“…পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত মানুষ…জীবনের প্রথম সিনেমাতেই…নিঃস্বার্থ ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন…আদর্শ কে আঁকড়ে…বহিঃপ্রকাশ ঘটলো অবিরত কান্নায়…”
২০০৩ এর ডিসেম্বর বা ২০০৪ এর জানুয়ারি মাসের কোনো এক দুপুর। বন্ধু পবিত্রর ডাক পেলাম সিনেমা দেখতে যাবার। এদিকে পকেটে পয়সা নেই। কিন্তু চিন্তারও কোনো কারণ নেই, কারন এই সিনেমাটা নাকি ওই দেখাবে। কি সিনেমা, কে কে আছে জিজ্ঞেস করায় বলল আগে তো আয়, নিজেই দেখবি। গন্তব্য চেতলার অহীন্দ্র মঞ্চ। এরম নামে যে কোনো সিনেমা হল আছে কলকাতায় তার আগে জানতামই না। লোককে জিজ্ঞেস করে করে পৌঁছালাম। টিকিট কেটে হল এ ঢুকে দেখি আমরা দুজন বাদে আর জনা দুয়েক মানুষ। হলের পরিবেশ ও খুব একটা ভালো কিছু নয়। একটা চাপা অস্বস্তি যে হচ্ছিলো না, তা বলা যায় না। মনে মনে ভাবছিলাম কি দেখাতে নিয়ে এলো পবিত্র। কিন্তু এর পরের দুঘন্টা যা যা দেখলাম, শুনলাম, উপলব্ধি করলাম তার বহিঃপ্রকাশ ঘটলো অবিরত কান্নায়। যেকোনো সিনেমার সাথেই একাত্ম হয়ে গিয়ে আবেগ তাড়িত হবার অভ্যেস আমাদের দুজনেরই ছিল। আর সিনেমা আমার প্রাণ। কিন্তু সেদিনটা যেন সব বাঁধ ভেঙে দিলো। হল থেকে বেড়িয়ে প্রায় এক ঘন্টা নিশ্চুপে হেঁটেছিলাম। জানতে পারলাম এই সিনেমাটা পবিত্র আগেও একবার দেখেছে। আর পরবর্তীতে আমিও দেখেছিলাম তৎকালীন বান্ধবীর সাথে। আর যতবারই দেখেছি একই অনুভূতি হয়েছে। একটা সহজ সরল গল্প, একজন সাদামাটা দেখতে হিরো, একজন নামকরা অভিনেত্রীর প্রায় পাশের বাড়ির মেয়ের মত মেকআপ, পরিচিত হলেও খুব নাম করা নয় এমন গায়ক গায়িকা অর্থাৎ সিনেমা হিট করানোর কোনো গুণই নেই। অথচ সেই সিনেমার “আলো” আমি আজও আমার চোখে ধরে রেখেছি।
প্রায় ১৫ বছর বাদে ২৪ শে জুন ২০১৮ সালে হায়দ্রাবাদের প্রসাদ ফিল্মস থিয়েটার হলে মুখোমুখি হলাম সেই ব্যক্তির সাথে, যিনি ছিলেন আমার দেখা ওই সিনেমার পরিচালক, বাংলা চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম শিক্ষিত, ভদ্র ও আদর্শবান মানুষ। হায়দ্রাবাদ বেঙ্গলি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল এ তিনি ছিলেন আমন্ত্রিত, আর আমি উপস্থিত ছিলাম আমাদের দুটো শর্ট ফিল্ম প্রদর্শনীর জন্য মনোনয়ন পাবার কারণে। মাঝে সেতুর কাজ করে দিলেন আরেক পরিচালক তথা অভিনেতা অভিজিৎ গুহ দা। পরিচয় করিয়ে দিলেন উঠতি পরিচালক তথা অভিনেতা হিসেবে। তারপর নয় নয় করে ঘন্টা দুই নির্ভেজাল আড্ডা, সিনেমার খুঁটিনাটি বহু কিছু নিয়ে কৌতুহলী মনের কৌতুহল নিবৃত্তি। অবাক হয়ে গেলাম একজন পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত মানুষ এক অনামি নাতির বয়সী ছেলেকে আপনি করে সম্মোধন করছেন। যেখানে সামান্য নাম হতেই মানুষ অবহেলার সুরে কথা বলে, সেখানে তিনি সত্যি বেমানান। তাই হয়তো তাঁর অসংখ্য সুপারহিট সিনেমা থাকার পরেও তাঁকে নিয়ে মাতামাতি হয়নি বা হয়না। ৪ টে ন্যাশনাল এওয়ার্ড পাবার পরেও তিনি এলিট পরিচালক দের ব্র্যাকেটে নিজেকে রাখেন না। তাঁর মুখেই শুনেছিলাম কিভাবে তিনি ও তাঁর কলেজের বন্ধুরা “পথের পাঁচালি” সিনেমার জন্য নিঃস্বার্থ ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন প্রচার করতে। যে কারণে সত্যজিৎ রায় পর্যন্ত তাঁকে ডেকে ধন্যবাদ দিতে বাধ্য হন। জীবনের প্রথম সিনেমাতেই সুপারস্টার উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেন কে পরিচালনা করার অনুভূতির গল্প, কিংবা বর্তমান সময়ের বাংলা সিনেমার হাল হকিকত সব কিছুই ছুঁয়ে যাবার সৌভাগ্য হয় সেদিন।
ঘটনাচক্রে সেদিন আমার অভিনীত শর্ট ফিল্ম “শ্রীচরণেষু মা” বেস্ট ফিল্ম এর পুরস্কার পায়, তাই ওনাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করার সৌভাগ্য ঘটে। কিন্তু দুঃখের বিষয় ওনাকে ছবিটা দেখাতে পারিনি। ছোটবেলায় কলকাতা থেকে পুরুলিয়া যাবার সময় ট্রেন যখন “ফুলেশ্বরী” ব্রিজের উপর দিয়ে যেত, গুনগুন করতাম অনেক দিন আগে দেখা একটা সিনেমার গান। সেদিন আমার মুখে এই কথা শুনে বাচ্চাদের মত আনন্দ পেয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন “আপনি ছবিটা দেখেছেন, কেমন লেগেছে?” ভাবুন এর কি উত্তর দেবো। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে জুনিয়র পি সি সরকারের বাড়িতে “নিমন্ত্রণ” পাওয়ার সুবাদে ওনার সাথে পরিচয় হয়েছিল বলায় বললেন “বাহ, আপনার তো স্মৃতি শক্তি দারুণ”। প্রথম পুরস্কার পাবার পর, সেদিন অনুষ্ঠানের শেষে হোটেলে খাবার জন্য আমন্ত্রণ পেলাম যখন, তখন বাদ বাকি সব পরিচিত মুখেরা যে যার পছন্দের মানুষদের সাথে বা পরবর্তীতে কাজ পেতে পারেন এরকম মানুষদের সাথে গাড়িতে যাবার জন্য ব্যস্ত তখন দেখলাম তিনি এক ধারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। একদম অনাড়ম্বর, কোনো তাড়া নেই। আর বাড়তি হিসেবে আমিও জুড়ে গেলাম তাঁর সঙ্গের গাড়িতে। এক টেবিলে বসে খেতে খেতেও অনেক গল্প হল, সবটাই আমার সৌভাগ্য।
মানুষটা আজ আমাদের ছেড়ে গেলেন “কাঁচের স্বর্গে”। কিন্তু আমাদের জন্য রেখে গেলেন অনেক কিছু। শুধুমাত্র ভালো কাজ করে আর আদর্শ কে আঁকড়ে কিভাবে বেঁচে থাকা যায় তার জলজ্যান্ত নিদর্শন ছিলেন তিনি। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে তাঁর মত করে চলতে পারা খুব কঠিন। অথচ তাঁর বানানো সিনেমা গুলো কত সহজ সরল একেবারে যেন মনের কথা বলে দেয়। মৃত্যুর পরেও তিনি চাননি তাঁকে নিয়ে শোরগোল হোক। তাই নিশ্চুপে দেহদান করে গেলেন। ছোট বেলার ছুটি ছুটি তে দেখা “শ্রীমান পৃথ্বীরাজ” আজ “পলাতক”। “শহর থেকে দূরে” হয়তো কোনো “পথভোলা” পথিক এখনও “আলোর পিপাসায়” “চাঁদের বাড়ি” খুঁজে চলেছে। আর আমরাও খুঁজে চলি এক অভিভাবক পরিচালক কে, যিনি এই ক্ষয়ে যাওয়া সমাজে আজও ‘তরুণ’।
কলমে : অনিরূদ্ধ চট্টোপাধ্যায়।
সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার ও ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম মেকার।