রাত হচ্ছে । অথচ কঙ্কাবতী বাড়ি ফিরছে না । চঞ্চল হয়ে উঠলো অনিন্দ । কঙ্কাবতী সাধারণত বিকেল গড়িয়ে যাওয়ার আগে ঘরে ঢোকে । আজ সন্ধ্যার অন্ধকার নামতে চলল, অথচ তার বাড়ি ফেরার নাম নেই । অনিন্দ বিচলিত হয়ে পড়ল । ঝড়-বৃষ্টি প্রচণ্ড হয়েছে । যদিও বৃষ্টি এখন কমতির দিকে । অথচ কঙ্কাবতীর বাড়ি ফেরার হদিস নেই । উদ্বিগ্ন অনিন্দ ছোট ছেলে ঘোতনকে ডাকলো ।
ঘোতন বাবার কাছে চটজলদি পৌঁছেই জিজ্ঞাসা করল, “ডাকছিলে বাবা ?”
“মা ফেরেনি । সম্ভবত বৃষ্টিতে আটকে গেছে । তুই শিগ্গির খোঁজ নিয়ে আয় । হরিবল্লভপুরের দিকের রাস্তাটাতে আগে খোঁজ নিবি । কেননা তোর মা সাধারণত সব্জি বিক্রি না হলে হরিবল্লভপুর গাঁয়ে ঢোকে । শিগ্গির যা বাবা ।“ বিচলিত অনিন্দ ছোট ছেলেকে মায়ের খোঁজ নিতে বলল ।
ঘোতন এদিক-সেদিক না গিয়ে সোজা হরিবল্লভপুরে যাওয়ার রাস্তার দিকে রওনা দিলো । কেননা বাবার কথাই সঠিক, কাছাকাছি গ্রামে থাকলে বৃষ্টিতে ভিজে মা নিশ্চয় বাড়ি ফিরতো । দ্রত পা চালালো ঘোতন । বেশী রাত্রি হলে ভাঙাচোরা রাস্তায় হাঁটাচলায় বিপত্তি । একরকম ছুটে এগিয়ে যাচ্ছে ঘোতন । হাঁটতে হাঁটতে ঘোতন গভীরভাবে নিজের জীবনের বেদনার দিনগুলির কথা ভাবতে লাগলো । ঘোতন ভাবছে, মা তাকে খুব একটা পছন্দ করে না । তার যথেষ্ট কারণ রয়েছে । কলেজে ভর্তি হওয়ার পর আতিয়ার প্রেমে জড়িয়ে পড়ল । আতিয়া শহরের প্রভাবশালী ধনী পরিবারের মেয়ে । প্রথটায় ঘোতন বুঝতে পারেনি । আতিয়ার বেশভূষা, চালচলন ছিল অতি সাধারণ ! ঘূণাক্ষরেও ঘোতন টের পায়নি আতিয়া ধনী পরিবারের আদরের একমাত্র কন্যা, যদিও তার দাদা রয়েছে । আতিয়াও তেমনি, ঘোতনের প্রেমে হাবুডুবু খাওয়ার মাঝে কখনও নিজেকে প্রকাশ করেনি । কলেজে তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় আতিয়ার আসল রূপ প্রকাশ্যে এলো । ততদিনে ঘোতন আতিয়ার ভালবাসায় মোহিত । আতিয়ার প্রেমে হাবুডুবু ।
অনেকদিন থেকেই ঘোতনের আতিয়ার সাথে কাছাকাছি কোথাও বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছা ! তাই আতিয়াকে নিয়ে একান্তে ঘুরতে যাওয়ার আবদার ধরলো ঘোতন । গ্রামের দিকে ঘোতনের বাড়ি । কিন্তু কলেজ অনেকটা দূরের শহরে, সালার । ট্রেনে যাতায়াত । কিন্তু আতিয়ার বাড়ি সালারে । তাই ঘোতন চেয়েছিল সালার থেকে বাসে অজয় নদীর তীরে ঘুরতে যেতে । কিন্তু আতিয়া কিছুতেই রাজী হল না । আতিয়ার বক্তব্য, ঘোতনের সাথে ঘুরতে গেলে তার বাড়ির লোকজন তাদের ভাব-ভালবাসার কথা জেনে ফেলবে । তাতে হিতে বিপরীত হবে । তার চেয়ে বরং যেভাবে তাদের মেলামেশা চলছে চলুক । সময়মতো আতিয়া বাড়িতে ঘোতনের সঙ্গে তার ভাব-ভালবাসার কথা জানিয়ে দেবে । তখন দুজনে ঘুরতে যেতে কোনো বাধা থাকবে না ।
কিছুদিন চুপচাপ । তারপর ঘোতন মনে মনে ভাবছে, ঘুরতে যেতে আতিয়ার আপত্তি উঠলো কেন ? দুজন-দুজনকে ভালবাসে । সুতরাং তারা শুধু নদীর পারে ঘুরতে যাবে । এতে আতিয়ার আপত্তি কেন ? সেই কারণে আতিয়ার আপত্তি অবলোকন করে ঘোতনের মনে সন্দেহের উদ্রেক ঘটলো । ঘোতনের মনে বারংবার একটা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে, আতিয়া কী তাকে সত্যিই ভালবাসে ? তাদের ভালবাসাটা দুই-একদিনের নয় । পুরো কলেজ লাইফ তাদের সালার শহরে একসঙ্গে ঘোরাফেরা । তাদের ঘোরাফেরায় সন্দিহান প্রকাশ করে কলেজের কিছু বন্ধু-বান্ধব ঘোতনকে আতিয়ার থেকে দূরে থাকতে পরামর্শ দিয়েছিল, কিন্তু সেসব কথার তোয়াক্কা না করে আতিয়ার সঙ্গে ঘোতন প্রেম-ভালবাসা চালিয়ে যাচ্ছে । আতিয়ার প্রতি তার ভালবাসা নির্ভেজাল । তাহলে ঘোতনের সাথে কলেজ কামাই করে ঘুরতে যাওয়াতে আতিয়ার কেন আপত্তি ?
ভাবনা তার অমূলক নয় ! সেটা টের পেলো পরীক্ষার কিছুদিন আগে । কলেজ শেষে খুব খিদে পেয়েছিল ঘোতনের । সকালবেলায় সেরকম কিছু বাড়ি থেকে খেয়ে আসতে পারেনি । বৌদি তাকে টিফিন বানিয়ে দিতে চেয়েছিল । কিন্তু ঘোতনের টিফিন নিয়ে কলেজে আসতে ঘোরতর আপত্তি । তাই সারাদিন পর কলেজ শেষে তার খুব খিদে ! সালারে তেমন কোনো বড় রেস্টুরেন্ট নেই । তবুও সালামুদ্দিনের রেস্টুরেন্ট তুলনামূলকভাবে ভাল । ভাল না বলে, বলা চলে চলনসই । সেখানে বিকেলবেলায় হরেকরকম খাবার মেলে । সালামুদ্দিনের হাল্কা বয়স । রেস্টুরেন্টে পৌঁছে সালামুদ্দিনকে বলল ডিম দিয়ে চাউমিন বানিয়ে দিতে । ঘোতনের মতে, ডিম চাউমিন সস্তায় পুষ্টিকর খাদ্য । কাঁটা-চামচে করে কিছুটা খেয়েছে, তারপর হঠাৎ রেস্টুরেন্টে আতিয়াকে দেখে অবাক ! আতিয়ার সাথে হাত ধরে ঢুকছে তার বয়ফ্রেণ্ড । পরে নাম জানতে পারলো, পল্লব ।
ঘোতন এমন ভাব করলো,যেনো আতিয়াকে সে দেখতে পায়নি ।
ঘোতন মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে এবং আতিয়ার দিকে তাকাচ্ছে । ঘোতন বোঝার চেষ্টা করছে, পল্লবের সাথে আতিয়ার কীরকম সম্পর্ক ! রেস্টুরেন্টে ঢুকে তাদের কী ধরনের খাবার অর্ডার ! কিন্তু ঘোতন কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলো, তাকে ইঙ্গিত করে আতিয়া পল্লবকে কিছু নির্দেশ দিচ্ছে । ঘোতন অতশত না ভেবে, চাউমিন খাওয়ায় মন দিলো । ঘোতন আরও ভাবছে, হয় তো আতিয়া তাকে ইঙ্গিত করে তাদের প্রেম-ভালবাসার কথা শোনাচ্ছে ।
খাওয়া শেষ !
পল্লব ধীরে ধীরে ঘোতনের খুব কাছে এসে বলল, “তুই কী ঘোতন ?”
“হ্যাঁ, আমি ঘোতন । কী হয়েছে বলুন ?” উত্তর দিলো বটে, কিন্তু পল্লবের কথা বলার ধরন বা শারীরিক ভাষা ঘোতনের কাছে মোটেই সুবিধার লাগলো না ।
শোনামাত্র পল্লব ঘোতনের জামার কলার চেপে ধরে বিশ্রি আওয়াজ করে বলল, “বড় লোকের মেয়ের সাথে পীড়িত করার শখ, তোকে আমি ঘোচাচ্ছি ! এবার তোকে কে বাঁচায়, দেখবো ?”
কিছু বোঝার আগেই পল্লব ঘোতনকে মারতে শুরু করল । বেধড়ক মার !
প্রথমটায় ঘোতন শুধুই মার খেলো । কিচ্ছু বলল না । তারপর আতিয়ার দিকে তাকিয়ে লক্ষ করল, ঘোতনকে পল্লবের হাতে মার খাওয়া দেখে দূরে দাঁড়িয়ে আতিয়া মুচকী মুচকী হাসছে । মজা লুটছে ! পল্লবকে ছাড়াবার কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না । বরং মারের দৃশ্য দেখে সে উৎফুল্ল ! আতিয়ার আনন্দোচ্ছ্বাস দেখে ঘোতন অনায়াসে উপলব্ধি করতে পারলো তাকে হেনস্থা করার আতিয়ার একটা ঘৃণ্য চক্রান্ত । নিজেকে শক্ত করলো ঘোতন । এতক্ষণ আতিয়ার কথা ভেবে পল্লবকে কিচ্ছু বলেনি । নীরবে মার খেয়েছে, অথচ প্রতিবাদে পল্লবকে কয়েক ঘা দেওয়া তো দূরের কথা তাকে গালি পর্যন্ত দেয়নি । একটাই কারণ, পাছে আতিয়া অসন্তুষ্ট হয় । ঘোতন আর নিজেকে সংযত রাখতে পারলো না । জোয়ান মর্দ গাঁয়ের খাটিয়া ছেলে । এইসব ছা-পোষা শহরের ছেলেদের কীভাবে টাইট দিতে হয় ঘোতনের ভালভাবে জানা । ডান হাতের মুঠি দিয়ে কয়েক ঘা মারতেই শুয়ে পড়ল পল্লব । তারপর ডান পায়ের লাথি মেরে তাকে একেবারে আতিয়ার কাছে । এবার ঘর্মাক্ত শরীরে আতিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি এত নেমক হারাম আগে এতটুকু টের পাইনি । এখন তোমার ছায়া মারাতে ঘৃণা হচ্ছে । ছি আতিয়া ! শেষে কিনা একটা পঙ্গু ছেলেকে দিয়ে আমাকে মার খাওয়ালে, যার কিনা তোমার হাত ধরার গুণ নেই ?”
“এই পঙ্গু ছেলেটাই আমার আসল বয়-ফ্রেণ্ড ! তুমি কাজটা ভাল করলে না । এর মাশুল তোমাকে গুণতে হবে ।“ আতিয়া শাসালো ঘোতনকে ।
ঘোতনও তেমনি স্পষ্ট জবাবে বলল, “তোমাদের মতো সুবিধাবাদী কুচক্রী অসভ্য মেয়েদের আমার চেনা আছে । যাদের এতটুকু শারীরিক ক্ষমতা নেই, সেইসব মস্তান দিয়ে আমাকে মারার হুমকি । আমিও ভবিষ্যতে দেখতে চাই, কার এত হিম্মৎ আমার গায়ে হাত তোলে ? এটা আমার চ্যালেঞ্জ !”
পরেরদিন সালার স্টেশনে নামতেই আতিয়া ঘোতনকে ডাকলো ।
কিন্তু আতিয়ার ডাকে সাড়া না দিয়ে ঘোতন আপন মনে স্টেশনের প্লাটফর্ম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য এগিয়ে গেলো ।
আবার আতিয়া ডাকলো, “ঘোতন, আমি তোমাকে ডাকছি ?”
এবার মুখ খুললো ঘোতন । আমাকে ডাকা মানে, তোমার নিত্য নতুন নাগর দিয়ে আমাকে পেটানো । তোমার আসল চরিত্র আমার কাছে পরিষ্কার ! তুমি পরষ্কার করে বলো, “তোমার কতগুলি নাগর ?”
ক্ষেপে গেলো আতিয়া । কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলো । তারপর ঠাণ্ডা মাথায় ঘোতনের কাছে এসে মিষ্টি কন্ঠে বলল, “সেদিনের ঘটনার জন্য আমি খুব দুঃখিত । আমি তোমাকেই ভালবাসি ।“ এই কথা বলার পর আতিয়া ঘোতনের হাত তার বুকের কাছে নিয়ে কী যেনো বলতে চাইছিল, ঠিক সেই সময় আতিয়ার দাদা ফিরিকি এসে হাজির । চিল্লিয়ে ঘোতনকে বলল, “আমার প্রিয় বোনের সঙ্গে বেলেল্লাপনা । প্রকাশ্য রাস্তায় বোনের হাত ধরে টানাটানি ।“
কাঁদো কাঁদো স্বরে ফিরিকির দিকে তাকিয়ে আতিয়া বলল, “দ্যাখ্ দাদা । এই বকাটে ছেলেটা কারণে-অকারণে রাস্তার উপরে আমাকে উত্ত্যক্ত করে । ছেলেটার চরম শাস্তি হওয়া উচিত !”
আতিয়ার কথা শুনে ফিরিকি তার গুণ্ডাবাহিনীকে অর্ডার দিলো মুহুর্তের মধ্যে ঘোতনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে ।
ততক্ষণে স্টেশনের প্লাটফর্ম থেকে বেরিয়ে তারা রিক্সা স্ট্যাণ্ডে ।
ইত্যবসরে ফিরিকির গুণ্ডাবাহিনী ঘোতনের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল । ঘোতন সর্বশক্তি দিতে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা চালালো । অনেক গুলি মস্তান গুণ্ডাবাহিনী । তাদের ঐক্যবদ্ধ শক্তির সাথে এঁটে ওঠতে পারছিল না ঘোতন । হয়রান হয়ে মাটিতে পড়ে গেলো ঘোতন । সেই সময় থানা থেকে বিরাট পুলিশ বাহিনী স্পটে হাজির । পথ চলতি কোনো মানুষ মারামারির ঘটনাটা থানায় রিপোর্ট করে দেওয়ার জন্য বিরাট পুলিশ বাহিনীর আগমন । পুলিশ দেখে ঐ গুণ্ডাবাহিনী ততক্ষণে স্পট থেকে উধাও ।
কিন্তু পুলিশের কাছে আতিয়া মরা কান্না শুরু করলো । ইনিয়ে-বিনিয়ে পুলিশকে বোঝালো, ইচ্ছার বিরূদ্ধে ঘোতন তার শ্লীলতাহানি করেছে । তারপর আতিয়া ও ফিরিকির লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে ঘোতনকে পুলিশ অ্যারেস্ট করে থানার লক আপে ঢুকিয়ে দিলো ।
থানা থেকে ছাড়া পেয়ে ঘোতন আর কলেজ মুখো হয়নি । পরবর্তীতে বেশ কিছুদিন গুম হয়েছিল ঘোতন । তারপর হঠাৎ একদিন ঘোতনকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না । চারিদিকে খোঁজখবর নিয়ে যখন পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন তার বন্ধু নিতাই এসে খবর দিলো ঘোতন বাড়ির বাইরে গেছে । দুদিন পরে ফিরবে । কীজন্য বাড়ির বাইরে থাকবে, কোথায় থাকবে, নিতাইকে কিচ্ছু জানায়নি ।
পরেরদিন সালার থানা ও নিয়ামতপুর থানার পুলিশ, একসঙ্গে বাড়িতে এসে হাজির । বাড়িতে পুলিশ দেখে কঙ্কাবতী ঘাবড়ে গেলো । সরাসরি পুলিশকে জিজ্ঞাসা কঙ্কাবতীর, “বাড়িতে আপনারা ! তাদের অপরাধ !”
“আতিয়া নামে সালারের বড় ব্যবসায়ীর মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না । মেয়ের দাদার দাবী, আতিয়াকে ঘোতন গায়েব করেছে । এখন বলুন, ঘোতনকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন ? আমরা তার সঙ্গে কথা বলতে চাই ?”
“ঘোতন এখন বাড়ি নেই । আর শুনুন, আমার ছেলে ঐ রকম জঘন্য কাজ কখনই করতে পারে না ।“ জোর গলায় কঙ্কাবতী পুলিশকে জানিয়ে দিলো ।
পুলিশ সম্ভবত নিয়ামতপুর থানায় ফিরে গেলো । নিয়ামতপুর থানা থেকে সালার থানা কাছে । তাই দুই থানার পুলিশ একযোগে আতিয়ার তল্লাশি চালাচ্ছে ।
অন্যদিকে ঘোতন আচমকা এবং অনেক কসরত করে আতিয়াকে তুলে নিয়ে সোজা সুন্দরবনের একটা অপরিচিত রিসোর্টে উঠলো । রাস্তায় আতিয়াকে এমনভাবে ধমকালো, কোনোরকম পালাবার ট্যাঁ-ফোঁ করলে তার বিপদ অনিবার্য । এমনকি আতিয়াকে বশে আনতে তার পিঠে দুই এক ঘা চড়-থাপ্পড় মারতে হয়েছিল । তারা দুইজন একঘরে দুটো রাত কাটাবার পর ঘোতন আতিয়াকে বুঝিয়ে দিলো, চালাকিতে গ্রামের ছেলে হওয়া সত্ত্বেও ঘোতন কোনো অংশে কম নয় । আতিয়াকে বড্ড বেশী ভালবাসে, তাই ঘোতন দয়াবশত আতিয়ায়াকে নিষ্কলুষ অবস্থায় বাড়ি ফিরিয়ে দিচ্ছে । সুযোগ পেয়েও ভালবাসার মানুষকে সে কখনও কলঙ্কিত করতে চায় না । এখানেই তাদের উচ্ছৃঙ্খল জীবন থেকে ঘোতনের জীবন আলাদা ।
আতিয়া ঘোতনের চরিত্র সম্বন্ধে ষোলআনা ওয়াকিবহাল । তাই কাঁদতে কাঁদতে ঘোতনকে আতিয়া বলতে বাধ্য হল, “সে পল্লবের ফাঁদে পড়ে গেছে । সেখান থেকে বেরিয়ে আসার আর কোনো রাস্তা খোলা নেই ! তাই ঘোতনকে তার জীবন থেকে সরাতে নাটক করতে বাধ্য হয়েছিল ।“
তারপর অনেকদিন কেটে গেছে, ঘোতন আতিয়ার খোঁজ নেয়নি । বাড়িতেই চুপচাপ দিন কাটছে । তবে ইদানীং ঘোতনের কথাবার্তার অনেক পরিবর্তন । কেউ কিছু কটু কথা বললে, চাঁছাছোলা ভাষায় উত্তর দিয়ে দেয় । হাটে-বাজারে তার সাথে নিত্য গণ্ডগোল । একদিন মুদিখানার দোকানদার হাসিচ্ছলে বলেছিল, তুমি নাকি নারী ঘটিত কারণে পুলিশ হেপাজতে জেল খেটেছো ?”
ঘোতন মুদিখানার দোকানদারকে সোজা থাপ্পড় । জামার কলার ধরে বলেছিল, আর যদি এইরকম কথা ফের শুনি তোমার টুঁটি টেনে ছিঁড়ে দেবো । আজ থেকে জেনে রাখবি, “আমি ঘোতন । বেশী ট্যাঁ-ফোঁ করেছিস, তো মরেছিস ।“
ঘোতনের রক্তচক্ষুর খবর চারিদিকে রটে যাওয়ার পর, এলাকার মানুষ ঘোতনকে সমীহ করে চলতে লাগলো । মারপিটে ওস্তাদ । ঘোতনের মারকুটে স্বভাব অবলোকন করে গাঁয়ের বয়স্ক মানুষেরা হতাশ । তাঁদের মধ্যে মৃদু গুঞ্জন, ভাল ছেলেটার এরকম কেন অবনতি ? বাড়িতে অনিন্দ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে, তার ছোট ছেলেটার দ্বারা কাজকর্ম কিচ্ছু হচ্ছে না । উপার্জনের পথ না খুঁজলে ভবিষ্যতে খাবে কী ? যার জন্য কঙ্কাবতীও চিন্তিত । কাজকর্ম না করার জন্য ঘোতন মায়ের কাছে অহরহ বকা খাচ্ছে । তবুও কাজকর্ম করার ব্যাপারে ঘোতনের হেলদোল নেই । কঙ্কাবতী এমন কথা পর্যন্ত তার ছেলেকে বলল, কিছু করতে না পারলে ভ্যান রিক্সায় মাল টানলে সারাদিনের শেষে যা মজুরী জুটবে তাতে সংসারের সুরাহা হবে ।
***************************
ঘোতন খুব দ্রুত পা চালিয়ে হাঁটছে । লম্বা চওড়া তাগড়াই চেহারার অল্প বয়সী যুবক, ঘোতন । তাই তার হাঁটার গতি সাংঘাতিক । রাতের অন্ধকার ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে । ঘোতন চিন্তা করল, বেশী রাত হলে মায়ের বাড়ি ফিরতে কষ্ট হবে । তা ছাড়া ভ্যান রিক্সা তার টানা ভীষণ কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে । সেই সকালে দুটো খেয়ে কাজে বের হয়েছে । সারাদিন নিশ্চয় খাওয়া হয়নি । এদিকে মা বাড়ি না থাকলে বড় বৌদি সবাইকে আদর যত্ন করে খাওয়ায় । বলা চলে বড় বৌদি মায়ের ভূমিকা নেয় । কিন্তু মায়ের তো সারাদিন খাওয়া হয়নি । সংসারের সচ্ছলতার কথা ভেবে মায়ের রাত দিন খাটা । আবার ঘোতন উল্টে আবার নিজের কথাও ভাবছে, সে একজন জোয়ান মরদ ছেলে । অথচ উপার্জনের এক ফোঁটা তার নিজের মুরদ নেই । এইসব কথা ভাবতে ভাবতে, বিদ্যুতের চমকানো আলোতে ঘোতন দেখতে পেলো তার মায়ের ভ্যান রিক্সাটি রাস্তার উপর পড়ে রয়েছে । অথচ মাকে দেখতে পাচ্ছে না । ঘোতনের মনটা অজানা আশঙ্কায় চমকে উঠল । তাহলে মায়ের কী কোনো বিপদ !
রাস্তার আশপাশে তাকাচ্ছে ঘোতন । মাকে দেখতে না পেয়ে ঘোতনের চিৎকার, “মা তুমি কোথায় ?” রাস্তা সুনসান । আকাশে মেঘের আনাগোনা । কিন্তু বৃষ্টি থেমে গেছে । ঝড়ো হাওয়া নেই । তবে চারিদিক অন্ধকার । ঘুটঘুটে কালো অন্ধকার । তারপর বিদ্যুত চমকানোর সাথে সাথে ঘোতন দেখতে পেলো, রাস্তার একটু নীচে জঙ্গলা গাছের ডালে একটা শাড়ি ঝুলছে । এবার ঘোতনের কাছে পরিষ্কার, নিশ্চয় মা পড়ে গিয়ে রাস্তার পাশে পড়ে রয়েছে । তাড়াতাড়ি ছুটলো সেখানে ।
সেখানে গিয়ে ঘোতনের চক্ষু চড়কগাছ ! মায়ের মুখ বাঁধা । রক্ষিতবাবু মাকে জাপটে ধরে রয়েছে । অন্যদিকে রক্ষিতবাবুর কব্জা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে কঙ্কাবতীর মরিয়া প্রয়াস । কিন্তু শয়তান রক্ষিতবাবুর হাত থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছে না । ঐ দৃশ্য দেখে ঘোতনের মাথায় রক্ত উঠে গেলো । কালবিলম্ব না করে এক ঝটকায় ভ্যান রিক্সার হ্যাণ্ডেল খুলে নিয়ে সোজা রক্ষিতবাবুর মাথায় আঘাত ! পিঠে আঘাত ! পায়ে আঘাত ! রক্ষিতবাবু যন্ত্রণায় চিল্লাচ্ছে ! ছটফট করছে । কঙ্কাবতী ঘোতনকে বাধা দিলো । লোকটা মরে গেলে আরও বিপদ । রক্ষিতবাবুকে রাস্তার পাশে ফেলে রেখে মা-বেটা ছুটলো বাড়ির দিকে । অন্যদিকে কঙ্কাবতীকে খোঁজার জন্য অনিন্দ টর্চ নিয়ে হরিবল্লভপুর রাস্তার দিকেই হাঁটছিল । তারপর বাবা-মাকে সঙ্গে নিয়ে ঘোতন বাড়ি ঢুকলো ।
শুয়ে রয়েছে কঙ্কাবতী । সারাদিনের ধকলের জন্য কঙ্কাবতী গভীর ঘুমে বিভোর । অন্যদিকে ঘোতনের ঘুম আসছে না । মায়ের দুঃসহ অবস্থা দেখে ঘোতন চিন্তান্বিত । মায়ের মতো মানুষের যদি ঐরকম অসহায়তার মধ্যে পড়তে হয় তাহলে তার অল্প বয়সী বোনদের অবস্থা কী দাঁড়াবে । মা এমনিতেই খুব সাহসী । তার ভয়ডর কম । তবুও তার অসহায়তার চরম পর্যায় দেখে ঘোতন ঘোর চিন্তান্বিত । এইসব ওলট-পালট ভাবনাতে ঘোতন আছন্ন । যার জন্য তার ঘুম আসছে না । ঘড়িতে তখন রাত দুটো ।
হঠাৎ দরজার কড়া নাড়ার আওয়াজ !
“এত রাত্রিতে আবার কে ?” প্রশ্ন জাগলো ঘোতনের মনে ।
বিছানা থেকে উঠে দরজা খুলতে যাচ্ছিলো ঘোতন । কিন্তু কঙ্কাবতী দরজা নাড়ার শব্দে ঘুম থেকে উঠে ঘোতনকে বলল, “তুই ঘরে ঢোক । আমি দেখছি কে এলো ?” কঙ্কাবতীর মনে ঘুমানোর আগে পর্যন্ত কু-গাইছিল, “রক্ষিতবাবু নিশ্চয় বদলা নিতে দলবল নিয়ে বাড়িতে হামলা করবে ।“ তাই বারংবার ভাবছে, “নচ্ছারটা নিশ্চয় বাড়ি এসে এখন হাজির ।“
দরজা খুলতেই পুলিশ । পুলিশ বাড়ি ঢুকেই বাড়ির সমস্ত ঘর তল্লাশি শুরু করল । ঘোতনকে হাতেনাতে ধরে হাতকড়া পড়িয়ে দিলো । থানার বড়বাবু কঙ্কাবতীকে বললেন, “আপনার ছেলে বিনা কারণে পঞ্চায়েত রক্ষিতবাবুকে বেধড়ক মেরেছে ! যার জন্য তিনি হাসপাতালে শয্যাশায়ী । মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন । পঞ্চায়েতকে অকারণে মারার জন্য আমরা আপনার ছেলেকে অ্যারেস্ট করলাম ।“
“আমার ছেলে রক্ষিতবাবুকে মেরেছে তার প্রমাণ ?” কঙ্কাবতী পাল্টা প্রশ্ন করলো থানার বড়বাবুকে ।
পেছন থেকে চড়ুইডাঙার মাতবর নকড়ি ও পল্লীদহ গ্রামের সুখহরি মোড়ল এগিয়ে এসে পুলিশের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমরা চাক্ষুষ দেখেছি । আমরা তার প্রত্যক্ষদর্শী ।“
এবার থানার বড়বাবু ধমকের সুরে বললেন, “আপনার যা কিছু বলার কোর্টে বলবেন । আমরা কাল সকালেই আপনার ছেলেকে কোর্টে চালান করে দেবো । সুতরাং আপনার যা সওয়াল করার কোর্টে গিয়ে করবেন ।“
ঘোতনের হাতে হাতকড়া পড়িয়ে পুলিশ তাকে প্রিজন ভ্যানে তুললো । তারপর পুলিশ ছুটলো নিয়ামতপুর থানায় । চালাক কঙ্কাবতী খুব সহজে বুঝতে পারলো, ঐ দুজনকে টাকা দিয়ে রক্ষিতবাবু সাক্ষী বানিয়েছে । যার জন্য তাঁদের এখন ঘোতনের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে সাহস ! মোড়লদের কাণ্ডকারখানা দেখে রাগে জ্বলছে কঙ্কাবতী । এদিকে কঙ্কাবতীর মেয়েগুলি মার কাছে বায়না ধরলো, দাদাকে ছাড়িয়ে আনতে । দাদাকে হাতকড়া পরিয়ে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য বোনদের চোখে জল । বড় বৌমা হাঁ করে তাকিয়ে অবস্থার প্রেক্ষাপট বোঝার চেষ্টা করছে । অনিন্দের দিকে তাকিয়ে কঙ্কাবতী বলল, এখন ঘুমোতে গেলে চলবে না । ঘোতনকে কীভাবে থানা থেকে ছাড়িয়ে আনা যায় তার ব্যবস্থা করতে হবে । নতুবা ছেলেটাকে কোর্টে চালান করে দিলে ঘোতনকে ছাড়ানো ভীষণ সমস্যা হবে ।
ভোর হতে দেরী নেই । ইতিমধ্যে বিভিন্ন ধরনের পাখির ডাক শুরু হয়ে গেছে । পূর্বদিকে রক্তিম আভা । গোয়ালা দুধের ক্যান নিয়ে গাঁয়ে ছোটাছুটি করছে । খুব ভোরে লাঙ্গল কাঁধে নিয়ে গাঁয়ের চাষীরা মাঠে ছুটছে । গৃহবধূরা উঠোনে গবর দিচ্ছে । তার মধ্যে দিয়ে কঙ্কাবতী ও অনিন্দ পায়ে হেঁটে চললো মিঁয়া হল্ট স্টেশনের নিকট মিঁয়াগ্রামে । সেখানে নটহরি উকিলের কাছে । নটহরি উকিলের যথেষ্ট নামডাক । সকাল ন’টার ট্রেনে কোর্টে বেরিয়ে যান । নটহরি উকিলকে কঙ্কাবতী ভাল চেনে । কঙ্কাবতীর কাছ থেকে উকিলবাবুর বাড়ির জন্য উকিলবাবুর গিন্নি নিয়মিত সব্জি কেনেন । তাই উকিলবাবুকে বাড়িতে ধরার জন্য তাদের তাড়াহুড়ো ।
বাড়ি পৌঁছে দেখে উকিলবাবু কুড়ুল দিয়ে গাছের গুঁড়ি থেকে কাঠ চেরাচ্ছে । কাঠের ফালি জ্বালানীর জন্য ভীষণ উপযুক্ত । কঙ্কাবতী কৌতুহলবশত উকিলবাবুকে জিজ্ঞাসা করলো, “আপনি নিজে কেন কাঠ চেরাচ্ছেন ?”
“কঙ্কাবতী, কুড়ুল দিয়ে গাছের গুঁড়ি থেকে কাঠ চেরানো একদিকে শরীর চর্চা, অন্যদিকে রান্নার জ্বালানীর কাঠ রেডি করা । মাত্র এক ঘন্টার কাজ !” হেসে হেসে কঙ্কাবতীর কথার উত্তর দিলেন । তারপর কঙ্কাবতীকে জিজ্ঞাসা করলেন, “এত সকালে তোমরা কী মনে করে ?”
“দাদা আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে ।“ বলেই কঙ্কাবতী কাঁদতে লাগলো ।
আহা ! না কেঁদে ঘটনাটা খুলে সবিস্তারে বলো ?
“চেম্বারে চলুন বলছি ।“ কঙ্কাবতী উকিলবাবুকে ঘরের চেম্বারে যেতে বলল ।
নটহরি উকিলবাবু হাতমুখ ধুয়ে চেম্বারে এসে বসলেন ।
কঙ্কাবতী তার সব্জি বিক্রি, হরিবল্লভপুর যাওয়ার সময় প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে পড়লে রক্ষিতবাবুর আগমন, রক্ষিতবাবু তার সঙ্গে কীরকম আচরণ করেছিলেন, সমস্ত কিছু সবিস্তারে উকিলবাবুকে জানালো । উকিলবাবুকে জানানোর পরে তাঁর পায়ে ধরে বলল, “স্যার, আমার ছেলেটাকে থানা থেকে জামিনে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করুন ।“
“ঘাবড়াবে না কঙ্কাবতী । আমি দেখছি । তবে তোমরা ঠিক সময় মতো আমার কাছে এসেছো, নতুবা ব্যাপারটা আমার হাতের বাইরে চলে যেতো ।“ উকিলবাবু কঙ্কাবতীদের আশ্বস্ত করলেন ।
জামিনে থানা থেকে ছাড়া পেলো ঘোতন । তারপর থেকে ঘোতনের ব্যবহার, চালচলন স্বাভাবিক ছন্দ থেকে একটু অন্যরকম ! চোখে মুখে অহরহ বিরক্তির ছাপ । তার হৃদয়ের ভিতরে অনেক রাগ । কঙ্কাবতীর ধারণা, আতিয়ার কাছ থেকে প্রত্যাখানের ধাক্কা এবং মায়ের সঙ্গে রক্ষিতবাবুর ঐরূপ আচরণ দেখে, ঘোতন অপ্রসন্ন । সব কিছুতেই বিরাগভাজন । তবুও কঙ্কাবতীর আশা, কিছুদিন কেটে গেলে ঘোতন আবার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরবে । কিন্তু কঙ্কাবতীর আশার গুড়ে বালি । ঘোতন যে কে তাই । বরং আরও ক্রমশ ডানপিটে হয়ে উঠছে ।
(ক্রমশ)