তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার গড়ে ওঠার পেছনে নেতাজির কি কোনো ভূমিকা ছিল? তাই নিয়ে একটু ইতিহাস খোঁজার ক্ষুদ্র প্রয়াস…
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে মেদিনীপুর জেলার এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। সময়টা বিংশ শতাব্দীর চারের দশক। স্বাধীনতালাভের জন্য মরীয়া দেশবাসী। শুরু হয়েছে ভারত ছাড়ো আন্দোলন। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে আন্দোলনের ঢেউ। সেই ঢেউ আছড়ে পড়ে মেদিনীপুরেও। বিয়াল্লিশের স্বাধীনতা আন্দোলনে জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল স্বাধীন তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা। সেই সময় দেশের কয়েকটি জায়গায় এরকম স্বাধীন সরকার গড়ে উঠেছিল। কিন্তু স্থায়িত্ব এবং কর্ম পদ্ধতির নিরিখে তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।
এখন প্রশ্ন হল কেন এই তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল? প্রথমত বলার জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা হঠাৎ কোনো আবেগের বহিঃপ্রকাশ নয়। কংগ্রেসের সর্বভারতীয় কর্মসূচির অঙ্গ ছিল এটি। তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার কারণ বা লক্ষ্য হিসেবে মূলত দুটি প্রেক্ষাপটের কথা বলা যেতে পারে। প্রথমত, জেলার সমসাময়িক পরিস্থিতি। দ্বিতীয়ত, সুদূরপ্রসারী ভাবনাচিন্তা। দুই ভাবনার একটাই সুর ছিল ব্রিটিশ দাসত্বমুক্ত স্বাধীন সরকার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন চরম আকার ধারন করেছে। জার্মান, জাপান অপ্রতিহত গতিতে এগিয়ে চলেছে। মিত্রশক্তি বেশ চাপে। সেই সময় নানান দেশ থেকে ভারতকে স্বাধীনতা দেওয়ার চাপ আসছিল। ১৯৪২-এর ১১ মার্চ ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ঘোষণা করা হয় যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ভারতকে সায়ত্ব শাসনের অধিকার দেওয়া হবে। এই ব্যাপারে আলোচনার জন্য স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসকে ভারতে পাঠানো হয়। কিন্তু ক্রিপসের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন ভারতীয় নেতৃত্ববৃন্দ। কংগ্রেসের সাথে ব্রিটিশ সরকারের সম্পর্ক খুব খারাপ হয়। মহাত্মা গান্ধি বলেন, ‘ক্রিপস মিশন একটি দেউলিয়া ব্যাঙ্কের মেয়াদ উত্তীর্ণ চেক।’ ক্রিপস ব্যর্থ হয়ে দেশে ফিরে যান। একটা মিথ্যে বার্তা জোর করে প্রচার করে দেওয়া হয়, ভারতীয়রা সায়ত্ব শাসনের অনুপযুক্ত। এমন বক্তব্য জাতীয় নেতৃবর্গের মনে ক্ষাভের সঞ্চার করে। স্বাধীনতালাভের জন্য কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি ‘ভারত ছাড়ো’ প্রস্তাব গ্রহন করে।
প্রসঙ্গত বলার ‘ভারত ছাড়ো’ প্রস্তাব প্রথম দিয়েছিলেন নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু। ১৯৩৯-এ ত্রিপুরী কংগ্রেসে সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি ‘ভারত ছাড়ো’ প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু মূলত গান্ধিজির আপত্তিতে সেই প্রস্তাব গৃহীত হয়নি। আন্দোলনের ধারা ও কর্মপন্থা নিয়ে মতানৈক্যের কারণে গান্ধিজির সঙ্গে সুভাষের বিরোধ তখন চরমে।
সেই সময় সর্বভারতীয় নেতা হিসাবে যে দুজনের নাম উল্লেখযোগ্য তাঁরা হলেন মহাত্মা গান্ধি ও নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু। তরুণ, তেজদীপ্ত, দুঃসাহসী সুভাষ দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষ বিশেষ করে তরুণ যুব শক্তির কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। দিনে দিনে তাঁর সেই জনপ্রিয়তা বাড়ছিল। ১৯৩৮-এর হরিপুরা কংগ্রেসে তাঁর সভাপতি নির্বাচনে গান্ধিজির ভূমিকা ছিল। কিন্তু স্বাধীনতা আন্দোলন নিয়ে গান্ধিজির নীতি ও কার্যকলাপ নিয়ে তাঁর সঙ্গে মতানৈক্য শুরু হয়। তাঁদের মধ্যে বিরোধ বাড়তে থাকে। কিন্তু নেতাজি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন যে ১৯৩৯-এ ত্রিপুরী কংগ্রেসে গান্ধিজির তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও তাঁর মনোনীত প্রার্থী পট্টভি সীতারামাইয়াকে হারিয়ে সুভাষচন্দ্র সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু নানাবিধ বিরোধিতার কারণে সুভাষ বুঝতে পারেন কংগ্রেসের মধ্যে থেকে তাঁর পক্ষে লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। বীতশ্রদ্ধ সুভাষ সভাপতির পদে পদত্যাগ করে এবং ওই বছরের ৩ মে ফরওয়ার্ড ব্লক গঠন করেন।
যাই হোক, কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি যখন ‘ভারত ছাড়ো’ প্রস্তাব গ্রহন করে সুভাষ তখন বিদেশে। বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর নেতাজি বুঝেছিলেন ইংরেজদের দেশ থেকে তাড়ানোর এটাই সুবর্ণ সুযোগ। তার জন্য চাই সশস্ত্র আন্দোলন। নেতাজি এটাও বুঝেছিলেন পরাধীন ভারতবর্ষের বুকে বসে সে কাজ করা সম্ভব নয়। সুভাষচন্দ্র তখন নজরবন্দী অবস্থায় আছেন। ১৯৪১-এর ১৬ জানুয়ারি ব্রিটিশ পুলিশকে ধোঁকা দিয়ে তিনি বিদেশের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেন। তাঁর সেই যাত্রা যে কোনো রোমহর্ষক কাহিনিকে হার মানায়। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল জার্মান এবং জাপানের সহযোগিতা নিয়ে সেনাবাহিনি গঠন করে ভারতবর্ষে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা। দেশ থেকে ছদ্মবেশে বেরিয়ে নানা পথ পেরিয়ে তিনি জার্মান যান। সেখান থেকে তিনি জাপানে যান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান তখন অপ্রতিহত গতিতে এগোচ্ছে। ইতিমধ্যে সিঙ্গাপুর দখল করেছে তারা। রাসবিহারী বসু সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ বাহনি গঠন করেছেন। নিজে অসুস্থ থাকায় সেই সময় তিনি এমন একজন মানুষের খোঁজ করছিলেন যিনি সেই সেনাবাহিনির দায়িত্ব নিতে পারবে। তাঁর আমন্ত্রণে সুভাষ সিঙ্গাপুরে যান এবং রাসবিহারী বসু তাঁর হাতে আজাদ হিন্দ বাহিনির দায়িত্ব তুলে দেন। সুভাষ আপন দক্ষতায় এই বাহিনিকে মজবুত করে গড়ে তোলেন। শুধু তাই নয় পরবর্তী সময়ে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ২১ অক্টোবর তিনি আজাদ হিন্দ সরকার গঠন করেন। তিনি ছিলেন এই স্বাধীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী। জার্মানি, ইতালি, জাপান সহ আরও ছয়টি দেশ এই স্বাধীন সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল।
‘ভারত ছাড়ো’ প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর গান্ধিজি দেশবাসীকে নির্দেশ দেন এরপর থেকে তারা নিজেদের স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে মনে করবে এবং সেইভাবে কাজ করবে। তিনি ডাক দেন ‘ডু অর ডাই’–হয় স্বাধীনতা নয় মৃত্যু। তাঁর এই আহ্বান উত্তাল তরঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশে। ব্রিটিশ সরকার গান্ধিজি সহ বেশকিছু নেতাকে গ্রেপ্তার করলে সারা দেশ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। সেই ক্ষোভের আগুন স্পর্শ করে মেদিনীপুরের বিপ্লবীদেরও। গান্ধিজির অহিংস নীতি মেনে জেলার বিপ্লবীরা এই আন্দোলনে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় জোরদার আন্দোলন। এমনকি ছাত্ররাও স্কুল ত্যাগ করে এই আন্দোলনে অংশগ্রহন করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে।
এটা অনস্বীকার্য যে জেলার বিপ্লবীরা গান্ধিজির ডাকে সাড়া দিয়ে এই আন্দোলনে সর্বোতভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তবে তাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহন ও গভীরভাবে এই আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার পেছনে নেতাজীরও পরোক্ষ অবদান ছিল বললেও ভুল হবে না। আগেই বলেছি, নেতাজি তখন দেশ বরেণ্য নেতা। যুবশক্তির আইকন। তাদের অনুপ্রেরণা। গান্ধিজির পাশাপাশি তিনিও দেশবাসীর মনে আলাদা একটা জায়গা করে নিয়েছেন। মেদনীপুরবাসীর মধ্যেও নেতাজীর গভার প্রভাব ছিল। সেটা আরও বৃদ্ধি পায় নেতাজির মেদিনীপুর আসার পর। ১৯৩৮-এর ১১ এপ্রিল তমলুকে সভা করতে আসেন সুভাষ। ব্রিটিশ সরকার নানাভাবে তাঁর সভা বানচাল করার চেষ্টা করেন। শেষপর্যন্ত তমলুক রাজবাড়ির বংশধর সুরেন্দ্র নারায়ণ রায়ের সহায়তায় রাজ পরিবারের আমবাগান-গোলাপবাগন সংলগ্ন খোষরঙের মাঠে এই সভা হয়। সুভাষচন্দ্র স্বরাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জেলার মানুষকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তাঁর ভাষণ মানুষের মধ্যে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। যা বিয়াল্লেশর আন্দালনে গান্ধিজির আহ্বানের পর বিপ্লবীদের মনে অনুঘটকের কাজ করেছিল।
ব্রিটিশ পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে সুভাষের দুঃসাহিসক অভিযান এমনিতেই ভারতবাসীর মনে বিরাট প্রভাব ফেলেছিল। তাঁর জার্মানিতে পৌঁছোনো, আজাদ হিন্দ সংঘ গঠন, সেখান থেকে বেতারে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে ভাষণ অন্যান্য জায়গার মতো এই জেলার বিপ্লবীদেরও অনুপ্রাণিত করেছিল। এই সময় সুভাষচন্দ্রের ওপর গান্ধিজির মনোভাবেরও পরিবর্তন লক্ষিত হয়। তাঁর দেশপ্রেম, নিষ্ঠা, তেজ, দুঃসাহসিকতা গান্ধিজিকে মুগ্ধ করে। সুভাষচন্দ্রের বিদেশের কার্যকলাপ, দেশবাসীর প্রতি আহাবন জেলার কংগ্রেস কর্মীদের ব্যাপকভাবে নাড়া দেয় যা তাদের ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে প্রবলভাবে জড়িয়ে পড়তে উৎসাহিত করেছিল, একথা বললে বোধহয় ভুল বলা হবে না।
যাই হোক, ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার পর গান্ধিজির আহিংস নীতি মেনে জেলার কংগ্রেস কর্মীরা আন্দোলন শুরু করেন। সতীশচন্দ্র সামন্ত, অজয়কুমার মুখোপাধ্যায়, কুমারচন্দ্র জানা, সুশীলকুমার ধাড়া প্রমুখ যোগ্য নেতৃবর্গের দক্ষ নেতৃত্বে সেই আন্দোলন ক্রমশ জোরদার হতে থাকে। ইতিমধ্যে সুশীলকুমার ধাড়ার নেতৃত্বে গড়ে ওঠে বিদ্যুৎ বাহিনী। পরে মহিলাদের নিয়ে তিনি গড়ে তোলেন ভগিনী সেনা। ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের অঙ্গ হিসেবে ১৯৪২-এর ২৯ সেপ্টেম্বর থানা ঘেরাও কর্মসূচি নেওয়া হয়। এই কর্মসূচিতে তমলুক, মহিষাদল, সুতাহাটা, নন্দীগ্রাম থানা মিলে মোট ৩৬ জন শহীদ হন। থানা ঘেরাও কর্মসূচি পুরোপুরি সফল না হলেও তা ব্রিটিশ শাসকদের নাড়িয়ে দেয়। ভয় পেয়ে যায় তারা। শুরু করে দমন পীড়ন নীতি। গ্রামের পর গ্রাম লুঠ করতে থাকে। পুরুষদের ওপর শুরু হয় অমানবিক অত্যাচার। বৃদ্ধ এবং শিশুরাও বাদ যান না। মহিলারা ধর্ষিতা হতে থারেন। মানুষের অবস্থা যখন বিপর্যস্ত তখন মরার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো নেমে আসে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। ১৯৪২-এর ১৬ অক্টোবর ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ে। সঙ্গে বন্যা। বহু মানুষ মারা যায়। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয় মানুষ। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে সরকার মানুষের পাশে দাঁড়ানো দূরে থাক, তাদের সঙ্গে অত্যন্ত বর্বর, অমানবিক চালিয়ে যেতে থাকে। আগের মতোই লুঠপাট, ঘরবাড়ি পুরোনো এসব চলতে থাকে। সেই সঙ্গে চলতে থাকে পুরুষদের ওপর অত্যাচার, মহিলাদের ধর্ষণ। অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর পরিবর্তে তাদের জীবনকে আরও দুর্বিষহ করতে থাকে।
শাষকের অত্যাচার আর বর্বরতা জেলাবাসীর মনে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করে। ইংরেজদের ভয়ে বিপ্লবীরা পিছিয়ে যান না। শাষকের রক্তচক্ষুকে পরোয়া না করে, তাদের শাষনকে অস্বীকার করে এবং তাদের উচিত শিক্ষা দিতে তাঁরা এক বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৪২-এর ১৭ ডিসেম্বর তমলুক, সুতাহাটা, মহিষাদল ও নন্দীগ্রাম–এই চারটি থানা নিয়ে গঠিত হয় স্বাধীন তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার। সতীষচন্দ্র সামন্ত হন এই স্বাধীন সরকারের প্রথম সর্বাধিনায়ক। সুশীলকুমার ধাড়ার তৈরি ‘বিদ্যুৎ বাহিনি’ এই জাতীয় সরকারের জাতীয় সেনা বিহিনীর মর্যাদা পায়। তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের পাশাপাশি থানা জাতীয় সরকারও গড়ে ওঠে। ১৯৪৪-এর ৩১ আগস্ট পর্যন্ত এই স্বাধীন সরকার স্থায়ী ছিল।
তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার এই ছিল অন্যতম প্রেক্ষাপট। তবে এই সরকার প্রতিষ্ঠায় পরোক্ষভাবে জড়িয়ে ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। পূর্বেই বলেছি, তরুণ তেজদীপ্ত সুভাষ বিপ্লবীদের কাছে ছিলেন অনুপ্রেরণা। যে কথা শোনা যায় জাতীয় সরকারের অন্যতম সেনানী রাধাকৃষ্ণ বাড়ীর কথায়। তাঁর লেখা বই ‘তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার’-এর এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, “…প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, আজাদ হিন্দ ফৌজের ভারত অভিযান তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠাকে প্রেরণা যুগিয়েছিল।” সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ বাহিনির দায়িত্ব নেওয়ার পর সুভাষচন্দ্র সেই বাহিনিকে দক্ষভাবে গড়ে তোলেন। তাঁর কার্যকলাপ ভারতে এসে পৌঁছোতে থাকে। এই জেলার বিপ্লবীরাও সেকথা জানতে পারেন। নিয়মিত তারা তাঁর কার্যকলাপের দিকে নজর রাখছিলেন। রেডিও মারফৎ দেশবাসীর প্রতি তাঁর বার্তা তারাও নিয়মিত শুনতে থাকেন। তাঁর কাজ, বক্তব্য জেলার বিপ্লবীদের উদ্বুদ্ধ করতে থাকে। তারা বুঝতে পারেন সুভাষচন্দ্র যে কোনো সময় সেনাবাহিনি নিয়ে ভারতবর্ষে ইংরেজদের আক্রমণ করবেন। তারা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন, নেতাজী যদি সেনাবাহিনি নিয়ে ভারতে পৌঁছোতে পারেন তাহলে দেশের স্বাধীনতাকে কেউ আটকাতে পারবে না।
নেতাজির সেনাবাহিনি নিয়ে ভারতবর্ষ আক্রমণের ব্যাপারটা জেলার বিপল্পবীদের নাড়িয়ে দেয়। সেই সময় এমনটা মনে করা হচ্ছিল যে নেতাজি জলপথে ভারতে প্রবেশ করবেন। এত বড় সেনাবাহিনি নিয়ে সেটাই তাঁর পক্ষে বেশি সুবিধাজনক। সেক্ষেত্রে মেদিনীপুর কিংবা উড়িস্যার সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকা হল অবতরণের আদর্শ জায়গা। ইংরেজরাও তেমনটা আশঙ্কা করছিলেন। তাই মেদনীপুর ও উড়িস্যার উপকূলবর্তী এলাকায় তাঁরা এমন কিছু নীতি গ্রহন করে যাতে নেতাজি এই পথ দিয়ে ভারতে ঠিকঠাক পৌঁছোতে না পারেন কিংবা পৌঁছোতে পারলেও যাতে প্রচণ্ড বাধার সম্মুক্ষীন হন। এই ব্যাপারটাও জেলার বিপ্লবীদের ক্ষুব্ধ করে তোলে। ইংরেজদের দেশ থেকে তাড়ানোর জন্য মরীয়া বিপ্লবীরা অপেক্ষা করছিলেন সেনাবাহিনী নিয়ে সুভাষের দেশে আসার। তারা বুঝতে পারেন দেশে প্রবেশ করার পর নেতাজী ও তাঁর সেনাবাহিনীর জন্য নিরাপদ জায়গা দরকার। নেতাজির জন্য মুক্তাঞ্চল তৈরি করার ভাবনা তাদের জাতীয় সরকার গঠনে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
এই সরকার গঠনের পেছনে আরও একটা কারণ ছিল। একটি জাতীয় সরকার গঠন মানে তার একটি উন্নত ও দক্ষ জাতীয় সেনা বাহিনি থাকবে। তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারেরও তা ছিল। জাতীয় সরকারের নেতাদের উদ্দেশ্য ছিল সেই সেনাবাহিনি দিয়ে নেতাজীকে সাহায্য করা। নেতাজির ‘দিল্লি চলো’ ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁর বাহিনির সঙ্গে যুক্ত হয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া। এই বক্তব্য আমরা পাই সুশীলকুার ধাড়ার আত্মজীবনী ‘প্রবাহ’ গ্রন্থে।
সময়টা ১৯৪৫। ততদিনে তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের অবসান হয়েছে। আরও অনেক নেতার মতো গ্রেপ্তার হয়েছেন সুশীলকুমার ধাড়া। তখন তিনি বন্দী ছিলেন মেদিনীপুর জেলে। সেখানে এক বিচারাধীন বন্দীর সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয় তাঁর। এই বিচারাধীন বন্দী ছিলেন আজাদ হিন্দ বাহিনি গুপ্তচর ড. প্রফুল্ল দত্ত। তাঁর সঙ্গে কথোপকথনের এক জায়গায় সুশীলবাবু লিখেছেন—
“…আচ্ছা, আপনারা কি সমুদ্রপথে আসতে পারতেন না – কেন এই গহন পথে গেলন? আমরা কতদিন আশা করেছি – প্রতীক্ষা করেছি। আর সেই জন্য এই মুক্তাঞ্চল তৈরি করে রেখেছিলাম যে আপনাদের সকলকে একটু বিশ্রাম করতে দেব – দীর্ঘ ক্লান্তি দূর করার জন্য, আপনাদের পেছনে মার্চ করে দিল্লি যাব – ভাবতাম যে, বলব –
“আমি তোমার যাত্রী দলের রব পিছে
স্থান দিও হে আমায় তুমি সবার নীচে।”
সুশীলকুমার ধাড়ার এই বক্তব্য থেকে দুটি জিনিস পরিস্কার। প্রথমত, নেতাজির আদর্শ ও কর্মপদ্ধতির দ্বারা তাঁরা গভীর ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং তাঁর দেখানো পথেই দেশের স্বাধীনতার লড়াই লড়তে চেয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, নেতাজির সেনাবাহিনির জন্য একটি মুক্তাঞ্চল তৈরি করে রাখা ছিল স্বাধীন তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য।
সবকিছু বিশ্লেষণ করলে এটা পরিস্কার হয় যে তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার গঠনের পেছনে অন্যতম কারণ ছিলেন নেতাজি। দেশমাতৃকার শৃঙ্ক্ষল মোচনের জন্য সুভাষ নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। এক দেশ থেকে অন্য দেশে ছুটে বেড়িয়েছেন, সেনাদল গঠন করেছেন, গঠন করেছেন আজাদ হিন্দ সরকার। তাঁর দেশপ্রেম, সাহস, বীরত্ব কর্মপদ্ধতি দেশের এক বিশাল অংশকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। তাই তিনি যখন সুদূর সিঙ্গাপুরে, মেদিনীপুরের বিপ্লবীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ পর্যন্তও নেই, তখনও কেবল তাঁর লড়াইয়ের পথ সুগম করতে জেলার বিপ্লবীরা স্বাধীন সরকার গঠন করেছিলেন।
এই প্রসঙ্গে একটি কথা বলার, জাতীয় সরকারের বিপ্লবীরা যে অহিংসার পথ ছেড়ে হিংসার পথ ধরেছে, সেই নিয়ে জেলার কংগ্রেস কর্মীরা গান্ধিজির কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলেন। যে অভিযোগ খতিয়ে দেখতে গান্ধিজি সশরীরে জেলায় এসেছিলেন। বেশ কয়েকদিন ছিলেন মহিষাদলে। গান্ধিজির কাছে সতীশবাবুরা সত্যিটা স্বীকার করেছিলেন। কোন পরিস্থিতিতে তাঁরা হিংসার পথ ধরতে বাধ্য হয়েছিলেন সেটা ব্যাখ্যা করেছিলেন। তাদের ব্যাখ্যায় গান্ধিজি সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। তাদের বীরত্বের প্রশংসা করেছিলেন। আবার কোনো কোনো মতে গান্ধিজি কোনোভাবেই তাদের এই হিংসার পথ সমর্থন করেননি। গান্ধিজির মতামত যাই হোক না কেন, এটা পরিস্কার জাতীয় সরকারের বিপ্লবীরা গান্ধিজির অহিংস পথ থেকে সরে গিয়েছিলেন। তাহলে প্রশ্ন, কার দেখানো পথে তাঁরা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন? জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৪২-এর ১৭ ডিসেম্বর। তারও প্রায় সাড়ে তিনমাস আগে নেতাজি দায়িত্ব নিয়েছেন আজাদ হিন্দ বাহিনির। নিজেকে প্রস্তুত করেছেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার। নেতাজি বিশ্বাস করতেন সশস্ত্র আন্দোলন ছাড়া ইংরেজদের এই দেশ থেকে তাড়ানো সম্ভব নয়। ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব’, এমন আত্মবিশ্বাস ভরা সুরে দেশবাসীকে আহ্বান জানাচ্ছেন সেই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে। জাতীয় সরকারের বিপ্লবীরাও সেই সশস্ত্র আন্দোলনের পথে এগিয়ে গিয়েছিলেন। তাই একথা বললে বোধহয় ভুল বলা হবে না, গান্ধিজির দেখানো পথে আন্দোলন শুরু করলেও তাঁরা শেষপর্যন্ত সেখান থেকে সরে গিয়ে সুভাষের নীতি, আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আন্দোলনের গতি এগিয়ে নিয়ে গেছে।
সব শেষে, একথাই বলা যেতে পারে তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের সঙ্গে সরাসরি কোনোভাবে যুক্ত না থাকলেও এই সরকার প্রতিষ্ঠার পেছনে পরোক্ষে এবং অত্যন্ত নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রয়েছেন নেতাজি।