কঙ্কাবতীর দুঃসাহস (ধারাবাহিক উপন্যাস, ষষ্ঠ পর্ব) : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

0
428
 মনীষা খুব চিন্তিত । বাড়িতে এতগুলি মানুষ । উপায়ের জায়গাটা দুর্বল । মা সব্জি নিয়ে গাঁয়ে গঞ্জে বিক্রি করে এবং  সেখানকার আয়ে মূলত সংসার চলে । অনীশার চায়ের দোকানে যেটুকু আয়, পুরোটাই চলে যায় দোকান ঘর তৈরীর কাজে । দোকানের জায়গাটা সম্প্রতি ইটের প্রাচীর দিয়ে ঘেরা হয়েছে । এখন সেখানে দো-তলা বিল্ডিং বানাবার পরিকল্পনা । কেননা উপরের ঘরে ঘোতনের কাপড়ের দোকান খোলার চিন্তাভাবনা  । তাই  দোকান ঘর বানানোর জন্য অনীশা উঠে-পড়ে লেগেছে । অনীশার একটাই শান্তি, এই মুহূর্তে তার চায়ের দোকান ভাল চলছে । বলা চলে স্টেশনের অন্যান্য দোকানের চেয়ে তার দোকান বেশী  চালু  । অন্যদিকে তানিশার দোকানে তেমন আয় নেই । কোনোরকমে তানিশার টেলারিং দোকান চলছে । তবে ধীরে ধীরে তানিশার পুঁজি বাড়ছে । আর একটা সেলাই মেশিন কেনার দিকে ঝোঁক ! তানিশার বিশ্বাস, আর একটা সেলাই মেশিন কিনতে পারলে দোকানে  আয় বাড়বে । যার জন্য তানিশার  টাকা জমানোর দিকে বেশী নজর । মনীষার বাবা অসুস্থতার জন্য কোনো কাজ করতে পারছে না । ফলে তাদের চার বোনকেই সংসারের স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে বেশী ভাবতে  হচ্ছে । বিশেষ করে মনীষার এই মুহূর্তে চিন্তা, কীভাবে সে সংসারের হিতার্থে নিজেকে উজার করে দেবে  ? 
  মিঁয়া স্টেশনে এখন সমস্ত লোকাল ট্রেন দাঁড়ায় । একমাত্র দূরপাল্লার এক্সপ্রেস ট্রেন দাঁড়ায় না । বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের ও গৌহাটির এক্সপ্রেস ট্রেনের স্টপেজ নেই । আর তা ছাড়া সবগুলি লোকাল ট্রেন মিঁয়া স্টেশনে দাঁড়ায় । তাই মনীষা মনস্থির  করলো,  ট্রেনে হকারি করবে । হকারির ব্যবসায় খুব একটা পুঁজির দরকার নেই । পাকা কলা, আপেল, পেয়ারা, অথবা  চা  বা অন্যান্য সামগ্রী বিক্রি করার চেয়ে ভাজাভুজি বিক্রি করা মনীষার পক্ষে উপযুক্ত । অবিক্রিত ভাজাভুজি নষ্ট হওয়ার সুযোগ কম । তা ছাড়া ভাজাভুজির কারখানার মালিকের দোকান সালারে । কারখানার মালিক মনীষাকে আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, “প্রয়োজন মতো যখন যতটা মাল দরকার নিয়ে যেতে এবং বিক্রির পরে টাকা মেটাতে । তবে পরিষ্কারভাবে তিনি আরও একটা কথা বলেছেন, আগের টাকা শোধ না হওয়া পর্যন্ত পুনরায় সে মাল তুলতে পারবে না ।“ সালারের কারখানায় চানাচুর, বাদাম, চিড়ে ভাজা, চাল (দেরাদুন-রাইস) ভাজা, নিমকী, মান-কচু ভাজা, ডাল ভাজা, ইত্যাদি সব পাওয়া যায় । ট্রেনের হকারিতে বাদাম ভাজা খুব চলে । এছাড়া চানাচুর, ভুজিয়া,  চিড়ে ভাজা, ডাল ভাজাও খুব কাটতি । মনীষা সুদ্ধান্ত নিলো, “প্রথম অবস্থায় বাদাম, ভুজিয়া ও  চিড়ে ভাজা দিয়ে হকারি শুরু করার ।“
   “বাদাম চাই, বাদাম । খোলা ছাড়ানো – মসলা মাখানো, বাদাম খান । একবার খেলে বার বার খেতে  চাইবেন, এমনই আমার বাদামের কোয়ালিটি । বাদাম চাই, বাদাম !” মিঁয়া থেকে ডাউন কাটোয়া লোকালে উঠে মনীষা হাঁকলো ।  বাদাম বিক্রির জন্য মনীষার গলার আওয়াজ শুনে ট্রেনের কামরার সমস্ত প্যাসেঞ্জার হতবাক ! সকলে ঔৎসুক দৃষ্টিতে  মনীষার দিকে তাকালেন । তাকানোর কায়দাটা এমনই, কালে কালে কতো দেখব ! মেয়েদের ট্রেনে হকারি ! কোনো কালে শুনিনি, “বয়স্থা মেয়েরা ট্রেনে উঠে কামরার ভিতরে হকারি করে । ভিড় ট্রেনে নিজেকে বাঁচিয়ে মেয়েটা কীভাবে হকারি করবে ?” এটাই এখন প্যাসেঞ্জারদের মধ্যে গুঞ্জন । 
   “একটি বাদামের প্যাকেট  দিন দিদি ।“ জনৈক ট্রেনের যাত্রী বাদাম চাইলেন ।
    “কেটে দেবো দাদা ?”
    হ্যাঁ, কেটে দিন । কত দাম দিতে হবে ?
    বাদামের প্যাকেটের মুখটা কেটে প্যাসেঞ্জারের দিকে এগিয়ে ধরে মনীষা বলল, “দাদা, দশ টাকা ?”  
    কেন ? বাদামের প্যাকেট মাত্র পাঁচ টাকা ! অথচ আপনি চাইছেন দশ টাকা ।
    “কী করব, দাদা । বাদামের এখন বিশাল দাম ! পাঁচ টাকায় বিক্রি করলে পড়তায় পোষাচ্ছে না । তা ছাড়া পাঁচ টাকার বাদামের প্যাকেট দেখলে আপনার মন ভরবে না । একবার খেয়ে বাদামের কোয়ালিটি দেখুন ! আমার বাদাম অনেক উন্নত ধরনের । সুতরাং খেলে আপনার মন ভরে যাবে ।“ কথাগুলি বলে মনীষা থামলো । 
    ট্রেনের প্যাসেঞ্জার ভদ্রলোক অনেক কষ্টে  ব্যাজার  মুখে  পকেট থেকে দশ টাকা বের করে দিলেন । বাদামের প্যাকেট (প্যাকেটের মুখ কাটা) হাতে নিয়ে কিছুটা বাদাম  মুখে দিয়ে তিনি খুশীতে গদ্‌গদ । পাশের প্যাসেঞ্জারের দিকে তাকিয়ে বাদাম খেতে খেতে তিনি  বললেন, “মেয়েটার বাদাম সত্যিই ভাল  । বাদামের কোয়ালিটি অনেক উন্নত ।“
   মেয়েটার দিকে তাকাতেই ট্রেনের ভদ্রলোক লক্ষ করলেন, হকার-মেয়েটি ট্রেনের দরজার কাছাকাছি  । তার গলার আওয়াজ এখনও পাওয়া যাচ্ছে, “বাদাম চাই, বাদাম ।“ 
     প্রথম দিন মনীষার বিক্রিবাট্টা সেরকম কিছু  হলো না । পাতে দেওয়ার মতো একদম বিক্রি হয়নি  । তবুও মনীষা হতাশ নয় । শারীরিক পরিশ্রমে করে অর্থ উপার্জন মনীষার জীবনে এটাই প্রথম । তাই মনীষার মন খুশীতে ভরপুর । নিজের প্রচেষ্টায় উপার্জন । পরের দিনের জন্য আবার প্রস্তুতি । 
   পরের দিন ট্রেনে ওঠামাত্রই একজন পেয়ারা বিক্রেতা হকার, নাম সুখেন,  মনীষাকে দেখেই বলল, “তুমি কী হকার্স ইউনিয়নের মেম্বার হয়েছ ?” 
    মনীষা  হা করে খানিকক্ষণ সুখেনের দিকে তাকিয়ে রইল । ব্যাপারটা মনীষা তখনও বুঝতে পারেনি । যার জন্য তার মনের ভিতর  ধন্দে । লোকটা বলে কী ? ট্রেনে হকারি করছি তাতে আবার  ইউনিয়নের মেম্বার হওয়ার প্রশ্ন কেন ? 
    মনীষার নীরবতা অবলোকন করে সুখেন পুনরায় বলল, “ট্রেনে হকারি করতে হলে ট্রেনের হকার্স ইউনিয়নের মেম্বার হওয়া বাধ্যতামূলক । সুতরাং তোমাকে সত্বর মেম্বারশিপ নিতে হবে । নতুবা ট্রেনে হকারি করা চলবে না ।“
    “আপনার নামটা কী দাদা ?”  চোখ বড় করে মনীষা নামটা জিজ্ঞাসা করলো ।
  “আমার নাম সুখেন । আমি ‘কাটোয়া-আজিমগঞ্জ’ রুটের হকার্স ইউনিয়নের সেক্রেটারি ।“ সুখেন বুক ফুলিয়ে মনীষার কাছে তার পদমর্যাদার কথা ব্যক্ত করে গর্বে উৎফুল্ল ! মনীষা সুখেনের হাবভাব দেখে বুঝতে পারলো, তার ঠাটবাট খানিকটা  হকার্স ইউনিয়নের বড় নেতার মতো  ।
   এবার মনীষা বেশ সুর চড়িয়ে সুখেনকে বলল, “শুনুন সুখেনদা, আপনি হকার্স ইউনিয়নের মেম্বার হওয়ার জন্য এতক্ষণ যে অনুরোধ করছিলেন, সেটার জন্য আমি মেম্বারশিপ নেওয়ার কথা ভাবছিলাম । কিন্তু শেষে যে কথাটা বললেন, মেম্বার না হলে ট্রেনে হকারি করতে দেবেন না, তাতে আমি আপনার সাথে একমত হতে পারলাম না । বরং মনে কষ্ট পেলাম । তবে আমার সিদ্ধান্তের কথা পরিষ্কার করে জেনে রাখুন, “এই মুহূর্তে আমি আপনাদের হকার্স ইউনিয়নের মেম্বার হচ্ছি না এবং অন্যদিকে  ট্রেনে নিয়মিত হকারি করবো । আপনাদের ক্ষমতা থাকলে আমার হকারি  বন্ধ করে দেবেন, তখন দেখব আপনাদের কতটা হকার্স ইউনিয়নের পাওয়ার ।“ বেশী উল্টোপাল্টা কথা শোনাতে আসবেন না । আমার নাম মনীষা । আমি  মিঁয়া স্টেশনের মেয়ে । আপনাদের ঐসব ভয়ডর অন্যদের দেখাবেন । আমাকে দেখাতে আসবেন না । নতুবা হিতে বিপরীত হবে । তখন আপনাকে ভাবতে হবে, আপনি নিজেই  ট্রেনে হকারি করতে পারবেন কিনা ? যতই আপনি সেক্রেটারি হন না কেন, আপনাদের ঐসব সেক্রেটারির জুজুর ভয় আমাকে দেখিয়ে লাভ নেই । 
  কথাগুলি সুখেনকে বলে মনীষা হাঁকতে শুরু করলো, “বাদাম চাই, বাদাম !”
  অন্যদিকে সুখেন মনীষার কথার ঝাঁঝ অনুধাবন করে বিচলিত !  মেয়েটার এত সাহস কীকরে হলো, সেটাই সুখেনের কল্পনার অতীত । সুখেন বেচাকেনা বাদ দিয়ে প্রমাদ গুণতে থাকলো, কীভাবে মেয়েটাকে জব্দ করা যায় ? কথার ঝাঁঝে সুখেনের অনুমান, মেয়েটার পেছনে লোকবল আছে । নতুবা ঐভাবে তার মুখের উপর কথা শোনাতে পারত না । সুতরাং তাকে সমস্ত দিক চিন্তাভাবনা করে এগোতে হবে । সুখেন রাগে ফুঁসছে । মেম্বারশিপ নেওয়ার কথা বলতে গিয়ে মেয়েটার কাছে উল্টে সে অপমানিত হলো । মহিলা হকারের কাছে এই প্রথম সুখেন অপমানিত হলো । তাই সহজে ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছে না । মেয়েটাকে সমুচিত শিক্ষা না  দেওয়া পর্যন্ত তার শান্তি নেই ।  মনীষার প্রতি সুখেনের আক্রোশ বেড়ে গেলো । এবার বদলা নেওয়ার সুযোগের অপেক্ষায় ! 
   মনীষা খোশমেজাজে ট্রেনের এক কামরা থেকে অন্য কামরা এবং এক ট্রেন থেকে অন্য ট্রেনে ঘোরাঘুরি করে তার ভাজাভুজি বিক্রি শুরু করে দিলো । পরের  কাটোয়াগামী ট্রেনটা যথেষ্ট ভিড়  । ট্রেনে ভিড় থাকলে প্যাসেঞ্জারদের ঠেলাঠেলি, হুটোপাটি স্বাভাবিকভাবে  বেশী । ভিড় ঠেলে হকারি করা মনীষার পক্ষে সত্যিই কষ্টের । একেই উঠতি বয়সের মেয়ে, তার উপর হকার । সুতরাং মহিলা হকারকে নিয়ে সাধারণ প্যাসেঞ্জারদের কৌতুহল বেশী । তা ছাড়া কাটোয়া-আজিমগঞ্জ লাইনের ট্রেনে এযাবৎ কোনো মহিলা হকার ছিল না । সেখানে মনীষা প্রথম মহিলা হকার । স্বাভাবিকভাবে মহিলা হকারের চালচলন, আদবকায়দা, ঠাটবাট, ভাজাভুজি বিক্রি করার কায়দাকানুন দেখতে মানুষ খুব উৎসুক ! 
    দিদি, এক প্যাকেট মুগ ডাল ভাজা দেবেন ?
    প্যাকেট কেটে দেবো দাদা ?
    হ্যাঁ, প্যাকেট কেটে দেবেন । কত দিতে হবে ?   
    দশ টাকা ।
    দশ টাকা কেন ? সবাই তো পাঁচ টাকা নেয় । 
    আমার কাছ থেকে যে কোনো ভাজার প্যাকেট কিনলেই দশ টাকা ।
    বড্ড বেশী দাম নিচ্ছেন দিদি ?
    প্যাকেটে মুগ ডালের পরিমান বেশী । ঐ পরিমান কাঁচা মুগ ডাল কিনতে গেলে প্রায় আট টাকা । সোনা মুগ ডালের দাম বাজারে সবচেয়ে বেশী । তার উপর কড়াইতে ভাজা, প্যাকেটিং করা এবং ঘুরে ঘুরে বিক্রি করা । পয়সার সঙ্গে তুলনা করলে এক প্যাকেট মুগ ডাল ভাজা বিক্রি করে লাভ কিছুই থাকে না । সুতরাং আমি দাম বেশী নিচ্ছি না, দাদা । বরং আমি অল্প দামে আপনাদের উন্নত মানের ভাজা খাওয়াচ্ছি । আপনি অন্য কোনো হকারের কাছ থেকে একটা মুগ ডাল ভাজা খেয়ে দেখুন এবং তারপর আমার মুগ ডাল ভাজা খান, তাহলেই তুলনাটা বুঝতে পারবেন কোন্‌টার গুণমান কতটা  ভাল ? 
    “বাদাম চাই, বাদাম !”   হাঁক দিয়ে কামরার অন্যত্র চলে গেলো ।
     আবার সুখেনের সঙ্গে দেখা ।  সুখেন চোখ গরম করে মনীষার দিকে তাকালো । মুখে কিছু বলল না । কিন্তু শারীরিক ভাষায় বোঝাতে চাইলো, সকালে মনীষার  ব্যবহারে সে রুষ্ট !  চটে অস্থির ! মনীষাও তেমনি । মুখ ভেংচিয়ে স্থান ত্যাগ  । 
     যত দিন যাচ্ছে মনীষার হকারি ব্যবসার রমরমা বাড়ছে । বেচাকেনা বর্ধমান । তবুও হকারিতে মনীষা স্বচ্ছন্দ নয় । মহিলা হওয়ার কারণে অনেকরকম অসুবিধার মুখোমুখি হচ্ছে, যেটা তার পক্ষে বোঝানো কঠিন ! 
      সেদিন  সোমবার । সোমবার দিন মনীষা ভোরের ট্রেন ধরে । কেননা সেই ট্রেনে অনেক প্যাসেঞ্জারের যাতায়াত । কেননা শনিবার রাতে যেসব কলকাতার অফিসযাত্রী বাড়ি এসেছিল, তাঁরা  কলকাতা ফিরে যাচ্ছে । তা ছাড়া ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা সকালের ট্রেনে কলকাতার বড়বাজারে মাল আনতে যায় । ঐ ট্রেনটাতে  মনীষার কাছে চেনাজানা প্যাসেঞ্জারদের  চিড়ে ভাজার  দাবি থাকে ।  তাই মনীষা মূলত সোমবারের সকালের ট্রেনের জন্য চিড়ে ভাজাটা বেশী রাখে । প্যাসেঞ্জারেরা চিড়ে ভাজার সাথে  সকালের চা খেতে ভীষণ ভালবাসেন । যার জন্য খুব ভোরে মনীষাকে বিছানা থেকে উঠে স্টেশনে ছুটতে হয় । সেদিন অন্যান্য  সোমবার দিনের মতো মনীষা শুধুমাত্র চিড়ে ও বাদামের প্যাকেট নিয়ে কেবল ট্রেনে উঠেছে । খুব ভোরের ট্রেন, তাই সঠিক সময়ে ট্রেনটি মিঁয়া স্টেশনে ঢুকলো । তখনও অন্ধকার ।  ট্রেনের কামরায় পা রেখে মনীষা অবাক ! ট্রেনে ঠাসাঠাসি ভিড় । পা রাখার জায়গা নেই বললেই চলে । ভিড়ের কারণ জানা গেলো, কলকাতায় শাসক গোষ্ঠীর রাজনৈতিক দলের মিটিং ।  কাতারে কাতারে মানুষ কলকাতাগামী । কামরার ভিতরে তিল ধারনের জায়গা নেই । হৈচৈ, কলরব অনবরত । মাঝে মাঝে দলীয় সমর্থকদের স্লোগান । 
     ট্রেনের চা বিক্রেতা ননীদা  প্রতি সোমবার মিঁয়া স্টেশনে নেমে মনীষার সাথে এক কামরায় ওঠে । কেননা বেশীর ভাগ যাত্রী চিড়ে ভাজা খাওয়ার পর চায়ের খোঁজ করেন । সেদিনও তার অন্যথা হয়নি । ননীদা গরম চায়ের কেটলি নিয়ে মনীষার পেছন পেছন উঠলো । ননীদাও অত লোক দেখে ঘাবড়ে গেলো । কী করবে ঠাহর করতে পারছে না ননীদা ।  তাই মনীষাকে বলল, “মনীষা, চলো আমরা সালার স্টেশনে নেমে যাই । এই অবস্থায় কাটোয়া পর্যন্ত যাওয়া কঠিন !”
   মনীষা ননীদাকে উত্তরে বলল, “একটু ধৈর্য্য ধরুন । কিছু বিক্রি হবেই ।“
   এমন সময় কয়েকজন চ্যাংড়া ছেলে নিয়ে সুখেন মনীষার সামনে হাজির । সুখেন কয়েকজন অল্প বয়সের চ্যাংড়া ছেলেপুলে নিয়ে দল বেঁধে কলকাতার মিটিংয়ে যাচ্ছিল । মনীষাকে দেখেই সুখেন প্রমাদ গুণলো, “মনীষাকে টাইট দেওয়ার এটাই  সুবর্ণ সুযোগ !” তড়িৎ গতিতে মনীষার কাছে এসে  অভব্য ভাষায় সুখেন  বলল, “আজ তোকে কে বাঁচাবে ? সেদিন খুব তড়পাচ্ছিলি ! এই মুহূর্তে মেম্বারশিপ ফর্মে  সই না করলে পরের স্টেশনে তোকে নামিয়ে অন্ধকারে পালিয়ে যাব । তখন দেখব, তোর তেজ কতটা ?” 
    শোনামাত্র মনীষা এক মুহুর্ত অপেক্ষা করলো না । একেই ভাজাভুজি বিক্রি হচ্ছিল না, সেইজন্য মনটা তার অস্থির  । তার উপর সুখেনের অভব্য আচরণে মনীষা রীতিমতো তিতিবিরক্ত । সুখেনের কথা শুনে রাগে ফুঁসছিল ।  মনীষা কিছুদিন আগে পর্যন্ত ক্যারাটে শিখতো । তাই আর দেরী করলো না ।  ক্যারাটের কায়দায় সুখেনকে ট্রেনের মধ্যেই দুই পায়ের মাঝখানে লাথি ! লাথি দিয়ে চিৎকার করে মনীষা বলল, “ট্রেনের ভিতরে অসভ্যতা ! আমাকে মারার হুমকি ! তোরা এখনও মনীষার আসল রূপ দেখিসনি ! এরপরে পুনরায় আমার পেছনে লাগতে এলে তোকেই ট্রেন থেকে তাড়িয়ে ছাড়বো ।“   মনীষার লাথি খেয়ে বেচারা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে ! এবার তার চামচাগুলি মনীষাকে মারতে উদ্যত ! মনীষা ঘুষী মেরে দুটোকে কাহিল করে দিলো । ততক্ষণে ট্রেনের যাত্রীরা মনীষার পাশে  এসে দাঁড়ালেন । তারাও মনীষার হয়ে সুখেনের চামচাগুলিকে মেরে পরের স্টেশন ঝামটপুর বহরানে ঠেলে নামিয়ে দিলেন  । লাথি খেয়ে অনেক আগেই সুখেন পালিয়েছিল । ট্রেনটি সালার স্টেশনে ঢুকছে  ।  সেই সময় ননীদা মনীষাকে বলল, “তুমি এত সাহসী, তোমাকে দেখে বোঝার উপায় নেই । সুখেনকে আমরা দীর্ঘদিন থেকে চিনি । নতুন কেউ হকারিতে নামলে মেম্বারশিপের নাম করে পয়সা হাতানোর চেষ্টা । তা ছাড়া দীর্ঘদিন হকারির সেক্রেটারি থাকার সুবাদে হকার্স ইউনিয়নের ফাণ্ডের টাকার অনেক নয়ছয় করেছে । কিছুতেই হিসাব  দিতে চায় না । ফাণ্ডের ব্যাপারে কেউ মুখ খুললে তাকে ভয় দেখিয়ে দাবিয়ে রাখে । গ্রামে-গঞ্জ থেকে উঠে আসা হকারের মানুষগুলি সুখেনের ভয়ে টুঁ শব্দ করে না । তারপর আবার মনীষার দিকে তাকিয়ে পুনরায় বলল, তোমাকে কী বলে ধন্যবাদ দেবো ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না । তবে তুমি সুখেনকে যোগ্য জবাব দিয়েছ, এইজন্য তোমাকে আমার অন্তর থেকে কুর্ণিশ ! এরপরে সমস্ত হকারেরা সুখেনের বিরূদ্ধে কথা বলার সাহস পাবে । হকার্স ইউনিয়নের ফাণ্ডের অতগুলি টাকার একটা ফয়সালা করতে পারবে !” 
        অন্যদিকে মনীষার চিড়ে বাদাম কেনা নিয়ে প্যাসেঞ্জারদের মধ্যে চরম উত্তেজনা ! সূর্য পূর্ব আকাশে রক্তিম আভা নিয়ে উদীয়মান । প্যাসেঞ্জারদের  মনীষার কাছ থেকে চিড়ে বাদাম কেনার ঢল !  চিড়ের প্যাকেটে বাদাম মিশিয়ে তাঁরা খাচ্ছেন । তাঁদের খাওয়ার অভিনব কায়দা দেখে ননীদা উৎফুল্ল ।  কেটলি থেকে চা অনবরত  ঢেলে যাচ্ছে, তার চায়ের কেটলিতে চা শেষ হওয়ার পথে । কাটোয়ায় ট্রেন ঢোকার আগেই মনীষার চিড়ে-বাদাম ও ননীদার চা শেষ ! কাটোয়া থেকে কানেক্টিং  “কাটোয়া-হাওড়া” লোকাল ট্রেন ধরার জন্য প্যাসেঞ্জারদের হুটোপাটি ।  কেননা ঐ ট্রেনে উঠলে তাঁরা সোজা হাওড়া পৌঁছে অনায়াসে পার্টির মিটিংয়ে হাজির হতে পারবেন । যার জন্য প্যাসেঞ্জারদের বিশেষ করে মিছিলে যোগদানকারী মানুষদের হাওড়া যাওয়ার লোকাল ট্রেন ধরার তুমুল ব্যস্ততা  । 
  বাড়িতে ফিরে ট্রেনের সকালের ঘটনা মনীষা কাউকে কিচ্ছু বলল না ।  স্নান খাওয়া সেরে পুনরায় বাদাম, চিড়ে, চানাচুর, ভুজিয়া, ডালমুট, ইত্যাদি ভাজার প্যাকেটগুলি  বড় ব্যাগে ঢুকিয়ে স্টেশনের দিকে হাঁটা শুরু  । হকারি থেকে উপার্জিত টাকা সংসারে দিয়েও কিছু টাকা জমিয়েছে মনীষা ।  এবার ভাবছে, ঐ টাকায় একটা সাইকেল কিনবে । বাড়ি থেকে স্টেশনে হাঁটাপথে যাতায়াত ভীষণ কষ্টকর ! মনীষা প্রথমে ভেবেছিল জমানো টাকা দিয়ে অন্য ব্যবসা শুরু করবে । কেননা  ভিড় ট্রেনে হকারিতে খুব সমস্যা ! উঠতি বয়সের মেয়ে হওয়ার কারণে তাকে ছেলে-বুড়ো সকলের কুনজরে পড়তে হয় । চক্ষুলজ্জার ভয় না করে অনেক প্যাসেঞ্জার বিশেষ করে চল্লিশের কোঠার প্যাসেঞ্জারেরা মনীষাকে ভীষণ উত্ত্যক্ত করে । মনীষা টের পেলে, কাউকে রেয়াত করে না । সঙ্গে সঙ্গে ওলট-পালট শুনিয়ে দেয় । এমনকি ঐ জাতীয় বেয়াদপ যাত্রীকে হাত দিয়ে মারতে পর্যন্ত যায় । তাই মনীষা চিন্তিত ।  এইসব কারণে মনীষার ইচ্ছা, স্টেশন চত্বরে দোকান ঘর করার । সেইক্ষেত্রে মনীষার অন্তত শ্লীলতা হানির ভয় কমবে ! 
                                                                  (ক্রমশ)