সুদূরপরাহত দিলীপ রায় : (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

0
414
       রোহিমা খাতুন ও মহিমা খাতুন, দুই বোন । রোহিমা বড় । তার বিয়ে হয়ে গেছে । মহিমা পড়াশুনা করে । গাঁয়ে ওর সমবয়সী মেয়েদের সকলের বিয়ে হয়ে গেছে । গ্রামে অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ । যার জন্য অনেক মেয়েদের এইট/নাইনে পড়ার সময় বিয়ে হয়ে যায় । মেয়েদের বিয়ের বয়স বেশী হলে, পাত্র পাওয়া দায় ! গাঁয়ে কয়েক ঘর ছাড়া আর সকলেই হতদরিদ্র । ‘দিন আনে দিন খায়’ অবস্থা ।  পরের জমিতে চাষ-আবাদে দিন-মজুর খাটে । বেশ কয়েকজন রাজমিস্ত্রির যোগাড়ে-মিস্ত্রি হিসাবে দূরের শহরে কাজ করে তাদের জীবিকানির্বাহ  । সেই ক্ষেত্রে মূল রাজমিস্ত্রি  চুক্তিভিত্তিক তাদের যোগাড়ে-মিস্ত্রি হিসাবে শহরের কাজে নিয়োগ করে । গাঁয়ের মানুষের আর্থিক অবস্থা তথৈবচ থাকার জন্য বিভিন্ন উপায়ে তাদের রোজগার । দুই একজন গ্রামবাসীর সবজি বিক্রি করে তাদের সংসার চলে । এইরকম একটা টানাটানির পরিস্থিতিতে  গাঁয়ের মানুষের দিনাতিপাত । তাই  অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার তাগিদ । 
    রোহিমা খাতুনের বিয়ে হয়েছে ঠিক চৌদ্দ বছরের মাথায় ।  এখন তার উনিশ বছর বয়স । দুটো সন্তানের জননী । সন্তান হওয়া ও সন্তান পালনের জন্য রোহিমার চেহারা শুকিয়ে কাঠ । এখন তার রোগা-পটকা চেহারা । চেহারার জৌলুস বয়স্ক মহিলাদের ন্যায় । এইসব দেখেশুনে মহিমা বিয়ের ব্যাপারে বেঁকে বসেছে । তার একটাই বক্তব্য, নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে  বিয়ের পিঁড়িতে বসবে না । এইজন্য মহিমাকে নানান গঞ্ছনা সইতে হচ্ছে । পাড়াপ্রতিবেশীদের কাছ থেকে গঞ্ছনার মাত্রা বেশী ।  আর আছে গাঁয়ের মোড়লদের উৎপাত । অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ের ব্যাপারে গাঁয়ের মোড়লদের প্রচ্ছন্ন মদত রয়েছে । তাঁরা গ্রামবাসীদের বুঝিয়েছেন, “মেয়ে পড়িয়ে কী হবে ? সেই তো বিয়ে দিতে হবে । পরের বাড়িতে  ঘর সংসার করতে হবে ।“  সুতরাং তাঁরা অল্প বয়সে বিয়ের পক্ষে ।  তাঁরা মহিমার বাবা লিয়াকত আলিকে অনেক দুষছেন । বিয়ের উপযুক্ত বয়স হওয়া সত্ত্বেও লিয়াকত কেন মেয়েকে  বিয়ে দিচ্ছে না, এইটাই তাঁদের গাত্রদাহ ? লিয়াকত শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহের অন্যান্যদিন বাড়িতেই নমাজ সারে । সপ্তাহের শুক্রবারদিন অর্থাৎ জুম্মাবারে  মসজিদে গিয়ে নমাজ পড়ে । নমাজ পড়া শেষ হয়ে গেলে মোড়লেরা লিয়াকতকে  মনে করিয়ে দেন, তার মেয়ের বিয়ের বয়স হওয়া সত্ত্বেও তাকে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে না ।  মেয়েদের কাজ ঘর-সংসার করা । মেয়েকে বিয়ে না দিয়ে তাকে কলেজে পাঠাচ্ছে লেখাপড়া করানোর জন্য । এটা কী  তার ঠিক  হচ্ছে  ? 
    গাঁয়ের মোড়লদের  নির্দেশ মহিমাকে জানিয়েছে লিয়াকত । কিন্তু মহিমা নির্দেশ মানতে নারাজ । জীবনটা তার ।  জীবনের ভাল-মন্দের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার একমাত্র তার নিজের ।  তাই মহিমার জেদ, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তবেই বিয়ে করবে । এই ব্যাপারে কারও পরামর্শ শুনতে নারাজ । প্রয়োজনে মোড়লেরা তাদের সমাজে একঘরে করে রাখলেও মহিমা তার সিদ্ধান্ত থেকে এক-চুলও  নড়বে না ।
     লিয়াকত নিজে মনেপ্রাণে চায়, তার মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াক । 
                                        ( ২ ) 
       সকালে ঘুম থেকে উঠে লিয়াকত জমিতে ছুটলো ।  তার সর্বসাকুল্যে দুই বিঘা জমি । জমিতে পাট চাষ করেছিল । পাট কাটার পর রোয়ার ধান পোতার কথা  । কিন্তু বৃষ্টি নেই । আকাশে মেঘের দেখা নেই ।  জমিতে পাট কাটা শেষ । সেগুলি আঁটি বেঁধে জলাশয়ে জাগ দিতে হবে । তাই তার তাড়াহুড়ো । জমিতে গিয়ে পাটের আঁটি বাঁধতে হবে ।  দুই বিঘা জমির পাট ঝাড়াই-বাছাই করে লিয়াকত  একাই আঁটি বাঁধতে পারবে, যার জন্য কোনো দিন-মজুর নেয়নি । গিন্নিকে বলে গেলো জমিতে দুপুরের খাবার পৌঁছে দিতে । কেননা তার পক্ষে দুপুরে বাড়িতে এসে খাওয়া সম্ভব হবে না । জমিতে কাজের চাপ অত্যন্ত বেশী । তার উপর বেশী সংখ্যায় পাট  একসঙ্গে আঁটি বাঁধার পর সেগুলি জাগ দেওয়ার প্রশ্ন ? 
   আঁটি বাঁধার কাজ শেষ !  
    মাথার উপর থেকে কেবল  সূর্য  পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছে । বেলা গড়িয়ে ঘড়ির কাটায় তখন দুটো  । এমন সময় মহিমা গামছায় খাবারের থালা বেঁধে মাঠে উপস্থিত ।  লিয়াকত তখন জমির আইলে গালে হাত দিয়ে বসে  । বাবাকে হতাশ হয়ে বসে থাকতে দেখে মহিমা আবাক ! তার বাবা কখনও কাজ ছাড়া কিছু বোঝে না । সর্বক্ষণ কাজে থাকতে তার আনন্দ । কাজ না থাকলে তার বাবার ছটফট । এমনকি জমির কাজ না থাকলে রাজমিস্ত্রির যোগাড়ের কাজে শহরে ছোটে । এখন বিভিন্ন জায়গায় ফ্লাট বাড়ি নির্মাণ চলছে । সেইসব কাজে কলকাতা ছাড়াও মফসল শহরেও কাজে ছোটে । সেই ক্ষেত্রে বাড়িতে শুধুমাত্র মা-বেটী । সেই বাবা চুপচাপ গালে হাত দিয়ে জমির আইলে বসে  । তাই মহিমার উদ্বিগ্নতা ।  
   মহিমা কিছুটা জানে, বাবার উদ্বিগ্নতার কারণ ? তার একটি ল্যাপটপ দরকার । কম্পিউটার ভাল করে শিখতে হবে ।  কম্পিউটার শেখার জন্য মহিমা একটি ইন্সটিটিউটে ভর্তি হয়েছে । কিন্তু বাড়িতে কম্পিউটার না থাকায়, শেখার প্রেক্ষাপটে  ক্লাসের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছে না । বাড়িতে প্র্যাক্টিস দরকার । তা ছাড়া কম্পিউটার না থাকায় ইন্টারনেটে ঢুকতে পারছে না । এখন ইন্টারনেটের যুগ ।  পড়াশুনা ছাড়াও অন্য অনেক বিষয় সম্বন্ধে ইন্টারনেটের মাধ্যমে জানা সম্ভব ! চাকরির প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে ইন্টারনেট ভীষণ জরুরি । তাই মহিমা বাবার কাছে আবদার ধরেছে, যেভাবে হোক এবছর তার ল্যাপটপ চাই । কিন্তু ল্যাপটপ কেনার ব্যাপারে বাবা বলেছে, হিন্দুদের দুর্গাপূজোর আগে কিনে দেবে ।  দুর্গাপূজো এখনও অনেক দেরী ? তাই মহিমা মনে মনে ভাবছে, তার ল্যাপটপ কেনার জন্য নিশ্চয়  হতাশ নয় । এই হতাশার পেছনে অবশ্যই অন্য কারণ রয়েছে ! 
  “বাবা তুমি গালে হাত দিয়ে বসে কেন ?”   মহিমা বাবাকে জিজ্ঞাসা করলো ।
    মহিমার ডাকে লিয়াকত সম্বিত ফিরে পেলো । মহিমাকে দেখে লিয়াকতের চোখে জল । করুণ সুরে মহিমাকে লিয়াকত বলল, “অনেক আশা নিয়ে পাট চাষ করেছিলাম । পাট বিক্রি করে তোর ল্যাপটপটা কিনে দেওয়ার সিদ্ধান্ত আমার পাকা । এমনকি জমিতে পাটের ফলনও ভাল ।  কিন্তু...?”
     “কিন্তু কী বাবা ?” জানতে চাইলো মহিমা ।
     পাট পচাবার জল পাওয়া যাচ্ছে না । গত বছরে যেখানে পাট পচিয়েছিলাম, সেই পুকুরটি শুকনো ।  জল নেই ।
     “জল নেই কেন বাবা ?” মহিমার কৌতুহলি প্রশ্ন ।
      এবার বর্ষা কোথায়  ? আকাশে মেহ নেই । বৃষ্টিই হচ্ছে না । আকাশে রৌদ্র, অথচ এই সময় প্রচুর বৃষ্টি হওয়ার কথা । বৃষ্টি না হওয়ার জন্য খানা-পুকুরে জল জমেনি । পাট কাটার পর এখন সেই পাট পচাবার জল পাওয়া যাচ্ছে না । দুশ্চিন্তায় মাথায় হাত ! 
     তাহলে উপায় কী বাবা ?
     সেটাই ভাবছি মা ! 
    “তুমি চিন্তা করো না । একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে । তুমি বরং খাবার খেয়ে নাও । তারপর তুমি ও আমি জলাশয় খুঁজতে বের হচ্ছি  । নিশ্চয় ধারে-কাছে জলাশয় পেয়ে যাবো ।“ বাবাকে সান্ত্বনা দিলো মহিমা ।
                                 ( ৩ ) 
    তারপর দুদিন কেটে গেলো, অথচ নানান জায়গায় ঘুরে পাট পচানোর জলাশয়ের হদিস মিললো না । খবর পেয়ে তৃতীয় দিন বাপ-বেটী মিলে পাশের গাঁয়ের হারাণ মোড়লের কাছে গেলো । তার  পুকুর রয়েছে । সেখানে পাট পচানো যেতে পারে ।  লিয়াকতের কাছে পাট পচানোর কথা শুনে হারাণ মোড়ল বেঁকে বসলো । তাঁর মেজাজ বেড়ে গেলো । হারাণ মোড়ল বললেন, “আমার হক কথা ! পাট পচাতে গেলে পয়সা লাগবে ? প্রতি আঁটিতে পাঁচ টাকা । আর একটা কথা, আমার পুকুরে এবছর এখনও পাট জাগ দেওয়া হয়নি । সুতরাং পাট পচতে সময় লাগবে । আগে একবার কিংবা দুবার পাট পচানো হলে পুকুরের জলটা থাকতো পাট পচানো জল । তাই তোমরা হাতে সময় নিয়ে পাট পচাতে দাও ।“   
    লিয়াকত পড়লো মহা ফাঁপড়ে । পাট তাকে পচাতে হবেই । নতুবা জমিতে কাটা পাট  রাখাটা নিরাপদ নয় । রৌদ্রে শুকিয়ে যাবে । তাতে আরও পাটের  ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা । এমনিতে দুদিনের বেশি পাটটা আঁটি বাঁধা অবস্থায়  জমিতে পড়ে রয়েছে । রৌদ্রে বেশী শুকালে পাটের পরিমান কম হতে পারে । হারাণ মোড়লের দাবিমতো টাকা দিলে পাট চাষের খরচা অনেক বেড়ে যাবে । তার উপর গাড়ি ভাড়া করে পাট জমি থেকে তুলে এনে হারাণ মোড়লের পুকুরে পচাতে দিতে হবে । তাতেও একটা বাড়তি  খাটুনি ও  খরচা । লিয়াকতের চিন্তার শেষ নেই । অথচ পাট পচাতে হলে এছাড়া অন্য উপায় নেই । আকাশে মেঘের দেখা নেই । যে আশায় ল্যাপটপ কেনার মনস্থির করেছিল, সেই আশার জলাঞ্জলি । এই রকম একটা  নেতিবাচক পরিস্থিতির উদ্ভাস ঘটবে লিয়াকতের ধারণার বাইরে । অগত্যা মোটর লাগানো ভ্যান ভাড়া করলো । ভ্যানে করে পাট জমি থেকে তুলে এনে হারাণ মোড়লের পুকুরে পাট জাগ দিলো ।  
     পাট পচতেও অনেক সময় নিলো । পাট ছাড়াতে মহিমা বাবার সাথে হাত লাগালো । একদিকে পাট আর অন্যদিকে পাটকাঠি ।  পাট ছাড়ানোর পর ভেজা পাট রৌদ্রে শুকাতে হবে । আবার ভ্যান ভাড়া । ভ্যান ভাড়া দিয়ে পাট ও পাটকাঠি  বাড়ির উঠোনে এনে তুললো । তারপর বাঁশ আড়াআড়িভাবে দাঁড় করিয়ে দড়ি টাঙিয়ে সেই দড়িতে পাট শুকোতে দিলো । অন্যদিকে পাটকাঠি বাড়ির  পাশের নারিকেল গাছের সাথে দাঁড় করিয়ে দিলো । পাটকাঠি শুকানো নিয়ে তাদের চাপ নেই । কিন্তু পাট শুকানোর চাপ রয়েছে । 
     একটা অদ্ভূত ব্যাপার লিয়াকত লক্ষ্য করলো, এতদিন আকাশে মেঘ ছিল না । যেই শ্রাবণ মাস শেষ হয়েছে, অমনি আকাশে মাঘের আনাগোনা । মাঝে মাঝে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি । এবার পাট শুকাতেও হ্যাপা । 
     মহিমা আদৌ ল্যাপটপ কিনতে পারবে কিনা, সেই ব্যাপারে পুরোটাই ধন্দে ? অথচ মহিমার বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে বাড়িতে মানুষের আনাগোনা ?  জমিতে পাট চাষে প্রচুর ক্ষয় ক্ষতির জন্য লিয়াকত রাজমিস্ত্রির যোগাড়ের কাজে ডায়মণ্ড হারবারে । সংসারের হালহকিকৎ দেখেশুনে মহিমার আত্মনির্ভরতার স্বপ্ন এখন প্রশ্ন চিহ্নের মুখে । তার স্বপ্নের বাস্তবায়ন সুদূরপরাহত ! তবুও মহিমা দমবার পাত্রী নয় ......?   
                         -------------০--------------