সুভাষ চন্দ্র দাশ, ক্যানিং –সুন্দরবনের প্রবেশদ্বার ক্যানিং শহর দিয়ে প্রতিদিনই দেশ-বিদেশের পর্যটক সহ লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষ চলাচলা করে ট্রেন কিংবা বাস,অটো,ম্যাজিক গাড়ির মতো পরিবহন ব্যবস্থার মাধ্যমে।যাতায়াতের রাস্তার দুপাশে সাধারণ মানুষের ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের পাহাড় জমছে।ছড়িয়ে পড়ছে দূষণ।সেই ঐতিহ্যবাহী শহরকে প্লাস্টিক মুক্ত শহর গড়তে রাতের অন্ধাকের তৎপরতা দেখা গোলো সুন্দরবনের প্রবেশদ্বার নামে খ্যাত বিট্রীশ আমলের ঐতিহ্যবাহী ক্যানিং শহরে।নিয়ম করেই প্রতিদিন রাতে এই শহরের বাজার,অলিগলি,রাজপথ ঝাঁটা দিয়ে ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করা হয় স্থানীয় ক্যানিং ব্রীজ রোড ব্যবসায়ী সমিতির উদ্যোগে।বর্তমানে পরিবেশের সুরক্ষার জন্য রাজ্য সরকার প্লাস্টিকের উপর নিষেধাঞ্জা জারি করেছে। সরকারের সেই নির্দেশ কে মান্যতা দিয়ে স্থানীয় ক্যানিং ব্রীজরোড ব্যবসায়ী সমিতি প্লাস্টিক মুক্ত ক্যানিং শহর গড়ার উদ্যোগ নেয়। সমিতির তরফ থেকে প্লাস্টিক বর্জন করার জন্য দোকানদারদের কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ক্যানিং ব্রীজরোড ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক সোনাই মোল্লা বলেন ‘ক্যানিং শহর দিয়ে প্রতিয়ত লক্ষ লক্ষ মানুষজন যাতায়াত করেন।যত্তত্র প্লাস্টিকের ছড়াছড়ি। যাতে করে প্লাস্টিক ও আবর্জনা মুক্ত ক্যানিং শহর গড়ে তোলা যায় সেই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ’
উল্লেখ্য এই ক্যানিং শহর কে বাণিজ্য কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলেন তৎকালীন ব্রিটিশ আমলের প্রথম বড়লাট লর্ড ডালহৌসি সাহেব।মূলত তাঁর উদ্যোগে ও একান্ত প্রচেষ্টায় বৃহত্তম ব-দ্বীপ গহীণ অরণ্য সুন্দরবনের জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করে প্রথম তৈরী হয় পোর্ট ক্যানিং। তখন অবশ্য গঙ্গার নদীর নাব্যতা ক্রমশঃ হ্রাস হওয়ায় পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যপথ অসুবিধা হয়।আর এই কারণে দক্ষিণের বৃহত্তম গভীর মাতলা নদীকেই বাণিজ্যপথ কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল।
১৮৫৩ সালে প্রথম শুরু হয় মাতলা নদীর তীরে মাতলা গ্রামকে বাণিজ্যকেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলার কাজ। প্রচুর কর্মী ও শিকারী আসেন। নদীর পশ্চিমে প্রায় ৮ কিলোমিটার নদী বাঁধ দিয়ে ঘেরা হয়।অতীতে এখানে একটা সময় প্রচুর বাঘের আনাগোনা ছিল।আর প্রতি বাঘ পিছু শিকারীদের পারিশ্রমিক ছিল পাঁচ টাকা। ১৮৫৬ সালে এই কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন হয়। তৈরি হয় নতুন জেটি ঘাট, নদীবাঁধ, খাল, বাজারহাট। তখন বড়লাট হয়ে আসেন লর্ড ক্যানিং সাহেব। তিনিই ১৮৫৮ সালে আনুষ্ঠানিক ভাবে এই পোর্ট ক্যানিংয়ের সূচনা করেন।
১৮৬২ সালে ক্যানিং (পূর্ব নাম -পোর্ট ক্যানিং) পৌরসভা হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে। নাম হয় ক্যানিং মিউনিসিপালিটি। আর এই একমাত্র ক্যানিং পৌরসভা নিয়ে একটি কথা বলে রাখা ভালো “এক মাত্র ক্যানিং শহর যা দেশ তথা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল থেকে বিরলতম ঘটনা পৌরসভার স্বীকৃতি অবলুপ্তি হয়ে আজ পঞ্চায়েতে শাসনে বিরাজমান।যা দেশ তথা পৃথিবীর কোনপ্রান্তে এমন ঘটনা কোথাও ঘটেনি।
১৮৬৩ সালে ক্যানিং পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারিত হয় এবং আনুষ্ঠানিক ভাবে রেল চালু হয়।একই বছরে ক্যানিংয়ে প্রথম জাহাজ প্রবেশ করে কথা ছিল। কিন্তু ক্যানিং নদীর উপর সেতু নির্মাণ করে আরো সাত মাইল পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণ করা হবে। কিন্তু ততকালীন প্রথম ভাইসরয় লর্ড ক্যানিংয়ের প্রবল অনিচ্ছা ও উদাসীনতায় তা আর সম্ভবপর হয়নি। ১৫৭ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও আজও সেই স্বপ্ন অধরা রয়েই গেছে।
ছোট লাট ও ভারতের প্রথম ভাইসরয় লর্ড ক্যানিংয়ের নাম অনুসারে নাম হয় ক্যানিং। তৎকালীন মাতলা নদীর তীরে বানিজ্যের আমদানি রপ্তানি হিসাবের সুবিধার্থে একটি দ্বিতল কক্ষ নির্মাণ করা হয়, যা অধুনা ক্যানিং সাহেবের বাংলো হিসাবে পরিচিত। তা বর্তমানে পরিত্যক্ত হিসাবে রয়েছে (ক্যানিং গোলকুঠি পাড়া)।ক্যানিং সাহেব এখানে ছিলেন কিনা সে বিষয়ে প্রচুর বিতর্কও রয়েছে। তবে লেডি ক্যানিং এখানে এসেছিলেন। নদী পরিবেষ্টিত নোনা আবহাওয়া ও গ্রাম্য প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে উনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। মুগ্ধ হয়ে তিনি বেশ কিছু তৈল চিত্র অঙ্কন করেছিলেন। ওনাকে খুশী করার জন্য তখন স্থানীয়রা দুধ চিনি ময়দা সহযোগে ওনাকে একপ্রকার মিষ্টি তৈরী করে খাইয়ে ছিলেন যা খেয়ে তিনি অত্যন্ত প্রীত হোন।মূলতঃ ওনার নাম থেকেই সেই মিষ্টির নাম হয় লেডি ক্যানিং। যা পরবর্তীতে অপভ্ৰংশ হয়ে ‘লেডিকেনি’ হিসাবে পরিচিতি লাভ করে।সেদিক দিয়েও ক্যানিংবাসীর গর্ব।সুস্বাদু মিষ্টি লেডিকেনি বাংলার আবিষ্কার।