কঙ্কাবতীর দুঃসাহস (ধারাবাহিক উপন্যাস : সপ্তম পর্ব) : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

0
609
    খুব সকালে বাড়ি থেকে বের হয়ে ফার্স্ট কাটোয়া লোকাল ধরলো মনীষা । ট্রেনে হকারির কাজের মধ্যে ঘুরেফিরে তার ভাবনা একটাই, কীভাবে হকারি থেকে বের হওয়া যায় ?     
    মনীষা মনেপ্রাণে চাইছে, স্থায়ীভাবে কিছু একটা ব্যবসা করার । এটা ঠিক,  ট্রেনের হকারিতে মনীষার ভাল রোজগার হচ্ছে । রোজগারের দিক দিয়ে তার সমস্যা নেই  । উপায়ের টাকা বাড়িতে সংসার খরচ বাবদ দিয়েও বেশ কিছু টাকা  জমছে  ।  ট্রেনটা গঙ্গাটিকুড়ি স্টেশনে থামলো । কিছুক্ষণ দাঁড়াবে । তা ছাড়া তার হকারির এলাকা আজিমগঞ্জ থেকে গঙ্গাটিকুড়ি পর্যন্ত । হকার ইউনিয়নের প্রথামাফিক তাদের কাটোয়া জংশন পর্যন্ত যাওয়ার পারমিশন নেই । পরের ট্রেন আসতে অনেক দেরী । তাই গঙ্গাটিকুড়ি স্টেশনে নেমে প্লাটফর্মের গাছের তলার বেঞ্চটায়  বসলো মনীষা । মনটা তার ভারাক্রান্ত ! বাড়ির জন্য, নিজেদের জন্য ভীষণ  চিন্তিত !  কেননা বাড়িতে তারা চারটি বোন অবিবাহিত । যদিও ছোট বোন ছাড়া অন্য তিন বোন ‘কিছু-না-কিছু’ উপার্জন করছে । কিন্তু বলা চলে, চারটি বোন বিয়ের উপযুক্ত । দেখেশুনে বড় বোনের যদিওবা বিয়ে হয়েছিলো, সেই বিয়ে বেশী দিন টিকলো না । সম্পর্ক ছেদ করে এখন বাড়িতে । যদিও তার টেলারিং ব্যবসা  রমরমা । মেজদির চায়ের দোকানও ভাল চলছে, কিন্তু তার দোকান ঘর নির্মাণ এখনও সম্ভব হয়নি । সেটা তার বড় দুশ্চিন্তা !  মনীষার  নিজের হকারির ব্যবসা আগের চেয়ে অনেক ভাল চলছে । মায়ের সব্জির ব্যবসা বর্তমানে অনেক বেশী  লাভজনক । বাড়িতে চারজন মহিলা উপার্জনের তাগিদে বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত । বড়দা চাষবাস নিয়ে ব্যস্ত । ছোট দাদাটা সেভাবে এখনও কোনো কাজে ঢুকতে পারেনি । বাবা শারীরিক কারণে বাড়িতেই চুপচাপ বসে । এহেন পরিস্থিতিতে চারটি বোন বিয়ের উপযুক্ত হওয়া সত্বেও কোনো বোনের বিয়ে হচ্ছে না । এমনকি বিয়ের ব্যাপারে বাড়িতে তোড়জোড় কম । এইসব ভাবনা মনীষাকে বড্ড ভাবিয়ে তুলছে । তার উপর হকারি ব্যবসাটা  ছাড়তে চায় । কিন্তু বিকল্প ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত সে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না ।  কী করবে ঠাহর করতে পারছে না । মনীষার ইচ্ছা, রেঁস্তোরা খোলার । মনীষা ভাল রান্না জানে । রান্নার প্রতি তার আলাদা আগ্রহ । মায়ের অনুপস্থিতিতে বৌদির সাথে অনেকদিন  নিজস্ব স্টাইলে রান্না করে বাড়ির সকলকে খাইয়েছে । তা ছাড়া ইউটিউবে রান্না দেখে কয়েকটি পদ  রপ্ত করে ফেলেছে  । মনীষা হকারি করার সুবাদে যেটা বুঝেছে, মানুষের মধ্যে রেস্টুরেন্টে বসে খাবার প্রবণতা বাড়ছে । তা ছাড়া বাড়িতে রান্না না করে, রেঁস্তোরাতে অর্ডার দিয়ে সেই খাবার বাড়িতে বসে খাওয়ার দিকে ঝুঁকছে । সুতরাং মনীষা রেঁস্তোরা খুলতে আগ্রহী ।
   সমস্যা হলো পুঁজি নিয়ে । জায়গার একটা হদিশ মিলেছে । তবে সেটা বাজারসৌ  স্টেশনের পূবদিকে, স্টেশন মাস্টারের ঘর ছাড়িয়ে তিনশত মিটারের মধ্যে । ভীষণ চালু জায়গা । একটা দোকান ছিলো । তবে সেটা চায়ের দোকান । কিন্তু সেই দোকানের মালিক, নরহরি খাটুই মিলিটারিতে চাকরি পেয়ে  গুজরাতের বরোদাতে পোস্টিং নিয়ে সেখানে  থাকে । জায়গাটা একরকম পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে । জমির খবরটা পেয়ে মনীষা মোবাইলে নরহরির সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং অল্প দামে একটা রফা হয় । নরহরি ছুটিতে বাড়ি এসে জায়গাটা মনীষার নামে রেজিস্ট্রি করে গেছে । এখন সেখানে ঘরটা মেরামত করে সত্বর দোকান চালু করা । জায়গাটা লম্বায় বড় । কিন্তু চওড়ায় ছোট ।  রেঁস্তোরা খোলার পক্ষে আদর্শ । পাশেই রিক্সা স্ট্যাণ্ড । রাস্তার উল্টোদিকে টোটো স্ট্যাণ্ড  । ফলে লোকজনের যাতায়াত অহরহ । তা ছাড়া বাজারসৌ স্টেশন সবসময় জমজমাট । আজিমগঞ্জ – কাটোয়া লাইনে বাজারসৌ   একটি পুরানো স্টেশন । এক্সপ্রেস ট্রেন ছাড়া সমস্ত ট্রেন বাজারসৌ স্টেশনে দাঁড়ায় । তাই মনীষার ইচ্ছা, বাজারসৌ স্টেশন বাজারে  খুব শীঘ্র রেঁস্তোরা খোলা  ।  
      হাওড়া-মালদা টাউন ইন্টারসিটি ট্রেনটি সিগনাল না পেয়ে গঙ্গাটিকুড়ি স্টেশনে দাঁড়িয়ে পড়লো  । গ্যালপিং ট্রেন । সব স্টেশনে দাঁড়ায় না । গঙ্গাটিকুড়ি স্টেশনে দাঁড়াবার কথা ছিল না । ট্রেনটি দাঁড়াতেই মনীষা ট্রেনে উঠে পড়লো । বাজারসৌ স্টেশনে ট্রেনটি দাঁড়ায় । সুতরাং সেখানে নেমে মনীষা তার কেনা  জায়গাটা ঘুরে আসবে । সে চাইছে, দোকান ঘরটি ধীরে ধীরে তৈরী করতে । ঘর বাড়ি বানানোর  জিনিসপত্রের যা দাম, তাতে মনীষা চিন্তিত ! আদৌ সে ঘর তুলতে পারবে কিনা ? কিন্তু মনীষার মনে নেতিবাচক চিন্তাভাবনার স্থান নেই । যেভাবে হোক, ইটের দালান  তুলে খাবারের দোকান সে  চালু করবেই ।
       ট্রেনে উঠে মনীষা তাজ্জব ! প্রচণ্ড ভিড় । ট্রেনের কামরায় ফরাক্কার মানুষে ভর্তি । ঠেলেঠুলে তার পক্ষে কাজ করা কষ্ট । 
     ভিড় কামরায় উঠে নির্দিষ্ট এক জায়গায় দাড়িয়ে মনীষা হাঁকছে, “বাদাম চাই, বাদাম !”
     “দিদি, ভিড় কামরায় উঠে চিল্লাবেন না ! একেই গরমে আমরা কাহিল, তার উপরে আপনার চিল্লানো আমাদের ভাল লাগছে না ।“ দেখতে বদরাগী এমন একজন প্যাসেঞ্জার বাঁকা চোখে মনীষাকে হুঙ্কার দিলো ।  
    “আপনি দিব্যি বাঙ্কে বসে আছেন । আপনার এত গাত্রদাহ কেন ? মেয়েদের হকারি করা দেখলেই আপনারা তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন, কেন বলতে পারেন ?” মনীষা কথা শোনাতে ছাড়লো না । ট্রেনে ভিড়ের জন্য এমনিতেই তার বেচাকেনা হচ্ছে না । তার উপর ট্রেন যাত্রীদের অভদ্র আচরণ । তাঁদের আবার  উত্ত্যক্তজনক কথাবার্তা ।
   মনীষার কথায় বিরক্ত হয়ে ট্রেনের ঐ যাত্রী বাঙ্ক থেকে লাফ দিয়ে নামলেন । এবার মনীষার একেবারে সামনে গিয়ে গলা চড়িয়ে বললেন, “তোমাদের মতো হকারদের বেলেল্লাপনার জন্য আমরা টিকিট কেটে ভদ্রভাবে ট্রেনে যাতায়াত করতে পারবো না ? বেশী তড়পালে ট্রেন থেকে ছুড়ে ফেলে দেবো ।“
    মনীষা ঐ প্যাসেঞ্জারের জামার কলার ধরতে যাচ্ছিল । কিন্তু থেমে গিয়ে বলল, “পাড়ার রাস্তায় আপনাদের বেলেল্লেপনা মানায় ! ট্রেনে নয় । আর একবার মুখ খারাপ করে কথা বলেছেন তো, আমিই আপনাকে ট্রেন থেকে ফেলে দেবো । তখন দেখব, আপনার কোন বন্ধু আপনাকে বাঁচায় ? আমি মনীষা । আপনাদের মতো কাপুরুষদের কীভাবে জব্দ করতে হয় আমি সেটা ভালভাবে জানি  !” তারপর হাত উঁচিয়ে চোখ বড় বড় করে ঐ লোকটাকে বলল, “ট্রেন এবার বাজারসৌ স্টেশনে ঢুকছে । বেশী তড়পালে বাজারসৌ স্টেশনে নামিয়ে গণধোলাই দিয়ে ছাড়ব ।“

 চলবে