্তে ও নিষ্ঠার সঙ্গে ভক্তি করলে তার কৃপা মেলে । মনস্কামনা পূর্ণ হয় । আবার অনেকে বলে, ভগবতীদেবী নাকি দুর্গার অবতার । যাই হোক মন্দিরের দেবীকে ভগবতী, বৈষ্ণদেবী, মহেশ্বরী, ইত্যাদি নামে অনেকেই ডেকে থাকেন । পুজার সময় আবীর, কেশর বাদাম, ফুল, বেল-তুলসী পাতা, বস্ত্র, নারিকেল, মিষ্টি, পান সুপারী ইত্যাদি দিয়ে ভগবতী দেবীকে তুষ্ঠ করার প্রয়াস আজও অব্যাহত । মন্দিরটি ২০১৫ সালের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্থ হয় । তখন প্রত্নতত্ব বিভাগ (Department of Archaeology) অনেক নেপালী রুপি খরচ করে সারিয়ে মন্দিরটির বাস্তব রূপ দেন । কাজটি শেষ হতে ২০১৮ সেপ্টেম্বর লেগে গিয়েছিল । মন্দিরটি আবার প্যাগোডা স্টাইলে । “মনোকামনা” অর্থ নিয়ে যেটা জানা যায় – মনো অর্থ অন্তর (heart ) আর কামনা অর্থ ইচ্ছা (wish ) । মনস্কামনা পূরণের তাগিদে ভগবতী দেবীকে দর্শন করতে দেশ-বিদেশ থেকে প্রচুর মানুষের সমাগম ঘটে । আমরা গাড়ি থেকে কুরিন্তার স্টেশনে নামলাম । সেখান থেকে কেবল কারে (Cable Car) মনোকামনা মন্দিরে পৌঁছালাম । কুরিন্তার থেকে মনোকামনা মন্দিরের দূরত্ব ২.৮ কিমি । নীচের জায়গা কুরিন্তার থেকে একেবারে উঁচুতে অর্থাৎ মনোকামনা মন্দিরের কাছে পর্যন্ত ১৩০২ মিটার উচ্চতা । কেবল কারে অনধিক ৬জন মানুষ উঠতে পারে । প্রায় ২.৮ কিমি রাস্তা কেবল কারের মাধ্যমে উঠতে সময় লাগে ২০ থেকে ২৫ মিনিট । ঝুলন্ত কার সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত পরিষেবা দেয় । কুরিন্তার স্টেশনের টিকিট কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে কেবল কারে ওঠার জন্য লাইন দিলাম । সেদিন অনেক পর্যটক এক একটা গ্রুপে মনোকামনা মন্দিরে ভগবতী দেবীকে দর্শনে এসেছিলেন । যার জন্য আমাদের সামনে প্রায় ৪০জনের একটি গ্রুপ কেবল কারে ওঠবার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছিল । তারা মনোকামনা মন্দিরে উঠে যাওয়ার পর আমরা কেবল কারে বসার সুযোগ পেলাম । একটা নতুন অভিজ্ঞতা । কেবল কারের মাধ্যমে পাহাড়ের উপর দিয়ে মনোকামনা মন্দিরে পৌঁছানো সত্যিই আনন্দের । কেবল কার থেকে মনোকামনা মন্দিরের প্রবেশ দ্বারে নামার পর অনেকটা খাড়াই সিঁড়ি বেয়ে উঁচু পাহাড়ে উঠতে হয় । বেশ কিছুক্ষণ সিঁড়ি বেয়ে ওঠার পর মন্দির ।
তারপর মনোকামনা মন্দিরে ঢোকার লাইন দেখে আমরা চমকে উঠলাম । প্রচুর মানুষের সমাগম । বিশাল লম্বা লাইন । লাইনটা উঁচু পাহাড়ের দিকে ক্রমশ বেড়েই চলেছে । লাইনে মানুষের মধ্যে শৃঙ্খলাপরায়ণতা যথেষ্ট ঠিক আছে । কেননা নিরাপত্তা বেষ্টনী যথেষ্ট টাইট । কিন্তু ভীষণ লম্বা লাইন । সেখানেও গ্রুপের একজন দাড়াঁনো, বাকীদের মন্দিরের আশেপাশে ঘোরাফেরা । পুজো দেওয়া হলে মন্দিরের পাশে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও ধুপবাতি জ্বালানোর জায়গা । সেখানেও প্রচণ্ড ভিড় । অনেক সময় লাগল । দেবীকে প্রণাম করার পর আমাদের শান্তি । তারপর মনোকামনা মন্দির থেকে বেরিয়ে দোকানের দ্রব্য সামগ্রী দেখতে দেখতে আবার কেবল কারে কুরিন্তার স্টেশনে নেমে আসা ।
( ২ )
কাঠমান্ডু থাকা অবস্থায় নাগরকোট ঘুরে বেড়ানোর বিষয়ে দুই-একটি কথা । উল্লেখ থাকে যে, কাঠমান্ডু শহর থেকে ২৮ কিমি দূরত্বে নাগরকোট । শোনা যায় হিমালয়ের মোট ১৩টি পর্বত রেঞ্জের মধ্যে ৮টিই নাগরকোট থেকে দেখা যায় । যদিও সেদিন ছিল মেঘলা আকাশ । যাই হোক নেপালের এই নাগরকোট গ্রামটি ভূমি থেকে ৭২০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত । এখানকার লোকজন ঘুম থেকে উঠলেই আকাশের খণ্ড খণ্ড ভাসমান মেঘগুলি দেখতে পান । এই গ্রামের বেশীর ভাগ মানুষ কৃষির উপর নির্ভরশীল । আদিবাসী মানুষ বেশী । চারিদিকে মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ভাণ্ডার । পাহাড়ের সরু, উঁচু-নীচু রাস্তা নজরকাড়া । নাগরকোট টাউয়ার থেকে হিমালয় পর্বত দর্শন ভীষণ আনন্দের । চোখ জুড়িয়ে গেল । এখানে ঠাণ্ডাটা বেশী । বিদেশী পর্যটক চোখে পড়ার মতো । নাগরকোট সফরে অপূর্ব প্রাকৃতিক ভাণ্ডার দর্শনে আমরা আপ্লুত ।
( ৩ )
মনোকামনা মন্দির থেকে ছুটলাম পোখরার দিকে । পোখরা হল নেপাল’এর পশ্চিমাংশে গণ্ডকী অঞ্চলের অন্তর্গত কাস্কী জেলার একটি শহর । পোখরা শহরটি পার্বত্য উপত্যকায় গড়ে উঠেছে । আবার অনেকে বলে, শহরটি পোখরা উপত্যকায় গড়ে উঠেছে । পোখরা উপত্যকার উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে শহরটি অবস্থিত । এই উপত্যকা দিয়ে স্বেত গন্ধকি নদী বা সাদা নদী প্রবাহিত হয়েছে । শহরটি সর্বোচ্চ ১৪৭০ মিটার ও সর্বনিম্ন ৮২৭ মিটার উঁচু । শহরটি অন্নপূর্ণা পর্বত শ্রণীর একটা অংশে এবং হিমালয়ের মধ্য এলাকায় অবস্থিত । পোখরা নেপালের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর যেটা কিনা কাঠমান্ডু থেকে ২০০ কিমি পশ্চিমে অবস্থিত । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর পোখরা শহরকে “নেপালের ভূস্বর্গ” ও “নেপালের রাণী” বলা হয় । মানুষের মধ্যে একটি প্রবাদ প্রচলিত, “তোমার নেপাল দেখা পূর্ণ হবে না, যদি না তুমি পোখরা দেখ” । বাস্তবে এটাই ঘটনা । এত সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য খুব কমক্ষেত্রে দেখা যায় । পোখরা থেকে বিশ্বের দীর্ঘতম (১৪০ কিমি) সারিবদ্ধ হিমালয় ও পাহাড়ের সারি দেখা যায় । এইজন্য পোখরাকে “মাউন্টেন ভিউ”এর শহর বলা হয় । এখান থেকে “অন্নপূর্ণা” ও “মাছের লেজের” মতো দেখতে মচ্ছ পুছরে (৬৯৭৭ মিটার) পর্বতশৃঙ্গ দেখা যায়, যা কিনা বিশ্ববিখ্যাত চারটি পর্বতশৃঙ্গের একটি । পোখরা থেকে মুক্তিনাথ মন্দির ও জ্বালামুখী মন্দির দর্শন করা খুব সহজ । এই মন্দির দর্শনের ক্ষেত্রে আকাশ পরিষ্কার থাকাটা খুব জরুরি । তা ছাড়া এই পোখরাতে রয়েছে অনেক দর্শনীয় স্থান ।
ফেউয়া লেক (Phewa Lake), অনেকে “ফেওয়া” লেক বলে থাকে । পোখরার সবচেয়ে মূল আকর্ষণ ফেউয়া লেক । ফেউয়া লেক নেপালের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক লেকের একটি । দৈর্ঘে ৪ কিমি এবং প্রস্থে ১.৫ কিমি । প্রথমটির নাম “রারা লেক” যা নেপালের পশ্চিম মুগু জেলার দুর্গম অঞ্চলে অবস্থিত । বলা চলে, ফেউয়া লেক পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু এবং আদর্শ বিনোদন কেন্দ্র । রঙ বেরঙের নৌকা ভাড়া পাওয়া যায় । দুই ধরনের নৌকা । ফ্যামিলি নৌকা ও ছোট নৌকা । পাহাড়ের গা ঘেঁষে লেক । লেকের মাঝখানে একটি মন্দির, নাম “বারাহি হিন্দু মন্দির” । হিন্দু সম্প্রদায়ের সকলেই নৌকায় পার হয়ে মন্দিরে ঢোকেন । ফেউয়া লেকে নৌকা ভ্রমণ, পর্যটকদের কাছে বিনোদনের অন্যতম অঙ্গ ।
আমরা যখন ফেউয়া লেকে পৌঁছালাম তখন বিকেল ৪টে বেজে গেছে । তারপর হঠাৎ বৃষ্টি ! সন্ধ্যা পর্যন্ত বৃষ্টিটা চলল । যার জন্য আমরা সন্ধ্যার সময় ঝুঁকি নিলাম না । লেকে বোটিং করার আগে টিকিট সংগ্রহ করা জরুরি । টিকিট কাউন্টারে টিকিট কাটতে গিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম । তবুও বৃষ্টি থামার লক্ষণ নেই । তাই পরেরদিন নৌকা ভ্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিলাম । সেই অনুযায়ী পরেরদিন ভোরবেলায় শরণকোটের টাউয়ার থেকে পর্বতের ভিউ ও সূর্য ওঠা দেখে লেকে বোটিংয়ের জন্য ছুটলাম । দুইজনের জন্য ছোট নৌকা । নৌকার মাঝি স্থানীয় । তার মুখে গল্প শুনছিলাম । লেকে অনেক ধরনের মাছ । মাছ ধরার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু মানুষ রয়েছেন । তারা ছাড়া কেউ মাছ ধরতে গেলে পারমিশন লাগে । তা ছাড়া পাহাড় থেকে অনেক ধরনের হিংস্র জন্তু জানোয়ার জল খেতে লেকের ধারে চলে আসে । এমনকি চিতা বাঘও দেখা যায় । অন্য প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে মাঝি তাদের কর্ম জীবনের কাহিনী শোনালো । তারা শুধুমাত্র নৌকার বাহক । নৌকার লাইন থাকে । কপাল ভাল থাকলে সারাদিনে তিনটি ট্রিপ পায় । নতুবা দুটিতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয় । ন্যুনতম মজুরী যেটা খুব কম । সেই মজুরীতে তাদের সংসার চালানো খুব কঠিন । উপরন্তু গত দুবছর অতি মহামারির কারণে তাদের কাজ বন্ধ ছিল । এবছর নাকি কেবলমাত্র কিছুদিন আগে থেকে পর্যটকদের আনাগোনা শুরু হয়েছে । এই এপ্রিল মাসেই নাকি ভ্রমণপিপাসু মানুষ বেশী আসেন । কিন্তু এবছর এখনও পর্যন্ত সেভাবে পর্যটকদের ভিড় বাড়েনি । ফেউয়া লেকের আশপাশ দিয়ে প্রচুর রেস্টুরেন্ট ও হোটেল । বলতে গেলে সবসময় ফেউয়া লেকের পাশ দিয়ে ভ্রমণপিপাসু মানুষদের আনাগোনা বেশী । মোদ্দা কথা, পোখরা ভ্রমণের মূল আকর্ষণ হচ্ছে ফেউয়া লেক ।
সামান্য মৃদুমন্দ বাতাসে, খোলা আকাশের নীচে নৌকা ভ্রমণ আমাদের চিত্ত ভরিয়ে দিলো । ঘড়ি ধরে এক ঘন্টা নৌকা ভ্রমণ । তবে লেকের মাঝখানের মন্দিরে অবশ্যই নিয়ে যাবে । অনেকে মন্দিরে নেমে পুজা দেন । সব ব্যবস্থা সেখানে রয়েছে । পরিষ্কার আকাশ থাকার জন্য আমাদের নৌকা ভ্রমণ ভীষণ আনন্দময় হয়ে উঠেছিল । নৌকা ভ্রমণ শেষে হোটেলে ছুটলাম ।
( ৪ )
ভোর পাঁচটায় ড্রাইভারের ডাক । সময় কম । শিগ্গির চলুন । শরণকোট (Sarangkot) । শরণকোট নেপালের কাস্কি জেলায় পোখরার নিকট অবস্থিত । পোখরার পশ্চিমদিকে ৫ কিমি দূরে ও ১৫৯২ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত । পোখরার শরণকোট পর্যটকদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ভিউ পয়েন্ট । এখান থেকে পর্বতমালার অপূর্ব দৃশ্য দর্শন করা যায় । এমনকি শরণকোটের উপর থেকে ফেউয়া লেক পরিষ্কার দেখা যায় । পর্যটকেরা এখানে আসে সূর্য ওঠা দেখতে । টাউয়ার থেকে সূর্য ওঠা দেখা পর্যটকদের কাছে খুব আকর্ষণীয় । পর্বতশৃঙ্গের সূর্যের অন্যদিকে অন্নপূর্ণা ও ফিসটেল । অভূতপূর্ব দৃশ্য । টাউয়ার থেকে পর্বতগুলি ছবির মতো দেখতে । গুরুত্বপূর্ণ দুটি পর্বতের মধ্যে ফিসটেলের উচ্চতা ৬৯৯৭ মিটার এবং অন্নপূর্ণা ৭৫৫৫ মিটার উচ্চতা । অথচ শরণকোট ভিউ পয়েন্টের উচ্চতা অনেক বেশী, ১৫৯২ মিটার । একটা জায়গার পর গাড়ি আর উপরে উঠতে পারে না । তারপর হেঁটে ওঠা । খাড়াই সিঁড়ি । হেঁটে ওঠা পরিশ্রম সাপেক্ষ । জিরিয়ে জিরিয়ে আমাদের উঠতে হয়েছিল । সিঁড়ি গুলি প্রচণ্ড খাড়াই । কয়েকটি সিঁড়ি উঠলে ছেলে-বুড়ো সকলকেই হাঁপিয়ে যেতে হয় । নামার সময় আমরা গণনা করে দেখলাম, মোট ৩৫০টি সিঁড়ির ধাপ । কিন্তু ভিউ পয়েন্টে ওঠার পর অফুরন্ত আনন্দ । আনন্দের ঘনঘটা বোঝানো দুঃসাধ্য । চারিদিকে পাহাড়ের প্রাকৃতিক দৃশ্য । পূর্বদিকে তখন সূর্যের রক্তিম আভা । পরিষ্কার আকশে ধীরে ধীরে সূর্যের আগমন । মনোরম দৃশ্য আমাদের মন ভরিয়ে দিলো । শরণকোট ভিউ পয়েন্টের টাউয়ারে একজন মাসি লিকার চা বিক্রিতে ব্যস্ত । ঐ সকাল বেলায় অতটা উচ্চতায় বসে ঠাণ্ডার মধ্যে এক কাপ লিকার চা ও দুটি বিস্কুট পাওয়ায় প্রাণ জুড়িয়ে গেলো । একদিকে সূর্য ওঠা এবং অন্যদিকে অন্নপূর্ণা ও ফিসটেলের অপরূপ দৃশ্য দেখতে পাওয়ায় নেপাল ভ্রমণের সার্থকতা সঠিক অর্থে খুঁজে পাওয়া গেল । তারপর ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে নামা । তারপর সোজা ফেউয়া লেক । উদ্দেশ্য বোটিং ।
শরণকোট ভিউ পয়েন্ট ও ফেউয়া লেকের বোটিং শেষে হোটেলে ফিরে স্নান সেরে আবার বেরিয়ে পড়লাম । গন্তব্য শান্তি স্তুপা । আনন্দু (Anandu Hill) পর্বতের উপর তৈরী করা খুব সুন্দর একটি প্যাগোডা । বুদ্ধ ধর্মালম্বীদের জন্য । শান্তি স্তুপা তৈরী হয়েছিল শান্তির প্রতীক হিসাবে । সারা বিশ্বে যে কটা শান্তি স্তুপা, তার মধ্যে দুটি নেপালে । একটি পোখরায় এবং অন্যটি লুম্বিনীতে । পোখরার শান্তি স্তুপা নেপালে বিশ্বের প্রথম শান্তি স্তুপা । এখানে মেডিটেশনের জন্য বহু মানুষ আসেন । পাহাড়ের উপর এই প্যাগোডা থেকে ফেউয়া লেক বা পোখরা শহর সুন্দর দেখা যায় । শান্তি স্তুপার পাশ দিয়ে নানান ধরনের দ্রব্যের বাজার । বিশেষ করে বৌদ্ধ ধর্মালম্বী মানুষদের প্রার্থনার সমস্ত রকম উপকরন পাওয়া যায় । আমরা যখন পুরো এলাকাটা ঘুরলাম, সেই সময় মূল গেটটা তখনও খোলেনি । তবে উল্টোদিকের বিল্ডিংয়ের বারান্দা থেকে সমস্তটাই আমরা উপভোগ করতে পারলাম ।
( ৫ )
শান্তি স্তুপা থেকে বের হয়ে আমরা ঢুকলাম ডেভিস ফলসে (Devi’s Falls) । টিকিট সিস্টেম রয়েছে । কাস্কি জেলায় পোখরার মধ্যে এই ডেভিস ফলস । মূলত ফেউয়া লেকের জল এই ঝর্ণার উৎস । টানেল দিয়ে ঝর্ণার জল নেমে আসছে । টানেলটি মোটামুটি ৫০০ ফুট লম্বা । ডেভিস ফলসে একটি ঘটনা ঘটার পর ফলসটির নাম রাখা হয় ডেভিস ফলস । ১৯৬১ সালের ৩১শে জুলাই এক স্যুইস দম্পতি ফলস দেখতে আসে । তখন ফলসের জলের প্রচণ্ড উচ্ছ্বাস । ফলসের জলে অতর্কিতে “ডাভি” নামে ঐ স্যুইস মহিলা পড়ে যান এবং জলে ডুবে মারা যান । তাঁর নামে ফলসটির নাম রাখা হয় ডেভিস ফলস । যাই হোক আমরা এপ্রিল মাসের শেষদিকে যাওয়ার দরুন নাকি ফলসে তেমন জলের উচ্ছ্বাস নেই । তারপর ফলস থেকে উপরে উঠে এলাম । লাগোয়া বাগান । বাগানের মধ্যে একটি বুদ্ধের মুর্তি । সামনে লেখা রয়েছে “Lord Buddha” । একটা জায়গায় বাউন্ডারি ওয়ালে লেখা আছে “Visit Nepal” । বাগান পার হলে অনেক দোকান । রকমারী জিনিসপত্র সাজিয়ে বসে রয়েছেন । বাঙালী টুরিস্টদের সাথে কথা বলার জন্য দোকানদারেরা অল্প বিস্তর বাংলাও জানেন । সব মিলিয়ে জায়গাটা ভীষণ উপভোগ করলাম ।
ডেভিস ফলসের অদূরে এবং উল্টোদিকে গুপ্তেশ্বর মহাদেব গুহা (Gupteshwor Mahadev Cave, Pokhara, Nepal) । তবে এটা একটা গুহা মন্দির । গুহা মন্দিরটি মহাপ্রভু মহাদেবের প্রতি উৎসর্গীকৃত । গুহায় ঢুকতে গেলে প্রবেশ ফি রয়েছে । টিকিট কেটে গুহার প্রবেশ পথে পৌঁছে দেখলাম, হিন্দুদের অনেক ধরনের ঠাকুর দেবতাদের নিপুন হাতে ছবি আঁকা রয়েছে । বাঁকানো সিঁড়ি বেয়ে নামার রাস্তা । প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা এই গুহাকে “শিবা লিঙ্গামের” পুরানো ঘর মনে করা হয় । গুহাটি দুটো ভাগে বিভাজিত । প্রথমটি নীচের দিকে ৪০ মিটার সিঁড়ি বেয়ে হাঁটলেই দেখা যাবে শিব লিঙ্গ । সেখানে মহাদেবের পুজা হচ্ছে । শিব লিঙ্গের ফটো তোলা নিষেধ । তারপর আনুমানিক ১০০ মিটার বা তারও বেশী নীচের দিকে সিঁড়ি বেয়ে হেঁটে নামলে দেখা যাবে ডেভিস ফলসের কিছু অংশ । নীচে ফলসের জল গড়িয়ে পড়ছে । পুরো সিঁড়িটা পাহাড় কেটে তৈরী । অন্ধকারের মধ্যে কিছু বিজলী বাতি থাকার জন্যে রক্ষে । পাহাড় থেকে চুইয়ে পড়া জলে ভেজা সিঁড়ি বেয়ে হাঁটাটা ঝুঁকিবহুল । তবুও দেখলাম বিদেশীরা ঝটাপট হেঁটে গুহার অন্দরমহলে ঢুকে যাচ্ছে । একটা জায়গায় পাহাড় কেটে সিঁড়ি তৈরী সম্ভব না হওয়ায় সেখানে লোহার সিঁড়ি লাগানো । অন্ধকারাচ্ছন্ন ভিজে স্যাঁৎস্যাঁতে সিঁড়ি দিয়ে নামতে আমাদের একটু ভয় ভয় লাগছিল । তবে শারীরিক স্থিতি ও মনের জোর সাংঘাতিক । তার জন্য বুকে অদম্য সাহস রেখে নেমে গেলাম । পাহাড় চুইয়ে জল গড়াচ্ছে । সেই জল মাথায় পড়তে বাধ্য । টুপি থাকায় বাঁচোয়া । মাথা ভেজেনি । গুহার ভিতরের জলপ্রপাত দেখে পুনরায় সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলাম । সিঁড়ি বেয়ে উঠতেও খুব ঝকমারী । একটু অসাবধানতায় বিপদ অনিবার্য । তাই শঙ্কা মেশানো ভয়ার্ত এক নতুন অভিজ্ঞতা !
( ৫ )
এবার ঢুকলাম ইন্টারন্যাশনাল মাউন্টেন মিউজিয়ামে (International Mountain Museum) । এটা নেপালের বিখ্যাত জাদুঘর । জানতে পারলাম এই মাউন্টেন মিউজিয়াম নাকি এডমণ্ড হিলারী ও তেঞ্জিং নোরগের উদ্দেশে উৎসর্গীকৃত । মিউজিয়ামের প্রধান বৈশিষ্ট্য এতে পর্বতারোহনের কলাকৌশল, বিশ্বব্যাপি প্রধান পর্বতমালার তথ্যসমূহ, পর্বতমালার ভৌগলিক অবস্থান, বিশ্বব্যাপি পর্বতারোহীদের ব্যবহৃত সরঞ্জামাদি, পোশাক-পরিচ্ছদ ও আরোহনের ইতিহাস প্রদর্শন । বিশ্বজুড়ে পর্বত ও পর্বতারোহণ সম্পর্কিত অতীত ও বর্তমান ঘটনাবলীর রেকর্ড । জাদুঘরে তিনটি প্রদর্শনী হল রয়েছে – মহা হিমালয়ের হল, খ্যাতি হল ও বিশ্ব পর্বতমালার হল । তা ছাড়া জাদুঘরের ভিতরে নেপালী জনগণের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ উপস্থাপনের প্রয়াস, বিখ্যাত শিখর, বিখ্যাত পর্বতারোহীদের বর্ণনা, পাহাড়ী মানুষের সংস্কৃতি ও জীবনধারা, ভূতত্ত্বসহ উদ্ভিদ এবং প্রাণীজগত ইত্যাদি তুলে ধরা হয়েছে । জাদুঘর ঘুরে আমরা নেপালের মানুষের কিছুটা পোশাক-পরিচ্ছদ, সংস্কৃতি, উপলব্ধি করতে পারলাম । যেমন মগর জাতি, গুরুং জাতি, শেরপা জাতি, তমাং জাতি, নেবার জাতি, রাই জাতি, রাজবংসী জাতি, তেলি জাতি, ইত্যাদি । তবে শোনা গেলো নেপালে নাকি অনেক জাতির ( সম্প্রদায়ের ) মানুষের বসবাস এবং তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ, সংস্কৃতি, সব আলাদা । যেমন আমাদের দেশে নাগাল্যাণ্ড রাজ্যে, শোনা যায়, ১৮টি জাতির বসবাস এবং তাদের সংস্কৃতি সম্পূর্ণ আলাদা । ১৮টি জাতির মানুষ ডিসেম্বরের শেষদিকে একটি জায়গায় মিলিত হয়ে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির উৎসব পালন করেন । নেপালের জাদুঘরে ঘুরে সেই দেশের মানুষের বিভিন্ন জাতির পোশাক-পরিচ্ছদ, সংস্কৃতি সম্বন্ধে একটা ধারণা জন্মালো ।
গুরখা মেমোরিয়াল মিউজিয়ামে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সাথে সাথে শান্তি রক্ষা মিশনে সাহসী গুরখাদের (নেপালের জাতীয় সৈনিক) বিভিন্ন ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে । তা ছাড়া বিশ্ববিখ্যাত গুরখা সৈন্যদের যুদ্ধ জয়ের কাহিনী, পোশাক, ব্যাচ, অস্ত্র, ইত্যাদি মিউজিয়ামের দর্শনীয় সামগ্রী ।
পোখরা নিয়ে আলোচনা আজ এইটুকুই । অন্যান্য দর্শনীয় স্থানগুলির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ পাবেন পরের পর্বে । (তথ্যসূত্রঃ সংগৃহীত ও স্থানীয় মানুষদের সাথে কথোপকথনে সংগৃহীত )
( ক্রমশ )