এক উপেক্ষিত মহাপ্রাণ : শুভঙ্কর দাস।

    0
    250

    ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস আসলে এক মহাকাব্যিক ধারা।যদি আধুনিক যুগে বাল্মিকী বা ব্যাসদেবের মতো মহাকবি আবির্ভূত হতেন, তাহলে স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে রামায়ণ বা মহাভারতের মতো মহাকাব্য রচিত হতে পারত।
    একটি দেশের সুদীর্ঘকাল পরাধীনতার আগল ভেঙে নতুন আলোর সকাল আনার জন্য যে ত্যাগ, তীতিক্ষা, তর্পণ এবং তপস্যা প্রয়োজন হয়েছিল, তা পৃথিবীর স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বিরল।কিন্তু সেই মহাকাব্যিক প্রবাহ ও প্রকাশ রাতারাতি সম্ভব হয়নি,দিনের পর দিন অপরিসীম প্রচেষ্টা ও অফুরান লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। মৃত্যুকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে করতে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে ফাঁসির দিকে চুম্বন করে নাভিমূল থেকে উচ্চারণ করে ঝড় তুলছেন,’বন্দেমাতরম ‘।
    বন্দেমাতরম অর্থাৎ মাতাকে বন্দনা করো,সেই বন্দনায় এরকম অগণিত আলোকময় পথিক রয়েছেন,যাঁদের ভারতবাসী বিস্মৃত হতে বসেছে।
    তাঁদের মধ্যে একজন মেদিনীপুরের দুর্ধর্ষ গান্ধিবাদী নেতা কুমারচন্দ্র জানা।

    কে এই কুমারচন্দ্র?

    যে বছর বীর শহীদ ক্ষুদিরাম বসু জন্মগ্রহণ করেন,সেই সময় ১৮৮৯ সালে ২৮ শে নভেম্বর জন্ম গ্রহণ করেন কুমারচন্দ্র জানা।কুমারচন্দ্রের যখন বয়স দুই, তখন বাংলা তথা মেদিনীপুর থেকে দূরে মেদিনীপুরের সিংহপুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর একাকী ও বিষাদে শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছেন।প্রবল প্রতিবাদী ও পরিবর্তনকামী পথপ্রদর্শকের মাটির শস্য ও মেঘের ছায়ায় বড় হতে লাগলেন কুমারচন্দ্র।
    স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় ‘কংগ্রেস’ এই নামটি অতি অজ গাঁয়ের ছেলে-বউয়ের মুখে কেউ যদি প্রথম তুলে দিয়ে থাকেন,তবে তিনি হলেন কুমারচন্দ্র জানা।দেশ প্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের দেহাবসানের পর কুমারচন্দ্রের মতো অন্য কোনো কংগ্রেস নেতা হেঁটে হেঁটে জনসংযোগের চেষ্টা করেননি।তিনি পেয়েছিলেন তাঁর জীবনে বীরেন্দ্রনাথের ইস্পাতকঠিন দৃঢ়চরিত্র,গান্ধিজির আদর্শনিষ্ঠা,অতি সহজ ও সরল গ্রাম্য জীবনযাপনের গান্ধিমন্ত্র, কথায়-চলায়- বলায় সম্পূর্ণভাবে মেদিনীপুরের গেঁওভাব, যা তাঁকে তৎকালীন সাধারণ মানুষের নিকটতম প্রিয় নেতা তথা প্রিয় মানুষ করেছিল।এই কথাই সবচেয়ে বড়ো সত্য, ” কুমারচন্দ্র অজ গাঁয়ের চাষার ছেলে না হয়ে শহুরে হতেন তাহলে সারা বাংলায় একজন প্রাতঃস্মরণীয় জননায়ক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করতেন।”

    মহাত্মার বাণীকে মাটি দিয়ে মূর্ত করলেন যাঁরা

    মহাত্মা গান্ধি শুধু ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসে নয়, পৃথিবীর ইতিহাসের পাতায় একজন বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব।মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের মতে,এই ধরণের মানুষ মাটিতে হেঁটে চলে বেড়াত, তাই লোকে একদিন বিশ্বাস করবে না।অবিস্মরণীয় মানুষের কর্মধারা যতক্ষণ না বহুজনের কাছে বিশ্বাসের মূর্তি হয়ে না পৌঁছাতে পারে,ততক্ষণ সেই বাণী,সেই বাণীর উদ্গাতা ব্যর্থ এবং সীমাবদ্ধ। মহাত্মা গান্ধির মহান চিন্তাধারাকে ভারতবর্ষের কোণায় কোণায় ছড়িয়ে দিতে যাঁরা প্রাণপাত করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রধান সেনানি কুমারচন্দ্র জানা।
    উপেক্ষিত মহাপ্রাণ

    ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের গতিপথ যে শুধু দিল্লিতে বসে হয়নি, তা যে ধূলিধূসর প্রত্যন্ত গ্রামের মেঠোপথে রচিত হয়েছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় দুর্ধর্ষ গান্ধিবাদী নেতা কুমারচন্দ্র জানার সংগ্রামী-জীবন অনুসন্ধান করলে।অথচ চরম দুঃখের বিষয় আমাদের দেশের ইতিহাস সর্বদা রাজধানী বা মহানগরের নেতা-মন্ত্রীদের পাদপ্রদীপের আলোয় এনেছে বারংবার। তাই যাঁরা ভারতের সিংহভাগ জনগণ, যাদের কাছে স্বাধীনতা সংগ্রাম কী? দেশ পরাধীন থাকলে কী ক্ষতি? এইসব কঠিন কথা সহজ-সরল ভাবে পৌঁছে দিতে প্রাণপাত করেছিলেন,তাঁদের কথা চিরকাল উপেক্ষিত ও অবহেলিত থেকে গেছে।
    তেমনই একজন অখণ্ড মেদিনীরপুরে দুর্ধর্ষ গান্ধীবাদী নেতা কুমারচন্দ্র জানা।মহাত্মা গান্ধির অহিংসা আন্দোলনের বক্তব্য যাঁরা শিরোধার্য করে গাঁয়ের উপেনের কাছে,গফুরের কাছে সত্যিকারের মূর্ত করে তোলেন কুমারচন্দ্রের মতো জননায়ক।এই স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলনের মন্ত্র যাঁর কাছ থেকে কুমারচন্দ্র জানা লাভ করেছিলেন,তিনি দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসমল।এঁদের ভূমিকা নিয়ে বলা হয়,” গান্ধিজির ডাকে যাঁরা স্কুল-কলেজ-আদালত ছেড়ে এলেন,তাঁরা জনসংখ্যার দু-ভাগও নয়। সেজন্য তিনি ডাক দিলেন নীচের তলার মানুষকে— যাঁরা গরুর গাড়ি চালান,যাঁরা তাঁত বোনেন,যাঁরা লাঙ্গল চালান,চাষ করেন,হাটে-ঘাটে-মাঠে খেটে খান— তাঁদের তিনি একত্র জড়ো করতে লাগলেন।”
    ১৯২২ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত প্রায় ২৪ বছরের স্বাধীনতা আন্দোলনে কুমারচন্দ্র জানা ১২ বছর কারারুদ্ধ ছিলেন,এমন কি একটা সময় স্ত্রী-কন্যাসহ জেল খেটেছেন।শুধু স্বাধীনতা সংগ্রাম করে দেশ স্বাধীন নয়, দেশ গঠনের দিকে কুমারচন্দ্রের সুগভীর চিন্তা ও চেতনা ছিল।তিনি বিদ্যালয়-পাঠাগার স্থাপন,স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি, গ্রামের রাস্তাঘাট ও খাল-নালা সংস্কার,সেবাদল ও সর্বার্থসাধক দল তৈরি, বাস সার্ভিস চালু,চরকা প্রচলন,মহাত্মা গান্ধির নামে আশ্রম চালু, যেখানে স্বয়ং মহাত্মা এসে কুমারচন্দ্রকে আশিস প্রদান করেন এবং দেশগঠনের কাজকর্ম দেখে অত্যন্ত প্রীত হন।হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির জন্য তাঁকে ‘মহম্মদ কুমারচন্দ্র’ বলে অভিহিত করা হয়। অহিংসার পূজারি ছিলেন বলেন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের রাজনৈতিক বন্দীর মর্যাদা না দেওয়ার প্রতিবাদে কুমারচন্দ্র ১১ দিন নিরম্বু অনশন করেন।
    এছাড়াও ১৯ ৫২ সালের ভারববর্ষের প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে দাঁড়ান, কংগ্রেস দল থেকে বেরিয়ে তৈরি করেন কৃষক-মজদুর-প্রজা পার্টি।কারণ সেই সময়ের কংগ্রেসী নেতাদের বিলাসিতা ও বিপুল দুর্নীতি সহ্য করতে না পারা।সবচেয়ে বিস্ময়, কংগ্রেসের সেই দুরন্ত জমানায় কুমারচন্দ্র বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন।
    এবং বিধায়ক হয়ে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত একটি মাত্র কাজ করে যান,দেশ গঠন। কোনোরূপ সরকারী সুযোগ-সুবিধা এবং ক্ষমতার বাহাদুরি না করে।একটা তিনি সারাজীবন বলতেন এবং বিশ্বাস করতেন,’ঠকিলেও,ঠকাইব না’
    এই ধরণের আলোকময় মানুষকে আমরা ক’জন মনে রেখেছি? ২৮ নভেম্বর কুমারচন্দ্র জানার আবির্ভাব দিবস,ক’জন আমরা শ্রদ্ধা-ফুল তাঁর জন্য হাতে করে দাঁড়িয়ে আছি?

    দেশের জন্য শুধু প্রাণ উৎসর্গ করা নয়, দেশকে উর্বর ও উপযুক্ত করাই যাঁদের ব্রত।

    কুমারচন্দ্র জানা স্বাধীনতা আন্দোলনের পাশাপাশি সমান গুরুত্বের সঙ্গে দেশ গঠনের দিকেও মন দিয়েছিলেন।এবং তা করেছিলেন নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থকে উপেক্ষা করে।নিজের প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয় ও আশ্রমের জন্য কলকাতায় পত্রিকা ফেরি করতেন।হাওড়া স্টেশনে কুলিগিরি করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন।দেশি সাবান বিক্রি, চায়ের দোকান,মিষ্টি দোকানের ব্যবসা পর্যন্ত করেছেন।বাসুদেবপুর আশ্রমের কাজের জন্য জন্য গলার রক্ত তুলে পরিশ্রম করতেন১৯৩০ সালে বুনিয়াদি শিক্ষার আদর্শ ও ধারায় ‘লোকভারতী’ নামে গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন।১৯৬০ সালে আসামে বাঙালিবিদ্বেষ মাথা ছাড়া দিলে,সেখানে কুমারচন্দ্র আসাম যান এবং সেবা করেন।
    ১৯৬৬ সালে রাজারামপুরে একটি সর্বোদয় পরিবার গঠন করেন।সাতটি পরিবার একত্র করে কুমারচন্দ্র সাম্যতাবাদের পরীক্ষা-পরিকল্পনা করেছিলেন।সুতাহাটা থানা অঞ্চলে প্রায় দু’শ গ্রামে দুই হাজার স্বেচ্ছাসেবক সৃষ্টি করেন।
    কুমারচন্দ্র কলকাতা থেকে ফিরে স্বগ্রামের পাশে অনন্ত গ্রামে একটি জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।উদ্বোধন করেন দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসমল।কুমারচন্দ্রের আন্তরিক পরিশ্রম এবং সাংগঠনিক ক্ষমতার বিদ্যালয়টি এই অঞ্চলে একটি আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল।ছুটির দিনে গ্রামের রাস্তাঘাট নির্মাণ ও সংস্কার,পুষ্করিণী পরিষ্কার, খাল-নালার জঞ্জাল সাফ,প্রাথমিক স্কুল প্রতিষ্ঠা, রোগীর চিকিৎসা,ঘরে ঘরে স্বনির্ভর করে তোলার জন্য চরকা প্রচলন প্রভৃতি কাজের মাধ্যমে গ্রামগঠন তথা দেশগঠন করেছিলেন।

    বোম মেরে নয়,বজ্রকঠিন বুক ঠেকিয়ে লড়াই।

    স্বাধীনতা সংগ্রামে হিংস্র-হায়নার মতো শাসকের গালে সরাসরি চপেটাঘাত করে লাল করা হয়,একটুও হিংসাত্মক আঘাত ছাড়াই গাল লাল করে দেওয়ার আশ্চর্য লড়াই করে গেছেন কুমারচন্দ্র।

    ” আই হেট টু স্যালুট ইট”

    ইংরেজ রাজসরকারের দৃষ্টিভঙ্গিতে ভারতবাসী কুকুর-বেড়ালের সমান।তাঁরা রাজপুরুষের সম্মান জানানোর সঙ্গে সঙ্গে বস্তুকেও সমান করানো শাসনের মূলভিত্তি মনে করত।আর আত্মসম্মানকারী সংগ্রামী কুমারচন্দ্র ঠিক সেই অপমানের প্রতিবাদ করেছিলেন চূড়ান্ত অহিংসভাবে।১৯৩৬ সালের ৯ ফেব্রুয়ারী। সরকার ঘোষণা করল এদিন দেশবাসীকে ব্রিটিশ পতাকাকে অভিবাদন করতে হবে।বড়োদারোগা বাসুদেবপুরের গান্ধি আশ্রমে সংবাদ দিলেন এ. ডি. এম.সাহেব ইউনিয়ন জ্যাক তুলবেন।কুমারচন্দ্রকে ডেকে পাঠানো হল পতকাকে স্যালুট করার জন্য। কুমারচন্দ্র জানা আমন্ত্রণ পত্রের ওপর লিখে দিলেন,”We the Indians specially the people of Midnapore are treated like cats and dogs,so l am not going to salute the Union Jack”
    এই ধরণের মানসিক দৃঢ়তা খুব স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়।
    যখন বার বার শাসনের ভয় দেখিয়ে জোর করার চেষ্টা করা হলে তিনি চেঁচিয়ে বলে উঠতেন,”আই হেট টু স্যালুট ইট”
    ১৯২১ সালে ইংল্যান্ডের যুবরাজ আগমন উপলক্ষ্যে কুমারচন্দ্র হরতাল ডাকেন।১৯২২ সালে তাঁকে গ্রেপ্তার করে জেলে রাখা হয়।১৯৩০ সালে ১৮ এপ্রিল লবন আইন অমান্য করার জন্য তাঁর কারাদণ্ড হয়। জেলা ম্যাজিস্ট্রেএ গ্রিথিফ সাহেব সপ্তাহে দুদিন থানায় হাজিরা দেওয়ার কথা বলেন।তিনি তা অমান্য করেন।আবার জেল।১৯৩৬ সালে মহকুমা শাসক থানায় হাজিরা দেওয়ার কথা মৌখিকভাবে স্বীকার করেন,তাও অমান্য করেন।তাতেও জেল হয়।এইভাবে নীরবে এবং দৃঢ়তার সঙ্গে ইংরেজ সরকারের দমননীতিকে ধূলিসাৎ করে দেন।

    দেশমিত্র কুমারচন্দ্র জানা

    জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত যাঁরা দেশের জন্য প্রাণপাত করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে কুমারচন্দ্র একজন প্রথম সারির দেশনায়ক।১৯৭২ সালে কেন্দ্রীয় সরকার নির্যাতিত স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পেনশন চালু করেন।কিন্তু কুমারচন্দ্র স্বেচ্ছায় সেই সরকারী পেনশন গ্রহণ করেননি।তিনি বলতেন,পেনশন বা সরকারি অনুদানের জন্যে স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদান করিনি।অথচ নিজে ২০০ জন স্বাধীনতা সংগ্রামীর আবেদনপত্রে অনুমোদন স্বাক্ষর করেছিলেন,যাতে তাঁদের অর্থকষ্ট না হয়। কুমারচন্দ্র প্রকৃত দেশসেবক।দেশবন্ধু বললে যেমন চিত্তরঞ্জন দাশকে,দেশপ্রাণ বললে যেমন বীরেন্দ্রনাথ শাসমলকে বুঝি,তেমনই কুমারচন্দ্র জানা হলেন দেশমিত্র। দেশ গঠনের প্রকৃত বন্ধু। যশ-খ্যাতি-প্রতিপত্তিকে পায়ের ধূলা মনে করতেন।মহাত্মা গান্ধি ছিলেন কুমারচন্দ্রের চোখে ও বিশ্বাসে আদর্শ নেতা ও গুরু।তাই মহাত্মার দেশগঠনের ১৮ দফা কর্মসূচির প্রধান দুটি অঙ্গ, গ্রামের মানুষকে আত্মনির্ভর এবং একে-অপরের জন্য হৃদয় দিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়ানো।এই দুটি কাজ কুমারচন্দ্র জানা অতি নিষ্ঠা ও নিমগ্নতার সঙ্গে করেছিলেন সারাটা জীবন।তাই দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যখন কংগ্রেসী নেতাদের ক্ষমতার লোভ ও দ্বন্দ্বযুদ্ধ দেখেছেন,তখনই সেখান থেকে সরে এসেছেন। তিনি ফিরে গেছেন সেই সব মানুষের কাছে, যাদের শ্রমে এই দেশটার রথের চক্র এগিয়ে চলে।
    কিন্তু চরম আক্ষেপ ও দুঃখের বিষয়,স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় কুমারচন্দ্রের প্রতি গান্ধিভক্ত কংগ্রেসিদের অবিচার মনকে পীড়িত করে।কুমারচন্দ্র জানা ১২ বছরের অধিক অগ্নিগর্ভ মেদিনীপুরের জেলা কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন,১৯২২ সাল থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে ১২ বছর কারারুদ্ধ ছিলেন,তিনি জাতির সেবায় নিজেকে একেবারে উৎসর্গ করেছিলেন,সেই তাঁকে নানা ধরণের চক্রান্ত করে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল।তাই মহাত্মা যখন মহিষাদলে এলেন,তখন তিনি যাতে কিছুতেই সুতা হাটার ল বাসুদেবপুর গ্রামে কুমারচন্দ্রের প্রতিষ্ঠিত আশ্রমে আসতে না পারেন,সেই জন্য ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে যায়।অবশ্যই শেষ পর্যন্ত কুমারচন্দ্রের জয়লাভ হয়।মহাত্মা গান্ধি কুমারচন্দ্রকে আশীর্বাদ করতে হলদিয়ায় এসেছিলেন এবং গান্ধি আশ্রমে হাজার হাজার মানুষের সুশৃঙ্খলা শ্রদ্ধা ও ভক্তি দেখে অত্যন্ত প্রীত হয়েছিলেন।কারণ মহাত্মা জানতেন,ভারতবর্ষ দেশটা দাঁড়িয়ে আছে,কুমারচন্দ্রের মতো মানুষের জন্য।
    আমরা যদি দেশমিত্র কুমারচন্দ্রকে ভুলে যাই বা তাঁর সমগ্র কর্মধারা বিস্মৃত হই,তাহলে এই স্বাধীনতা আন্দোলন ব্যর্থ এবং এই দেশ যথার্থ স্বাধীনতালাভ করেনি।
    কুমারচন্দ্র জানা অখণ্ড মেদিনীপুরে দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের পর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সর্বজনপ্রিয় প্রথম সারির নেতা,গুরু এবং সাধক।শেষ করব রাসবিহারী জানার কথা দিয়ে—
    “কুমারবাবু অজগাঁয়ের চাষার ছেলে না হয়ে যদি শহুরে হতেন তা হলে সারা বাংলায় এক প্রাতঃস্মরণীয় জননায়ক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করতেন”

    এই আক্ষেপ আর কতদিন বহন করতে হবে? কতদিন?
    একজন প্রকৃত দেশনায়ক কতদিন উপেক্ষার আবিলতায় পড়ে থাকবে?
    কতদিন?
    এই উত্তর যতদিন না আসছে,আমাদের সত্যিকারের স্বাধীনতা ততোদিন আসবে না!

    ঠকিলেও, ঠকাইব না

    কোনো কোনো মানুষের জীবন এমনভাবে পথরেখা নির্মাণ করে,তাই বাণী হয়ে ওঠে।মহাত্মা গান্ধি যেমন বলেছিলেন,আমার জীবনই আমার বাণী।
    তেমনই অসংখ্য অপমান,অবহেলা ও ঠকে যাওয়ার পরও মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী সাধক কুমারচন্দ্র জানা উচ্চকণ্ঠ বলতেন,’ঠকিলেও,ঠকাইব না।’

    এ যেন সুসভ্যতার শেষতম বাণী।