আজাদ হিন্দ বাহিনির প্রথম মহিলা ক্যাবিনেট সদস্যা ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সেহগল : সৌরভকুমার ভূঞ্যা।

    0
    551

    “Freedom comes in three forms. The first is political emancipation from the conquerer, the second is economic (emancipation) and the third is social…India has only achieved the first.”

    স্বাধীনতার কয়েক দশক পেরিয়ে এসেছি আমরা। কিন্তু বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন জাগে কতখানি স্বাধীন আমরা. দেশের ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, দারিদ্র্যের ভয়ংকর থাবা, শিক্ষার ডামাডোল অবস্থা, নারী সমাজের নিরাপত্তাহীনতা, বঞ্চনা-লাঞ্ছনা, যুব সমাজের নৈতিক অবক্ষয়, সব মিলিয়ে মাঝে মাঝে মনে হয় একেই বলে স্বাধীনতা. আর তখনই লক্ষ্মী সেহগলের ওপরের কথাগুলো বড়ো বেশি প্রাসঙ্গিক মনে হয়। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ সেনানী হলেন ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সেহগল (স্বামীনাথন) যিনি ছিলেন আজাদ হিন্দ সরকারের প্রথম মহিলা ক্যাবিনেট সদস্যা। পাশাপাশি তিনি হলেন প্রথম মহিলা যিনি দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।
    ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ২৪ অক্টোবর মাদ্রাজের মালাবারে লক্ষ্মী স্বামীনাথনের জন্ম। তাঁর বাবা সুব্বারাম স্বামীনাথন ছিলেন একজন উকিল। তিনি মাদ্রাজ হাইকোর্টের উকিল। তাঁর মা এভি অম্মুকাট্টি, যিনি পরিচিত ছিলেন অম্মু স্বামীনাথন হিসেবে। তিনি ছিলেন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী ও সমাজসেবী। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তিনি গণপরিষদের সদস্য হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি মহারাষ্ট্র থেকে রাজ্যসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে লক্ষ্মী ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁর বাবা ছিলেন প্রগতিশীল চিন্তাধারার মানুষ। জাতপাত কিংবা ধর্মীয় ভেদাভেদকে যেমন তিনি প্রশ্রয় দেননি তেমনি সংসার জীবনে ছেলেমেয়েদের মধ্যে তিনি কোনো ফারাক রাখেননি। তাঁদের দুই পুত্র গোবিন্দ ও সুব্বারাম এবং কন্যা লক্ষ্মী ও মৃণালিনী, সকলকেই তিনি সমানভাবে মানুষ করেছিলেন। অম্মুকুট্টি কংগ্রেসের সদস্য হওয়ায় বাড়িতে অনেক বড়ো বড়ো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের আনাগোনা ছিল। ছোটোবেলা থেকেই লক্ষ্মী তাঁদের সংস্পর্শে এসেছিলেন। বাবা-মায়ের গুণের সংমিশ্রন দেখা যায় লক্ষ্মীর চরিত্রের মধ্যে। একদিকে তিনি যেমন ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী, অন্যদিকে ছিলেন একজন সক্রিয় সমাজসেবী ও একজন রাজনীতিবিদ।
    ছোটোবেলা থেকেই লক্ষ্মী ছিলেন অন্যদের থেকে আলাদা। তাঁর মধ্যেকার প্রতিবাদের গুণ সেইশৈশব থেকেই। শৈশবেই তিনি প্রতিবাদে মুখর হয়েছিলেন জাতপাতের বিরুদ্ধে। তাঁর দিদিমার বাড়ি থেকে প্রায়শই তিনি শুনতে পেতেন আশপাশের জঙ্গল ও পাহাড় থেকে তীব্র চিৎকার ও চেঁচামেচি। তাঁর দিদিমার কথায় এরা হল সেই মানুষ যাদের ছায়াও দূষিত। ছোট্ট লক্ষ্মী দিদিমার এমন কথা মানতে পারে না। একদিন তিনি একটি উপজাতি মেয়ের কাছে যান এবং তার হাত ধরে খেলা করেন। দিদিমা খুব রেগে যান কিন্তু লক্ষ্মী হার মানেননি।
    শৈশবেই যিনি এমন তিনি যে ভবিষ্যতে আরও বড়ো কিছু করার জন্য এসেছেন তা সহজেই অনুমেয়। আসলে তিনি ছিলেন সময়ের চেয়ে অনেকটাই অগ্রবর্তী। সেই সময় যখন অধিকাংশ মেয়ে নিজেদের আবদ্ধ রাখত রান্নাঘরে, সেখানে লক্ষ্মী স্বপ্ন দেখতেন দেশের কাজ করার, দুঃস্থ অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়াবার। চিকিৎসা শাস্ত্রে ছিল তাঁর প্রবল আগ্রহ। তাই স্কুলের পড়া শেষ করার পর তিনি মাদ্রাজে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন। ডাক্তারি পড়ার সময়ই তাঁর বিয়ে হয় টাটা এয়ারলাইনসের পাইলট পিকেএন রাও-এর সঙ্গে। কিন্তু বিয়ের তিন মাসের মধ্যে তিনি বুঝতে পারেন সিদ্ধান্তটি ঠিক হয়নি। তিনি বোম্বে থেকে মাদ্রাজ চলে আসেন ডাক্তারি ডিগ্রি পূরণ করার জন্য। ক্ষুব্ধ স্বামী তাঁকে ডিভোর্স দেন না। যে কারণে তাঁকে বেশ কিছু সমস্যায়ও পড়তে হয়। যাই হোক, ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি এমবিবিএস পাশ করেন। এর এক বছর পর গাইনোকোলজি ও অবস্টেট্রিক্স বিষয়ে ডিপ্লোমা অর্জন করেন। ডাক্তার পাশ করার পর তিনি চেন্নাইয়ের ত্রিপলিক্যান এলাকার সরকারি কস্তুর্বা গান্ধি হাসপাতালে ডাক্তার হিসেবে পেশাদারী জীবন শুরু করেন। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে পিকেএন রাএ-এর সঙ্গে তাঁর বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। পরবর্তীকালে প্রেমকুমার সেহগলকে তিনি বিয়ে করেন।
    ছোটোবেলা থেকে তাঁর মধ্যে ছিল দেশপ্রেমবোধ। বিদেশী দ্রব্য বর্জনের ডাকে তিনি তাঁর বিদেশী পোশাক, খেলনা পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। কলেজে পড়ার সময় তিনি ছিলেন কংগ্রেসের যুব শাখার সদস্য। তাঁর ইচ্ছে ছিল দেশের মানুষের জন্য কাজ করা। তার জন্য তিনি চেয়েছিলেন আগে নিজেকে গড়ে তুলতে। গান্ধিজির কিছু কিছু সিদ্ধান্ত তিনি মানতে পারেননি। যেমন স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহনের জন্য ছাত্রসমাজের স্কুল কলেজ ত্যাগ করার যে আহ্বান গান্ধিজি দিয়েছিলেন তা তিনি সমর্থন করেননি। তাঁর মনে হযেছিল, স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশের প্রয়োজন হবে সুশিক্ষিত ও দক্ষ পেশাদারী মানুষ। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “If we all gave up our studies, what would the nation have done after Independence? After Independence, it was even more important that we were educated, that we have become professionals. How, otherwise, were we ever going to build a nation?” তাই গান্ধিজির ডাকে সাড়া না দিয়ে তিনি ডাক্তারি পড়া শেষ করেন।
    ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে তিনি সিঙ্গাপুর যান এবং সেখানে গরিব মানুষদের চিকিৎসার জন্য একটি ক্লিনিক খোলেন। তখন থেকেই তিনি একটু একটু করে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলেন যুক্ত হতে থাকেন। রাসবিহারী বসুর নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেনডেন্স লিগে তিনি যোগদান করেন। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ২ জুলাই সিঙ্গাপুরে আসেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু। লক্ষ্মী প্রথম নেতাজীকে দেখেছিলেন ১৯২৮-এর ডিসেম্বর মাসে, কলকাতায়। তখন থেকে তাঁর নেতাজীর প্রতি ছিল গভীর শ্রদ্ধা। সিঙ্গাপুরে নেতাজী এলে তাঁর ইচ্ছে হয় নেতাজীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার। ঠিক সেই সময় সিঙ্গাপুরে প্রায় প্রতিটি সভাতে নেতাজী ঘোষণা করছেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য একটি নারী বাহিনি গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার কথা। ৫ জুলাই তিনি কেপি কেসভা মেননের কাছে জানতে চান সিঙ্গাপুরে এমন কোনো মহিলা আছেন কিনা যিনি তাঁর প্রস্তাবিত নারী বাহিনি ঝাঁসির রাণি বাহিনি-র উপযুক্ত হবেন। শ্রী মেনন তাঁকে লক্ষ্মী স্বামীনাথনের কথা বলেন। সেদিনই নেতাজীর সঙ্গে লক্ষ্মীর সাক্ষাৎ হয় এবং প্রায় ছয় ঘন্টা সেদিন তাঁদের মধ্যে কথাবার্তা হয়। এরপর নেতাজীর আহ্বানে লোভনীয় কর্মজীবন ত্যাগ করে তিনি নারী বাহিনিতে যোগ দেন এবং এর গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হন। সমগ্র এশিয়ায় এই ধরনের নারি বাহিনি ছিল এই প্রথম। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ২১ অক্টোবর যখন আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় তখন তিনি ছিলেন এই সরকারের প্রথম এবহং একমাত্র ক্যাবিনেট সদস্যা। শীঘ্রই তিনি আজাদ হিন্দ বাহিনির একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে ওঠেন এবং এর নারী সংগঠন বিভাগের মন্ত্রী হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন। আজাদ হিন্দ বাহিনির মিলিটারি ও চিকিৎসা উভয় বিভাগে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
    ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে আইএনএ জাপানের সেনাবাহিনির সাথে বার্মা অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। ১৯৪৫-এ প্রবল যুদ্ধে তারা পিছু হটতে বাধ্য হন। ওই বছরের মে মাসে লক্ষ্মী ধরা পড়েন এবং তাঁকে রেঙ্গুনে নিয়ে আসা হয়। গ্রেপ্তার করা না হলেও নিয়মিত তাঁকে মিলিটারি কর্তৃপক্ষের কাছে হাজিরা দিতে হহত। এই সময় তিনি পুনরায় আন্দোলনের কাজে জড়িয়ে পড়েন। ফলে পুনরায় তিনি গ্রেপ্তার হন এবং ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ৪ মার্ট তাঁকে ভারতে আনা হয়।
    আজাদ হিন্দ সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন কলোনেল প্রেম কুমার সেহগল। তিনি ছিলেন বিচারপতি অছ্রুরাম সেহগলের ছেলে। এই অছ্রুরাম সেহগল ছিলেন গান্ধী হত্যা মামলার বিচারপতিদের একজন। যাই হোক, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে লাহোরে তিনি প্রেমকুমার সেহগলকে বিয়ে করেন। বিয়ের পরে তিনি কানপুরে থাকতে শুরু করেন এবং এখানে চিকিৎসা শুরু করেন। অনুন্নত সম্প্রদায়ের মহিলা ও শিশুদের জন্য চিকিৎসার মাধ্যমে তিনি একটু একটু করে সমাজসেবার কাজে জড়িয়ে পড়েন। মেডিক্যাল ক্লিনিক খোলার পাশাপাশি তিনি পৌরসভার ডিসপেনসারিতে কাজ করতে শুরু করেন। বহু মহিলাকে তিনি চিকিৎসা সহায়কের ট্রেনিং দেন।
    ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন এবং রাজ্যসভায় দলের প্রতিনিধত্ব করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। উদ্বাস্তু শিবির পরিচালনা, বাংলাদেশী শরনার্থীদের চিকিৎসা প্রদান প্রভৃতি কাজ তিনি করেন। ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে দলের অখিল ভারতীয় জনবাদী মহিলা সমিতির তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। পরবর্তীকালে তিনি এর সহ-সভাপতি হয়েছিলেন। ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে ভূপাল গ্যাস দূর্ঘটনায় চিকিৎসক দলের নেতৃত্ব দেন তিনি। ওই বছরই ইন্দিরা গান্ধি হত্যার পর দেশে শিখবিরোধী দাঙ্গা শুরু হয়। শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি শিখ পরিবারদের পাশে দাঁড়ান। আবার ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে ব্যাঙ্গালোরে মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতা আয়োজনের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদে মুখর হন। এজন তাঁকে গ্রেপ্তারও বরণ করতে হয়। ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভূষণ খেতাব দিয়ে সম্মানিত করেন। ২০০২ খ্রিস্টাব্দে দেসের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তিনি কমিউনিস্ট মনোনীত প্রার্থী হেসেব এপিজে আব্দুল কালামের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তিনি হলেন প্রথম ভারতীয় মহিলা যিনি দেশের রাষ্ট্রপতি পদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।
    ২০১২ খ্রিস্টাব্দের ১৯ জুলাই তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন এবং ২৩ জুলাই ৯৮ বছর বয়সে মারা যান। অন্ধ মানুষের চোখে আলো ফিরিয়ে দিতে তিনি তাঁর চোখ দান করে যান এবং চিকিৎসাশাস্ত্রের কাজে সাহায্যের জন্য নিজের দেহ দান করে যান।