কঙ্কাবতীর দুঃসাহস (ধারাবাহিক উপন্যাস, চতুর্থ পর্ব) : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

0
550

দোকান খোলার তোড়জোড় তুঙ্গে । চায়ের দোকান । কিন্তু চায়ের দোকান হলে কী হবে, তোড়জোড় কম নয় । ঘর বানানো । উনুন বসানো । যদিও গ্যাসে চা জ্বাল দেওয়ার প্রথা । তবুও কয়লার উনান রেডি রাখা ভীষণ দরকার । গ্যাসের সংকুলান হলে কয়লার উনুন ভরসা । খরিদ্দারদের বসার জায়গা । চায়ের সঙ্গে টায়ের ব্যবস্থা । কী ধরনের বিস্কুট খরিদ্দারদের রুচি তার একটা প্রস্তুতি । বাপ-বেটিতে এই নিয়ে দিনে দশবার শলা-পরামর্শ । পকেটে পয়সার টান । পয়সার টান না থাকলে এতটা শলা-পরামর্শ বা কসরতের দরকার ছিল না । কঙ্কাবতীর বক্তব্য, “এমনভাবে দোকান ঘর তুলতে হবে যাতে প্রয়োজনে ভবিষ্যতে দোকান বাড়ানোর সুযোগ থাকে ।“ সেইজন্য তোড়জোড় বেশী । জায়গাটা পরিষ্কার করার পর কিছুদিন রৌদ্রে শুকালো । তারপর ইট দিয়ে উনুন বানিয়ে উপরে ত্রিপল টাঙিয়ে চায়ের দোকান খোলার সিদ্ধান্ত নিলো । স্টেশন কাছাকাছি এবং স্টেশন যাওয়ার রাস্তার পাশে হওয়ার তাদের চায়ের দোকানের একটি অতিরিক্ত সুবিধা । খরিদ্দারেরা অনায়াসে তাদের চায়ের দোকান দেখতে পাবে এবং তাদের চায়ের দোকানে ঢুকতে বা বের হতে কোনোরকম কসরতের ঝঁক্কিঝামেলা পোহাতে হবে না ।
কোনোরকম জাকজমক ছাড়াই অনীশা ও অনিন্দ দোকান চালু করে দিলো । মাথার উপরে ত্রিপল । খরিদ্দার বসার জন্য দোকানের সামনে একটা বেঞ্চ । অনিন্দ ভেবে দেখলো, ঘর বানানোর জন্য অপেক্ষা করলে সেটা কতদিনে সম্ভব হবে সে নিজেও সন্দিহান ! তার হাতে একটাও পয়সা নেই । এমতাবস্থায় অনেক ভেবেচিন্তে অনিন্দ খোলা আকাশের নীচে দোকান চালু করলো । তার বক্তব্য, দোকান চলুক, সেই সঙ্গে ঘর বানানোর প্রয়াস অব্যাহত থাকুক ।
খুব ভোরে এসে দোকান খোলে অনিন্দ । তার কিছুক্ষণ পর, অনিশা এসে দোকানে বসে । অধিকাংশ খরিদ্দার ট্রেনের যাত্রী । তবে সকালে ও বিকালে স্থানীয় মানুষের ভিড় চোখে পড়ার মতো । আরও একটা চায়ের দোকান আছে বটে, কিন্তু অনীশাদের চায়ের দোকানে মানুষের ভিড় বেশী । এর পেছনে কয়েকজন খরিদ্দারের বক্তব্য, চা তৈরীর রসায়ন । অনীশাদের চায়ের গুণগত মান অনেক বেশী উন্নত । যার জন্য চা পিপাসু মানুষদের অনীশাদের দোকানে চা খাওয়ার ভিড় ।
খুব সকালে বিশেষ করে সূর্য উঠার মুহুর্তে মিঁয়া গ্রামের বেশ কয়েকজন মানুষ অনীশাদের দোকানে ঢোকেন এবং অনেকক্ষণ বসে থাকেন । তাঁরা চা খান । খবরের কাগজ পড়েন । তারপর একে অপরের সাথে গল্পগুজবে মেতে উঠেন । এছাড়া রিক্সাওলায়া, ছোট ছোট ব্যবসায়ী, ইত্যাদি মানুষজনের আনাগোনা সর্বক্ষণ । চায়ের দোকান বন্ধ রেখে অন্যত্র যাওয়ার উপায় নেই । সারাদিন বলা চলে সর্বক্ষণ খরিদ্দারদের আসা-যাওয়া ।
অনিন্দের শরীরটা ভাল যাচ্ছে না । ঠিক সন্ধ্যাবেলায় অনিন্দের শরীরে জ্বর আসে । অনিন্দের শরীরে জ্বর আসার আরও কারণ রয়েছে । দোকানে মাথার উপর ত্রিপল টাঙানো । সারাদিনের রৌদ্র-বৃষ্টির হ্যাপা ঐ ত্রিপলের উপরেই । দুপুরবেলায় প্রচণ্ড গরম । গরমে তার হাঁসফাঁস । অনিন্দের শারীরিক স্থিতি আগাগোড়াই দুর্বল । ফলে তার শরীরের জ্বরটা সারছে না । “ক্যালপোল-৬৫০” খেলে সাময়িক নিষ্কৃতি । কিন্তু একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর অনিন্দের শারীরিক অবস্থা যে-কে-সেই । অনিন্দের অসুস্থ ও দুর্বল শারীরিক অবস্থা অবলোকন করে কঙ্কাবতী অনিন্দকে কয়েকদিন বাড়িতে বসে বিশ্রাম নিতে বলল । সেই সঙ্গে গাঁয়ের হাতুড়ে কয়াল ডাক্তারের পরামর্শ নিতে বলল । যার জন্য চায়ের দোকান অনীশাকে একা সামলাতে হচ্ছে । সেই ভোরবেলায় গিয়ে দোকান খোলে । ভোরের ট্রেনের প্যাসেঞ্জারেরা অনীশাদের দোকানে চা খেতে ভিড় করে । কোনো কারণে দোকান না খুললে ঐসব খরিদ্দার খোয়া যাওয়ার সম্ভাবনা । তাই ভোরবেলায় অনীশাকে দোকান খোলার জন্য ছুটতে হয় । তারপর সারাদিন এবং তারপর রাত্রি ন’টা পর্যন্ত দোকান খোলা । তবে সন্ধ্যাবেলায় মাঝে মাঝে কঙ্কাবতী এসে দোকানে বসে, নতুবা মনীষা এসে দোকান বন্ধ হওয়া পর্যন্ত অনীশার সঙ্গে থাকে । মনীষা জানে, তার পরের বোনটি কিছুটা ভীতু টাইপের । সন্ধ্যার পরে খোলা আকাশের নীচে দোকান চালানো যেমন শক্ত, তেমনি রাত্রিবেলায় ফাঁকা রাস্তা ধরে বাড়ি ফেরা তার পক্ষে দুর্বিসহ । তাই মনীষার সন্ধ্যা-রাত্রিতে অনীশার সঙ্গে দোকানে থাকা এবং একসঙ্গে রাত্রিবেলায় বাড়ি ফেরা । তা ছাড়া মনীষা মানসিক ও শারীরিকভাবে শক্তপোক্ত মেয়ে । সহজে ঘাবড়ানো তার ধাঁচে নেই । তা ছাড়া তার ভয়ডর কম, বেপরোয়া সাহসের । ছোটবেলায় মনীষা গাঁয়ের মধ্যে সব ধরনের খেলায় ছিল পটু । যেমন হা-ডু-ডু ও রানে ভীষণ দক্ষ । ফুটবল ভাল খেলত । মেয়েদের ফুটবল টীম না থাকার দরুন সে ছেলেদের সাথে ফুটবল খেলত । মনীষার ফুটবল খেলা নিয়ে গাঁয়ের মানুষের কাছে কঙ্কাবতীকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে । বিশেষ করে গাঁয়ের মোড়লেরা প্রায় তাকে নালিশ করতেন, তার ধিঙ্গি মেয়ে নাকি ছেলেদের সাথে ধেইধেই করে লাফাচ্ছে । কখনই তাঁরা ভালভাবে বলতেন না, “মনীষা ছেলেদের সাথে খুব ভাল ফুটবল খেলছে !” উল্টে বলতেন, নির্লজ্জ মেয়েটার ছেলেদের সাথে ফষ্টিনষ্টি করার স্বভাব । অশান্তির বাতাবরণ লক্ষ করে কঙ্কাবতী মনীষার ফুটবল খেলা বন্ধ করে দিয়েছিল । “অথচ মেয়েটা সুযোগ পেলে ফুটবল খেলায় অনেক উন্নতি করতে পারত”, এই কথাটা কঙ্কাবতী এখনও তার ছেলেদের কাছে আপশোশ করে ।
সেদিন বুধবার । সন্ধ্যাবেলায় মনীষা বা কঙ্কাবতী কেউ চায়ের দোকানে অনীশার সঙ্গে থাকতে পারলো না । মনীষা ও ঘোতন, দুজনকে যেতে হল ব্লক অফিসে । সেখানে মেয়েদের কন্যাশ্রী ভাতা দিচ্ছিল । ঘোতন সঙ্গে যাওয়ার একটাই কারণ, মনীষাকে সঙ্গ দেওয়া । কেননা ব্লক অফিসে যাওয়ার রাস্তাটা ভীষণ ভজঘট । রাস্তায় মনীষার যাতে বিপদ না ঘটে, সেইজন্য ঘোতনকে তার সঙ্গে যাওয়া । অন্যদিকে কঙ্কাবতী সব্জীর বিক্রিবাট্টা চুকিয়ে বাড়ি ফিরে দেখে অনিন্দের শরীরে খুব জ্বর । তাই তাকে নিয়ে ছুটলো হাসপাতালের আউটডোরে । হাতুড়ে ডাক্তার, কয়াল দাদা অনিন্দকে সারিয়ে তুলতে না পারার জন্য কঙ্কাবতী আর ঝুঁকি নিলো না, তাই সোজা হাসপাতালে । ফলে চায়ের দোকানে যাওয়ার মতো বাড়িতে কেউ ছিল না । অনীশার ছোট বোনের যাওয়া, না যাওয়ার সমান । কেননা কিছু একটা অঘটন ঘটলে সেটা ছোট বোনটার জন্যেই ঘটবে, এটা অনীশার ধারণা । ছোট বোন থাকা মানে অনীশার দোকান ছাড়াও আরও একটা দায়িত্ব, ছোট বোনকে সামলানো ।
অনীশা প্রত্যেকদিন রাত্রিতে সাড়ে আটটার ট্রেনটা দেখে দোকান বন্ধ করার প্রস্তুতি শুরু করে । কেননা সাড়ে আটটার ট্রেনে অনেক নিত্যযাত্রী ট্রেন থেকে নেমে অনীশার চায়ের দোকানে চা খেয়ে বাড়ি ফেরে । তাই সন্ধ্যারাত্রির সাড়ে আটটার ট্রেন দেখে অনীশা চায়ের দোকান বন্ধ করে । দোকানের সরঞ্জাম যেমন বিস্কুটের বয়াম, চায়ের কেটলি, চা-চিনি, ইত্যাদি সমস্তকিছু কাঠের বাক্সে ঢুকিয়ে তালা দিয়ে অনীশা বাড়ি ফেরে । এটা তার প্রত্যেকদিনের রুটিন ।
বুধবার রাত্রিতে ট্রেনটা ঢুকলো দেরীতে । তখন রাত্রি ৯টা ১০মিনিট । ট্রেন থেকে নেমে অন্তত বারোজন খরিদ্দার বাড়ি যাওয়ার পথে অনীশার চায়ের দোকানে চা খেতে বসে গেলো । ঐ খরিদ্দারের মধ্যে ফেকলু চা খাওয়ার দলে । ফেকলু পঞ্চায়েত রক্ষিতবাবুর একমাত্র ছেলে । বাবা পঞ্চায়েত হওয়ার সুবাদে ফেকলু নানান অসামাজিক কাজকর্মে যুক্ত । নানান অপকর্ম-কুকর্ম করে রাজনৈতিক নেতার ছেলে হওয়ার সুবাদে নিষ্কলুশ খালাস পেয়ে এলাকায় ঘুরে বেড়ায় । ভয়ে কেউ তার টিকিও ছুঁতে পারে না । এমনকি প্রকাশ্যে রাস্তার উপরে মেয়েদের শ্লীলতাহানিতে এতটুকু তার হাত কাঁপে না । অনেক সময় বয়স্থা মেয়েদের তুলে নিতেও পিছপা হয় না । খুন, রাহাজানি, মেয়েদের শ্লীলতাহানি, ইত্যাদি অসামাজিক কাজকর্মে ফেকলু সিদ্ধহস্ত । ভুক্তভোগী মানুষেরা রক্ষিতবাবুকে নালিশ জানিয়েও তাঁদের কোনো সুরাহা হয়নি । বরং উল্টে তাঁদের বিপদ বেড়েছে বই কমেনি ।
চা খাওয়ার দলে মিঁয়া গ্রামের কানাইকাকা ছিলেন । মিঁয়াগ্রামের কানাইকাকা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে অনীশার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি কখন বাড়ি ফিরবে মা ? অনেক রাত হয়ে গেলো ।“
এবার দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরব কাকা ।
আজ তোমার সঙ্গে কে যাবে ? দোকানে কাউকে তো দেখছি না ?
বাবাকে ডাক্তার দেখাতে মা হাসপাতালে গেছে ।
“সেইক্ষেত্রে তোমার দিদি কোথায় ?” কানাইকাকা উদ্বিগ্নতার সাথে পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন ।
দিদিও আসতে পারেনি । আজ আমি একাই বাড়ি ফিরব কাকা । ট্রেন লেট করার দরুন দোকান বন্ধ করতে একটু রাত হচ্ছে ।
এত রাত্রিতে একা ফিরতে পারবে তো মা ?
“হ্যাঁ কাকা । একা ফিরতে পারব । আপনি চাপ নেবেন না ।“ কানাইকাকাকে আশ্বস্ত করলো অনীশা ।
কানাইকাকা ও অনীশার কথাবার্তা শুনে ফেকলু অনীশার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছি । আমি বরং তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফিরব ।“
“আপনাকে উতলা হতে হবে না । আমি একাই বাড়ি ফিরতে পারব । আমার এভাবে বাড়ি ফেরার অভিজ্ঞতা রয়েছে ।“ অনীশা উত্তরে ফেকলুকে জানালো । অনীশা ফেকলুর গুণ্ডা-মস্তানীর কথা শুনেছে । কিন্তু তাকে কোনোদিন দেখেনি । তাই আজ সে ফেকলুকে একেবারেই চিনতে পারলো না ।
খরিদ্দারেরা যে যার বাড়ি ফিরে গেলো । কানাইকাকা দাঁড়িয়ে । অনীশার দোকান গোটানো শেষ । অনীশার বের হবার সময় দেখতে পেলো কানাইকাকা তখনও দাঁড়িয়ে । ঘড়িতে তখন রাত্রি প্রায় দশটা । কানাইকাকা ও অনীশা রাস্তায় উঠে দেখে, তখনও ফেকলু বাইকে চেপে রাস্তার উপরে দাঁড়িয়ে । অনীশার জন্য অপেক্ষায় রয়েছে ! রাস্তা ফাঁকা । লোকজনের আনাগোনা বন্ধ । রাস্তা সুনসান । রাস্তায় ওঠামাত্র ফেকলু অনীশাকে বলল, “বাইকে ওঠো ।“
কানাইকাকার ফেকলুর দুশ্চরিত্রের নাড়িনক্ষত্র জানা । ফেকলুকে কানাইকাকা বললেন, “তুমি যাও বাছা ! আমি বরং অনীশাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি ।“
অনীশা দাঁড়িয়ে থাকা ফেকলু ও কানাইকাকাকে বলল, “আপনাদের কাউকে আমার সঙ্গে যেতে হবে না । আমি একাই বাড়ি ফিরে যেতে পারব ।“
ফেকলু এবার গলা চড়িয়ে বলল, “কথা না বাড়িয়ে আমার বাইকের পেছনে চুপচাপ উঠে বসো । “
অনীশা ফেকলুর দিকে তাকিয়ে দেখলো সে তার নিজের মধ্যে নেই । তার চোখ দুটি লাল । তাকে বাইকে তুলতে মরিয়া । ফেকলুর উদ্দেশ্য ক্রমশ অনীশার কাছে পরিষ্কার, তাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার নামে ফেকলুর অন্য ধান্দা । তাই ফেকলুকে বলল, “দাদা, আপনি বাড়ি যান । আমি প্রয়োজন হলে কানাইকাকাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরছি ।“
কানাইকাকা তৎক্ষণাত ফেকলুকে বললেন, “অনীশা মা আমার সাথেই বাড়ি ফিরবে । সুতরাং রাত বাড়ছে, তুমি বরং বাড়ি যাও ।“
ফেকলু রাগে ফুঁসছে । ঘোতনের উপরে ফেকলুর একটা পুরানো রাগ রয়েছে । ঘোতনকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য কয়েকবার সুযোগ খুঁজেছিল, কিন্তু ঘোতনকে ঘায়েল করতে পারেনি । তার উপস্থিত বুদ্ধি ও শক্তির কাছে ফেকলু বুঝতে পেরেছে, সে এখনও নাবালক ! কোনো পরিস্থিতিতেই ঘোতনের সঙ্গে পেরে উঠছিল না । তা ছাড়া অতি সম্প্রতি ঘোতন তার বাবা রক্ষিতবাবুকে বেধড়ক মেরেছে । সুতরাং বদলা নেওয়ার এমন সুযোগ সে হাত ছাড়া করতে চাইছে না । সরাসরি ঘোতনকে যখন কিচ্ছু করতে পারছে না, তখন পরোক্ষভাবে ওর বোনকে তুলে নিয়ে ঘোতনকে অনায়াসে জব্দ করা সহজ হবে । তা ছাড়া উদ্দাম যৌবনশ্রী মেয়েকে হাতের মুঠোয় পেয়ে একটা আলাদা আনন্দ উপভোগ করা যাবে । সেখানে কানাইবুড়োর মাতব্বরি তার বরদাস্ত হচ্ছে না । রাগে ফেকলু জ্বলছে । তাই কানাইকাকার ধানাই-পানাই অবলোকন করে ফেকলু আর সময় নষ্ট করলো না । একরকম জোর করে অনীশাকে বাইকের পেছনে বসালো । তারপর কানাইকাকাকে লাথি মেরে রাস্তার উপরে ফেলে দিয়ে বলল, “কাকা, সোজা বাড়ি যাও । আমার ব্যাপারে থানায় মুখ খুললে তোর বাড়ি থেকে কচি বৌমাকে তুলে আমার ডেরায় তুলবো । তখন দেখব তোর কতটা হিম্মৎ বৌমাকে বাঁচানো ।“
অনীশাকে বাইকে তুলে নিয়ে নিমেষের মধ্যে এলাকা ছেড়ে দূরের শহরের হোটেলে গিয়ে উঠলো ।
এদিকে কানাইকাকা ফেকলুর লাথি খেয়ে রাস্তার উপরে গড়াগড়ি । তারপর সোজা হয়ে দাঁড়ালেন এবং মনে মনে ভাবলেন, এক্ষুণি কঙ্কাবতীকে না জানালে অনীশাকে বাঁচানো কঠিন হয়ে দাঁড়াবে । কানাইকাকা ঐ রাত্রিতে ছুটলো চড়ুইডাঙা গ্রামে । ফেকলুর হাত থেকে অনীশাকে উদ্ধার করতে না পারলে অনীশার বিষম বিপদ ! তখনি হন্তদন্ত হয়ে রাত্রিবেলায় কঙ্কাবতীর বাড়ির সদর দরজায় গিয়ে কড়া নাড়লো কানাইকাকা ।
তখন কঙ্কাবতী ছেলে-মেয়েদের খাবার দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে । কিছুক্ষণ আগে ফিরেছে মনীষা ও ঘোতন । হাসপাতাল থেকে ফিরে কঙ্কাবতী ও বৌমা রাতের খাবার গোছাচ্ছে । অনীশা ফিরলেই সবাইকে খেতে ডাকবে, ঠিক সেই মুহুর্তে কড়া নাড়ার আওয়াজ !
“কে ? এত রাত্রিতে কে কড়া নাড়ছে ?” রান্না ঘর থেকে কঙ্কাবতীর আওয়াজ । মনীষা ও বিপাশা একটা ঘরে বসা । বিপাশা ঘরে বসে বইয়ের পৃষ্টা উল্টাচ্ছে । অন্যদিকে তানিশা তার বড় ভাইয়ের সঙ্গে গল্পগুজবে মত্ত । বোনের ফেরার দিকে তাকিয়ে ঘোতন একবার ঘর আর একবার বাহির করছে । অনীশার জন্য ঘোতনের উদ্বিগ্নতা চূড়ান্ত । বাড়ি ফিরতে এতটা রাত্রি সাধারণত অনীশা করে না । বোনের ফেরার ব্যাপারে ঘোতন বেশী উতলা হয়ে পড়ছে । যার জন্য ঘোতন কয়েকবার মাকে বলল, অনীশাকে আনতে যেতে । কিন্তু কঙ্কাবতী তাকে বাধা দিলো । কঙ্কাবতীর বক্তব্য, অনীশা যথেষ্ট বুদ্ধিমতী ও সাহসী । একাই বাড়ি ফিরতে পারবে । তা ছাড়া রাত্রিও বেশী হয়নি । মায়ের নিষেধের জন্য ঘোতন আর স্টেশনের দিকে পা বাড়ায়নি । কিন্তু বোনের বাড়ি ফেরার জন্য তার ছটফট ।
“আমি, আমি মিঁয়াগ্রামের কানাই দরাণী ।“ কানাইকাকা বললেন ।
কঙ্কাবতী কানাইকাকার নাম শুনে একরকম ছুটে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা কানাইকাকার সামনে । এবার কঙ্কাবতী উতলা হয়ে পড়লো । কঙ্কাবতী জানে, কানাইকাকা স্টেশন লাগোয়া মিঁয়া গ্রামে থাকেন । তাদের পরিবারের হিতাকাক্ষ্মী । জায়গাটা কেনার সময় কানাইকাকা তাদের প্রভুত সহযোগিতা করেছেন । তা ছাড়া নাসিরুদ্দিনের সাথে কানাইকাকার সখ্যতা দীর্ঘদিনের । কানাইকাকাকে দেখে কঙ্কাবতী উদ্বিগ্ন মুখে জিজ্ঞাসা করলো, “কাকা, হঠাৎ !”
কানাইকাকার চোখে জল । তিনি হাউ হাউ করে কেঁদে দিলেন । কান্না থামাতে পারছেন না । কানাইকাকার কান্না শুনে বাড়ির সবাই বাইরে এসে দাঁড়ালো, তাঁর কী হয়েছে শোনার জন্য ।
“অনীশাকে ফেকলু বাইকে তুলে উধাও ।“
কঙ্কাবতী শোনা মাত্র ধপাস্‌ করে মাটিতে বসে পড়লো । অন্যদিকে মনীষা রাগে গজরাচ্ছে ! ঘোতন শোনা মাত্র স্থির থাকতে পারলো না । কানাইকাকার মুখ থেকে ফেকলুর নাম উচ্চারণ হওয়ার সাথে সাথে ঘোতন সাইকেল নিয়ে ছুটলো । রাস্তায় তার বন্ধু পিতাম্বরের বাড়ি । পিতাম্বরের বাইকে দুজনে ছুটলো অনীশাকে উদ্ধারে । ঘোতন জানে, ফেকলুর ডেরাগুলি । কেননা ইতিপূর্বে বেশ কয়েকবার ঘোতনের হাতে হ্যাকল হয়েছে ফেকলু । যার জন্য ফেকলুর ডেরাগুলি ঘোতনের নখদর্পণে ।
বাইক চালিয়ে প্রথমেই ঢুকলো শক্তিপুরের কেবলুর ডেরায় । সেখানে জানতে পারলো, ফেকলু নগদ টাকার জন্য এসেছিল বটে কিন্তু তারপর বাইকের পেছনে বসা মেয়েটাকে নিয়ে রাতের অন্ধকারে অন্যত্র চলে গেছে । কোথায় গেছে সেসব কিচ্ছু বলে যায়নি ।
তারা পালালো কোন্‌ দিকে ?
“সেটাও তারা জানে না ।“ কেবলু ঘোতনের প্রশ্নের উত্তরে জানালো ।
এবার ছুটলো সালারের দিকে । অত রাত্রিতে সালার যাওয়াও সমস্যা । কিন্তু বোনকে বাঁচাতে সালার যাওয়া ছাড়া ঘোতনের অন্য উপায় নেই । রাস্তাঘাট চেনা থাকায় ঘোতনের বাইক চালাতে অসুবিধা হচ্ছে না । দ্রতগতিতে বাইক নিয়ে ছুটছে ঘোতন । তার টার্গেট, রাতের মধ্যেই বেয়াদপ ফেকলুর হাত থেকে বোনকে উদ্ধার করা ।
 (চলবে)