ভারতবর্ষের সামাজিক মানচিত্রে মহিলাদের অবস্থান কখনওই তেমন মর্যাদাকর ছিল না। নানারকম বঞ্চনা, লাঞ্ছনা, অবমাননার পাশাপাশি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পুরুষ-প্রাধান্যের বশীভূত হয়ে যন্ত্রণার জীবন কাটাতে হয়েছে তাদের। বেদ-পুরাণের সময় থেকে শুরু করে যদি আমরা বর্তমান সময়ে চোখ রাখি, দেখব গতানুতিক ভাবনার ছবিটা অনেকটা একইরকম। একথা সত্যি বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে মহিলাদের সামাজিক অবস্থান অনেকটাই উন্নত। কিন্তু শতাব্দীর হাত ধরে আমরা যদি পিছিয়ে যাই ধাপে ধাপে, তাহলে যে ছবিটা ফুটে ওঠে তা অত্যন্ত নিদারুন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নানাবিধ কঠোর অনুশাসন, নিষ্ঠুর প্রথায় জর্জরিত ছিল তাদের জীবন। শিক্ষা, স্বাধীনতা প্রভৃতি অধিকার-বঞ্চিত এক অপমানকর দুর্বিষহ জীবন কাটাতে হত তাদের। এককথায় চিত্রটা ছিল হতাশাব্যাঞ্জক। তবে কোনোকিছুই চিরস্থায়ী নয়। অন্ধকার যত গভীরই হোক না কেন, আলো জ্বললে সে হারিয়ে ফেলে তারা রূপ। আর যুগে যুগে বিভিন্ন মহামানব জন্ম নেন এই পৃথিবীতে যারা সমাজের বুকে অন্ধকার দূর করার জন্য আলোর মশাল হাতে নিজেদের নিংড়ে দেন হাজারও প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে। সময় বয়ে যায় তার স্বাভাবিক নিয়মে। পরিবর্তনের হাত ধরে নতুনের জন্ম হয়। বিস্মৃতির পাতায় হারিয়ে যায় অনেক কিছু। কিন্তু এইসব মহামানবের নাম ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকে সোনার অক্ষরে। ভারতবর্ষের এরকম অসংখ্য আলোকপুরুষের অন্যতম হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় যিনি আমাদের কাছে অধিক পরিচিত বিদ্যাসাগর নামে।
বহুমুখী কর্মধারার মানুষ বিদ্যাসাগরের জীবনের ব্রতই ছিল সমাজের বুকে আলো জ্বালানোর। নিজের জীবন তিনি উজাড় করে দিয়েছিলেন সেই ব্রত সম্পাদনে। সারাজীবন ধরে তিনি অসংখ্য কাজ করেছেন। তাঁর সেই অসংখ্য কাজের মধ্যে অন্যতম ছিল নারী কল্যাণ। এককথায় বলা যায়, তাদের জীবনকে অন্ধকার থেকে আলোয় আনার জন্য তিনি প্রাণপাত করেছিলেন। বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, বিধবা বিবাহ, নারী শিক্ষা প্রসার প্রভৃতি বিষয়ে তার লড়াই ও অবদান অবিস্মরণীয়। গুরুত্বের বিচারে এদের কোনোটাই কারও থেকে কম নয়। তবুও যদি বেছে নিতে হয়, তাহলে সর্বাগ্রে থাকবে বিধবা বিবাহ, যেটাকে বিদ্যাসাগর নিজেই বলেছেন তাঁর জীবনের অন্যতম সৎকর্ম হিসেবে। এই কর্ম সম্পাদনে তিনি প্রাণ বিসর্জন দিতে ভীত ছিলেন না। বিধবা বিবাহ নিয়ে তাঁর জীবনের লড়াই আলোচনা করলে আমরা সহজেই বুঝতে পারব কেবল কথার কথা নয়, সত্যি সত্যি তিনি বড়ো ঝুঁকি নিয়ে জীবনের এক ভয়ংকর লড়াই লড়েছেন। আপন জেদ, দৃঢ় সংকল্প, সৎ প্রচেষ্টা, আন্তরিক অনুভব আর হৃদয়ের সহমর্মিতায় হাজারো প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এই লড়াইতে জয়ী হয়েছেন। বিধবাদের নিদারুণ অবমাননাকর ও যন্ত্রণার অন্ধকারময় জীবনে আলো জ্বালিয়ে অজান্তেই হয়ে উঠেছিলেন এক মানব ‘ঈশ্বর’।
বিধবা বিবাহ নিয়ে বিদ্যাসাগরের লড়াইয়ের কথা বলার আগে তৎকালীন ভারতবর্ষের বিধবাদের জীবন কেমন ছিল সে বিষয়ে আলোকপাত করা প্রয়োজন। প্রথমত কোনো মেয়ের স্বামী মারা গেলে তার পুনরায় বিয়ে করার অধিকার ছিল না। উচ্চবর্ণ ও ব্রাহ্মণ সমাজে বাল্যবিবাহ প্রথা চালু ছিল। অনেকক্ষেত্রে বংশের কৌলিন্য রক্ষা করতে গিয়ে সাত-আট বছর বয়সি মেয়েকে বাবারবয়সি এমনকি দাদুরবয়সি লোকেদের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হত। এর কারণে সমাজে বাল্য বিধবার সংখ্যাও ছিল অনেক। কোনো মেয়ের স্বামী মারা গেলে তার জীবনে নেমে আসত দুঃসহ যন্ত্রণা। একসময় সমাজে সহমরণ প্রথা চালু ছিল। স্বামী মারা গেলে স্বামীর চিতায় প্রাণ দিত স্ত্রী। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো স্বেচ্ছায় এমনটা ঘটত কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে এমন নৃশংশ মৃত্যুবরণ করতে হত বাধ্য করা হত তাদের। সহমরণে মারা না গেলেও জীবনটা সুখকর ছিল না। কঠোর অনুশাসনের মধ্যে জীবন কাটাতে হত তাদের। স্বামীর সংসারে তাদের স্থান হত না তাদের। বাপের বাড়িতেও জীনবটা ছিল অনেক অপমানকর ও যন্ত্রণাময়। কিন্তু আমরা যদি ফিরে যাই সুদূর অতীতে, তখন কিন্তু ছবিটা মোটেও এমন ছিল না।
পূর্বেই বলেছি, ভারতবর্ষে কোনো সময়েই নারীদের স্থান খুব উচ্চ মর্যাদার ছিল এমনটা নয়। তবুও, আদি বৈদিক যুগে নারীদের তুলনামূলকভাবে অনেক স্বাধীনতা ছিল। বিয়ের ক্ষেত্রে নিজেদের জীবনসঙ্গী বাছার অধিকার ছিল তাদের। বৈদিক যুগে নারীদের শিক্ষার অধিকার ছিল। যদিও তা সীমাবদ্ধ ছিল। কম বয়সে সেসময় মেয়েদের বিয়ে হত না। ঋগ্বেদে বিধবা বিবাহের উল্লেখ পাওয়া যায়। এপ্রসঙ্গে বলার আমাদের মহাকাব্য মহাভারতেও বিধবা বিবাহের দৃষ্টান্ত দেখতে পাই। তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন বিয়ে করেছিলেন নাগবধূ বিধবা উলুপীকে। যাই হোক, বেদ পরবর্তী যুগে নারীদের সামাজিক অবস্থানের ক্রমশ অবনতি ঘটতে থাকে। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দ পর্যন্ত মেয়েদের সামাজিক অবস্থানের অনেক অবনতি হলেও তখনও সমাজে বিধবা বিবাহের প্রথা ছিল। কোনো বিধবা পুনরায় বিয়ে নাও যদি করে, সমাজে মোটামুটি মাথা তুলে বাঁচতে পারত। কিন্তু এরপর অবস্থার ক্রমশ অবনতি হতে থাকে। নানাবিধ অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, বহুবিধ প্রথা ও কুংস্কারের জালে জড়িয়ে ক্রমশ চার দেওয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয় তাদের জীবন। বাল্যবিবাহ, সতীদাহ প্রথা, বিধবা বিবাহের নিষেধাজ্ঞা তাদের জীবনে অভিশাপ হয়ে নেমে আসে। শিক্ষার অধিকার হারায় মেয়েরা। এমন বিশ্বাস মানুষের মনে গেঁথে দেওয়া হয়েছিল যে মেয়েরা পড়াশোনা করলে সমাজ ও সংসারে অকল্যাণ নেমে আসবে। অকাল বৈধব্য ঘটবে তাদের। এই ভ্রান্ত ধারনা সমাজের এতটাই গভীরে ছড়িয়ে পড়েছিল যে মহিলারাও তা গভীরভাবে বিশ্বাস করত। তাদের বিয়ের বয়স নেমে আসে সাত-আটে। অনেকক্ষেত্রে চার-পাঁচ বছরের মেয়েরও বিয়ে দেওয়া হত। বিয়ে কিংবা সংসার জিনিসটা কী তা বোঝার অনেক আগেই অনেক মেয়ে বিধবা হয়ে যেত।
বৈধব্য ছিল নারী জীবনের চরম অভিশাপ। স্বামী হারানোর কষ্ট, যন্ত্রণার চেয়ে ভয়াবহ ছিল তাদের অবমানকর সামাজিক অবস্থান। আগেই বলেছি কোনো মেয়ের স্বামী মারা গেলে তার জন্য দায়ী করা হত তার স্ত্রীকে। বলা হত তার পাপেই স্বামীর মৃত্যু হয়েছে। সারাজীবন তাকে এই অপবাদ মাথায় নিয়ে বাঁচতে হত। তাদেরকে অপয়া বলে মনে করা হত। সমাজ কিংবা সংসারের কোনো মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে তাদের অংশগ্রহণ করার অধিকার ছিল না। সারাজবীন ধরে তাদের নানান ব্রত, উপবাস প্রভৃতি পালন করতে হত। মাছ, মাংস, ডিম প্রভৃতি খাওয়ার অধিকার ছিল না তাদের। পরতে হত সাদা থান। শরীরে কোনো অলংকার রাখার অধিকার ছিল না। অনেকক্ষেত্রে তাদের মাথার চুল ছোটো করে কেটে দেওয়া হত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবার তাদের মাথা মুড়িয়ে ন্যাড়া করে দেওয়া হত। প্রসঙ্গত বলার, সাবিত্রীবাই ফুলে, যিনি ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত নারী, যাঁকে বলা হয় ভারতবর্ষের প্রথম মহিলা শিক্ষক, তাঁকেও তাঁর স্বামী মারা যাওয়ার পর মাথা মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। ব্যাপারটা তাঁর কাছে চরম অপমানকর মনে হলেও সমাজের প্রচলিত প্রথার কাছে তাঁকে মাথা নত করতে হয়েছিল। অথচ এই সাবিত্রীবাই ফুলে নিজেই ছিলেন নারীজাতির নবজাগরণের এক উজ্জ্বল অগ্রদূত। তিনি বলেছিলেন, “হাম ভারত কি নারী হ্যায়, ফুল নাহি চিঙ্গারী হ্যায়।” তাঁর স্বামী জ্যোতিবা ফুলে ছিলেন একজন বিখ্যাত সমাজ সংস্কারক। তিনি আর তাঁর স্বামী মিলে নারী শিক্ষা প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। বিধবাদের জীবনের যন্ত্রণা দূর করতেও তাঁরা অনেক ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর মতো মহিলার জীবনে যদি এমন পরিণতি হয়, তাহলে সাধারণ মহিলাদের অবস্থা সহজে অনুমান করা যায়। যাই হোক, এসব করার উদ্দেশ্য ছিল মেয়েটিকে যেন সুন্দর আর আকর্ষণীয় না দেখায়। খাওয়ারের বিধিনিষেধ, উপবাস, ব্রত প্রভৃতির মাধ্যমে তার জীবনের জৈবিক চাহিদাকে দমিয়ে রাখার উদ্দেশ্য ছিল।
এটি গেল বিধবাদের জীবনের একটি দিক। এবার আলো ফেলা যাক অন্যদিকে। একটি মেয়ে বিধবা হয়ে গেলে তার শরীরের সমস্ত চাহিদা মরে যাবে এমন ভাবাটা বোকামি। শরীরের চাহিদা একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। তা সে যতই ব্রত উপবাস করুক না কেন। এর ফলে অনেক বিধবা অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ত। অনেকক্ষেত্র তাদের অসহায়ত্ব আর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বিকৃতকাম পুরুষ তাদের ভোগ করত। এর অবশম্ভ্যাবী পরিণতি হিসেবে বিধবাটি গর্ভবতী হয়ে পড়ত। ফলে গর্ভপাতের মতো ব্যাপার সমাজে হামেশাই ঘটত। কিন্তু সবক্ষেত্রে গর্ভপাত সম্ভব হয়ে উঠত না। তখন সামাজিক লজ্জার হাত থেকে বাঁচতে অনেক বিধবা সন্তানের জন্ম দিয়ে তাকে হত্যা করে ফেলত। ফলে সমাজে ভ্রূণহত্যা, শিশুহত্যার মতো ঘটনা বাড়তে থাকে। এখান থেকে পরিস্কার বৈধব্য সমাজ এবং সংসার জীবনেও মারাত্মক খারাপ প্রভাব ফেলেছিল। অনেকক্ষেত্রে অপমানকর জীবনের থেকে বাঁচতে মেয়েরা আত্মহত্যা করত। আবার অনেকে বেশ্যালয়ে আশ্রয় নিত। শুনতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি পতিতালয়ের মেয়েদের থেকেও খারাপ অবস্থা ছিল বিধবাদের। একটি পরিসংখ্যান বলছে ঊনবিংশ শতাব্দীতে পতিতালয়ের আশি থেকে নব্বই শতাংশ পতিতাই ছিল বিধবা।
বৈধব্যের এই নিদারুণ পরিণামের কথা অনেক সমাজ সচেতন মানুষ অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। এই অবস্থা থেকে সমাজ এবং নারী উভয়ের জীবনকে সুরক্ষিত ও সুন্দর করতে গেলে বিধবা বিবাহের প্রয়োজনীয়তা অনেকেই বুঝতে পারেন। তাই বিধবা বিবাহ নিয়ে শুরু হয় নানাবিধ প্রচেষ্টা। এই কাজে যিনি বিশাল ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। মূলত তাঁরই ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, হার-না-মানা লড়াই ও উদ্যোগে বিধবা-বিবাহ আইন পাশ হয়। তবে একথা মাথায় রাখতে হবে শুধুমাত্র বিদ্যাসাগর নন, তাঁরও অনেক আগে থেকেই বহু মানুষ, ব্যাক্তিগত কিংবা সাংগঠনিক স্তরে বিধবা বিবাহ প্রচলনের উদ্যোগী হয়েছিলেন। বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ আন্দোলন নিয়ে সে বিষয়ে একটু আলোকপাত করা দরকার।
বিদ্যাসাগরের একশো-দেড়শো বছর আগে থেকে বিধবাদের পুনরায় বিয়ে দেওয়ার ব্যাপার নিয়ে লেখালিখি শুরু হয়। তবে গোঁড়া হিন্দুদের প্রতিবাদে এই প্রচেষ্টা বেশিদূর এগোতে পারেনি। বিদ্যাসাগরের বহু পূর্বে ঢাকার রাজা রাজবল্লভ, কোটার রাজা বিধবা বিবাহ প্রচলনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন কিন্তু সফল হননি। বিদ্যাসাগরের ঊনিশ-কুড়ি বছর পূর্বে মহারাষ্ট্রের এক ব্রাহ্মণ বিধবা বিবাহ প্রচলনের দাবিতে আন্দোলন করেছিলেন। কলকাতা শহরের প্রসিদ্ধ ধনী ব্যক্তি মতিলাল শীলও এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বিদ্যাসাগরের আন্দোলন শুরু প্রায় দু-বছর আগে কলকাতার এক ধনী ব্যাক্তি শ্যামচরণ দাস নিজের বিধবা মেয়ের বিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েও ব্যার্থ হন। এসকল প্রচেষ্টা ব্যার্থ হয়েছছিল এটা ঠিক, তবে এসব দৃষ্টান্ত থেকে পরিস্কার এই সমস্যা নিয়ে প্রগতিশীল কিছু মানুষ যেমন সচেতন ছিলেন তেমনি বিধবা বিবাহের যে প্রয়োজনীয়তা আছে তা তারা বুঝেছিলেন। বিধবাদের জীবনে যে যন্ত্রণা তা যে সমর্থনযোগ্য নয় সেটা তারা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। বিখ্যাত আত্মীয়সভার সদস্যরাও বিধবাদের সমস্যা নিয়ে সচেতন ছিলেন। আত্মীয়সভার একটি বৈঠকের বিবরণ এমন ছিল – “At the meeting in question … the necessity of an infant widow passing her life in a state of celibacy, the practice of polygamy and suffering widows to burn with the corps of their husbands were condemned.” এখানে স্পষ্ট, সতীদাহ প্রথা, বহুবিবাহ এবং বিধবাদের পুনরায় বিয়ে না করতে দেওয়ার বিধানকে ধিক্কার জানানো হয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর তিনের দশকে ইন্ডিয়ান ল কমিশন বাল্য বিধবাদের পুনরায় বিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে আইন প্রনয়নের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু বহুবিধ প্রতিবন্ধকতা বিশেষ করে ধর্মীয় প্রথার ওপর আঘাত হানার মতো সংবেদনশীল ব্যাপারগুলো আইন প্রনয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এসব ছাড়াও আরও বেশকিছু দৃষ্টান্ত রয়েছে বিধবা বিবাহ প্রচলনের ব্যাপারে। কিন্তু সেসব প্রচেষ্টা সফল হয়নি। কিন্তু এটা ঠিক ব্যাপারটা নিয়ে একটা আন্দোলনের ঢেউ ছিল যদিও তার তীব্রতা বেশি ছিল না। এই জায়গায় বিদ্যাসাগরের কৃতিত্ব। তিনি বলতে গেলে, একক লড়াইয়ে কৃচ্ছ্রসাধন করেছিলেন। তাঁর লড়াইটা সহজ ছিল না। কিন্তু তিনি হার-না-মানা মানসিকতায়, কর্তব্যে অবিচল থেকে লক্ষ্যের পথে এগিয়ে গেছেন এবং শেষমেষ সফল হয়েছেন।
বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ নিয়ে কেন আন্দোলন শুরু করেছিলেন? বিদ্যাসাগর ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারক। সমাজের হিতসাধন করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। সমাজের অগ্রগতির পথে যে সব সামাজিক ব্যাধিগুলো অন্তরায় তাদের মধ্যে বিধবাদের বিধবাদের অবমাননাকর যন্ত্রণার জীবন যে একটা সেটি বুঝতে তাঁর মতো মানুষের অসুবিধা হয়নি। তাই বিধবাদের পুনরায় বিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে তিনি লড়াই করেছিলেন। তবে এ-প্রসঙ্গে তাঁর ব্যক্তিজীবনের কিছু ঘটনা লড়াইয়ের পথে অনুঘটকের মতো কাজ করেছিল। ছোটোবেলায় রাইমণি নামে পাশের বাড়ির একটি ছোট্ট মেয়ে বিদ্যাসাগরের খেলার সাথী ছিল। দুজনের মধ্যে খুব ভাব ছিল। এক সময় বিদ্যাসাগর কলকাতায় পড়তে আসেন। প্রথমবার যখন তিনি বাড়ি ফেরেন দেখেন সেই রাইমণির শুধু বিয়েই হয়নি, সে বিধবাও হয়ে গেছে। বিদ্যাসাগর রাইমণির সঙ্গে দেখা করার জন্য তার বাড়ি যান। সেখানে গিয়ে তার এক করুণ অভিজ্ঞতা হয়। সেদিন ছিল একাদশী ফলে মেয়েটির উপবাস। সারাদিন তাকে কিছু খেতে দেওয়া হয়নি। ওইটুকু মেয়ে উপবাসের কিছু বোঝে না। না খেতে পেয়ে তার বিধ্বস্ত অবস্থা বিদ্যাসাগরের মনকে নাড়িয়ে দেয়।
আরও একটি ঘটনার কথা বলা যায়। সংস্কৃত কলেজে পড়ার সময় একবার বাড়ি ফিরে একটি হৃদয় বিদারক ঘটনার কথা জানতে পারেন। এক বিধবার সঙ্গে একটি যুবকের অবৈধ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ফলে বিধবাটি গর্ভবতী হয়ে পড়ে। গর্ভপাত ব্যার্থ হয় এবং বিধবাটি একটি সন্তানের জন্ম দেয়। কিন্তু লোকলজ্জার হাত থেকে বাঁচতে বিধবাটি তার সন্তানকে মেরে ফেলে। ব্যাপারটি বিদ্যাসাগরের মনকে নাড়া দেয়।
পরবর্তী সময়ে তার কর্মজীবনের একটি ঘটনা—কলকাতার সংস্কৃত কলেজের বয়স্ক বেদান্ত পণ্ডিত মৃত্যুর কয়েকমাস আগে একটি বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করেন। ব্যাপারটি বিদ্যাসাগরের মনকে আঘাত করে। বাচ্চা মেয়েটির জীবনের দীর্ঘ বৈধব্য যন্ত্রণার কথা ভেবে তিনি খুব আঘাত পান। এরকমই অসংখ্য টুকরো টুকরো অভিজ্ঞতা বিদ্যাসাগরের মনে রেখাপাত করেছিল এবং ভেতরে ভেতরে তাঁকে দৃঢ় সংকল্পিত করে তুলেছিল সমাজের বুক থেকে এই নিষ্ঠুর ব্যাধিটাকে দূর করতে এবং পাশাপাশি হতভাগ্য বিধবা নারীদের অবর্ণনীয় যন্ত্রণার জীবন থেকে মুক্তি দিতে। কাজটা যে সহজ নয় তা বিদ্যাসাগর ভালোভাবে জানতেন। সমাজের দীর্ঘ্যস্থায়ী কোনো প্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেলে অনেক বাধা আসবে এটা তিনি বুঝেছিলেন। সবচেয়ে বেশি বাধা আসবে সমাজের শাস্ত্রীয় পণ্ডিতদের পক্ষ থেকে এটা তাঁর কাছে পরিস্কার ছিল। তাঁর পূর্বে বিধবাদের পুনরায় বিয়ে দেওয়ার উদ্যোগগুলি ব্যার্থ হওয়ার কারণে ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার, শাস্ত্রীয় বিশ্বাস আর পণ্ডিত সমাজের বিরোধ প্রভৃতি ব্যাপারগুলো যে ছিল তা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। তাই তিনি স্থির করেন আঁটঘাঁট বেধে এই আন্দোলনে নামবেন। একটা জিনিস তিনি বুঝেছিলেন শাস্ত্র দিয়ে শাস্ত্রীয় বিশ্বাসকে খণ্ডন করতে হবে। কেননা পণ্ডিত সমাজের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেলে তাদের শাস্ত্রীয় ভুল বিশ্বাসকে ভাঙতে না পারলে তাঁর পক্ষে এই লড়াইয়ে জয়লাভ করা খুব কষ্টসাধ্য। একজন পণ্ডিত হিসেবে তিনি জানতেন ভারতের শাস্ত্র অনেক সমৃদ্ধ ও উন্নত। তাঁর স্থির বিশ্বাস ছিল ভারতীয় শাস্ত্রে বিধবাদের বিবাহের নিশ্চিত কোনো না কোনো বিধান থাকবে। এই বিশ্বাস নিয়ে দিনরাত এক করে তিনি একের পর এক শাস্ত্র পাঠ করতে শুরু করলেন। অবশেষে ‘পরাশর সংহিতা’-য় তিনি পেলেন তাঁর কাঙ্খিত বস্তু। বিধবাদের বিয়ে নিয়ে যেখানে বলা হয়েছে—
“নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ।
পঞ্চসাপৎসু নারীনাং পতিরেণ্য বিধীয়তে।।”
অর্থাৎ কোনো নারীর যদি স্বামী মারা যায়, নিরুদ্দেশ হয়ে যায়, সন্ন্যাস গ্রহন করে কিবং সন্তান উৎপাদনে অক্ষম হয় তাহলে সেই নারী দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে পারে। সুতরাং ‘পরাশর সংহিতা’য় স্পষ্ট করে বিধবা বিবাহের বিধান দেওয়া আছে। এই শ্লোক যেন বিদ্যাসাগরের হাতে ব্রহ্মাস্ত্র তুলে দিল কেননা পরাশর সংহিতাকে অমান্য করার সাধ্য কোনো পণ্ডিতের নেই। কেন নেই, সেটা পরাশর সংহিতার একেবার প্রথম অধ্যায়ে বলা আছে—
“কৃতে তু মানবা ধর্মাস্ত্রেতায়াং গৌতমাঃ স্মৃতাঃ।
দ্বাপরে শঙ্খলিখিতাঃ কলৌ পরাশরঃ স্মৃতাঃ।।”
এর অর্থ – “মনুনিরূপিত ধর্ম সত্যযুগের ধর্ম, গোতমনিরূপিত ধর্ম ত্রেতাযুগের ধর্ম, শঙ্খনিরূপিত ধর্ম দ্বাপরযুগের ধর্ম, পরাশরনিরূপিত ধর্ম কলিযুগের ধর্ম।” অর্থাৎ মনু যে ধর্ম নিরূপন করেছেন তা মেনে চলতে হবে সত্যযুগের মানুষকে। গৌতম যে ধর্ম নিরূপন করেছেন তা মানতে হবে ত্রেতাযুগের মানুষকে। দ্বাপরযুগের মানুষকে মানতে হবে শঙ্খ যে ধর্ম নিরূপন করেছেন। আর কলি যুগের মানুষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে পরাশর নিরূপিত ধর্ম পালনে। এই বিধান বিদ্যাসাগরকে তার লড়াইয়ের পথে অনেকটাই এগিয়ে দেয়।
পরাশর সংহিতায় বিধবা বিবাহের বিধান খুঁজে পাওয়ার পর বিদ্যাসাগর আন্দোলনে নামলেন। তাঁর সেই আন্দোলনের কথা বলার আগে আরও কয়েকটি তথ্য তুলে ধরা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। শুধুমাত্র পরাশর সংহিতা নয়, বেদ-এ ও বিধবাদের বিবাহের বিধান রয়েছে। ঋগ্বেদে বিধান আছে স্বামীর মৃত্যুর পর অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছল কিংবা সামাজিক সমস্যার মুখোমুখি বিধবারা পুনরায় বিয়ে করতে পারে। এমনকি স্বামী যদি স্ত্রীর মৌলিক চাহিদা পূরণ না করতে পারেন কিংবা সন্তান উৎপাদনে অক্ষম হন, তাহলেও পুনরায় বিবাহের বিধান রয়েছে। অথর্ব বেদ-এ বলা হয়েছে—
“ইয়ং নারী পতিলোকং বৃণানা নিপদ্যত উপত্বা মর্ত্য প্রেতম।
বিশ্বং পুরাণ মনু পালয়ন্তী তস্যৈ প্রজাং দ্রবিণং চেহ ধেহি।।”
আর্থাৎ স্বামীর মৃত্যুর পর কোনো নারী পুনরায় বিয়ে করে সনাতন ধর্ম পালন করতে চায় এবং সন্তানাদি ও সুখভোগ করতে চায় তাহলে পুরুষের কর্তব্য তার সেই আকাঙক্ষা পূরণ করা। মহাভারতে অর্জুন-উলুপী পর্বেও আমরা এমন দৃষ্টান্ত দেখতে পাই। দ্বাদশ বছরের ব্রহ্মচর্য পালনের শাস্তি নিয়ে বনবাসে গিয়েছেন অর্জুন। সুন্দরী নাগবধূ বিধবা উলুপী অর্জুনকে স্বামীরূপে পেতে এবং তার সন্তানের জননী হতে আকুল। নিজের মনোবাসনার কথা অর্জুনকে জানান তিনি। তার আহ্বানে সাড়া দিতে গিয়ে অর্জুন যখন দ্বিধাগ্রস্ত, তখন উলুপী তাকে বলেছিলেন তিনি অর্জুনের শরণাগত। আর শরণাগতকে রক্ষা করা একজন ক্ষত্রিয়ের ধর্ম। এরপর দেখা যায় অর্জুন উলুপীর মনোবাসনা পূরণ করে তাকে ভার্যা হিসেবে গ্রহন করেন। যাই হোক, এই অথর্ব বেদ-এর আর একটি শ্লোক এমন—
“উদীষর্ব নার্ষ্যভি জীবলোকংগতাসুমেতমুপশেষ এহি।
হস্তাগ্রাভস্য দিধিষোস্তবেদং পত্যুর্জনিত্বমভি সংবভূব।।”
এখানে আরও স্পষ্ট করে বলা হয়েছে স্বামী মারা যাওয়ার পর নারীকে পতির শোক করে জীবন অপচয় না করে পুনরায় বিয়ে করে নতুন করে জীবন শুরু করতে।
এসব দৃষ্টান্ত থেকে পরিস্কার আমাদের শাস্ত্র, পুরাণ প্রভৃতিতে বিধবাদের বিবাহে কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি উল্টে তাদের বিয়ে করার কথা বলেছে, পুনরায় সংসার ধর্ম পালনের কথা বলা হয়েছে।
যাই হোক, পরাশর সংহিতায় বিধবা বিবাহের সমর্থন পাওয়ার পর বিদ্যাসাগর মনে বল পেলেন। তিনি এবার ঝাঁপিয়ে পড়লেন এই নিয়ে আন্দোলনে। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জানুয়ারি ‘বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না’ নামে ২২ পাতার একটি পুস্তিকা প্রকাশ করলেন তিনি। শাস্ত্রীয় বিধানের পাশাপাশি বিধবা বিবাহ কেন দেওয়া উচিত তা নিয়ে তিনি নানান যুক্তি ও ব্যাখ্যা দিলেন এই পুস্তিকায়। প্রথমে বিদ্যাসাগর নিজেও কিছুটা সন্দিহান ছিলেন মানুষ ভালোভাবে এই ব্যাপারটা নেবে কি না, এর প্রতি আগ্রহ দেখাবে কি না। কিন্তু পুস্তিকা প্রকাশের এক সপ্তাহেই প্রথম মুদ্রণের দুই হাজার কপি শেষ হয়ে যায় এবং বিদাসাগর পুনরায় তিনহাজার কপি ছাপান। সে কপিগুলিও খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। প্রসঙ্গত বলার, এই পুস্তিকা প্রকাশ ও আন্দোলনে নামার আগে তিনি তাঁর বাবা-মায়ের অনুমতি নিয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর বাবা-মাকে ঈশ্বর জ্ঞানে ভক্তি করতেন। পুস্তিকা লেখার পর তিনি প্রথমে বাবার সম্মতি প্রার্থনা করেন। পিতা প্রথমটা একটু দ্বিধাগ্রস্ত হন কেননা ব্যাপারটা কতখানি সংবদেনশীল তা তিনি জানেন। একজন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত হিসেবে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এই নিয়ে আন্দোলন শুরু করলে সমাজে আলোড়ন পড়ে যাবে। ছেলের জীবনে ভয়ংকর বিপদ এসে হাজির হবে। কিন্তু নিজের ছেলেকে তিনি ভালো করে চেনেন। কোনো কাজ যদি সে করবে মনে করে তাহলে করবেই। তিনি জানতে চান, তিনি যদি অনুমতি না দেন তাহলে বিদ্যাসাগর কী করবেন? উত্তরে বিদ্যাসাগর তাঁকে জানান, এই আন্দোলন থেকে তিনি সরে আসবেন না। তবে তিনি যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন তিনি এই নিয়ে কোনোরূপ আন্দোলন করবেন না। ছেলের এমন জেদ আর দৃঢ় সংকল্প তিনি তাঁকে অনুমতি দেন। আর মা ভগবতীদেবীর সন্তানের প্রতি ছিল গভীর আস্থা ও বিশ্বাস। তিনি বিশ্বাস করতেন তাঁর ঈশ্বর কোনোরূপ খারাপ কাজ করতে পারে না। এই প্রসঙ্গে একটি কথা বলার। তখন বিধবা বিবাহ আইন পাশ হয়ে গেছে এবং অনেক বিধবার বিয়েও হয়েছে। এরকম দেখা গেছে বিদ্যাসাগর যে বিধবাদের বিবাহ দিতেন তাদের অনেকের সঙ্গে আহার করতেন ভগবতীদেবী। এই নিয়ে তাঁর নাতি নারায়ণচন্দ্র জাত যাওয়ার প্রসঙ্গ তুললে তিনি তাকে বলেছিলেন—“দোষ কি? ঈশ্বর বহুশাস্ত্রজ্ঞ; ঈশ্বর কি অন্যায় কাজ করিতে পারে?” সত্যি বিদ্যাসাগরের প্রতি মায়ের ছিল গভীর বিশ্বাস। তাই তিনি সরাসরি তাঁকে অনুমতি দেন।
এই প্রসঙ্গে একটা প্রশ্ন আমাদের মনে এসে যায়, যদি না শাস্ত্রে তিনি বিধবাদের বিবাহের বিধান পেতেন তাহলে কি বিদ্যাসাগর এই লড়াই লড়তেন না? এর জবাব, অবশ্যই তিনি লড়াই করতেন। শাস্ত্রীয় সমর্থন পণ্ডিত সমাজের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাঁর হাতে একটি বড়ো অস্ত্র তুলে দিয়েছিল ঠিকই, তবে বিদ্যাসাগর এই লড়াইয়ে নেমেছিলেন অন্তরের ডাকে। তাঁর পুস্তিকায় শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা রয়েছে কিন্তু তার থেকেও বেশি রয়েছে তার মানবিক প্রেম, সহমর্মিতা ও উদারতা। এই মানবপ্রেম আর উদারতার কারণে সমাজের এক দীর্ঘ্যস্থায়ী ব্যাধির মূলে কুঠারাঘাত করেছেন তিনি। তাঁর হৃদয়ের সেই সহমর্মিতার কথা বোঝা যায় তাঁর এই পুস্তিকা পাঠ করলে। পাশাপাশি বিধবাদের পুনরায় বিবাহের অনুমতি না থাকায় সমাজের ব্যাভিচার, পাপ-পঙ্কিলতা প্রভৃতি যে বাড়ছে তা তিনি উল্লেখ করেছেন এই পুস্তিকায়। এক জায়গায় তিনি লিখেছেন—
“দুর্ভাগ্যক্রমে, বাল্যকালে যারা বিধবা হইয়া থাকে, তাহারা সারাজবীন যে অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করে, তাহা যাঁহাদের কন্যা, ভগিনী, পুত্রবধূ অল্পবয়সে বিধবা হইয়াছেন, তাঁহারা বিলক্ষণ অনুভব করিতেছেন। কতশত বিধবারা, ব্রহ্মচর্য নির্ব্বাহে অক্ষম হইয়া, ব্যাভিচারদোষে দৃষিত ও ভ্রূণহত্যাপাপে লিপ্ত হইতেছে; এবং পতিকূল, পিতৃকূল ও মাতৃকূল কলঙ্কিত করিতেছে। বিধবাবিবাহের প্রথা প্রচলিত হইলে, অসহ্য বৈধব্যযন্ত্রণা, ব্যাভিচারদোষ ও ভ্রূণহত্যাপাপের নিবারণ ও তিন কূলের কলঙ্ক নিবারণ হইতে পারে। যাবৎ এই শুভকারী প্রথা প্রচলিত না হইবেক, তাবৎ ব্যাভিচার দোষের ও ভ্রূণহত্যাপাপের স্রোত, কলঙ্কের প্রবাহ ও বৈধব্য যন্ত্রণার অনল উত্তরোত্তর প্রবল হইতে থাকিবেক।
পরিশেষে, সর্বসাধারণের নিকট বিনয়বাক্যে আমার প্রার্থনা এই, আপনারা এই সমস্ত অনুধাবন করিয়া, এবং বিধবাবিবাহের শাস্ত্রীয়তা বিষয়ে যাহা লিখিত হইল, তাহার আদ্যোপান্ত বিশিষ্টরূপ আলোচনা করিয়া, দেখুন বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না।”
শাস্ত্র নয়, নারী হৃদয়ের কষ্ট যন্ত্রণাবোধ এবং তা দূরীকরণটাই তাঁর কাছে মুখ্য ছিল। পাশাপাশি একটি সুস্থ, সুন্দর সমাজ গঠনের ব্যাপারেও তিনি অতিমাত্রায় সচেতন ছিলেন।
বিধবা বিবাহ নিয়ে প্রকাশিত বিদ্যাসাগরের এই পুস্তিকা সমাজে আলোড়ন তোলে। মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে এর প্রথম সংস্করণ ফুরিয়ে যায়। পুস্তিকা প্রকাশের পর কেউ কেউ বিদ্যাসাগরের মতামতকে সমর্থন করেন, কেউ মানতে না পেরে বিরূপ মন্তব্য করেন। আর গোঁড়া হিন্দু ব্রাহ্মণ, পণ্ডিতরা বিদ্যাসাগরের পুস্তিকা পড়ে ক্ষেপে যান। নানাভাবে তারা বিদ্যাসাগরের বক্তব্যের বিরোধিতা করতে লাগলেন। যেসকল পণ্ডিতরা বিদ্যাসাগরের বিরোধিতা করেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ব্রজনাথ বিদ্যারত্ন, কালীনাথ তর্কালঙ্কার, রামতণু তর্কসিদ্ধান্ত, গঙ্গাধর কবিরাজ, মহেশচন্দ্র চূড়ামণি, দীনবন্ধু ন্যায়রত্ন, ঈষাণচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ প্রমুখ। বিদ্যাসাগরের পুস্তিকার প্রতিবাদেও বেশকিছু পুস্তিকা প্রকাশ করেন পণ্ডিতেরা। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হল—‘বিধবা বিবাহের নিষেধক বিচারঃ’, ‘বিধবা-বিবাহ-নিষেধক প্রমাণাবলী। দ্বিতীয়াঃ’, ‘শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কল্পিত বিধবা বিবাহ ব্যবস্থার বিধিবোদ্ধাহবারকঃ’, ‘বিধবা বিবাহ প্রতিবাদ’, ‘বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাবের উত্তর’, ‘বিধবা বিবাহ হওয়া উচিত নহে’, ‘বিচিত্র স্বপ্নবিবরণম্’, ‘বিধবা বিবাহ নিষেধ বিষয়িনী ব্যবস্থা’ প্রভৃতি। পরাশর সংহিতার যে শ্লোককে হাতিয়ার করে বিদ্যাসাগর পণ্ডিত সমাজের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামেন, বেশ কিছু পণ্ডিত জানান বিদ্যাসাগর ওই শ্লোকের ভুল ব্যাখ্যা করেছেন। শ্রীযুক্ত পঞ্চানন তর্করত্ন ওই শ্লোকের ব্যাখ্যা করেন এইভাবে—
“যে পাত্রের সহিত বিবাহের কথাবার্তা স্থির হইয়া আছে, তাহার সহিত কন্যার বিবাহ দিতে হইবে; তবে ওই ভাবী পতি যদি নিরুদ্দেশ হয়, মরিয়া যায়, প্রব্রজ্যা অবলম্বন করে, ক্লীব বলিয়া স্থির হয় বা পতিত হয়, তবে এই পঞ্চপ্রকার আপদে, ঐ কন্যার পাত্রান্তরে প্রদান করা বিহিত।” এখানে পরিস্কার ভাবে বিধবা রমনী কথাটি বাদ দেওয়া হয়েছে। এমনি করে আরও নানাভাবে বিদ্যাসাগরের যুক্তিকে খণ্ডন করেছেন বিরুদ্ধ পণ্ডিতেরা।
পণ্ডিত সমাজের বিরুদ্ধে লড়াই করা আর নিজের উদ্দেশ্য যাতে সফল হয় সে কারণে বিদ্যাসাগর রাজা রাধাকান্তদেবের শরণাপন্ন হলেন। শোভাবাজার রাজবাড়ির রাধাকান্তদেবের হিন্দু সমাজে ভালো প্রভাব ছিল। পাশাপাশি সরকারী মহলেও তার বেশ মর্যাদা ছিল। বিদ্যাসাগর ভাবলেন কোনোভাবে রাধাকান্তদেবকে যদি তার বক্তব্য বুঝিয়ে তাঁর সমর্থন পাওয়া যায় তাহলে তাঁর কাজ আনেকটাই সহজ হবে। রাজা রাধাকান্তদেবের নাতি আনন্দকৃষ্ণ বাবু ছিলেন বিদ্যাসাগরের বন্ধু। তার সঙ্গে পরামর্শ করে বিদ্যাসাগর রাধাকান্ত দেবকে তার পুস্তিকাটি পাঠান। রাধাকান্তদেব পুস্তিকা পড়ে আকর্ষিত হন এবং তিনি বিদ্যাসাগরকে ডেকে পাঠান। সরাসরি বিদ্যাসাগরকে সমর্থন না করে তিনি একটি বিতর্কসভার ব্যাবস্থা করে দেন যেখানে বিদগ্ধ পণ্ডিতদের আমন্ত্রণ জানান। এখানে বিদ্যাসাগর পণ্ডিতদের বক্তব্যের বিরুদ্ধে যুক্তিপূর্ণ ও জোরালো ব্যাখ্যা দেন। বিদ্যাসাগরের যুক্তি-তর্কে মুগ্ধ হলেও তিনি বিদ্যাসাগরকে সমর্থন করেন না। বিরোধী পণ্ডিত সমাজকে তিনি জানিয়ে দেন ব্যাক্তিগতভাবে তিনি বিধবা বিবাহ সমর্থন করেন না। এরপর তিনি আরও একটি আলোচনাসভার আয়োজন করেন এবং এই সভায়ও বিদ্যাসাগর তার বক্তব্যের স্বপক্ষে জোরালো যুক্তি খাড়া করেন। তাসত্ত্বেও রাধাকান্তদেব তার নিজের বিশ্বাস থেকে সরে আসেননি। পণ্ডিত সমাজের প্রতিবাদের পাশাপাশি তাঁকে উদ্দেশ্য করে নানান ব্যাঙ্গ, বিদ্রূপও শুরু হয়। সেই সময়ের একটি প্রতিষ্ঠিত কাগজ ‘সমাচার সুধাবর্ষণ’ তাঁর বই পড়ে লেখে—
“সাজগো বিধবাগণ ফুটিয়াছে ফুল
তোমাদের সৌভাগ্যে ঈশ্বর সানুকূল।।”
মানুষের এই উপহাস ব্যাঙ্গ নিয়ে তিনি দ্বিতীয় পুস্তকে লিখেছেন—“অধিক আক্ষেপের বিষয় এই যে, উত্তরদাতা মহাশয়দিগের মধ্যে অনেকেই উপহাস-রসিক ও কটূক্তিপ্রিয়। এদেশে উপহাস ও কটূক্তি যে ধর্মশাস্ত্রবিচারের এক প্রধান অঙ্গ, ইহার পূর্বে আমি অবগত ছিলাম না।”
যাই হোক, বিদ্যাসাগর ছিলেন অত্যন্ত দৃঢ়চেতা মানুষ। পণ্ডিতদের প্রতিবাদ, বহু মানুষের ব্যাঙ্গ-বিদ্রূপ, রাজা রাধাকান্তদেবের অসহযোগিতা কোনোকিছুই তাঁকে তাঁর কর্তব্য থেকে টলাতে পারেনি। পণ্ডিতদের যুক্তি-তর্ক খণ্ডন করে এবার তিনি আরও একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন—‘বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব।’ এই পুস্তিকা পাঠ করলে বোঝা যায় পণ্ডিতদের যুক্তি খণ্ডন করার জন্য তিনি কী অক্লান্ত পরিশ্রম করিছিলেন। বহু শাস্ত্র, পুরাণ প্রভৃতি পাঠ করে যুক্তি তর্ক দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন বিধবা বিবাহ নিয়ে প্রতিবাদী পণ্ডিতদের যুক্তি কতখানি ভুল। তবে সকল প্রতিবাদী পণ্ডিতদের যুক্তি খণ্ডনের কাজ তিনি করেননি। তাঁর কথায়—“প্রতিবাদী মহাশয়েরা স্ব স্ব উত্তরপুস্তকে বিস্তর কথা লিখিয়াছেন; কিন্তু সকল কথাই প্রকৃত বিষয়ের উপযোগিনী নহে। যে সকল কথা প্রকৃত বিষয়ের উপযোগিনী বোধ হইয়াছে, সেই সকল কথার যথাশক্তি প্রত্যুত্তর প্রদানে প্রবৃত্ত হইলাম।” এই পুস্তিকায় তাঁর চরিত্রের দৃঢ়তা, নিষ্ঠা ও লক্ষ্যে অবিচল থাকার দৃষ্টান্ত প্রবলভাবে প্রতীয়মান হয়। বিধবাদের বিবাহ না হওয়ার কারণে সমাজে যে সব কলঙ্কমূলক কাজ হচ্ছে, তা দেখে চুপচাপ সহ্য করে যাওয়ায় মানুষকে কিছুটা যেন তিরস্কার করেছেন। তিনি বলেছেন—
“তোমরা প্রাণতুল্য কণ্যা প্রভৃতিকে অসহ্য বৈধব্য যন্ত্রণাবলে দগ্ধ করিতে সম্মত আছ। তাহারা দুর্নিবার রিপুবশীভূত হইয়া, ব্যাভিচার দোষে দূষিত হইলে তাহার পোষকতা করিতে সম্মত আছ; কেবল লোকলজ্জার ভয়ে ভ্রূণহত্যার সহায়তা করিয়া স্বয়ং সপরিবারে পাপপঙ্কে কলঙ্কিত হইতে সম্মত আছ; কিন্ত কি আশ্চর্য! শাস্ত্রবিধি অবলম্বনপূর্বক পুনরায় বিবাহ দিয়া তাহাদিগকে দুঃসহ বৈধব্য যন্ত্রণা হইতে পরিত্রাণ করিতে এবং আপনাদিগকে সকল বিপদ হইতে মুক্ত করিতে সম্মত নহ।”
এর পরে তিনি যা লিখেছেন তা পড়লে বোঝা যায় বিধবা নারী জাতির প্রতি তার কত গভীর মর্মবেদনা ছিল—
“তোমরা মনে পতি বিয়োগ হইলেই স্ত্রী জাতির শরীরও পাষাণময় হইয়া যায়; দুঃখ আর দুঃখ বলিয়া বোধ হয় না; যন্ত্রণা আর যন্ত্রণা বলিয়া বোধ হয় না; দুর্জয় রিপুবর্গ এককালে নির্মূল হইয়া যায়। কিন্তু তোমাদের এই সিদ্ধান্ত যে নিতান্ত ভ্রান্তিমূলক, পদে পদে তাহার উদাহরণপ্রাপ্ত হইতেছ। ভাবিয়া দেখ, এই অনবধান দোষ, সংসারতরুর কি বিস্ময় ফল ভোগ করিতেছে। হায় কি পরিতাপের বিষয়! যে দেশের পুরুষ জাতির দয়া নাই, ধর্ম্ম নাই, ন্যায় অন্যায় বিচার নাই, হিতাহিত বোধ নাই, সদসদ্বিবেচনা নাই, কেবল লৌকিক রক্ষাই প্রধান কর্ম্ম ও পরম ধর্ম্ম, আর যেন সে দেশে হতভাগ্য অবলাজাতি জন্মগ্রহণ না করে।
হা অবলাগন! তোমরা কি পাপে, ভারতবর্ষে আসিয়া, জন্মগ্রহণ কর, বলিতে পারি না!”
দেশাচার ও কুসংস্কারে আক্রান্ত মানুষদের তিনি তীব্রভাবে আক্রমণ করেছেন এই পুস্তিকায়। পাশাপাশি তাদের নতুন ভাবনায় জাগ্রত হয়ে, শাস্ত্রের বিধান মেনে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি—
“হা ভারতবর্ষীয় মানবগন! আর কতকাল তোমরা, মোহনিদ্রায় অভিভূত হইয়া, প্রমোদশয্যায় শয়ন করিয়া থাকিবে! একবার জ্ঞানচক্ষু উন্মীলন করিয়া দেখ, তোমাদের পুন্যভূমি ভারতবর্ষ ব্যাভিচারদোষে ও ভ্রূণহত্যাপাপের স্রোতে উচ্ছলিত হইয়া যাইতেছে। আর কেন, যথেষ্ট হইয়াছে; অতঃপর, নিবিষ্ট চিত্তে, শাস্ত্রের যথার্থ তাৎপর্য ও যথার্থ মর্ম অনুধাবনে মনোনিবেশ কর এবং তদনুযায়ী অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হও, তাহা হইলেই স্বদেশের কলঙ্ক বিমোচন করিতে পারিবে।”
বিদ্যাসাগরের দ্বিতীয় পুস্তিকা প্রকাশ হওয়ার পর আবারও বিভিন্ন প্রতিবাদ শুরু হয়। তাঁর প্রয়াস ও পুস্তিকাকে নিয়ে নানারকম ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ হতে থাকে। বিদ্যাসাগরকে ব্যাঙ্গ করে তাঁর বন্ধু কবি ঈশ্বর গুপ্ত লেখেন—
“পরাশর প্রমাণেতে বিধি বলে কেউ।
কেহ বলে এযে দেখি, সাগরের ঢেউ।।
……………………………………………
অনেকেই এই মত দিতেছে বিধান।
অক্ষত যোনির বটে বিবাহ-বিধান।।
কেহ বলে, ক্ষতাক্ষত কিবা আর আছে।
একেবারে তরে যাক যত রাঁড়ী আছে।।
কেহ কহে এই বিধি, কেমনে হইবে।
হিঁদুর ঘরের রাঁড়ী, সিঁদূর পরিবে।।”
সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বিধবা বিবাহের পক্ষে ছিলেন না। তিনি বিদ্যাসাগরের এই প্রয়াসকে কঠোরভাবে বিদ্রুপ করেছেন। ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসে সূর্যমুখির মাধ্যমে বিদ্যাসাগরকে ব্যাঙ্গ করেছেন তিনি। সূর্যমুখির লেখা একটি চিঠির অংশ এরূপ—“আর একটা হাসির কথা। ঈশ্বর বিদ্যাসাগর নামে কলকাতায় কে না কি বড় পণ্ডিত আছেন, তিনি আবার একখানি বিধবা বিবাহের বহি বাহির করিয়াছেন। যে বিধবার বিবাহের ব্যাবস্থা দেয়, সে যদি পণ্ডিত হয়, তবে মূর্খ কে?”
প্রথম পুস্তক প্রকাশ হওয়ার পর পণ্ডিতদের কটাক্ষ, প্রতিবাদী যুক্তি খণ্ডন করে যেমন তিনি দ্বিতীয় পুস্তিকা রচনা করেন, এবার আর তা করেন না। বরং ইতবাচক ভাবনায় তিনি তাদের প্রতিবাদ, ব্যাঙ্গ প্রভৃতি গ্রহন করেন। কেননা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন সমর্থন হোক কিংবা প্রতিবাদ, বিধবা বিবাহ ব্যাপারটি মানুষকে ভাবাতে পেরেছে। মানুষ যদি এটা নিয়ে না ভাবত, চুপ করে থাকত তাহলে এই ব্যাপারটা ব্যাপকভাবে সমাজে ছড়িয়ে পড়তে পারত না। প্রতিবাদের মাধ্যমে পণ্ডিতকূলের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যেও ব্যাপারটা গভীরভাবে ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্যাসাগর এটাই চাইছিলেন। তিনি বলেছেন—“যিনি যে প্রণালীতে উত্তর প্রদান করুক না কেন, আমি উত্তরদাতা মহাশয়দিগের সকলের নিকটেই আপনাকে যৎপরনাস্তি উপকৃত স্বীকার এবং তাঁহাদের সকলকেই মুক্তকন্ঠে সহস্র সাধুবাদ দিতেছি। তাঁহারা পরিশ্রম স্বীকার করিয়া উত্তরদানে প্রবৃত্ত না হইলে, ইহাই প্রতীয়মান হইত, এতদ্দেশীয় পণ্ডিত ও প্রধান মহাশয়েরা প্রস্তাবিত বিষয় অগ্রাহ্য করিয়াছেন। তাঁহাদের উত্তরদান দ্বারা অন্ততঃ ইহা বিলক্ষণ প্রমাণ হইয়াছে যে এই প্রস্তাব এরূপ নহে যে একেবারেই উপেক্ষা ও অবজ্ঞা করিয়া নিশ্চিত থাকা যাইতে পারে।”
বিধবা বিবাহবিষয়টি পণ্ডিত সমাজ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল তা বিহারীলাল সরকারের একটি লেখা থেকে বোঝা যায়। তিনি লিখেছিলেন—“বিচার ফলে যাহাই হউক, বিধবা-বিবাহের প্রচলন-প্রসঙ্গে একটা তুমূল আন্দোলন উত্থিত হইয়াছিল। বাত্যাবিক্ষোভিত সমগ্র বঙ্গভূমি বিচলিত হইয়াছিল। ধনী, দরিদ্র, বিদ্বান, মূর্খ, স্ত্রী, বালক, যুবা, বৃদ্ধ সকলেরই মুখে দিবারাত্র এতৎ সম্বন্ধে অবিরাম জল্পনা-কল্পনা চলিয়াছিল। হিন্দুর গৃহে প্রকৃতই একটা বিস্ময়-বিভীষিকার আবির্ভাব হইয়াছিল।”
বিচক্ষণ বিদ্যাসাগর এটা বুঝতে পেরেছিলেন এইভাবে প্রতিবাদ, যুক্তি-তর্ক প্রভৃতি করে আসল কাজ হবে না। এই নিয়ে আইন প্রণয়ন প্রয়োজন। তা করতে গেলে ভারত সরকারের নজরে বিষয়টি আনা দরকার। ভারতবর্ষ তখন ইংরেজদের অধীন। তাদের কাছে তাঁর লড়াইয়ের ব্যাপারটা ভালোভাবে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তিনি ‘বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা’ পুস্তকটির ইংরাজি অনুবাদ করলেন ‘Marriage of Hindu Windows’ নামে। তার সেই অনুবাদ ইংরেজদের নজর কাড়ে। এমনিতেই শাসক দলের মধ্যে বিবাহ বিধবা চালু করার ব্যাপার নিয়ে একটা ইতিবাচক মনোভাব ছিল। বিদ্যাসগরের যুক্তি ও প্রচেষ্টাতে তারা মুগ্ধ হন। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৪ অক্টোবর বিধবা বিবাহ চালুর স্বপক্ষে ৯৮৬ জন মানুষের স্বাক্ষর সহ ভারত সরকারের কাছে আবেদনপত্র জমা দেন বিদ্যাসাগর। এই আবেদনপত্রে যারা স্বাক্ষর করেছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু নাম হল, রাজনারায়ন বসু, দক্ষিণারঞ্জন মজুমদার, অমিয়কুমার দত্ত, কেশবচন্দ্র ন্যায়রত্ন, মহারাজ দূর্গাচরণ লাহা, ডাক্তার হরিশচন্দ্র শর্মা, ডেপুটি মেজিস্ট্রেট ঈশ্বরচন্দ্র ঘোষাল, রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ, জজ দ্বারকানাথ মিত্র প্রমুখ।
১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ১৭ নভেম্বর বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভায় বিধবা বিবাহ আইনের খসড়া পেশ করেন বিদ্যাসাগর। সারা দেশে এর বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। রাজা রাধাকান্তদেব এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ৩৩০০০ মানুষের স্বাক্ষর সহ আবেদন জমা দেন। এছাড়াও আরও নানাদিক থেকে এর বিরুদ্ধে নানান আবেদন আসতে থাকে। তবে সুখের কথা এই যে, তৎকালীন ভারত সরকার জনমতের চাপের কাছে নতি স্বীকার না করে সমস্যার গভীরতা বুঝতে পারেন এবং এর সমাধানে ইতিবাচক মানসিকতা দেখান। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই পাশ হয় ‘Hindu Widow’s Remarriage Act‘। এই আইন পাশ হওয়া বিদ্যাসাগরের জীবনে এক অন্যতম সাফল্য। এই আইন ভারতবর্ষের বুকে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।
ভারত সরকার বিধবা বিবাহ আইন পাশ করলেও তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চলতে থাকে। পাশাপাশি বিধবা বিবাহ নিয়ে নানান ব্যাঙ্গ, বিদ্রুপ চলতে থাকে। সেই সময় সংবাদ প্রভাকরে প্রকাশিত হওয়া একটি ব্যাঙ্গাত্মক কবিতার কয়েকটি লাইন এরূপ—
“কোলে কাঁখে ছেলে ঝোলে যে সকল রাঁড়ী।
তাহারা সধবা হবে, পরে শাঁখা শাড়ী।।
এ-বড় হাসির কথা, শুনে লাগে ডর।
কেমন কেমন করে মনের ভিতর।।
……………………………………………
সাগর যদ্যপি করে সীমার লঙ্ঘন।
তবে বুঝি হতে পারে, বিবাহ ঘটন।।
নচেৎ না দেখি কোন, সম্ভাবনা আর।
অকারণে হই হই, উপহাস সার।।”
যাই হোক, আইন প্রণয়নের পর প্রথম বিধবা বিবাহের ঘটনা ঘটে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর। বিদ্যাসাগরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু রামধন তর্কবাগীশ-এর ছেলে শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন ভট্টাচার্যের সঙ্গে ব্রাহ্মানন্দ মুখার্জীর দশ বছর বয়সি মেয়ে কালিমতির সঙ্গে। প্রসঙ্গত মাত্র ৪ বছর বয়সে কালিমতির বিয়ে হয়েছিল শ্রীযুক্ত রুক্মিণীপতি ভট্টাচার্যের ছেলে হরমোহন ভট্টাচার্যের সঙ্গে। বিয়ের দুই বছর পর কালিমতি বিধবা হয়। ১২ নং সুকিয়া স্ট্রিটে রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে এই বিয়ের আসর বসে। এই বিয়ের আয়োজনে দশ হাজার টাকা খরচ করেছিলেন বিদ্যাসাগর। এই বিয়ের ব্যাপারটা সহজ ছিল না। চারদিক থেকে নানারকম প্রতিবাদ আসতে থাকে। এমনকি তার পেছনে গুণ্ডা লাগানো হয়। প্রাণ সংশয়ের মতো পরিস্থিতিও উদ্ভব হয়। কিন্তু তাতে দমে যাননি বিদ্যাসাগর। কড়া নিরাপত্তার মধ্যে প্রথম বিধবা বিবাহের কাজ সম্পন্ন হয়। এই বিবাহের ফলে রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়কেও সমাজপতিদের রোষের শিকার হতে হয়। তাকে একঘরে করে দেওয়া হয়। শুধু তাঁকে নয়, শ্রীশচন্দ্রের পরিবারকেও একঘরে করে দেওয়া হয়। যাই হোক, এরপর আরও বেশকিছু বিধবা বিবাহের ঘটনা ঘটতে থাকে। উল্লেখ্য, এই সমস্ত বিয়ের ক্ষেত্রে অর্থ সাহায্য করেছেন বিদ্যাসাগর। বিদ্যাসাগরের জীবদ্দশায় তিনি প্রায় সত্তরটির মতো বিধবার বিয়ে দিয়েছিলেন।
বিদ্যাসাগরের জীবনে বিধবা বিবাহ নিয়ে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের ১১ আগস্ট। নিজের ২২ বছরের সন্তান নারায়নের সঙ্গে বিয়ে দেন ১৪ বছর বয়সি বিধবা ভবসুন্দরীর। এই বিয়ে নিয়ে আত্মীয়দের মধ্যে সমস্যার সৃষ্টি হয়। তারা এই বিয়ে মানতে চান না। এমনকি এই বিয়ে করলে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার কথাও জানায়। কিন্তু তাতে বিদ্যাসাগর দমে যাননি। ছেলের বিধবা বিয়েতে তিনি মত দিয়েছেন এবং এই বিয়ে হয়েছে। এই বিয়ের পর বিদ্যাসাগর তাঁর তৃতীয় সহোদর শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্নকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠির এক জায়গায় লিখেছিলেন—“বিধবা বিবাহের প্রবর্তন আমার জীবনের সর্বপ্রধান সৎকার্য। জন্মে ইহা অপেক্ষা অধিক কোনো সৎকর্ম করিতে পারিব, তাহার সম্ভাবনা নাই; এ বিষয়ের জন্য সর্বসান্ত করিয়াছি এবং আবশ্যক হইলে প্রাণান্ত স্বীকারেও পরাম্মুখ নহি; সে বিবেচনায় কুটু্ম্ববিচ্ছেদ অতি তুচ্ছ কথা।”
বিধবা বিবাহ প্রচলনে বিদ্যাসাগরকে অনেক সামাজিক প্রতিকূলতার মধ্যে পড়তে হয়েছিল। বহু মানুষ তার বিরুদ্ধে লেগেছিলেন। বহু কাছের মানুষ তার শত্রু হয়ে উঠেছিলেন। পাশাপাশি এই বিধবা বিবাহ নিয়ে তাঁকে অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়তে হয়। এইক্ষেত্রেও তাঁর কাছের লোকেরা তাঁকে বিপদে ফেলেন। বিধবা বিবাহ সংগঠেনর জন্য একটি ফান্ড গঠিত হয়। কিন্তু যারা সাহায্য করবেন বলে প্রতিশ্রুত হয়েছিলেন তাদের অনেকেই শেষমেষ আর্থিক সাহায্য করেননি। ফলে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন বিদ্যাসাগর। কিন্তু এতসব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও নিজের লক্ষ্য থেকে সরে আসেননি তিনি।
সমাজের হিতসাধনে বিদ্যাসাগর সারাজীবন ধরে নানান সংস্কারমূলক কাজ করেছেন। নারী কল্যাণের জন্য তিনি সারাজীবন কত যে কাজ করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। তাঁর সেই নারী কল্যাণকর কাজের অন্যতম হল বিধবা বিবাহ প্রচলন। একথা অনস্বীকার্য যে সময়ের নিরিখে বিধবা বিবাহ প্রচলন একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। বিধবা নারীদের জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন তিনি। যন্ত্রণা, আপমানের ঘন অন্ধকারময়তা থেকে তাদের জীবনকে আলোয় নিয়ে আসেন আলোকদিশারী বিদ্যাসাগর। মর্ত্যের মানুষ হয়েও আন্তরিক অনুভবে আর অবিস্মরণীয় কর্মপ্রচেষ্টায় অজান্তেই হয়ে ওঠেন এক ঈশ্বর-পুরুষ।