রবীন্দ্রনাথ ‘ছেলেটা’ কবিতায় ছেলেটার জন্য দুঃখ করে বলেছিলেন–‘থাকত যদি ওর নিজের জগতের কবি/তাহলে গুবরে পোকা এত স্পষ্ট তার ছন্দে/ও ছাড়তে পারত না..।’
আমরা বড়োরা ছোটো ছেলেমেয়েদের নিজস্ব জগতের কবি হতে পারিনা বলেই, বিভিন্ন অভিযোগের হাড়িকাঠে কোমলমতি শিশুদের গলা পুরে দিয়ে নিজেদের ‘ধোয়া তুলসীপাতা’ ভাবি। আজকের শিশু-কিশোর ও তরুণদের মধ্যে যেসব অস্বাস্থ্যকর প্রবৃত্তি তথা অনভিপ্রেত প্রবণতার জন্ম হচ্ছে, সেজন্য তাকে দায়ী করার আগে বড়োদের আত্মানুসন্ধান প্রয়োজন। কারণ, আমাদের নতুনপ্রজন্মের আদর্শ ও নীতিবোধহীন মানবসত্তা রূপে গড়ে ওঠার,অনেকটা দায় আমাদের, অর্থাৎ বড়োদের উপর বর্তায়।
যে সমাজপরিবেশে আজ একজন শিশু-কিশোর বড়ো হয়ে উঠছে,সে সমাজ সে এসে তৈরি করেনি। আমরা আগে থেকেই তা প্রস্তুত করে রেখেছি তার জন্য। বলাবাহুল্য এই সামাজিক পরিবেশ আমাদের দীর্ঘকালের সমবেত অপচেষ্টায় এতটাই পঙ্কিল হয়ে উঠেছে যে, তা নতুন জন্মলাভ করা একজন শিশুর সামাজিকতাবোধের পূর্ণ বিকাশের পক্ষে একেবারেই অনুপযুক্ত।
অনিবার্য ফলশ্রুতি হিসেবে তাই ক্রমাগত শিশু-কিশোরদের মূল্যবোধহীনতার ছবি প্রকট হয়ে উঠছে সমাজে। আত্মনিয়ন্ত্রণের অক্ষমতা, অসহিষ্ণুতা, পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারার অসামর্থ্য, তাদের আবেগ ও প্রক্ষোভকে করে তুলছে নিয়ন্ত্রণহীন। কোন কোন সময় ব্যর্থতার ‘mal adaptive’ প্রতিক্রিয়ায় তারা হয়ে উঠছে আক্রমণাত্মক। অস্বাভাবিক জেদ, বড়োদের অপমান,এমনকি শারীরিক নিগ্রহের মতো নীতিহীন আচরণেও ছোটোদের দ্বিধা সংকোচ আসছে না। সমাজের নানাস্তরে নানাভাবে কমবয়সীদের এই আবেগগত অসামঞ্জস্যের ছবি ধরা পড়ছে। ভাবীকালের সমাজ গঠনের দায়িত্ব যাদের হাতে বর্তাবে, তাদের যথাযথ চরিত্রগঠন করতে না-পারার এই অক্ষমতাই বোধ হয় বর্তমান সমাজের সবচেয়ে বড়ো ব্যর্থতা।
নিয়ন্ত্রনহীন অগ্রগতিকে সভ্যতার পথে দীপ্ত পদযাত্রা বলে ভুল করে, যে যার মত খেয়ালখুশিতে এগোচ্ছি আমরা। খেয়াল রাখছি না, সামাজিক বিপর্যয়ের ‘খাদ’টা বেশি দূরে নেই। যুগ-যুগান্তরের জীবন অভিজ্ঞতায় যে সমাজ-শৃঙ্খল রচনা করেছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষেরা, আজ দিকে দিকে শৃঙ্খল খসে পড়ার আওয়াজ শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। এটা যে বিপর্যয় শুরুর ইঙ্গিত, তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এটি সমাজবিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনাও নয়। একেবারেই সমাজের অগ্রগতির সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়। বড়দের চাহিদা মানসিকতার পরিবর্তন এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। আজ আমরা,যারা আমাদের নবীন প্রজন্মের মূল্যবোধের অধোগতিকে সামাজিক বিপর্যয় বলে চিহ্নিত করে গলা ফাটাচ্ছি, তারাই কিন্তু কিছুটা সচেতন বা কিছুটা অচেতন ভাবে অবক্ষয়ের এই বীজ বুনেছি। বীজ বোনার ক্ষেত্র হয়ে উঠছে আমাদেরই নিজের নিজের পরিবার। আমার আপনার শিশুকিশোর সন্তানের নেতিবাচক জীবনাভ্যাস গঠনের মধ্য দিয়েই,নিজের অজান্তে খাল কেটে মূল্যবোধহীনতার অবাঞ্ছিত কুমিরকে ডেকে আনছি আমরা নিজেরাই।
গতকালের শিশু যখন অপরাধপ্রবণ কিশোর কিংবা মানসিক বিকারগ্রস্ত যুবকে পরিণত হচ্ছে, বিষবৃক্ষের ‘অগ্রমুকুল’গুলো নজরে পড়ছে তখনই। সন্তানকে পূর্ণবিকশিত মানবসত্তায় রূপান্তরের পর্যায়কালে অর্থাৎ তাকে বড়ো করে তোলার ধারাবাহিক পরিচর্যাকালে, বিষয়টিতে গুরুত্ব না দেওয়ার ফল পেতে হচ্ছে পরবর্তী জীবনে।
আমরা নিজের সন্তানদের বয়োবৃদ্ধির সাথে সাথে তার ভবিষ্যৎ আর্থিক ‘ক্যারিয়ার’ নিয়ে যতটা ভাবছি, ততটা তার মন নিয়ে, মানসিক গঠন নিয়ে ভাবছি না। ফলে সমাজে মানবিক আদর্শ ও মূল্যবোধহীন সমাজ-সদস্যের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। রাজনীতি, সংস্কৃতি, ধর্মবোধের সকলক্ষেত্রেই অবক্ষয়ের চিহ্ন ফুটে উঠছে স্পষ্টভাবে। শিক্ষাক্ষেত্র, ক্রীড়াক্ষেত্র, বিনোদনক্ষেত্র কোন জায়গা আজ এই অবক্ষয়ের কলুষমুক্ত নয়।
মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে একটি শিশুকে বিচার করলে আমরা দেখতে পাবো যে, শিশু একটি বিশেষ শক্তিপুঞ্জের মতো। শিশুর মন ও তার পরিবেশ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্কেই আবদ্ধ থাকে। যেহেতু সে-ও এক সামাজিক জীব,তাই সময়ের সঙ্গে তাল রেখে শুধু দেহের নয়, তার মনেরও পরিবর্তন ঘটে চলেছে। চারপাশের নানা বিষয়ের প্রতি আগ্রহ,বাহ্যিক পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজন,আবেগ,অনুভূতি প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি বোধগুলির ক্ষমতা, ধীরে ধীরে সে আয়ত্ত করছে। শিশুর মনের এই ক্রমবিকাশ তার অন্তর্নিহিত শক্তির দ্বারা কিছু পরিমাণ চালিত হলেও, পরিবেশ ও যথার্থ শিক্ষার ধারা নিয়ন্ত্রিত হয় বেশি। শিশু যদি একা থাকতো, তাহলে তার ‘অহং’ জ্ঞান আসতো না। অন্যের সংস্পর্শে আসে বলেই, অন্যেরা তাকে কি চোখে দেখছে, কে বিরক্তি উৎপাদন করছে, কে ভালোবাসছে, এসব চিন্তা তার আসে। এইসব চিন্তা থেকেই তার মধ্যে জন্ম নেয় আত্মসচেতনতার বোধ।
একজন শিশু এটাও ক্রমে ক্রমে বুঝতে পারে যে, তার কাছ থেকেও তার চারপাশের মানুষ বিশেষ বিশেষ ব্যবহার, আচারআচরণ প্রত্যাশা করছে। তাকেও কিছু রীতিনীতি, আদর্শ মেনে চলতে হবে। সে যে কৃষ্টির মধ্যে বড়ো হয়, সেখান থেকেই সে ভাবধারা ও আদর্শ গঠনের উপাদান সংগ্রহ করে। ফ্রয়েড,এডলার, গুষ্টাভ য়ুং প্রভৃতি বিখ্যাত মনোবিদ শিশুর জন্মের প্রথম পাঁচ বছরকে শিশুর মানসিক ও চারিত্রিক গঠনপ্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় বলে উল্লেখ করেছেন। দার্শনিক রুশো জীবনের পরের পর্বটি পাঁচ থেকে বারো পর্যন্ত নির্ধারিত করেছেন। বড়োদের স্নেহের ধারায় অভিষিক্ত হয়েই, দয়া মায়া উদারতা শ্রদ্ধাবোধ প্রভৃতি সুকুমার বৃত্তিগুলো আর মনের মধ্যে অঙ্কুরিত হয় এই বিশেষ সময়কালে। ভবিষ্যৎ নাগরিক হিসাবে তার চেতনা কতটা ‘আলো’য় কিংবা ‘কালো’য় ভরে উঠবে, তার অনেকটাই নির্ভর করে এই সময়টায় তার যাপনের উপর। শিশুর যথাযথ বিকাশে গৃহ পরিবেশের গুরুত্বের কথা মাথায় রেখে শিশুমনস্তত্ত্ববিদ বলেন, ‘The home is the soil in which bring up those virtues..’ আরো পরিষ্কার করে বলা হয়, ‘One good mother is worth a hundred school master.’
বিজ্ঞান ও যান্ত্রিক সভ্যতার অপরিমিত অগ্রগতির ফলে, ‘ইঁদুরদৌড়ে’ নাম লিখিয়ে বল্গাহীন চাহিদার দিকে ছুটছি আমরা। জীবন সংগ্রামের নিদারুণ জটিলতায় ঘরে থেকেও আমরা ঘরছাড়া। জননীর হাতেও ঘুমপাড়ানি গান শুনিয়ে, রূপকথার রঙিন গল্প শুনিয়ে শিশুমনকে বিমুগ্ধ করে রাখার সময় এখন নেই। টিভি বা অন্যান্য দৃশ্য-শ্রাব্য বিনোদন মাধ্যম মায়ের স্নেহের আঁচলের বেষ্টনী থেকে শিশুকে দূরে এনে ফেলেছে। নিজস্ব গৃহকর্ম, পেশাগত কর্ম ও বিনোদনের রুটিনে বাঁধা পড়েছে মায়ের প্রতিদিনের জীবন। অধিকাংশ শিশুই আজ মানসিকভাবে বঞ্চিতের দলে। যৌথ পরিবার ভেঙ্গে যাওয়ার ফলে, শিশুর ভালোবাসা পাওয়ার ক্ষেত্রও সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। জ্যাঠা কাকা দাদু দিদা পরিবেষ্টিত জীবন থেকে আজকের শিশু অধিকাংশই বঞ্চিত। শৈশবের জীবনে অনেকেই একা একা বসে বিনোদনের জন্য মোবাইলফোনে ‘গেম’ খেলতে ব্যস্ত ও বাধ্য হচ্ছে। শিশুমনের যথার্থ বিকাশের প্রতি দায়বদ্ধতাহীন উচ্ছৃংখল বিনোদনের যথেচ্ছ আয়োজন সর্বত্র। নানান উপকরণ আজকের শিশুকে নিয়ে গিয়ে ফেলছে এক জটিল নেতিবাচক ক্ষতিকর মনস্তত্ত্বাত্বিক আবর্তের ঘোলাজলে।
শৈশবের পরেই আসে কৈশোর জীবন। অনুকরণপ্রিয়তা এই বয়সের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্বভাব বৈশিষ্ট্য। এই পর্যায়ে তার মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। এই জীবন পর্যায়ে, বাইরের কোনো কিছু বারবার দেখে বা শুনে, তার মধ্যে স্বেচ্ছাচারিতা, অবাধ্যতা আসার সুযোগ থেকেই যায়। আধুনিক গণজীবনের এক বৈশিষ্ট্য হল, অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতায় নেমে একে অন্যকে টপকে যাওয়ার মানসিক প্রবণতা। এই অভিপ্রায়ে প্রতি মুহূর্তেই লড়াইয়ের ময়দানে নতুন প্রজন্মকে নামিয়ে দিচ্ছি আমরা। সরলমতি শিশুদেরও তা থেকে রেহাই মিলছে না। যেনতেন প্রকারেন সাফল্যের ‘সোনার আপেল’ ছিনিয়ে আনতেই হবে তাকে ! বড়োদের সর্বক্ষেত্রে অতিরিক্ত যত্নশীলতা শিশুকিশোরকে যে পরনির্ভরশীল হিসাবে গড়ে তোলে, সে কথাও মাথায় রাখে না কেউ। এ প্রসঙ্গে জে.এস মিলের কথা মনে পড়ে, ‘strong-willed parents make weak-willed children.’
সামাজিক মূল্যবোধ ও মানবিক গুণাবলীর আলোয় শিশু-কিশোরের হৃদয় কে আলোকিত করার সামর্থ্য, প্রচলিত শিক্ষা ধারা আজও অর্জন করতে পারল না। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় যুক্ত থাকার সঙ্গে আদর্শ মানুষ হয়ে ওঠার আজ আর যেন কোনো সম্পর্কই নেই। রবীন্দ্রনাথের একশো বছর আগে বলা কথাটির প্রাসঙ্গিকতা একটুও বদলায়নি আজো। তিনি লিখেছিলেন, –‘সরস্বতীর সাম্রাজ্যে কেবল মজুরি করিয়া মরি,পৃষ্ঠের মেরুদন্ড বাঁকিয়া যায় কিন্তু মনুষত্বের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ হয় না।’ আজকাল সরকারি বেসরকারি, নামী-অনামী কতনা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে! সেসবেরই কোনো একটিতে পাঠিয়ে, বাবামা শিশুর চরিত্রগঠনের বুনিয়াদ রচনার দায়িত্ব খালাস করে দিচ্ছেন। টাকা খরচ করলেই যে শিশুকে যথার্থ মানুষ করে তোলা যায় না, এই সত্যটা আজও বুঝে উঠতে পারলাম না আমরা। বিদ্যালয়গুলিও যে শুধু পুঁথিগত জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র নয়, সে ধারণা ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। ভুলে যাচ্ছি,
..’there should be two way traffic between the school and society.’
স্কুলকে গৃহ ও সমাজ দুয়েরই চাহিদা মেটাতে হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের কথায়,’শিক্ষার আলোর জন্য উঁচু লণ্ঠন ঝোলানো হয়েছে স্কুল কলেজে, কিন্তু সেটা যদি বন্ধ দেওয়ালে বন্দী আলো হয়, তাহলে বলব আমাদের অদৃষ্ট মন্দ! ..কারখানায় মানুষ গড়া হচ্ছে, জ্ঞানের তপস্যা,মনের তপস্যা কিছুটা চলছে, কিন্তু বোধের তপস্যা হচ্ছে না।’
স্বভাবতই সর্বব্যাপী এই অবক্ষয়ের জন্য নিজেদের দায় এড়িয়ে যাওয়া মানেই বালিতে মুখ গুঁজে থেকে ঝড়কে অস্বীকার করতে চাওয়া। রুশোর সেই বিখ্যাত উক্তিটি স্মরণ করে, সমাজের অধোগতিকে যদি রোধ করা যায় তবেই মুক্তি ঘটবে এই সমাজসংকট থেকে। রুশো তাঁর শিক্ষাদর্শন সংক্রান্ত বিখ্যাত গ্রন্থ Emile-এর সূচনাতেই লিখেছিলেন, ‘Everything is good as it comes from the hands of creator of things(des choses): everything degenerates in the hands of man.’
—————-
কাজী নুদরত হোসেন
নলহাটি / বীরভূম (প.ব)